Muhammed Zafar Iqbal's Article on Adibashi

Muhammed Zafar Iqbal's Article on Adibashi

সাদাসিধে কথা | কারও মনে দুখ দিয়ো না… | মুহম্মদ জাফর ইকবাল | তারিখ: ০৯-০৮-২০১১

মে মাসের শেষের দিকে আমি দেশের বাইরে, ইন্টারনেটে খবরের কাগজ পড়ি। একদিন পত্রিকায় একটা খবর পড়ে আমার আক্কেলগুড়ুম হয়ে গেল। জাতিসংঘের কোনো একটা অধিবেশনে বাংলাদেশ মিশনের ফার্স্ব সেক্রেটারি ঘোষণা দিয়েছেন, বাংলাদেশে কোনো আদিবাসী নেই (ডেইলি স্টার, ২৮ মে)! মাত্র অল্প কয়দিন আগে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা হয়েছে—প্রথমবারের মতো আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, প্রতিবন্ধী কোটার সঙ্গে সঙ্গে আদিবাসী কোটায় ছাত্রছাত্রী ভর্তি করেছি। দেশের বাইরের নেপালি ছাত্রছাত্রীদের পড়িয়ে এসেছি, অথচ দেশের চাকমা, মারমা, ম্রো, সাঁওতাল বা গারো ছেলেমেয়েদের পড়াতে পারি না; সেটা নিয়ে আমাদের দুঃখবোধ ছিল। আদিবাসী কোটায় তাদের পড়াতে পারব, সেটা নিয়ে আমাদের একধরনের আত্মতুষ্টি ছিল, কিন্তু খবরের কাগজ পড়ে আমি হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম। দেশে যদি আদিবাসী নেই, তাহলে আদিবাসী কোটায় আমরা কাদের ভর্তি করেছি? শুধু কি তাই, কত হইচই করে শিক্ষানীতি করা হয়েছে, আমিও সেই কমিটির একজন সদস্য, সেই শিক্ষানীতিতে আদিবাসী ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া নিয়ে সুন্দর সুন্দর কথা লিখে এসেছি। তাহলে আমাদের সেই কথাগুলো কার জন্য?
দেশে থাকলে বন্ধুবান্ধব, সহকর্মীদের সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করা যেত। বিদেশে এখন পরিচিত দেশের মানুষ শুধু আমার স্ত্রী। কাজেই তার সঙ্গেই আমি ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করলাম। আমি তাকে বোঝালাম, ফার্স্ব সেক্রেটারি নিশ্চয়ই অনভিজ্ঞ মানুষ, এক কথা বলতে গিয়ে আরেক কথা বলে ফেলেছেন। জাতিসংঘের অধিবেশনে পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা পকেট থেকে ভুল কাগজ বের করে ভুল ভাষণ দিয়ে ফেলেন বলে শুনেছি। এটা সম্ভবত সে রকম একটা কিছু। এ রকম গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় এ রকম বেঁফাস একটা কথা বলে ফেলার জন্য তাঁর চাকরি চলে যায় কি না, সেটা নিয়েও আমরা একটু দুশ্চিন্তা অনুভব করলাম।
সপ্তাহ খানেক আগে খবরের কাগজ পড়ে আমার আবার আক্কেলগুড়ুম হয়ে গেল। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি আবার সেই কথাগুলোই বলছেন, আরও অনেক স্পষ্টভাবে। বিভ্রান্তির বিন্দুমাত্র জায়গা নেই। আমাদের দেশের যেসব রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীর জন্য আমার অনেক শ্রদ্ধাবোধ, ডা. দীপু মনি তাঁদের একজন। রাজনীতি করার আগে তিনি যেভাবে নিজেকে প্রস্তুত করেছেন, সে রকম আর কেউ আছেন কি না আমার জানা নেই। তিনি যদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী না হয়ে একজন সাধারণ রাজনৈতিক কর্মী বা নেতা হতেন, তাহলে অবশ্যই আমি তাঁর বাসায় হাজির হয়ে বিষয়টা বুঝতে চাইতাম। এখন আমি জানি, এর মধ্যে বোঝাবুঝির কিছু নেই। অনেক ওপরের পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে, নিচের পর্যায়ে এখন স্টিম রোলার চালানো শুরু হয়েছে, কারও কিছু করার নেই।
কিন্তু তাই বলে কি আমরা আমাদের দুঃখ বা শোকের কথা বলতে পারব না? প্রথমত, আদিবাসী কথাটা ডিকশনারিতে কীভাবে ব্যাখ্যা করা আছে, সেটা দিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। ছোট ছোট বাচ্চারা স্কুল-কলেজের বিতর্কের শুরুতে ডিকশনারি বা এনসাইক্লোপিডিয়া থেকে ব্যাখ্যা দেয়। গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের সেটা করতে হয়—আমি জানতাম না। শুধু কৌতূহলের জন্য আমি ডিকশনারিতে ক্রসফায়ার শব্দটির অর্থ খুঁজেছি। র‌্যাব যখন বিনা বিচারে, সন্দেহভাজন কাউকে গুলি করে মেরে ফেলে, সেটা হচ্ছে ক্রসফায়ার—ডিকশনারিতে সেটা লেখা নেই। আমার বাসায় আরবি ডিকশনারি নেই, থাকলে রাজাকার শব্দটির অর্থ খুঁজে দেখতাম। আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, মতিউর রহমান নিজামী বা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের মতো দেশদ্রোহী মানুষ যাঁরা স্বাধীনতাযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পদলেহী হয়ে এই দেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন, তাঁরা হচ্ছেন রাজাকার—সেই কথাটি ডিকশনারিতে লেখা থাকবে না। আমি যত

দূর জানি, সেখানে রাজাকার শব্দের অর্থ লেখা আছে সাহায্যকারী। কাজেই সব শব্দের অর্থ খোঁজার জন্য ডিকশনারিতে যেতে হয় না। অনেক শব্দ আছে যার অর্থ ডিকশনারিতে বেঁধে দেওয়া অর্থ থেকে অনেক বেশি ব্যাপক। আদিবাসী ঠিক সে রকম একটা শব্দ। আমরা বহুদিন ধরে এই শব্দটা ব্যবহার করে আসছি। হঠা ৎ করে দেশের সরকার তাদের নিজস্ব একটা অর্থ দিয়ে এটাকে বেঁধে ফেলতে পারবে না। যদি তার চেষ্টা করা হয়, তাহলে অবশ্যই আমরা খুব দুর্ভাবনায় পড়ে যাব।
মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের পরপরই জাতিসংঘের আদিবাসীবিষয়ক স্থায়ী ফোরামের সদস্য রাজা দেবাশীষ রায় প্রথম আলোতে একটা লেখা লিখেছিলেন (২৯ জুলাই ২০১১)। সেখান থেকে আমরা জানি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী অনেক কিছুই ঠিক বলেননি। একজন মানুষ একটা ভুল তথ্য দিতে পারেন, সেটা পরে শুদ্ধ করে নিলে ঝামেলা মিটে যায়। এবারের বিষয়টি আরও চমকপ্রদ—বাংলাদেশ সরকার তার নিজস্ব ব্যাখ্যা দিয়েছে। জাতিসংঘ বলেছে, তারা বাংলাদেশ সরকারের ব্যাখ্যাটা মেনে নেবে না, বহুদিন থেকে সর্বজনস্বীকৃত যে ব্যাখ্যার ওপর নির্ভর করে আছে, সেটাই তারা মেনে চলবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পুরো বক্তব্যটা আসলে মধুর বক্তব্য নয়, তাঁর ভেতরে কেমন জানি হিংসা হিংসা ভাব। তাঁর বক্তব্য দিয়ে মনে হচ্ছে পুরো দেশটাকেই একটা হিংসুটে, নীচ, সাম্প্রদায়িক দেশ হিসেবে পৃথিবীর সামনে উপস্থিত করে দেওয়া হলো। আমরা খুব পরিষ্কার করে বলতে চাই, এটা মোটেও আমাদের দেশের মানুষের কথা নয়। আমাদের দেশের মানুষ রীতিমতো যুদ্ধ করে রক্ত দিয়ে যখন এই দেশ স্বাধীন করেছিল, তখন সবচেয়ে বড় বিষয়টিই ছিল যে এই দেশের সব মানুষ সমান। এই দেশের মানুষকে আমরা সংবিধানে স্বীকার করে নেব, তাদেরকে তাদের ন্যায্য অধিকারটুকু দেব।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যের একপর্যায়ে বলেছেন, জনসংখ্যার মাত্র ১ দশমিক ২ শতাংশ মানুষকে বিশেষ আর উন্নত পরিচয় দিতে গিয়ে বাকি ৯৮ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষের অধিকার হরণ করা যাবে না। আমরা তো সবাই একসঙ্গে ছিলাম, হঠা ৎ করে কেন আমাদের একে অন্যের প্রতিপক্ষ তৈরি করা হলো? কেন বোঝানো হলো তাদেরকে কিছু একটা দিতে হলে সেটা আমাদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে দিতে হবে? শুধু কি তাই, তাঁর বক্তব্যের মধ্যে পাহাড়ি মানুষদের জন্য একধরনের তাচ্ছিল্য আর অশ্রদ্ধা প্রকাশ পেয়েছে। তিনি আমাদের বুঝিয়েছেন, তারা বাঙালিদের মতো এখানকার খাঁটি অধিবাসী নয়, ইতিহাসের কোনো এক সময় ‘অর্থনৈতিক’ সুযোগ-সুবিধার জন্য এই দেশে ‘রাজনৈতিক’ আশ্রয় নিয়েছে মাত্র। আমেরিকা-ইউরোপে আদম ব্যাপারিরা যেভাবে লোকজন পাঠিয়ে দেয়, তারা ছোটখাটো কাজ করে টাকা-পয়সা কামাই করে এবং চেষ্টা করে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে পাকাপাকিভাবে থাকার জন্য—ব্যাপারটা ঠিক সে রকম। আমি জানি, তাঁর এই বক্তব্যে পাহাড়ি মানুষেরা মনে খুব কষ্ট পেয়েছে। ব্যাপারটির সত্য-মিথ্যা নিয়ে আমি প্রশ্ন তুলছি না—হঠা ৎ করে কেন এটা এভাবে বলা হলো, আমি সেটা বোঝার চেষ্টা করছি। আমরা তো চেষ্টা করি আমাদের কথাবার্তায় কাজকর্মে কাউকে আঘাত না দিতে। হঠা ৎ করে কেন গায়ে পড়ে কিছু মানুষকে অপমান করা হলো?
আমি বিষয়টি ভেবে কোনো কূল-কিনারা পাইনি। তখন হঠা ৎ করে খবরের কাগজে ছোট একটা খবর পড়ে আমার মনে হলো, আমি পেছনের কারণটি অনুমান করতে পারছি। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনী হিসেবে অসম্ভব দক্ষতা নিয়ে কাজ করে এসেছে। আমি জানি তাদের এই কাজ শুধু দায়িত্ব পালন নয়, তার থেকে অনেক বেশি আন্তরিক। সে জন্য কোনো একটি দেশ তাদের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষাকেই স্থান করে দিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, আমি শুনেছি, আমাদের সেনাবাহিনীর লোকজন সে দেশে এত জনপ্রিয় যে তারা যদি সে দেশে ইলেকশনে দাঁড়াতে পারত, তাহলে বিপ

ুল ভোটে বিজয় পেতে পারত। এই খবরগুলো জেনে খুব স্বাভাবিকভাবেই আমাদের সবার ভালো লাগে।
এর সঙ্গে সঙ্গে এ কথাটিও সত্যি, পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেক পাহাড়ি মানুষ আমাদের সেনাবাহিনীর হাতে নির্যাতিত হয়েছে। বিষয়টা দেশের মানুষের কাছে গোপন ছিল। শান্তিচুক্তির ঠিক আগে আগে ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরের ২ তারিখ সব পত্রপত্রিকায় পার্বত্য চট্টগ্রামের একটা ঐতিহাসিক ঘটনাপঞ্জি ছাপানো হয়েছিল। সেই ঘটনাপঞ্জি যারা পড়েছে শুধু তারাই জানে, সেই এলাকায় মানবতার বিরুদ্ধে কী ভয়ংকর অপরাধ করা হয়েছিল। শান্তিচুক্তির পর হঠা ৎ করে সব বন্ধ হয়ে গেছে, সেটা সত্যি নয়। আমরা জানি, তার পরও পাহাড়ি মানুষেরা নানা ধরনের বিচ্ছিন্ন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। শুধু যে পত্রপত্রিকায় পড়েছি তা নয়, আমি নিজের কানেও তাদের কাছ থেকে তার কিছু বর্ণনা শুনেছি।
আদিবাসী বিতর্ক শুরু হওয়ার পর আমি খবরের কাগজে দেখেছি, জাতিসংঘে আলোচনা করা হচ্ছে, সেনাবাহিনীর যেসব সদস্য আদিবাসীদের সঙ্গে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে, তাদের যেন জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনীতে যোগ দিতে না দেওয়া হয়। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সেনাবাহিনী যে শেষ পর্যন্ত সামরিক শাসন দিয়ে ফেলেনি, তার পেছনেও এই শান্তিরক্ষা মিশনে যোগ দেওয়ার সুযোগটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। কাজেই এখন যদি আদিবাসীদের ওপর অত্যাচার করাটা জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে যোগ দেওয়ার জন্য একটা বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে তার সবচেয়ে সহজ সমাধান হবে ঘোষণা দিয়ে দেওয়া, এই দেশে আদিবাসী বলেই কিছু নেই। যদি আদিবাসী না থাকে, তাহলে তাদের ওপর অত্যাচারটা করার প্রশ্নই তখন থাকবে না। অত্যন্ত জটিল একটা সমস্যার এর থেকে সহজ সমাধান আর কী হতে পারে?
এটি আমার একটি অনুমান, যদি সরকার বা সেনাবাহিনীর কেউ আমার অনুমানটিকে ভুল প্রমাণ করিয়ে দেন, তাহলে আমার থেকে বেশি খুশি আর কেউ হবে না।

২.
আমি যখন যুক্তরাষ্ট্র বেল কমিউনিকেশন্সে কাজ করি তখন মাঝেমধ্যেই আমাদের গ্রুপের সবাই দল বেঁধে পিতজা (শব্দটা পিজা বা পিজজা নয়, আসলে পিতজা) খেতে যেত। একদিন সে রকম একটা অনুষ্ঠানে গিয়ে হঠা ৎ করে আমি লক্ষ করলাম, আমাদের গ্রুপে সাদা চামড়ার আমেরিকানের সংখ্যা বলতে গেলে নেই। সেখানে ফ্রেঞ্চ, জার্মান, ভারতীয়, বাংলাদেশি (আমি), চায়নিজ, কোরিয়ান, গ্রিক এককথায় পৃথিবীর সব দেশের মানুষ আছে। আমি তখন বুঝতে পেরেছিলাম, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে এত দ্রুত পৃথিবীতে এত ওপরে উঠে গেছে, তার একটা কারণ হচ্ছে সারা পৃথিবীর সব কালচারের মানুষ এখানে পাশাপাশি থাকে। ডাইভারসিটি বা বৈচিত্র্য হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় একটা সম্পদ।
দেশে ফিরে এসে আমি এই বৈচিত্র্যের অভাবটি খুব বেশি অনুভব করেছি। আমাদের সবাই দেখতে এক রকম, আমরা প্রায় সবাই এক ভাষায় কথা বলি, আমাদের সংস্কৃতিও এক রকম। আমাদের দেশের ভিন্ন ভাষা বা সংস্কৃতির মানুষ হচ্ছে এই অত্যন্ত অল্প কয়জন আদিবাসী। আমাদের নিজেদের জন্যই এই আদিবাসীদের বুকে আগলে রাখা উচিত। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা ভিন্ন দেশ নেপালের ছাত্রছাত্রীদের নিয়মিত পড়িয়ে আসছি, কিন্তু আমার নিজের দেশের একজন সাঁওতাল, গারো বা ম্রো ছাত্রছাত্রীকে এখানে পড়াতে পারিনি—সেটা আমার অনেক বড় দুঃখ। কয়েক বছর আগে আমি রাঙামাটির একটা স্কুলে গিয়েছিলাম। সেখানে পাহাড়ি ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করে। সেখানে হঠা ৎ করে লক্ষ করলাম, একটা ছোট পাহাড়ি শিশু একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে, হাতে একটা বই এবং সে খুব সাহস করে আমার কাছে আসতে পারছে না। এটি আমার জন্য একটি খুবই পরিচিত একটা দৃশ্য। আমি তাকে কাছে ডাকলাম এবং হাতে ধরে রাখা আমার লেখা কোনো একটা কিশোর উপন্যাসে অটোগ্রাফ করে দিলাম। তার সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম, সে ম্রো শিশু এবং সে যেখানে থাকে তার আশপাশে কোনো স্কুল নেই বলে রাঙামাটির এই স্কুলে হোস্টেলে থেকে পড়ে। বইমেলা চলার সময় কোনো কোনো দিন বাংলা একাডেমীর বটগাছের নিচে বসে বসে দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত হাজার হাজার ছেলেমেয়েকে অটোগ্রাফ দিয়েছি। কিন্তু সেই একটি ম্রো শিশুর বইয়ে অটোগ্রাফ দিতে আমি তার থেকে অনেক বেশি আনন্দ পেয়েছিলাম। আমার মনে হয়েছিল, আমি এই দেশের আদিবাসী একটা শিশুর কাছে পৌঁছাতে পেরেছি।
শৈশবে আমার বাবা বান্দরবানে পুলিশ অফিসার হিসেবে ছিলেন। আমি সেখানকার স্কুলে পড়েছি। আমাদের স্কুলে অল্প কয়েকজন বাঙালি ছেলেমেয়ে ছিল। বেশির ভাগই ছিল পাহাড়ি। আমার মনে আছে, আমার সেই পাহাড়ি বন্ধুদের সঙ্গে শঙ্খ নদের তীরে কিংবা বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়িয়েছি। ভাষার খানিকটা দূরত্ব ছিল, কিন্তু সেটি মোটেও কোনো সমস্যা ছিল না। শুধু ভাষা নয়, তাদের গায়ের রং, মুখের ছাপ, পোশাক, আচার-আচরণ সেগুলোও ভিন্ন ছিল, কিন্তু সেই শৈশবে আমি নিজের মতো করে আবিষ্কার করেছিলাম, এই ভিন্নতাটুকুই হচ্ছে আমার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। বড় হয়ে বুঝেছি, বৈচিত্র্যটাই হচ্ছে সৌন্দর্য। সবচেয়ে বড় কথা, আমার সেই পাহাড়ি বন্ধুরা আর আমরা কিন্তু একই মানুষ।
তাই আমার খুব দুঃখ হয়, যখন দেখি এই দেশে আমার সব অধিকার আছে, অথচ আমার শৈশবের সেই বন্ধুরা এই দেশে সংবিধানে একটুখানি অধিকারের জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে, তারা সেটা পাচ্ছে না। শুধু যে পাচ্ছে না তা নয়, একেবারে সরকারের পক্ষ থেকে আমরা তাদের অবহেলা করে দূরে ঠেলে দিচ্ছি।
বিষয়টা কেমন করে নিষ্পত্তি হবে আমি জানি না। আমি শুধু একটা জিনিস জানি, এই দেশের সব মানুষ যখন কোনো একটা কিছু চায়, তখন তারা সেটা আদায় করে নিতে পারে। আর দেশের মানুষের কোনো একটা কিছু চাওয়া শুরু হয় এই দেশের তরুণ প্রজন্ম দিয়ে। তাই আমার খুব ইচ্ছে, এই দেশের তরুণ প্রজন্ম বিষয

়টা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করুক। তাদের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন একজন গারো, সাঁওতাল কিংবা ম্রো সহপাঠী নেই, সেই প্রশ্নটা সবাইকে করতে থাকুক। সারা পৃথিবী যখন ‘ডাইভারসিটি’ নিয়ে ব্যস্ত হয়েছে, তখন আমরা কেন সেটাকে চাপা দিয়ে চোখের আড়াল করতে চাইছি, সেটা জানার চেষ্টা করুক। আমরা বাঙালিরা শতকরা ৯৮ দশমিক ৮ ভাগ থেকেও মাত্র ১ দশমিক ২ ভাগ আদিবাসী মানুষের দায়িত্ব নিতে পারব না, সেটা তো হতে পারে না।

৩.
আদিবাসীদের নিয়ে এই বিতর্কটুকু দেখে আমি একটু আতঙ্ক অনুভব করেছি। তার কারণ ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক, সেখানে ৯৮ দশমিক ৮ শতাংশ বাঙালি যে বাকি ১ দশমিক ২ ভাগ মানুষ থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেই বিষয়টা কিন্তু প্রকাশ পেয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে যখন কোনো জাতি নিজেকে অন্যদের থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভাবে, তার ফল হয় ভয়ানক। জার্মানির না ৎ সিরা ভেবেছিল, নানকিংয়ে জাপানিরা ভেবেছিল, ফিলিস্তিনে ঐশ্বরিক অধিকার পাওয়া ইসরায়েলিরা ভাবে। সর্বশেষ উদাহরণ হচ্ছে নরওয়ের গণহত্যাকারী সেই উন্মাদ, যার ধারণা তার খাঁটি জাতিটাকে যেকোনো মূল্যে রক্ষা করতে হবে। আমরা দুর্নীতিপরায়ণ, অশিক্ষিত, পশ্চা ৎ পদ জাতি, আমাদের কোনো ভবিষ্য ৎ নেই—আমি মোটেও সে কথা বিশ্বাস করি না। আমি প্রায় অনুভব করতে পারি, আমাদের নতুন প্রজন্মের হাত ধরে আমরা মাথা তুলে দাঁড়াতে যাচ্ছি। কিন্তু সেই সঙ্গে আমি এটাও বিশ্বাস করি না, দেশের ৯৮ দশমিক ৮ ভাগ মানুষ হিসেবে এই দেশে আমার অধিকার বেশি।
আদিবাসী বিতর্ক দেখে আমি হয়তো দুর্ভাবনা অনুভব করেছি, কিন্তু আমি নিশ্চিতভাবে জানি, এই দেশের আদিবাসীরা একটা আঘাত পেয়েছে, তাদের ভেতরকার অনুভূতি হচ্ছে দুঃখ।
আমি জানি না সরকারকে কোনো কথা বলা যায় কি না। যদি যেত, তাহলে আমি তাদের ওমর খৈয়ামের কবিতার একটি লাইন শোনানোর চেষ্টা করতাম—
‘কারও মনে দুখ দিয়ো না, করো বরং হাজার পাপ—’। হাজার পাপ করার থেকেও কারও মনে দুঃখ দেওয়া যে অনেক বেশি নির্মম, এই সহজ কথাটা বোঝা কি এতই কঠিন?
মুহম্মদ জাফর ইকবাল: লেখক। অধ্যাপক শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

Link requested by Anim Rahman | original source at Prothom Alo


Place your ads here!

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment