সেহরি খাওয়ার গুরুত্ব ও উপকারিতা : সিয়াম সাধনার মাস

সেহরি খাওয়ার গুরুত্ব ও উপকারিতা : সিয়াম সাধনার মাস

মাহে রমজানে রোজা রাখার উদ্দেশ্যে শেষ রাতে উষা উদয়ের আগে যে পানাহার করা হয় তা সেহরি হিসেবে পরিচিত। ‘সেহরি’ উর্দু শব্দ, মূল আরবি ‘সুহুর’; এর শাব্দিক অর্থ নিদ্রা ভঙ্গ, ঘুম থেকে জেগে ওঠা, রাত্রি জাগরণ প্রভৃতি। রোজা পালনের জন্য সুবহে সাদিকের পূর্বে ভোররাতে যা কিছু খাওয়া হয় তাকে উর্দুতে ‘সাহ্রি’ আর আরবিতে ‘সুহুর’ বলা হয়। প্রচলিতভাবে সেহরি এ দেশীয় উচ্চারণ। রোজা পালনের জন্য সেহরি খাওয়া সুন্নত ও অধিক সওয়াবের কাজ। ক্ষুধা না থাকলেও রমজান মাসে শেষ রাতে যে খাবার খাওয়া হয় তা-ই সেহ্রি। সামান্য একটু পানি পান করাকেও সেহরি হিসেবে গণ্য করা হয়। সেহরি খাওয়ার মধ্যে নবী করিম (সা.)-এর সুন্নতের ওপর আমল করা হয়। সেহরি খাওয়ার মধ্যে অফুরন্ত রহমত, বরকত, নিয়ামত ও কল্যাণ আছে। এ সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) ঘোষণা করেছেন, ‘তোমরা সেহরি খাও, কারণ সেহরি খাওয়ার মধ্যে বরকত নিহিত রয়েছে।’ (বুখারি ও মুসলিম)

সেহরি খাওয়ার মাধ্যমে রোজা রাখার শক্তি অর্জিত হয়। এতে করে রোজার কোনো রকম ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। সেহরি খেলে রোজাদার সহজে দুর্বল ও মনোবলহীন হয়ে পড়েন না, সারা দিন দীর্ঘ সময়ের উপবাস বা অনাহারে থাকলেও কর্মঠ থাকার প্রাণশক্তি পান এবং সিয়াম পালন সহ্যসীমার মধ্যে থাকে। রমজান মাসে শেষ রাতে ক্ষুধা না থাকলেও অন্তত দু-একটি খুরমা বা খেজুর অথবা অন্য কোনো জিনিস খাবেন। কিছু না হলে একটু পানি পান করবেন। এতে সুন্নত আদায় হয়ে যাবে। সেহ্রির সময় যদি কেউ সেহরি না খেয়ে মাত্র এক মুঠো চাল পানি দিয়ে খান বা একটি পান খান এতেও সেহরি খাওয়ার সওয়াব হাসিল হয়ে যাবে। পেট ভরে সেহরি খাওয়া জরুরি নয়, সামান্য খাবারই যথেষ্ট। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘যদি কিছু না জোটে তবে একটি খেজুর এবং এক গ্লাস পানি পান করো।’

রমজান মাসে সেহরি যথাসম্ভব দেরি করে খাওয়া ভালো তবে এত বেশি দেরি করা উচিত নয়, যাতে সুবহে সাদিক হওয়ার আশঙ্কা হয়। যদি সেহরি খেতে বিলম্ব্ব হয় এবং এ ধারণা প্রবল হয় যে ভোর হওয়ার পর কিছু পানাহার করেছে, তবে এ অবস্থায় সন্ধ্যা পর্যন্ত পানাহার ত্যাগ করা এবং পরে ওই রোজার কাজা আদায় করা ওয়াজিব। যদি কেউ সেহরি খুব জলদি খান, কিন্তু এরপর চা, পান, পানি ইত্যাদি অনেকক্ষণ পর্যন্ত খেতে থাকেন এবং সুবহে সাদিক হওয়ার কিছু আগে কুলি করে ফেলেন, তবু দেরি করার সওয়াব পাবেন। সুবহে সাদিকের আগে রাতের শেষ ভাগে সেহরি খাওয়া মুস্তাহাব বা পছন্দনীয়। রোজাদার ব্যক্তির যেন সাধ্যাতীত কোনো কষ্ট না হয় এ জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) সেহ্রিকে সুন্নত এবং বিলম্বে সেহরি গ্রহণ করাকে মুস্তাহাব ঘোষণা করেছেন।

মাহে রমজানে সেহরি খাওয়ার আসল সময় সুর্যাস্ত থেকে সুবহে সাদিক পর্যন্ত যে কয় ঘণ্টা সময়, তার ছয় ভাগের শেষ ষষ্ঠ ভাগ। যদি কেউ এর আগে ভাত খান; কিন্তু চা, পান ইত্যাদি এ ষষ্ঠাংশে করেন, এতেও মুস্তাহাবের সওয়াব পাবেন। যদি শেষ রাতে ঘুম না ভাঙে এবং এ জন্য সেহরি খেতে না পারেন তাহলে সেহরি না খেয়ে রোজা রাখবেন। সেহরি না খাওয়ার কারণে রোজা ছেড়ে দেওয়া বড়ই গুনাহের কাজ। আর যদি নিদ্রা বা অন্য কোনো কারণবশত কেউ সেহরি খেতে না পারেন, তাহলে সেহরি না খাওয়াতে তার রোজার কোনো ক্ষতি হবে না। যতক্ষণ পর্যন্ত সুবহে সাদিক না হয় অর্থাৎ পূর্ব দিগন্তে সাদা বর্ণ না দেখা যায় ততক্ষণ পর্যন্ত সেহরি খাওয়া দুরস্ত আছে। সুবহে সাদিক হয়ে গেলে তারপর আর কিছু খাওয়াদাওয়ার সুযোগ নেই।

পরম করুণাময় অতি দয়ালু আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত অনুগ্রহ করে বিশ্বনবী (সা.)-এর উম্মতদের মাহে রমজানে ক্ষুধা-তৃষ্ণা অনেকাংশে লাঘব করার উদ্দেশ্যে এবং তাঁরা যাতে ৩০ দিন ক্রমাগতভাবে রোজা রাখতে সক্ষম হন সে জন্য ভোররাতে সেহরি খাওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন। সেহরি খাওয়ার সময়সীমা সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তোমরা পানাহার করো যতক্ষণ না কালো রেখা থেকে ভোরের শুভ্র রেখা পরিষ্ককার দেখা যায়। অতঃপর রাত্রি পর্যন্ত রোজা পূর্ণ করো।’ (সুরা আল-বাকারা, আয়াত-১৮৭)

এ আদেশের আওতায় ধনীরা যেমন রোজা রাখতে সক্ষম হবেন, তেমনি গরিব মেহনতি মানুষও শেষ রাতে সেহরি খাওয়ার সুযোগ পাওয়ায় রোজা রাখতে কোনো রকম ভয় পাবেন না। এভাবে মাহে রমজানে সেহরি রোজাদারের মনে সাহস সঞ্চার করে থাকে। নবী করিম (সা.)-এর মহানুভব হূদয় তাঁর উম্মতে মুসলিমার প্রতি অনুকম্পা ও সহূদয়তা প্রকাশের মাধ্যমে সেহরি গ্রহণ করে রোজার নির্দেশ দেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) স্বয়ং সেহরি খেয়েছেন এবং অন্যদের খাওয়ার জন্য তাগিদ দিয়েছেন। তাঁর অনুসারী সাহাবায়ে কিরামও সেহরি খেয়ে রোজা রাখতেন। এ সম্পর্কে সাহাবি হজরত যায়িদ ইবনে সাবিত (রা.) বলেছেন, ‘আমরা রাসুলে করিম (সা.)-এর সঙ্গে খেয়েছি। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো, সেহরি ও নামাজের মধ্যে (ফজরের) কী পরিমাণ সময় ছিল? তিনি উত্তরে বললেন, ৫০ আয়াত তিলাওয়াতের সমান।’ মোটকথা, সেহরি দেরিতে খাওয়া উত্তম। আগেভাগে খেয়ে নেওয়া সুন্নতের বরখেলাফ।

রমজান মাসের সিয়াম সাধনার মাধ্যমে রোজাদারদের শারীরিকভাবে দুর্বল করা আল্লাহর ইচ্ছা বা উদ্দেশ্য নয়, আল্লাহ তাআলা মাহে রমজানে দিনের বেলা পানাহার নিষিদ্ধ করেছেন, সে জন্য রাতের শেষাংশে প্রয়োজনীয় খাদ্য গ্রহণ করাই যুক্তিসংগত, রাতে ক্ষুধা না থাকলেও কিছু খাওয়া উচিত। রমজান মাসে রোজাদার ব্যক্তি যদি নিয়মিত সেহরি না খান তাহলে অত্যন্ত ক্লান্ত-শ্রান্ত-অবসন্ন হয়ে পড়বেন। ফলে পরের দিন রোজা রাখার সাহস হারিয়ে ফেলবেন এবং কাহিল হয়ে পড়তে পারেন।

সেহ্রির সময় আরামের ঘুম পরিহার করে জাগ্রত হওয়া আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ ও ইবাদত। এতে শেষ রাতে ওঠার অভ্যাস হয়। কেননা শেষ রাতে আল্লাহর রহমত অবিরাম ধারায় বর্ষিত হতে থাকে। এ সময় আল্লাহপ্রেমিকেরা সৃষ্টিকর্তার কাছে কায়মনোবাক্যে মোনাজাত, নফল নামাজ, পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত ও জিকিরে লিপ্ত থাকেন। এ সময়টি আল্লাহর পক্ষ থেকে মাগফিরাত বা ক্ষমা লাভের সর্বোত্তম সময়। এ সময়ের ইবাদতকারী ব্যক্তি আল্লাহর দরবারে সফলতার সনদ লাভ করেন।

সেহ্রির ফজিলত সম্পর্কে এক রেওয়ায়েতে উল্লেখ আছে, নিশ্চয়ই আল্লাহ এবং তাঁর ফেরেশতারা সেহরি গ্রহণকারীদের জন্য দোয়া করে থাকেন। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সেহরি খায় তার ওপর আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাগণ রহমত বর্ষণ করেন।’ (তাবারানি)

রাসুলুল্লাহ (সা.) সেহরি ও ইফতারের সীমা নির্ধারণ করে উম্মতের জন্য রোজা পালন সহজ করে দিয়েছেন। সুতরাং রোজাদারদের সময়মতো মাহে রমজানে সেহরি খাওয়া উচিত।

ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক একাডেমি, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়। dr.munimkhan@yahoo.com

Link requested by Borhanuddin Shafi Bijoy | original source


Place your ads here!

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment