শহুরে শিক্ষিতদের মনোজগতের সাম্প্রদায়িকতা দূর করার জন্যও অনেক কাজ করতে হবে – শাহরিয়ার কবির

শহুরে শিক্ষিতদের মনোজগতের সাম্প্রদায়িকতা দূর করার জন্যও অনেক কাজ করতে হবে – শাহরিয়ার কবির

সাক্ষাতকার গ্রহণে চিত্রা পাল

শাহরিয়ার কবির। মানবাধিকার কর্মী, লেখক-সাংবাদিক, কলামিষ্ট, চলচ্চিত্রকার। বর্তমানে একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটীর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। মৌলবাদী, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী আর সংখ্যালঘু নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে তিনি উচ্চকন্ঠ। জামাত-বিএনপি জোট সরকারের আমলে দুবার গ্রেফতার হয়েছেন এবং শিকার হয়েছেন ভয়াবহ রাষ্ট্রিক সন্ত্রাসের। সম্প্রতি ইউকেবেঙ্গলির পক্ষ থেকে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছে চিত্রা পাল।

ইউকেবেঙ্গলিঃ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য নির্মূল কমিটীর দীর্ঘ ১৭বছরের আন্দোলনের অর্জন এবং বর্তমানের রাজনৈতিক পটভূমিতে আপনাদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা কী?

শাহরিয়ার কবির১৯৭১ এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং জামাত-শিবির চক্রের মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবীতে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ১৯৯২ সালের ১৯শে জানুয়ারী একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটী গঠিত হয়। গত ১৭ বছরেরও বেশি সময় ধরে নির্মূল কমিটী এ-আন্দোলনের সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক-পেশাজীবী-মুক্তিযোদ্ধা-ছাত্র-যুব-নারী সংগঠনকে বিভিন্ন ভাবে যুক্ত করেছে; দেশে ও বিদেশে জনমত সংগঠিত করার জন্য বহুমাত্রিক কর্মসূচি প্রনয়ণ ও বাস্তবায়ন করেছে। ১৭ বছর আগে নির্মূল কমিটীর প্রতিষ্ঠাতা ১০১ জন বিশিষ্ট নাগরিক যে-দাবী উত্থাপন করেছিলেন, কাল-পরিক্রমায় তা আজ গণদাবীতে পরিণত হয়েছে। ১৭ বছর পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এটা শহীদ জননীর আন্দোলনের বিজয় বলে আমরা মনে করি। এ-বিজয় তখনই পূর্ণতা পাবে, যখন আমরা শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত এবং জামাত-শিবির চক্রের মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে পারব। যতোদিন পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ভাস্বর ১৯৭২-এর সংবিধানের চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি সংবিধানে পুনঃস্থাপন করে ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণ না করতে পারবো, ততো দিন পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।

ইউকেবেঙ্গলিঃ একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটী কি কোনো রাজনৈতিক সংগঠন?

শাহরিয়ার কবিরঃ নির্মূল কমিটী কোনো রাজনৈতিক দল বা দলের অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠন নয়। এটি একটি সামাজিক সংগঠন, যার প্রধান কাজ হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ইতিহাস সম্পর্কে দেশের জনগণ বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে অবহিত করা এবং আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। আমাদের আন্তজার্তিক শাখাগুলোর প্রধান কাজ হচ্ছে প্রবাসী বাঙালী এবং সে-সব দেশের নাগরিকদের ভিতর নির্মূল কমিটীর আন্দোলন সম্পর্কে আগ্রহ সৃষ্টি করা, দাবীর প্রতি সমর্থন ও সহযোগিতা সংগঠিত করা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পর্কে এবং মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদীদের সংলাপ, সমঝোতা এবং চুড়ান্ত পর্যায়ে একটি আন্তর্জাতিক মঞ্চ নির্মাণে অগ্রনী ভূমিকা পালন করা।

ইউকেবেঙ্গলিঃ একাত্তরের ঘাতক-দালাল কমিটী কর্তৃক গঠিত নাগরিক কমিশনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলবেন কি?

শাহরিয়ার কবিরঃ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য সরকার ১৯৭৩-এর ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালস আইন’ অনুযায়ী যে-ট্রাইবুনাল গঠন করতে যাচ্ছে, একে সহায়তা করার জন্য গত ১৯শে জানুয়ারী আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারবিষয়ক নাগরিক কমিশন গঠন করেছি। বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানীর নেতৃত্বে গঠিত ১৭ সদস্য বিশিষ্ট এ-নাগরিক কমিশনে নির্মুল কমিটী-সহ সেক্টরস কমান্ডার্স ফোরাম, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, মহিলা পরিষদ, প্রজন্ম ৭১, আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, ও গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতির প্রতিনিধিবৃন্দ এবং দেশের বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ও নাগরিক সমাজের নেতৃবৃন্দ রয়েছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য সরকারের করণীয় বিষয়ে গত ফেব্রুয়ারী মাসে প্রথম দফার সুপারিশমালা কমিশনের পক্ষ থেকে আইনমন্ত্রীর কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

নাগরিক কমিশন ব্যক্তিগত উদ্যোগে ভুক্তভোগী ও সংক্ষুব্ধদের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য প্রচলিত আদালতের শরণাপন্ন হতে নিরুৎসাহিত করছে। কারণ, পৃথিবীর কোনোও দেশে প্রচলিত আইনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা সম্ভব নয়। একাত্তরের গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের ভুক্তভোগী, প্রত্যক্ষদর্শী ও শহীদ পরিবারের বিচারপ্রার্থীদের জবানবন্দি নথিবন্ধকরন এবং গঠিতব্য ট্রাইবুনালকে তা প্রদানের জন্য কমিশন নির্দিষ্ট ফর্ম তৈরী করে সারা দেশে বিলি করেছে। কমিশনের নেতারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সমাবেশের মাধ্যমে জনগণকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করছেন। একই সঙ্গে সরকারের নীতিনির্ধারকদের বিভিন্ন আইনী ও কারিগরী বিষয়ে পরামর্শ প্রদান অব্যাহত রেখেছেন।

ইউকেবেঙ্গলিঃ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার একটা সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে বিপুলভাবে কন্ঠ-ভৌটে পাস হয়েছে ২৯শে জানুয়ারী। এর পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণে সরকারের কী ভুমিকা হওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?

শাহরিয়ার কবিরঃ সংসদে যে-প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে, তা কোনো আইন নয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আইন ১৯৭৩ সালেই জাতীয় সংসদে পাশ হয়েছে এবং সংবিধানের প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে এ-আইন সাংবিধানিকভাবে সুরক্ষিত রয়েছে। বর্তমানে ১৯৭৩-এ প্রণীত ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল আইন’ অনুযায়ী বিশেষ ট্রাইবুনালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়া আরম্ভ হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বর্তমান সরকার আন্তরিক হলেও প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে জামাতের লোকজন যেভাবে অবস্থান করছে, তারা প্রতিপদে এ-উদ্যোগকে বিঘ্নিত করতে চাইবে এটাই স্বাভাবিক। প্রশাসন জামাত মুক্ত করেই এ-বাধা দূর করতে হবে।

ইউকেবেঙ্গলিঃ বিএনপির মহাসচিব দেলোয়ার হোসেন বলেছেন, যুদ্ধাপরাধীর বিচার তারাও চান, তবে সেটা যেনো রাজনৈতিক হয়রানি না হয়। সে-সাথে জামাত ও বলছে, তারাও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায়। তাদের চাওয়া-পাওয়ার সাথে আপনাদের চাওয়ার কি কোনো পার্থক্য আছে?

শাহরিয়ার কবিরঃ বিরাজমান গণদাবীর কারণেই বিএনপি-জামাত মুখে যুদ্ধাপরাধীর বিচার চাইছে। বিএনপি-জামাতের যুদ্ধাপরাধীর বিচার চাওয়া নিকৃষ্ট ধরণের রাজনৈতিক প্রতারণা ছাড়া আর কিছু না। জামাত জানে, তারা যুদ্ধাপরাধী। বিচারপ্রক্রিয়া বানচাল করার জন্য তারা দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন তৎপরতা চালাচ্ছে। এর একটি হচ্ছে, যে-আইনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে, সে-আইনকে চ্যালেঞ্জ করা, সে-আইন সম্পর্কে জনগণকে বিভ্রান্ত করা। আমাদের অবস্থান এর বিপরীত মেরুতে।

ইউকেবেঙ্গলিঃ সেক্যুলার বাংলাদেশ বলতে আপনি বুঝেন?

শাহরিয়ার কবিরঃ সেক্যুলার বাংলাদেশ বলতে ধর্মকে ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে সীমাবদ্ধ রেখে রাষ্ট্র ও রাজনীতি থেকে পৃথক রাখার কথা বলেছেন স্বাধীন বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান । মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধুর সরকার যে-সংবিধান প্রনয়ণ করেছিলো, সেখানে রাষ্ট্রের অন্যতম নীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালী জাতীয়তাবাদ গ্রহণ করা হয়। এ-বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাইলে আপনি আমাদের ওয়েব সাইটে (www.secularvoiceofbangladesh.org) History of Secular Humanism in Bangladesh লেখাটি পড়তে পারেন।

ইউকেবেঙ্গলিঃ বর্তমান সরকারের ৫ বছর মেয়াদে ১৯৭২ এর সংবিধানে ফিরে যাবার দাবী বাস্তবায়িত হবে কি?

শাহরিয়ার কবিরঃ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে সরকার আন্তরিক হলে ১৯৭২-এর সংবিধানে ফিরে যেতে হবে। সংবিধান সংশোধনের জন্য জাতীয় সংসদে প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা মহাজোট সরকারের আছে। ১৯৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাবার জন্য ব্যপক জনসচেতনতা প্রয়োজন। ১৯৭২-এর সংবিধান সম্পর্কে তরুণ প্রজন্মেনের ভিতর সচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে আমাদের নেতা বিচারপতি গোলাম রাব্বানীর একটি সহজ পাঠ ব্যাখ্যাসহ রচনা করেছেন।

ইউকেবেঙ্গলিঃ বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের তৎপরতা সম্পর্কে কিছু বলুন।

শাহরিয়ার কবিরঃ ২০০১ ও ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামাতের নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় সারা দেশে শতাধিক জঙ্গী মৌলবাদ আত্ম-প্রকাশ করেছে। এ-সব জঙ্গী-মৌলবাদী সংগঠনের অধিকাংশ জামাতে ইসলামীর সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে যুক্ত বলে মনে করি। প্রধানতঃ কওমি মাদ্রাসাগুলো থেকে জঙ্গীদের রিক্রুট করা হয়। হিজবুত তাহরির কিংবা ইসলামী ছাত্র শিবিরের মতো সংগঠনগুলো বিভিন্ন স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটি থেকে তাদের কর্মী রিক্রুট করে। জঙ্গী দমনের ক্ষেত্রে জামায়াত প্রভাবিত প্রশাসন একটি বড়ো বাধা।

মধ্যপ্রাচ্য-সহ ইউরৌপেরও কিছু মুসলিম এনজিও বিভিন্ন দেশে জঙ্গীদের আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করে। সম্প্রতি ব্রিটিশ এনজিও গ্রীন ক্রিসেন্টের অর্থায়নে প্রতিষ্ঠিত ভোলার একটি মাদ্রাসা থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও অস্ত্র বানাবার মেশিনপত্র উদ্ধার করেছে।

ইউকেবেঙ্গলিঃ মাদ্রাসা শিক্ষার ব্যপারে আপনার অভিমত কী?

শাহরিয়ার কবিরঃ যতোদিন পর্যন্ত সংবিধান-বর্ণিত সকলের জন্য সর্বজনীন সাধারণ শিক্ষা নিশ্চিত করা না যাবে, ততো দিন পর্যন্ত মাদ্রাসা থাকবে। চীনের মতো সমাজতান্ত্রিক দেশেও মুসলমানদের জন্য মাদ্রাসা আছে। মাদ্রাসা শিক্ষাকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করতে হবে। ভারতে মাদ্রাসায় হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছাত্ররা পড়তে পারে। বাংলাদেশের মাদ্রাসায় সর্ব-ধর্ম শিক্ষার ব্যবস্থা থাকলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বাড়বে, জঙ্গীমৌলবাদ নিরুৎসাহিত হবে। জোট সরকারের আমলে সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনে মাদ্রাসা ছাত্রদের নিযুক্তি আশঙ্কাজনক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিলো। বর্তমান সরকার প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে অবস্থানকারী জঙ্গীদের খুজে বের করার উদ্যোগ নিয়েছে।

ইউকেবেঙ্গলিঃ বিভিন্ন সরকারের সময় বিভিন্ন মহল থেকে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবী উঠেছে। আপনি কি এ-দাবীর সাথে একমত?

শাহরিয়ার কবিরঃ শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস নির্মূল করার জন্য ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করার কথা যারা বলেন, আমি তাদের সাথে ভিন্নমত পোষণ করি। রাজনীতি করা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ছাত্র ছাত্রীদের সাংবিধানিক অধিকার। ছাত্ররা সমাজের সচেতন অংশ। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের আন্দোলনের সিংহ-ভাগ কর্মী ছাত্র, যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এবারের নির্বাচনে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৪৮-এ ভাষা আন্দোলনের সূচনা, ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণ-অভূত্থান ও ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে ছাত্রসমাজ। ছাত্ররাজনীতিকে সন্ত্রাসের চোরাবালি থেকে উদ্ধার করে সমাজ বদলের আন্দোলনের মূলধারায় ফিরিয়ে আনার জন্য সরকার, রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ-সহ শিক্ষক ও অভিভাবকদের সম্মিলিত ভাবে কাজ করতে হবে।

ইউকেবেঙ্গলিঃ বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে সংখ্যা-লঘুদের হত্যা ও নির্যাতনের ব্যাপারে আপনার অনুভুতি ও মন্তব্য কী? সংখ্যা-লঘুদের সামাজিক ও রাজনৈতিক নিরাপত্তা প্রদানের দায়ভার কার? এব্যপারে বর্তমান সরকার কতখানি আন্তরিক বলে আপনার মনে হয়?

শারিয়ার কবিরঃ খালেদা-নিজামী জোট সরকারের আমলে সংখ্যা-লঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উপর যে-ধরণের নির্যাতন হয়েছে, সেটাকে আমি নজিরবিহীন বলেছি। এ-নির্যাতন সম্পর্কে নির্মূল কমিটী আমার সম্পাদনায় ২০০৫ সালের অক্টোবরে এক বিশাল শ্বেত-পত্র প্রকাশ করেছিলো। তিন খণ্ডে প্রকাশিত এ-শ্বেত-পত্রে নির্যাতনের প্রায় ৩ হাজার ঘটনা উল্ল্যেখ করা হয়েছে। এ-বিষয়ে আমার বক্তব্য শ্বেত-পত্রে রয়েছে। এ ছাড়া ২০০৬ সালে আমি ‘আমাদের বাঁচতে দাও’ নামে একটি প্রামাণ্য-চিত্রও নির্মাণ করেছি। সংখ্যা-লঘুদের উপর নির্যাতনের প্রতিবাদ করার জন্য জোট সরকার আমাকে দুবার গ্রেপ্তার করে অবর্ণনীয় নির্যাতন চালিয়েছে। আমার বিরুদ্ধে তারা রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা ও করেছে। একটি দেশ বা সমাজ কতোটুকু গণতান্ত্রিক, কতটুকু সভ্য তা নির্ধারণের অন্যতম মাপ-কাঠি হচ্ছে সে-দেশে ধর্মীয় সম্প্রদায় ও অন্যান্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠী কতোখানি নিরাপদ, কতোটুকু মর্যাদা ও অধিকার ভোগ করে, তার উপর। যে-কোনো দেশে সংখ্যালঘু ধর্মীয় ও অন্যান্য জাতিসত্ত্বার নিরাপত্তা বিধান, সমান অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিতকরণের প্রধান দায়িত্ব রাষ্ট্র ও সরকারের। রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজেরও দায়িত্ব কম নয়।

অতীতের জোট সরকার ও এরশাদ আমলের তুলনায় বর্তমান সরকার সংখ্যা-লঘুদের অধিকার ও মর্যাদায় যথেষ্ট আন্তরিক হলেও সাম্প্রদায়িক নির্যাতন পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। এখনও ‘অর্পিত সম্পত্তি আইন’-এর মতো অমানবিক কালা-কানুন বাতিল হয়নি। আমারা গত ১৩ই মার্চ ২০০৯ প্রধান-মন্ত্রীকে যে-স্মারক-পত্র দিয়েছি, সেখানে ‘অর্পিত সম্পত্তি’ আইন বাতিল-সহ জোট-সরকারের আমলে যে-নির্যাতন হয়েছে, তার তদন্ত, বিচার, অপরাধীদের শাস্তি-বিধান এবং ক্ষতিগ্রস্তদের উপযুক্ত ক্ষতি-পূরণের দাবী জানিয়েছি। আমরা সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও বৈষম্য দূর করার জন্য ১৯৭২-এর ধর্মনিরেপেক্ষ সংবিধান পুনঃপ্রবর্তনের জন্য আন্দোলন করছি। তবে এর পাশাপাশি শহুরে শিক্ষিত সমাজের মনোজগতের সাম্প্রদায়িকতা দূর করা জন্যও অনেক কাজ করতে হবে।

বঙ্গবন্ধুর নৃশংশ হত্যাকাণ্ডের পর জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অসাম্প্রাদায়িক সংবিধানকে একটি সাম্প্রদায়িক সংবিধান বানিয়েছেন। রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে গৃহীত ‘ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালী জাতীয়তাবাদ বাদ দিয়ে সংবিধানের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ সংযোজন করে, ইসলামকে রাষ্ট্র-ধর্ম বানিয়ে তারা সংখ্যা-লঘু অমুসলিম নাগরিকদের কার্যতঃ দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করেছেন। ১৯৭১ সালে ধর্ম-নির্বিশেষে ৩০ লক্ষ মানুষ এর জন্য শহীদ হননি। এ-অমানবিক পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে ১৯৭২-এর সংবিধানে। সংখ্যা-লঘু প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সমান অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত না হলে গণতন্ত্র কখনও অর্থবহ হতে পারে না।

ইউকেবেঙ্গলিঃ একাত্তরের গণহত্যা নিয়ে আপনার নির্মিত ছবি বিগত নির্বাচনে কতোখানি প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছে বলে আপনি মনে করেন? বর্তমান নির্মাণাধীন ছবির বিষয় বস্তু কী? এবং কবে নাগাদ শেষ হবে বলে মনে করছেন?

শাহরিয়ার কবিরঃ নির্বাচনের একমাস আগে থেকেই ‘যুদ্ধাপরাধ ৭১’ ছবিটি জামাত ও যুদ্ধাপরাধীরা যে-সব এলাকা থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলো, সে-সব এলাকায় গ্রামে ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে এবং টেলিভিশনে দেখানো হয়েছিলো। জামাতের আমীর মতিউর রহমান নিজামীকে পরাজিত করে পাবনার বেড়া সাথিয়া থেকে জয়ী হয়েছেন বর্তমান বিদ্যুৎ ও জ্বালানী প্রতিমন্ত্রী এডভৌকেইট শামসুল হক টুটু। নির্বাচনে জয়ী হবার পর তিনি একধিকবার জনসমাবেশে বলেছেন, তার জয়লাভের ক্ষেত্রে নির্মূল কমিটীর প্রচারাভিযান ও ছবিটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ায় জঙ্গী তৎপরতা উত্থানের উপর একটি প্রামাণ্য-চিত্র নির্মাণ করছি। ছবিটি এবছর শেষ হবে বলে আশা করি।

ইউকেবেঙ্গলিঃ বাংলাদেশের মেয়ে তসলিমা নাসরিনকে কোন্‌ অপরাধে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে বলে আপনি মনে করেন? বাংলাদেশের প্রগতিশীল সমাজ তাসলিমাকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যপারে কী ভূমিকা রাখতে পারে বলে আপনি মনে করেন? আপনি কি এ-ব্যাপারে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করবেন?

শাহরিয়ার কবিরঃ তসলিমা মৌলবাদের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠভাবে লিখেছেন বলে মৌলবাদীরা ফতোয়া দিয়ে হত্যার হুমকি দিয়ে তাকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। বাংলাদেশের সচেতন নাগরিকরা এর প্রতিবাদ করেছেন। ‘তসলিমার স্বদেশ’ নামে আমি লিখেছি; সেটা আমাদের ওয়েবসাইটে আছে। গত ১৮ই এপ্রিল তসলিমার দেশে ফেরার বিষয়ে অধ্যাপক কবীর চৌধুরী ও আমি পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডাঃ দীপুমনির সঙ্গে আলোচনা করেছি। তসলিমার দেশে ফেরার ব্যপারের যা করার দরকার আমি আমার সকল সাধ্য দিয়ে করব। আমি বিশ্বাস করি, আজ হোক, কাল হোক সে তসলিমা স্বদেশে ফিরে আসবেনই।

ইউকেবেঙ্গলিঃ আপনি অনেক বার পুলিসের নির্যাতন-সহ একাধিকবার কারা-বরণ করেছেন সংখ্যালঘুদের পক্ষে কথা বলার জন্য। কেনো আপনি সংখ্যালঘুদের মানবিক অধিকার নিয়ে কাজ শুরু করেন? এর মূল উৎস ও প্রেরণা কী?

শাহরিয়ার কবিরঃ ১৯৮৮ সালে জেনারেল এরশাদ যখন সংবিধানের ৮ম সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্র-ধর্ম ইসলাম ঘোষণা করেন, তখন দেশের বিশিষ্ট লেখক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী ও সংস্কৃতি-কর্মীদের সমন্বয়ে ১০০১ সদস্য বিশিষ্ট ‘স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী নাগরিক কমিটী’ গঠনের মূলদায়িত্ব পালন করেছিলাম। রাজনৈতিক দলগুলোর অসহযোগিতা ও বিরোধীতার কারণে এ-কমিটীর কার্যক্রম বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৯২ সালে ভারতে বাবরী মসজিদ ভাঙ্গার প্রতিক্রিয়া হিসাবে বাংলাদেশে যখন কয়েক হাজার মন্দির ভাঙ্গা হয়, তার প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে আমি লিখেছিলাম ‘বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার চালচিত্র।’ বইটি প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯৯৩-এর বই মেলায়। এরপর গত ১৫ বছরে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে গোটা দশেক বই বেরিয়েছে; যা লেখা হয়েছে আন্দোলনের প্রয়োজনে। গল্প উপন্যাসের কথা যদি বলি, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আমার প্রথম গল্প ‘থেমে নেই’ প্রকাশিত হয়েছে চল্লিশ বছর আগে। গল্পটি ১৯৬৪ এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পটভূমিতে লেখা। শৈশবে পারিবারিক জীবনেপরে ছাত্র জীবনে অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক পরিবেশে বড়ো হয়েছি। আর প্রেরণা অবশ্যই অগ্রজ লেখক, সাংবাদিক ও চলচ্চিত্রনির্মাতা শহীদুল্লাহ কায়সার ও জহির রায়হান। বড়দা চেয়েছেন আমি তার মতো লেখক ও সাংবাদিক হই। আর মেজদা চেয়েছেন আমাকে চিত্র-নির্মাতা বানাতে। তারা দুজনই মুক্তিযুদ্ধে শহীদ। বেঁচে থাকলে আজ তাঁরা বলতে পারতেন তাঁদের ইচ্ছা কতটুকু পূরণ করতে পেরেছি।

ইউকেবেঙ্গলিঃ সাক্ষাতকার দেবার জন্য ইউকেবেঙ্গলির পক্ষ থেকে আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ। ভালো ও সুস্থ থাকুন।

শাহরিয়ার কবিরঃ আপনাদের ও আপনাদের সকল পাঠককে ধন্যবাদ।

original source


Place your ads here!

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment