Raj Kumar Chakraborti

Raj Kumar Chakraborti

রাজকুমার চক্রবর্তী: বিস্মৃত এবং উপেক্ষিত এক ভাষা সৈনিক

মোহাম্মদ হাননান

পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট। এর প্রায় ছয়মাস পর ১৯৪৮ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদ (পার্লামেন্ট)-এর অধিবেশন করাচিতে শুরু হয়েছিল। অধিবেশনের শুরুতেই পরিষদের ব্যবহারিক ভাষা কী হবে এনিয়ে বিতর্ক শুরু হয়ে যায়। ভাষা আন্দোলন নিয়ে লেখালেখি করেছেন এমন অনেকে এখানে একটি ভুল করেন, অনেকেই বলেছেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে এনিয়ে এই অধিবেশনে বিতর্ক চলে। প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রভাষা নয়, অধিবেশনগুলোতে কোন কোন ভাষা ব্যবহার করা যাবে এনিয়েই বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের শরিফ (উচ্চ শ্রেণির মুসলমান) সদস্যরা প্রস্তাব করেছিলেন যে, পরিষদের কার্যক্রম উর্দু এবং ইংরেজিতে চলতে পারে। পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগ সদস্যরা এই সময় কী বক্তব্য রেখেছিলেন তার রেকর্ড নেই ( তবে পরে তারা উর্দু ও ইংরেজির পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন)। এই পর্যায়ে পূর্ব বাংলা (বাংলাদেশ) থেকে আগত পরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সংশোধনী প্রস্তাব করেন যে,

উর্দু-ইংরেজির সঙ্গে বাংলাকেও গণপরিষদের
অন্যতম ভাষা হিসেবে ব্যবহার করা হোক।

ঘটনাটি ১৯৪৮ সারের ২৩শে ফেব্রুয়ারি। বিতর্কের এই পর্যায়ে স্পিকার সংশোধনী প্রস্তাবটির উপর ২৫শে ফেব্রুয়ারি আলোচনার প্রস্তাব করেন। ২৫শে ফেব্রুয়ারি অধিবেশন শুরু হলে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান অত্যন্ত কঠোর কণ্ঠে বলেন,

পাকিস্তানের অধিবাসীদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করা এবং একটি সাধারণ ভাষার দ্বারা ঐক্যসূত্র স্থাপনের প্রচেষ্টা থেকে মুসলমানদের বিচ্ছিন্ন করাই এই প্রস্তাবের উদ্দেশ্য। [ সাপ্তাহিক নওবেলাল, ৪ঠা মার্চ ১৯৪৮ ]।

সংশোধনী প্রস্তাবের উপর আলোচনায় অনেকেই অংশ নেন। প্রায় সকলেই ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন এবং তাঁর নিন্দাও করেন। এর মধ্যে ঢাকা থেকে আগত পরিষদ সদস্য উর্দু ভাষী খাজা নাজিম উদ্দিন সদম্ভে ঘোষণা করেন,

পূর্ব বাংলার অধিকাংশ অধিবাসীরই মনোভাব এই যে, একমাত্র উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা রূপে গ্রহণ করা যাইতে পারে। [সাপ্তাহিক নওবেলাল, ৪ঠা মার্চ ১৯৪৮]।

উর্দু ভাষী নাজিমউদ্দিন সমগ্র পূর্ববাংলার বাংলাভাষী জনগণের এরূপ ম্যান্ডেট কোথা থেকে পেয়েছিলেন তার উল্লেখ পাওয়া যায় না। আসলে এটা ছিল তাঁর নিজস্ব একটা ধারণা যে, পূর্ব বাংলার মানুষ যেহেতু পাকিস্তান আন্দোলনের সমর্থক ছিল, সুতরাং তারা নিশ্চয়ই ভাষা হিসেবে উর্দুকেও সমর্থন করবে।

পরিষদের এই কার্যক্রমের এই পর্যায়ে এক বিশেষ ভূমিকা পালন করতে দাঁড়ান পূর্ব বাংলার আরেক গণপরিষদ সদস্য রাজকুমার চক্রবর্তী। তিনি লক্ষ্য করছিলেন, পশ্চিম পাকিস্তানি উর্দু ভাষী সদস্যরা এবং মুসলিম লীগের অন্যান্য সদস্যগণ প্রকৃতপক্ষে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সংশোধনী প্রস্তাবটি বুঝতে পারেননি। কারণ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত তো উর্দুর বিরুদ্ধে কোনো প্রস্তাব উত্থাপন করেননি। কিন্তু অধিবেশনের বক্তৃতাগুলিতে সকলে যেভাবে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে আক্রমণ করছিলেন তাতে মনে হচ্ছিল যে, তারা মনে করেছেন, দীরেন্দ্রনাথ দত্ত বোধ করি উর্দুর বিরোধিতা করছেন। এই পর্যায়ে তাই রাজকুমার চক্রবর্তী উঠে দাঁড়ান এবং খুব সুন্দরভাবে গুছিয়ে বলতে থাকেন,

উর্দু পাকিস্তানের কোনো প্রদেশেরই কথ্য ভাষা নয়। তা হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানের উপরতলার কিছু সংখ্যক মানুষের ভাষা। …বাংলাকে আমরা দুই অংশের সাধারণ ভাষা করার জন্য চাপ দিচ্ছি না। আমরা শুধু চাই পরিষদের সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি। [আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২৭শে ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮]।

রাজকুমার চক্রবর্তীর এই ভাষণ বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। তিনি সহজ-সরলভাবে উর্দু সমর্থক পরিষদ সদস্যদের একটা মূল জায়গায় আঘাত করলেন। প্রকৃত সত্য ছিল, উর্দু তৎকালীন পাকিস্তানের কোনো অঞ্চলেরই ভাষা ছিল না। উর্দু ছিল ভারতের উত্তর প্রদেশের ভাষা। এই প্রদেশের যেসব উর্দুভাষী মুসলমান পাকিস্তানের হিযরত করে এসেছিলেন, তারা মোহাজের হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিল। গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান, উচ্চ পদস্থ আমলা, সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা প্রায় সকলেই ছিলেন মোহাজের। এই মোহাজের যাঁরা বাইরে থেকে নবগঠিত পাকিস্তানে প্রবেশ করেছিল, তারাই তাঁদের মাতৃভাষাকে পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা হিসেবে জোর করে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলেন।
রাজকুমার চক্রবর্তী ভাষা প্রশ্নে সেই স্পর্শকাতর বিষয়টিই সেদিন সকলের সামনে তুলে ধরেছিলেন। তিনি স্পষ্ট করেছিলেন, ‘উর্দু পাকিস্তানের কোনো প্রদেশেরই কথ্য ভাষা নয়’ এবং ‘তা হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানের উপরতলার কিছু সংখ্যক মানুষের ভাষা’। এই দ্বিতীয় বাক্যে তিনি ‘মোহাজের’দেরই ইঙ্গিত করেছেন, যারা সদ্য প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে রাতারাতি‘উপরতলা’র মানুষ সেজেছিলেন।

এরপর রাজকুমার চক্রবর্তী ‘বাংলাকে আমরা দুই অংশের সাধারণ ভাষা করার জন্যে চাপ দিচ্ছি না’Ñবলে তিনি আসলে ‘দুই অংশের সাধারণ ভাষা’-র কথার মাধ্যমে রাষ্ট্রভাষার প্রসঙ্গটি এনেছেন। তাঁর কথার রেশে বুঝা যায়, বাংলা তো দুই অংশের রাষ্ট্রভাষারই যোগ্য।

যদিও করাচি অধিবেশন এমন যুক্তি ও আবেগকে গ্রহণ করতে মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল না। উর্দু সমর্থকরা ছিল তখন একগুঁয়ে এবং উর্দুকে যে কোনোভাবেই পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠিত করতে তাদের ভ’মিকা ছিল বেপরোয়া। তবে পূর্ব বাংলাও বাংলা প্রশ্নে ছিল পরোয়াহীন। রাজকুমার চক্রবর্তীর ভাষণের যুক্তিগুলিই পূর্ব বাংলার জনগণ তাদের জনমত গঠনে পরবর্তী সময়ে ব্যবহার করেছিল।

কিন্তু দুঃখের বিষয়, ভাষা সৈনিক হিসেবে রাজকুমার চক্রবর্তী আজ বাংলাদেশের মানুষের কাছে বিস্মৃত এক ব্যক্তিত্ব। আমরা সবাই তাঁকে ভুলে গেছি। একাত্তরে নিহত হয়ে বেঁচে গেছেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। সে জন্য হয়তো তাঁর নাম মাঝে-মধ্যে আমরা নিয়ে থাকি। পয়লা ফেব্রুয়ারি (২০১২) বাংলা একাডেমীর বইমেলা উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ধীরেন্দ্রনোথ দত্তকে স্মরণ করা হয়েছে।

কিন্তু উপেক্ষিত থেকে গেছেন রাজকুমার চক্রবর্তী। প্রকৃতপক্ষে ভাষা সৈনিক রাজকুমার চক্রবর্তী আমাদের ইতিহাস থেকে হারিয়েই গেছেন। বাংলা একাডেমীর চরিতাভিধান গ্রন্থে অনেক স্মৃত-বিস্মৃত নাম আপনি পাবেন, কিন্তু ‘রাজকুমার চক্রবর্তী’র নামে কোনো শব্দ- নাম খুঁজে পাবেন না। এশিয়াটিক সোসাইটির বাংলাপিডিয়া-তেও খুঁজলাম, না সেখানেও ‘রাজকুমার চক্রবর্তী’ নামে কোনো পৃষ্ঠা বা পাতা নেই।
তিনি বাস্তবিকই হারিয়ে গেছেন। তাঁর জীবন ইতিহাসের বিশেষ কোনো তথ্য ও সংবাদ আমরা পাই না। ১৮৯২ সালে তিনি বাংলাদেশের সন্দ্বীপে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৭৫ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বেঁচেছিলেন তিনি। (১৫ই সেপ্টেম্বর ১৯৭৫ তারিখে তিনি কলকাতায় পরলোকগমন করেন)।

রাজকুমার চক্রবর্তী ব্রিটিস আমলেই বাংলার গণপরিষদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৪৭ সালে যেসকল গণপরিষদ সদস্য বাংলা ভাগের বিপক্ষে ভোট দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। বাংলাদেশ যাতে ভাগ না হয় তার জন্য তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। শেষ পর্যন্ত বাংলা ভাগ হয়ে গেলে তিনি মাতৃভূমি পূর্ব বাংলাতেই থেকে যান।

১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে করাচিতে পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে তিনি যোগ দেন এবং পরিষদের ব্যবহারিক ভাষা হিসেবে বাংলাভাষা যাতে মর্যাদা লাভ করে তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পাকিস্তানে তিনি পাঁচ বছর গণপরিষদের সদস্য ছিলেন।

রাজকুমার চক্রবর্তী পাকিস্তানের গণপরিষদ সদস্য হিসেবে তৎকালীন মুসলিম লীগ সরকার থেকে বিরূপ আচরণের শিকার হন এবং এক পর্যায়ে তিনি কলকাতা চলে যান। সেখানেও তিনি রাজ্য বিধান সভার সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। পরে ভারতের কেন্দ্রীয় গণপরিষদেরও তিনি সদষ্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এথেকে তাঁর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের অসাধারণত্ব উপলব্ধি করা যায়।

তবে তিনি ছিলেন মূলত শিক্ষাবিদ। প্রায় ৫০ বছর তিনি ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যাপনা করেন। পশ্চিম বাংলার বঙ্গবাসী কলেজে তিনি দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির তিনি ছিলেন অন্যতম প্রতিষ্ঠিাতা। পরে এই সংগঠনের সভাপতির দায়িত্বও তিনি পালন করেন।

পাকিস্তানে তিনি কংগ্রেস দলের অন্তভুর্ক্ত থাকলেও যখন দেশত্যাগ করে পশ্চিম বাংলায় চলে যান, তখন তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে যেগদান করেন এবং আজীবন মেহনতি মানুষের সঙ্গে একাত্ম থাকেন।

বাঙালির ভাষা আন্দোলনের তিনি ছিলেন অন্যতম সূচনাকারী। পাকিস্তানের শুরুতে যখন রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলা ভাষাকে অবমূল্যায়ন করার অপচেষ্টা চলছিল, তখন খুব স্বল্প সংখ্যকদের নিয়ে তিনি উচ্চ পর্যায়ে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছিলেন।
বাঙালি সমাজ যুগ যুগ তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণে রাখবে।

ড. মোহাম্মদ হাননান, লেখক ও গবেষক e-mail : drhannapp@yahoo.com

2012/pdf/127556_raj_kumar__263955003.pdf ( B) 


Place your ads here!

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment