Sheik Mujibur Rahman : Eto Mitthachareo Noto Non Jatir Pita

Sheik Mujibur Rahman : Eto Mitthachareo Noto Non Jatir Pita

এত মিথ্যাচারেও নত নন জাতির পিতা

…মধুমতির উপর দিয়ে খোলা নৌকায় বাসন্তিবালার বাবা মেজো মামাকে ধরে আছে। বড়ো আশায় বারবার বলছে, কথা ক। কথা ক, অ কপিল। এই সময় একটি লঞ্চ দূর থেকে ভটভট করে আসতে দেখা গেল। দোতলার রেলিংয়ে কিছু লোকজন দাঁড়িয়ে আছে। একটা শালু কাপড়ে লেখা- জাগো বাঙালী, জাগো। বড় মামা বিরক্ত হল। ঢেউ দুলিয়ে দিচ্ছে ছোট নৌকাটাকে। তাল সামলানো মুশকিল। ঢেউয়ের আড়াআড়ি নৌকাটা তুলে দিল। বলল, কাগু কপিলরে ধইরা রাইখো ঠিক কইরা। হঠাৎ মেজো মামা লাফিয়ে উঠল। দাঁড়ালো সোজাসুজি। মাথা খাড়া করে দুহাত ছড়িয়ে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে চেঁচিয়ে বলল, মুজিব ভাইইই! লঞ্চের বাইরে সাদা পাঞ্জাবী দীর্ঘদেহ চশমা পড়া পাইপ হাতে কে একজন জলদ গম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন- জয় বাংলা… (পরীকথা : কুলদারঞ্জন রায়)

…………………………………………………………………………………

আলী আহমদ গানের বই বিক্রি করেন। সিনেমার গান। বইয়ের মলাটে নায়ক-নায়িকাদের ছবি থাকে। মোহাম্মদ আলী-জেবা। উল্টোদিকের বাড়িতে দুই বাঁধা কাস্টমার আছে তার। অল্পবয়সী দুই কিশোর কিশোরী। হাসিনা ও কামাল। টাকা না থাকলে বাকিতে বই নিয়ে যায়। ঠিক অনিচ্ছেতে নয়, ভয়েই দিয়ে দেন আলী। দোতলা বাড়ির ওই ভাড়াটিয়াকে নিয়ে তার মধ্যে একটা তীব্র আতঙ্কবোধ কাজ করে। কিছুদিন পরপর এ বাড়িতে পুলিশ আসে। কিছুদিন পর পর গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় ওই ভাড়াটিয়াকে। তার মানে কত বড় ডাকাত ওই লোক! ঈদের দিন আলী অবাক হন বাড়ির সামনে গাড়ীর ভিড় দেখে। বিখ্যাত সব লোক, শিক্ষিত সব লোক, নামী সব লোক! এরা এই ডাকাতের বাড়িতে কি করে! আলী যান সেই বাড়িতে। পাওনা টাকা চাইতে এসেছে ভেবে হাসিনা ও কামাল মাকে খবর দেন, বসতে দেন অতিথিকে। তিনি আসেন আলীকে নাস্তা-পানি দেন। আর বলেন, ‘সবসময় তো হাতে টাকা থাকে না, ওদের বাবা প্রায়ই দূরে থাকেন। তারপরও ওরা যা চায় দিয়ে দিবেন, আমি টাকা দিয়ে দিব।’ আলী বলেন, ‘আমি তো পাওনা চাইতে আসি নাই আম্মা। আসলে ফুটফুইটা দুই ছেলে মেয়ে আপনার, বাড়ীঘর দেইখা বুঝা যায় বংশ ভালো। সাহেবরে বলেন আজেবাজে কাজ ছাইড়া ভালো হইয়া যাইতে। দুইদিন পরপর পুলিশ আইসা তারে বাইন্ধা নিয়া যায়, এইটা কি ভালো কিছু?’ উত্তরে আলী যা শোনেন তাতে তার চোখ ছানাবড়া। কোনো ডাকাত নন, ওই ভাড়াটিয়ার নাম শেখ মুজিবুর রহমান। পাকিস্তান সামরিক জান্তার সার্বক্ষণিক এক মাথাব্যথা, যাকে যে কোনো ইস্যুতে চৌদ্দশিকের আড়ালে না রেখে স্বস্তি পায় না তারা। আলী সেই প্রথম জানলেন শুধু ডাকাত নয়, দেশের মানুষের রাজনীতি করলেও পুলিশ ধরে। তিনি আগ্রহী হন। পল্টন মাঠে বৃষ্টিতে ভিজে শোনেন ছয় দফার গান। সিনেমার বই লাটে ওঠে, এই লোকের কথা মানুষের কাছে পৌছানোর পণ করেন আলী। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকা রেসকোর্স ময়দানেই শেখ মুজিবের তখন পর্যন্ত করা বক্তৃতা সংকলন ৩৬ হাজার কপি বিক্রি হয় তার।

আলী আহমদ একটি বিচ্ছিন্ন উদাহরণ মাত্র। দীর্ঘদিন একটি ভুল ধারণা বয়ে বেড়াবার পর যখন চোখ খুলে গেলো অসংখ্য মুজিবপ্রেমীর একজন হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। এদের কেউ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর থেকে আর জুতো পায়ে দেননি। কেউ এখনও এই বৃদ্ধ বয়সে দেশজুড়ে সাইকেল রিকশা চালিয়ে মাইকে শুনিয়ে বেড়ান সেই মহামানবের বজ্রকঠিন কণ্ঠস্বর। কেউ নিঃস্ব অবস্থায় মৃত্যুবরণ করার সময়ও হাত দেননি শেষ সহায় একখন্ড জমিতে, যে জমি মুজিবের এতিম কন্যা শেখ হাসিনার নামে কেনা! এদের কারো স্মৃতিতে এখনও জ্বলজ্বল আবেগী এক আলিঙ্গনের স্মৃতি, তার আগে সেই কথাগুলো, ‘পিছনে বইসা আছো কেন মেন্তু মিয়া, সামনে আসো। চলো সরিষা তেলে মাখা মুড়ি খাই।’ এই বাংলাদেশে এখনও অসংখ্য মানুষ শেখ মুজিবের গল্প করার সময় স্বাভাবিক অভিব্যক্তি হারিয়ে ফেলেন। তাদের চোখমুখ অন্যরকম হয়ে যায়। তাদের চোখের জল কখনোই বাঁধ মানে না। এ আসলে এক ভয়ানক ব্যর্থতা। ব্যর্থতা সেই সব অপশক্তির, যারা দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে এদেশ থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম ও নিশানা মুছে ফেলতে চেয়েছে। ১৯৭৫ সালে জাতির জনকের নির্মম সেই হত্যাকাণ্ডের পর তাদের হাতে রেডিও টিভি সংবাদপত্রসহ যাবতীয় প্রচার মাধ্যম ছিলো। তারা যাই চেয়েছে, যেভাবে চেয়েছে, তাই প্রচারিত হয়েছে, তাই ছাপা হয়েছে। এদেশের ক্ষমতায় স্বাধীনতাবিরোধীদের অধিষ্টানের জন্য জরুরী ছিলো মুক্তিযুদ্ধের অর্জনগুলোকে বিতর্কিত করা, প্রশ্নবিদ্ধ করা। আর সেজন্য সবচেয়ে জরুরী ছিলো এই স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টাকে নানা অপপ্রচারের মাধ্যমে কলঙ্কিত করা। এতে তার সপরিবারে নির্মম হত্যাকাণ্ডকে বৈধতা দেওয়া যায়, নেপথ্যের স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তিকে বৈধতা দেওয়া যায়, মুক্তিযুদ্ধকে কলঙ্কিত করা যায়, স্বাধীনতাবিরোধীদের মুক্তিযুদ্ধকালীন যাবতীয় অপকর্মকে বৈধতা দেওয়া যায়। সর্বোপরি যেই সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখে গোটা একটা জীবন উৎসর্গ করেছেন শেখ মুজিব নামের মহামানুষটা, তার বাস্তবায়ন ঠেকিয়ে রাখা যায়। ঠারেঠোরে পক্ষপাতটা পাকিস্তানের দিকেই রয়ে যায়।

তাই বলে একেবারে ব্যর্থ কি তাদের বলা যায়? না বলা যায় না। এদেশের সাধারন মানুষের কাছে শেখ মুজিব এতদিন পরও এক কিংবদন্তীসম মহান পুরুষ। বিপরীতে দেশের শিক্ষিত সমাজের একটা বড় অংশই তার নামে নাক সিঁটকায়। এই শিক্ষিতরা প্রজন্মান্তরে ওই অপপ্রচারণার সফল শিকার। তারা সেগুলো বিশ্বাস করেছে, ধারণ করেছে। প্রচারও করেছে। তলিয়ে না দেখে দিনের পর দিন কুতর্ক চালিয়ে গেছে। ব্যাপারটা যে কত ভয়াবহ রূপে একদল মানুষের মনে গেড়ে বসেছে, তা আতঙ্কিত হয়ে আবিষ্কার করেছি আন্তর্জালে। আধুনিক প্রযুক্তির সর্বাধুনিক মাধ্যম বাংলা ব্লগে লেখালেখির সময় আবিষ্কার করেছি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কি সব ভয়ঙ্কর কল্পকথা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি। আজকে আওয়ামী লীগ ডিজিটাল বাংলাদেশের তত্ত্ব দেয়, কিন্তু দলটির কোনো পর্যায়ের কোনো বুদ্ধিজীবিকেই কখনও দেখা যায়নি এসব অপপ্রচারের দাঁতভাঙা জবাব নিয়ে হাজির হতে। দায়টা স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নেই আমরা কয়েকজন যারা স্রেফ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রাখার সংকল্পে জাতির জনকের যাবতীয় কলঙ্কমোচনকে যুদ্ধজ্ঞান করি। প্রতিটি অপপ্রচার দলিল দস্তাবেজ, অডিও ভিডিও, ছবি সহকারে উপস্থাপন করা হয়। আমাদের যাবতীয় আত্মপ্রসাদকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নতুন নতুন গল্প বানানো হয়। আমাদের লড়াইয়ের খবর মূলধারার প্রকাশনায় আসে না, মগজধোলাইর শিকার কাগজ পাঠকদের অগোচরে থেকে যায়। এই লেখাটিতে সেরকমই কিছু অপপ্রচারণা নিয়ে খানিকটা আলোকপাত করা যাক। এতে দীর্ঘদিন ভুল গল্প বিশ্বাস করে অন্যকে বলে বেড়ানো কিছু মানুষের হয়তো কাণ্ডজ্ঞান ফিরলেও ফিরতে পারে।

তার আগে কিছু কথা না বললেই নয়। মুজিববিরোধী ও স্বাধীনতাবিরোধী এসব লেখালেখির ইতিহাস কিন্তু অনেক পুরানো। বাংলাদেশে ব্লগ তো সেদিনের ঘটনা। কিন্তু নানা ইংরেজী মাধ্যমে, নানা প্রকাশনায় এসব লেখালেখি চলে আসছে কয়েকযুগ ধরে। লেখকদের প্রত্যেকেই ’৭৫ পরবর্তী সামরিক সরকারকের ধামাধরা লোক, অনেকেই যুদ্ধকালীন বিশ্ববিদ্যালয়ের দালাল শিক্ষক, স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর পোষা বুদ্ধিজীবি। ধারাবাহিকতায় আনলে খুব মোটা দাগের কয়েকটি অভিযোগকে চিহ্নিত করা যায়, যেগুলোতে এরা দিনের পর দিন বাতাস দিয়ে যাচ্ছে। শুরুটা মুজিবের রাজনৈতিক উত্থানের সময়টা নিয়ে। অভিযোগ তিনি মহা দাঙ্গাবাজ লোক। দেশভাগের সময় কলকাতায় মুসলীম লীগের হয়ে দাঙ্গায় অংশ নিয়েছেন আর তারপর ’৫৮ সালে প্রাদেশিক সংসদ অধিবেশন চলার সময় স্পিকার শাহেদ আলীকে চেয়ার দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেছেন। কি ভয়াবহ আবিষ্কার। মুসলীম লীগের এত বড় গুন্ডাটা কিনা পাকিস্তান হওয়ার পরপর ভোলপাল্টে ধর্মনিরপেক্ষতার আলখেল্লা চাপিয়ে আওয়ামী লীগ থেকে মুসলিম নামটাকে প্রত্যাহার করে একে সার্বজনীন রূপ দিলো! আর এতবড় দাঙ্গাবাজের এককোটির উপর সমর্থককে মুক্তিযুদ্ধের সময় সাড়ে নয়মাস খাইয়ে দাইয়ে আশ্রয় দিয়ে লড়তে রসদ যুগালো সেই কলকাতার অধিবাসীরা! স্পিকার শাহেদ আলীর ঘটনা নিয়ে পড়তে চাইলে তার বিবরণ যে কোনো সমকালীন লেখালেখিতেই মিলবে। ’৭০ এর আগে পাকিস্তানে কোনো সাধারণ নির্বাচন হয়নি। যা হয়েছে তার নাম সিলেকশন। নেপথ্যে কলকাঠি নাড়া সামরিক বাহিনীর তল্পীবাহক একদল রাজনীতিবিদ পূর্ব পাকিস্তানের সাম্যবাদী ডাককে দমিয়ে রাখতে পুতুলের ভূমিকা নিয়েছেন। ’৫৮ সালের সেই ঘটনা ছিলো পাকাপাকিভাবে সামরিক শাসন আনার এক ষড়যন্ত্র মাত্র। আর তাতে শেখ মুজিবকে জড়ানোর কোনো অবকাশই নেই। তখনকার তখনকার নিউইয়র্ক টাইমস (২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৫৮) ও টাইমস ম্যাগাজিন (অক্টোবর ৬, ১৯৫৮) যে খবর প্রকাশিত করে তাতে আবু হোসেন সরকারসহ যে ১২ জন রাজনীতিবিদকে গ্রেফতার করে জামিন দেওয়া হয়, তাদের মধ্যে মুজিব ছিলেন না। ঘটনার বিবরণ এরকম যে স্পিকার আবদুল হাকিম সরকারী চাকুরী করার অভিযোগে ৬ জন সদস্যের সংসদপদ বাতিল করেন। সুবাদেই সংখ্যাগরিষ্টতা হারায় সরকারী দল। উত্তেজিত হাকিমকে ‘উম্মাদ’ আখ্যায়িত করে ধাওয়া দেন তারা। অধিবেশন আবার বসলে, ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলী স্পিকারের দায়িত্ব নেন এবং ৬ জনের সদস্যপদ বহাল করেন। এবার উত্তেজিত হয় বিরোধী দলের সদস্যরা যার নেতৃত্ব দেন আবু হাসান সরকার এবং তারই ছোঁড়া মাইকের স্ট্যান্ডের আঘাতে রক্তাক্ত মাথায় লুটিয়ে পড়েন শাহেদ আলী। ক’দিন কোমায় ভোগার পর মারা যান তিনি। আর পরিণামে সব ধরণের রাজনৈতিক কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা জারি করে আইয়ুব খান দখল করেন পাকিস্তানের ক্ষমতা। এই ঘটনার আট বছর পর যখন আগরতলা ষড়যন্ত্র নামের রাষ্ট্রদ্রোহী মামলায় বঙ্গবন্ধুর বিচার করছে পাকিস্তান সরকার, তারা নিশ্চিত প্রমাণ হাতড়ে বেরিয়েছে। অথচ শাহেদ আলীর ঘটনায় মুজিবের বিন্দুমাত্র ভূমিকা থাকলে, তাকে ঝোলাতে দুবার ভাবতো না সামরিক জান্তা। প্রমাণ ওই ঘটনার ২০ বছর পর জুলফিকার আলী ভুট্টো দিয়ে গেছেন। আহমেদ রাজা কাসুরি হত্যার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে তাকে ফাঁসি দিয়েছেন জিয়াউল হক।

আগেই বলেছি, ’৭০ সালের নির্বাচন ছিলো পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথম সাধারণ নির্বাচন যাতে প্রথমবারের মতো সারা দেশের মানুষ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পায়। আর এই নির্বাচনেই নিজেকে বাংলার মানুষের একমাত্র প্রতিনিধি অন্যভাবে বললে ‘সবার নেতা’ হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করলেন বঙ্গবন্ধু। শত ষড়যন্ত্রেও ঠেকানো যায়নি তার সেই উত্থান। তাকে ও বাঙালীকে প্রাণের দাবি থেকে বঞ্চিত করার উপায় ছিলো একটিই, গণহত্যা। সুবাদেই শুরু হলো প্রতিরোধের লড়াই, পাল্টা মারের লড়াই, স্বাধীনতার লড়াই, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। এই মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি অধ্যায় অনেক আগেই ছক কেটে রেখেছেন বঙ্গবন্ধু। তার অনুপস্থিতিতে, স্রেফ তার নামেই একটি দেশ স্বাধীন হয়ে যাওয়ায় বিস্মিত অনুভূতি জানিয়েছিলেন ফিদেল ক্যাস্ত্রো। কিন্তু আসলেই বিস্ময়ের কিছু ছিলো না। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু বলে প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা লড়ে গেছেন দ্রোহের তীব্রতায়। একাত্তরের মার্চেই শুরু আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। আর এই মার্চকে ঘিরে তিনটি ভয়ানক অপপ্রচার চালানো হয় মুজিবকে নিয়ে। প্রথমটি ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে। বিশ্ব রাজনীতির পাঠক মাত্রই এই ভাষণটিকে এ যাবতকালের সেরাদের তালিকায় ওপরের দিকেই রাখেন। প্রেক্ষাপট, ঘটনার পর্যায়ক্রম ইত্যাদি মিলিয়ে এটি ধ্রূপদীই বটে। কিন্তু সেই ভাষণেই হঠাৎ করে জয় বাংলার পর জিয়ে পাকিস্তান কথাগুলো আবিষ্কার করে বসলো একদল কূপমন্ডুক। তখনও রাষ্ট্রটা পাকিস্তান, সাধারণ নির্বাচনে জয়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনের নেতা মুজিব। হিসেবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার নায্য হকদার। জিয়ে পাকিস্তান তিনি বলতেই পারেন, কিন্তু বলেননি। জনপ্রিয় উপন্যাসিক হুমায়ুন আহমেদ তার ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ নামের ফিকশনে এই কল্পগল্পটি আমদানী করেন। উদ্ধৃতি দেন প্রয়াত কবি শামসুর রাহমানের। এরপর হাবিবুর রহমানও নাকি তার কোন এক স্মৃতিকথায় এমনটি লিখেছেন। কিন্তু তার সমর্থন মেলেনি সেই জনসভায় উপস্থিত লাখো শ্রোতার কারো তরফেই। বাংলাদেশ কিংবা বিদেশী নানা আর্কাইভে রেকর্ড হিসেবে থাকা সেই বক্তৃতার কোনো সংস্করণেই জিয়ে পাকিস্তান কিংবা জয় পাকিস্তান নামে কোনো বাক্য নেই। চারদলীয় জোট সরকারের মন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা বিটিভি আর্কাইভে গোটা একটা দিন কাটিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন ওই শব্দ দুটো খুঁজে বের করতে। হাস্যকর প্রয়াস। কিন্তু তারপরও কথাগুলো স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি কৌশলে ঢুকিয়ে দিয়েছে তাদের সমর্থক প্রজন্মের মননে। এরা তা বিশ্বাস করে কুতর্কে নামে, শত প্রমাণেও নিবৃত্ত হয় না।

বলা হয় শেখ মুজিব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্নে এতটাই বিভোর ছিলেন যে ২৩ মার্চ তার বাড়িতে পাকিস্তানের পতাকা উড়িয়েছেন। এখন এই মিথ্যেবাদীরা এটা জানে না সেদিনের ঘটনার ফুটেজ আছে, ইউটিউবে খুঁজলেই মিলবে। সেদিন ছিল পাকিস্তান দিবস। অথচ গোটা বাংলাদেশে পালন হয়েছে প্রতিবাদ দিবস হিসেবে। দেশজুড়ে উড়েছে কালো পতাকা। স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়েছে একটাই, সেটা বঙ্গবন্ধূর বাসভবনে। শেখ মুজিব নিজের হাতে উড়িয়েছেন তা। সেদিন সারাদিন ঘর থেকে বের হননি তিনি। গোটা ঢাকা জুড়ে মিছিল হয়েছে, আর তা আছড়ে পড়েছে ধানমন্ডী ৩২ নম্বরের গেটে। ‘জয় বাংলা বাহিনী’ সশস্ত্র ট্রেনিং নিয়েছে। সেদিন বঙ্গবন্ধু হ্যান্ড মাইক হাতে নিজে শ্লোগান ধরে উদ্দীপ্ত করেছেন উপস্থিত বাঙালীদের। ‘জাগো জাগো, বাঙালী জাগো, তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা, সংগ্রাম সংগ্রাম চলবে চলবে, জয় বাংলা…’ বঙ্গবন্ধুর নিজের কণ্ঠে এই কথাগুলো শোনার পর শরীর ঝিম ধরে যায়। শ্লোগানের পর কিছু কথা ছিলো : মনে রাখবেন নীতির সঙ্গে আপোষ চলে না। বিশ্বাস রাখতে হবে।’ তার মানে বঙ্গবন্ধু ইয়াহিয়ার সঙ্গে আপোষে যাচ্ছেন এমন একটা কথা ইচ্ছা করেই রটিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু তা পাত পায়নি।

২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতার নিয়েও নানা কুকথা। একদল বলে শেখ মুজিব যদি স্বাধীনতাই চাইবেন তাহলে কেনো পালিয়ে গেলেন না! কেনো নিজে দাড়িয়ে থেকে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিলেন না! কেনো গ্রেফতার বরণ করলেন! আরেক দল তো আরো রূঢ়। দেশকে রক্তগঙ্গায় ভাসিয়ে বঙ্গবন্ধু নাকি পাকিস্তানে অতিথি হয়ে গেছেন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার তদবীর চালাতে। হায় পাপাচার! এই মূঢ়েরা বোঝে না স্বাধীনতার জন্য নিজের জীবনটা নিয়েই কতবড় একটা জুয়া খেলেছেন বঙ্গবন্ধু। তিনি পালাবেন? পালিয়েছেন কোনো কালে? তার সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে একবারও কি পালিয়েছেন? ’৭৫এর সেই কালো রাতে যখন ঘাতকরা স্টেন উচিয়ে এগিয়ে আসছে, পালিয়েছেন? নাকি মুখোমুখি হয়েছেন নির্ভয়ে? আরে এই লোকটা বাঙালীর নেতা। বাঙালীর ইজ্জত তার হাতে। তার পালালে চলে? আর তার অভিধানে থাকতে হবে তো শব্দটা! কোনোকালেই ছিলো না। তিনি গ্রেফতার হয়েছিলেন বলেই মুক্তিযুদ্ধ নায্য লড়াইর স্বীকৃতি পেয়েছে। সারা বিশ্ব জেনেছে জনতার রায়কে বুটে মাড়িয়ে, তাদের রক্তে হোলি খেলে, তাদের নেতাকে হাতকড়ি লাগিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে উপনিবেশবাদ কায়েম রাখতে ইয়াহিয়া কতখানি মরিয়া। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে বুলেটে নিকেশ করার সেই ষড়যন্ত্রের নায্য প্রতিবাদ হিসেবেই স্বীকৃতি পেয়েছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। নায্য হয়েছে তাজউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে প্রবাসী সরকারের লড়াই। তারা সব নির্বাচিত প্রতিনিধি, দেশের জনগনের ভোটে নির্বাচিত। কোনো বিদ্রোহী উপদল নয়, গৃহযুদ্ধের যুযুধান অংশ নয়। মুজিব গ্রেফতার না হলে অনেক সহজ হয়ে যেতো পাকিস্তানীদের কাজটা। তাকে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নেতা হিসেবে চিহ্নিত করে গণহত্যা জায়েজ করা যেতো। যে কোনো সময় হত্যা করে সেটাকে বৈধতা দেওয়া যেত। আগামী একশ বছরেও পূর্ব পাকিস্তান থেকে আর স্বাধীনতা শব্দটা উচ্চারিত হতো না। স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে আর নাইবা বলি, এ নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। তবে ২৫ মার্চ গভীর রাতে গনহত্যা শুরু হয়ে যাওয়ার পরপরই যখন প্রতিরোধের লড়াই চলছে দেশজুড়ে, মুক্তিযুদ্ধ চলছে। তখন ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় কালুরঘাট প্রপোগান্ডা রেডিও স্টেশনের কোনো ঘোষণার আলাদা মূল্য থাকে না। ৪৮ ঘণ্টা কম সময় নয়।

আজ যখন দেশজুড়ে স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতক দালালদের বিচারের তোড়জোর চলছে, তখন আবার মুজিবকে কাঠগড়ায় তোলা হচ্ছে। বলা হচ্ছে তিনি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে সব যুদ্ধাপরাধীকে রেহাই দিয়েছেন। এটিও একটি জঘন্য মিথ্যাচার। ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর যে সাধারণ ক্ষমা তিনি ঘোষণা করেছেন তার কোথাও হত্যাকারী, ধর্ষক ও লুটেরাদের ক্ষমা করার কথা নেই। তিনি নিজেই বলেছেন তাদের ক্ষমা করা হবে না। এ বিষয়ে পরদিন ১ অক্টোবরের দৈনিক বাংলার প্রতিবেদনটিকে আমলে আনা যেতে পারে। সেখানে লেখা হয়েছে : সরকার বাংলাদেশ দালাল আইনে অভিযুক্ত ও সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছেন। বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইবুনাল) অধ্যাদেশ ১৯৭২ বলে যারা আটক হয়েছেন, যাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা অথবা হুলিয়া রয়েছে এবং যারা এই আইনে সাজা ভোগ করছেন তাদের সকলের প্রতিই এই সাধারণ ক্ষমা প্রযুক্ত হবে এবং তারা অবিলম্বে মুক্তিলাভ করবেন। তবে নরহত্যা, নারী ধর্ষণ এবং অগ্নিসংযোগ অথবা বিস্ফোরকের সাহায্যে ঘরবাড়ি ধ্বংস অথবা জলযান ধ্বংসের অভিযোগে অভিযুক্ত ও সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এই সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা প্রযুক্ত হবে না। গতকাল শুক্রবার রাতে প্রকাশিত এক সরকারী প্রেসনোটে এই সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার কথা প্রকাশিত হয়।
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গতরাতে বলেন, দলমত নির্বিশেষে সকলেই যাতে আমাদের মহান জাতীয় দিবস ১৬ ডিসেম্বরে ঐক্যবদ্ধভাবে নতুন দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে দেশ গড়ার শপথ নিতে পারে সরকার সেজন্য দালাল আইনে আটক ও সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছেন। বাংলাদেশ দালাল অধ্যাদেশে আটক ও সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা যাতে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পর অনতিবিলম্বে জেল থেকে মুক্তিলাভ করতে পারেন এবং আসন্ন ১৬ ডিসেম্বরে বিজয় উৎসবে যোগ দিতে পারেন বঙ্গবন্ধু সেজন্য তাদের মুক্তি তরান্বিত করতে স্বরাষ্ট্র দফতরের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন। সাধারণ ক্ষমায় যারা মুক্তি পাবেন তাদের বিজয় দিবসের উৎসবে একাত্ম হতে এবং দেশ গঠনের পবিত্র দায়িত্ব ও দেশের স্বাধীনতা রক্ষার শপথ গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু তার সরকারের সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শনের কথা ঘোষণা করতে গিয়ে বলেন, মুক্ত হয়ে দেশগঠনের পবিত্র দায়িত্ব গ্রহণের পূর্ণ সুযোগ তারা গ্রহণ করবেন এবং তাদের অতীতের সকল তৎপরতা ও কার্যকলাপ ভুলে গিয়ে দেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন তিনি এটাই কামনা করেন।
বঙ্গবন্ধু বলেন, বহু রক্ত, ত্যাগ তিতিক্ষা আর চোখের পানির বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা লাভ করেছি। যে কোনো মূল্যে এই স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে হবে। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে এবারের বিজয় দিবস বাঙালীর ঘরে ঘরে সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি ও কল্যাণের এক নতুন দিগন্ত উম্মোচিত করবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কিছু লোক দখলদার বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা করে আমাদের মুক্তি সংগ্রামের বিরোধিতা করেছিলেন। পরে বাংলাদেশ দালাল আদেশ বলে তাদের গ্রেফতার করা হয়। এদের মধ্যে অনেকেই পরিচিত ব্যক্তি। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় দখলদার বাহিনীর সঙ্গে তাদের সহযোগিতার ফলে বাংলাদেশের মানুষের জীবনে অবর্ণনীয় দুঃখ দুর্দশা নেমে এসেছিল।
বঙ্গবন্ধু বলেন, এসব লোক দীর্ঘদিন ধরে আটক রয়েছেন। তিনি মনে করেন এতদিনে তারা নিশ্চয়ই গভীরভাবে অনুতপ্ত। তারা নিশ্চয়ই তাদের অতীত কার্যকলাপের জন্য অনুশোচনায় রয়েছেন। তিনি আশা করেন তারা মুক্তিলাভের পর তাদের সকল অতীত কার্যকলাপ ভুলে গিয়ে দেশ গঠনের নতুন শপথ নিয়ে প্রকৃত দেশপ্রেমিকের দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন। গতকাল স্বরাষ্ট্র দফতর থেকে নিম্নোক্ত প্রেসনোটটি ইস্যু করা হয়।

প্রেসনোট : যারা ১৯৭২ সালের দালাল (বিশেষ ট্রাইবুনাল) আদেশ (পি.ও নং-৮, ১৯৭২ সালের) বলে আটক রয়েছেন অথবা সাজাভোগ করছেন তাদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শনের প্রশ্নটি সরকার আগেও বিবেচনা করে দেখেছেন। সরকার এ সম্পর্কে এখন নিম্নোক্ত ঘোষণা করছেন :
১. দুনম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত ব্যক্তিদের ও অপরাধ সমূহের ক্ষেত্র ছাড়া :
(ক) ১৮৯৮ সালের ফৌজদারী দন্ডবিধি ৪০১ নং ধারা অনুযায়ী উল্লিখিত আদেশবলে আটক ও সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের রেহাই দেওয়া হচ্ছে এবং উল্লিখিত আদেশ ছাড়া অন্য কোনো আইনবলে তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ না থাকলে তাদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার অনতিবিলম্বে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হবে।
(খ) কোনো বিশেষ ট্রাইবুনালের সম্মুখে অথবা কোনো বিশেষ ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে উক্ত আদেশবলে বিচারাধীন সকল মামলা সংশ্লিষ্ঠ ট্রাইবুনাল ও ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি নিয়ে প্রত্যাহার করা হবে এবং উল্লিখিত আদেশ ছাড়া অন্য কোনো আইনে তাদের বিরুদ্ধে বিচারাধীন কোনো মামলা বা অভিযোগ না থাকলে তাদের হাজত থেকে মুক্তি দেওয়া হবে।
(গ) কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে উল্লিখিত আদেশবলে আনীত সকল মামলা ও তদন্ত তুলে নেওয়া হবে এবং উল্লিখিত আদেশ ছাড়া অন্য কোনো আইনে বিচার বা দন্ডযোগ্য আইনে সে অভিযুক্ত না হলে তাকে মুক্তি দেওয়া হবে। উল্লিখিত আদেশবলে ইস্যু করা সকল গ্রেফতারী পরোয়ানা, হাজির হওয়ার নির্দেশ অথবা কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে হুলিয়া কিংবা সম্পত্তি ক্রোকের নোটিশ দেয়া থাকলে তা প্রত্যাহার বলে বিবেচিত হবে এবং গ্রেফতারী পরোয়ানা অথবা হুলিয়ার বলে কোনো ব্যক্তি ইতিপূর্বে গ্রেফতার হয়ে হাজতে আটক থাকলে তাকে অনতিবিলম্বে মুক্তি দেওয়া হবে। অবশ্য সে ব্যক্তি উল্লিখিত দালাল আদেশ ছাড়া কোনো বিচার বা দন্ডযোগ্য অপর কোনো আইনে তার বিরুদ্ধে যদি কোনো মামলা না থাকে তবেই।
যাদের অনুপস্থিতিতেই সাজা দেওয়া হয়েছে অথবা যাদের নামে হুলিয়া বা গ্রেফতারী পরোয়ানা ঝুলছে তারা যখন উপযুক্ত আদালতে হাজির হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা ও বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করবে কেবল তখনই তাদের বেলা ক্ষমা প্রযোজ্য হবে।
২. দন্ডবিধির ৩০২ নং ধারা (হত্যা), ৩০৪ নং ধারা, ৩৭৬ ধারা (ধর্ষণ), ৪৩৫ ধারা (গুলি অথবা বিস্ফোরক ব্যবহার করে ক্ষতিসাধন), ৪৩৬ ধারা (ঘর জ্বালানো) ও ৪৪৮ ধারায় (নৌযানে আগুন বা বিস্ফোরণ) অভিযুক্ত ও সাজাপ্রাপ্তগণ এক নম্বর অনুচ্ছেদে উল্লিখিত ক্ষমার আওতায় পড়বে না।

বলা হয় বঙ্গবন্ধু ১৯৫ জন পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীকে রেহাই দিয়েছেন। এটিও সমমানের আরেকটি মিথ্যাচার। ১৯৫ জন পাকিস্তানীর বিনিময়ে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানে আটক ২ লাখ বাঙালীকে ফিরিয়ে এনেছেন। মধ্যপ্রাচ্যের স্বীকৃতি এনেছেন, মুসলমানদের হ্জ্ব করার অধিকার আদায় করেছেন, জাতিসংঘে সদস্যপদ নিয়েছেন। আর যারা ত্রিদেশীয় চুক্তিটি পড়েছেন, তারা জানেন, সেখানে স্পষ্ট উল্লেখ আছে পাকিস্তান নিজেরাই ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচার করবে বলে অঙ্গীকার করেছে।

মুজিবের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগটি তিনি বাকশাল নামে একটি ভয়ানক জুজুর আমদানী করেছিলেন। যারা অভিযোগটি তোলে, তারা কখনোই এর ব্যাখ্যা দেয় না। প্রাসঙ্গিকভাবেই আসে সিরাজ শিকদারের কথা। সর্বহারা বিপ্লবের শেষ কথা বলা হয় তাকে। কিন্তু সিরাজ শিকদার একটি স্বাধীন দেশের যে পরিমান ক্ষতি করেছেন তাতে তার বিপ্লব মোটেও মর্যাদা পায় না। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ যখন নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে তখন একের পর এক ব্যাঙ্ক লুট করে, একমাত্র রফতানীযোগ্য পণ্য পাটের গুদামে আগুন দিয়ে কিসের বিপ্লব করছিলেন তিনিই জানেন। অসহায় পুলিশদের গুলি করে মারা হচ্ছিলো। এই সিরাজ শিকদার নিজেরই দলের বিশ্বাসঘাতকতায় ধরা পড়েন। তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। পুলিশি প্রেসনোটে বলা হয় গাড়ি থেকে পালানোর সময় তাকে গুলি করা হয়েছে। এরপরই এই হত্যাকাণ্ডে মুজিবকে ভয়াবহভাবে জড়ানো হয়। বলা হয়, তার মৃত্যুর পরদিন সংসদে দাড়িয়ে নাকি বঙ্গবন্ধু দম্ভভরে বলেছেন : কোথায় আজ সিরাজ শিকদার!! ইতিহাস বলে ১ জানুয়ারি সিরাজ মারা গেছেন, আর সেবার সংসদ বসেছে ২৫ জানুয়ারি। এই অধিবেশনেই বঙ্গবন্ধূ তার দ্বিতীয় বিপ্লব অর্থাৎ বাকশাল কর্মসূচীর ঘোষণা দেন। আর সেই ঘোষণার এক পর্যায়ে সিরাজ প্রসঙ্গ আসে। কথাগুলো ছিলো হুবহু এরকম : স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হওয়ার পর যারা এর বিরোধীতা করেছে, যারা শত্রুর দালালী করেছে, কোনো দেশেই তাদের ক্ষমা করা হয় নাই। কিন্তু আমরা করেছি। আমরা তাদের ক্ষমা করে দিয়ে বলেছি দেশকে ভালোবাসো। দেশের স্বাধীনতা মেনে নাও। দেশের কাজ করো। কিন্তু তারপরও এদের অনেকে শোধরায়নি। এরা এমনকি বাংলার স্বাধীনতার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করতে বিদেশ থেকে টাকা নিচ্ছে। ওরা ভেবেছে আমি ওদের কথা জানি না! একজন রাতের আঁধারে মানুষ মেরে যাচ্ছে আর ভাবছে তাকে কেউ ধরতে পারবে না। কোথায় আজ সিরাজ শিকদার? তাকে যখন ধরা গেছে, তখন তার সহযোগীরাও ধরা পড়বে। আপনারা কি ভেবেছেন ঘুষখোর কর্মকর্তাদের আমরা ধরবো না? যারা বিদেশীদের থেকে টাকা নেয় তাদের আমরা ধরবো না? মজুতদার, কালোবাজারী আর চোরাকারবারীদের ধরবো না? অবশ্যই ধরবো। এটা শুধু সময়ের ব্যাপার। তারা কিছুই হজম করতে পারবে না। ইনশাল্লাহ, পাপী একদিন ধরা পড়বেই…’

ফিরে আসি বাকশালে। এই ভয়ানক বস্তুটি দিয়েই বঙ্গবন্ধু নাকি সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পরিকল্পনা করেছিলেন। হায়রে, মৃত্যুর আগপর্যন্ত এমনিতেও বাঙালী এই দেশের সর্বক্ষমতা যার হাতে সঁপে দিয়েছিলো তিনি নতুন করে আর কি কুক্ষিগত করবেন! কি এই বাকশাল? আপনি বলার চেয়ে বরং শোনা যাক খোদ বঙ্গবন্ধুর মু্খেই। আবীর আহাদ নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক বাকশাল কর্মসূচী ঘোষণার পরপরই সাক্ষাতকার নিয়েছিলেন তার। নিচে তুলে দিচ্ছি তার নির্বাচিত অংশ :
বঙ্গবন্ধু, আপনার রাজনৈতিক চিন্তাধারার মূলনীতি বা লক্ষ্য কি?

আমার রাজনৈতিক চিন্তাচেতনা ধ্যান ও ধারণার উৎস বা মূলনীতিমালা হলো গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এই চার মূলনীতিমালার সমন্বিত কার্যপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি শোষণহীন সমাজ তথা আমার দেশের দীনদুখী শোষিত বঞ্চিত শ্রমজীবি মেহনতী মানবগোষ্ঠীর মৌলিক মানবাধিকার ও তাদের সমষ্ঠিগত প্রকৃত ‘গণতান্ত্রিক একনায়কতান্ত্রিক’ শাসন প্রতিষ্ঠাকরণই আমার রাজনৈতিক চিন্তাধারার একমাত্র লক্ষ্য।

বঙ্গবন্ধু, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র কি একযোগে বা পাশাপাশি চলতে পারে?

যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আমাদের দেশে প্রচলিত আছে তাকে সংখ্যালঘু ধনিক শোষকদের গণতন্ত্র বলাই শ্রেয়। এর সাথে সমাজতন্ত্রের বিরোধ দেখা দেয় বৈকি। তবে গণতন্ত্র চিনতে ও বুঝতে আমরা ভুল করি। কারণও অবশ্য আছে। আর তা হলো শোষক সমাজ গণতন্ত্র পূর্ণভাবে বিকাশলাভ করুক তা চায় না। এবং গণতন্ত্রকে কিভাবে নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার হাতিয়ারে পরিণত করা যায়- এখানে চলে তারই উদ্যোগ আয়োজন। এভাবেই প্রকৃত গণতন্ত্রকে ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে। সাধারণ অজ্ঞ জনগণই শুধু নয়- তথাকথিত শিক্ষিত সচেতন মানুষও প্রচলিত আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় গণতন্ত্রকে সঠিকভাবে বুঝতে অক্ষম। এরা ভাবে যে ভোটাভুটিই হলো গণতন্ত্র। একটু তলিয়ে দেখে না প্রাপ্তবয়স্ক মোট জনসংখ্যার কত পার্সেন্ট ভোট দিলো, কোন শ্রেনীর লোকেরা নির্বাচনী প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হলো, কারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় গেলো, ক্ষমতাসীনরা কোন পদ্ধতিতে তাদের শাসন করছে, সাধারণ জনগণ কতোটুকু কি পাচ্ছে। সুতরাং আমি আমার অভিজ্ঞতার আলোকে বলছি- প্রচলিত গণতন্ত্রের বদৌলতে সমাজের মাত্র ৫% লোকের বা প্রভাবশালী ধনিকশ্রেনীর স্বৈরাচারী শাসন ও বল্গাহীন শোষণকার্য পরিচালনার পথই প্রশস্ত হচ্ছে। অর্থাৎ প্রচলিত গণতন্ত্রের মারপ্যাচে সমাজের নিম্নতম সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর শাসন ও প্রভাব প্রতিপত্তি, সর্বপ্রকার দূর্নীতি শোষন অবিচার অত্যাচার ও প্রতারণায় সমাজের সর্ববৃহত্তম অজ্ঞ দুর্বল মেহনতী কৃষক-শ্রমিক সাধারণ মানব গোষ্ঠীর (শতকরা প্রায় ৯৫ ভাগ) মৌলিক মানবাধিকার ও তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব হচ্ছে। তারা বঞ্চিত হচ্ছে।

প্রকৃত গণতন্ত্র বলতে আমি এমন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বুঝি, যে ব্যবস্থায় জনগনের বৃহ্ত্তর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের বৃহত্তর কল্যাণের নিমিত্তে তাদের জন্য, তাদের দ্বারা এবং তাদের স্বশ্রেণীভুক্ত নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত সরকার প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে তাদেরই প্রকৃত শাসন ও আর্থসামাজিক মৌলিক অধিকার সংরক্ষিত হয়। কিন্তু এই ব্যবস্থা প্রচলিত গণতান্ত্রিক উপায়ে অর্জিত হতে পারে না। কারণ প্রচলিত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে রাজনৈতিক ও আর্থ সামাজিক ক্ষেত্রে চলে অর্থ সম্পদের অবাধ ও মুক্ত প্রতিযোগিতা। এক্ষেত্রে দরিদ্র জনসাধারণের পক্ষে এ জাতীয় আর্থ প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়া কোনো প্রকারেই সম্ভব না। একমাত্র সমাজতান্ত্রিক পদ্ধতিই এদেরকে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহনের কার্যকরী নিশ্চয়তা দিতে পারে-তাদের আর্থ সামাজিক মৌলিক মানবাধিকার ও তাদের প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। এজন্য আমি মনে করি প্রকৃত গণতন্ত্রের আরেক নাম সমাজতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রের মধ্যেই প্রকৃত গণতন্ত্র নিহিত। এজন্যেই আমি গণতান্ত্রিক উপায়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেছি। আমি মনে করি প্রকৃত গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রের ভেতর কোনো বিরোধ নেই।

লেখাটির বাকি অংশ নিচের পিডিএফ এ দেখুন।


Place your ads here!

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment