ঢাকার হাতির গল্প – আশীষ-উর-রহমান

ঢাকার হাতির গল্প – আশীষ-উর-রহমান

ঢাকায় নেমেই হাতির ডাক শুনে চমকে গেলেন এক বিদেশি অতিথি। নৌকায় করে সুদুর কলকাতা থেকে ঢাকায় বেড়াতে এসেছেন তিনি। পথে নদীর দুই পাশে সবুজ মাঠে গরুর পাল চরতে দেখে বড়ই মুগ্ধ হয়েছেন। কিন্তু নৌকা থেকে নেমেই বিস্িনত, হাতির ডাকে প্রকম্পিত সদরঘাট। ঘটনা ১৮২৪ সালের ৪ জুনের। ওই দিনই লর্ড বিশপ রেজিল্যান্ড হেবার এসেছিলেন ঢাকায়। ডায়েরিতে ঢাকায় বেড়ানোর স্নৃতি লিখতে গিয়ে হাতির কথা উল্লেখ করতে ভোলেননি। বিশপ হেবার বেশ কদিন ছিলেন ঢাকায়। উঠেছিলেন সে সময়ের ঢাকার কালেক্টর গিলবার্ট কভেন্ট্রি মাস্টারের বাড়িতে। সদরঘাট সে সময় হাতির ডাকে উচ্চকিত থাকত। কারণ বুড়িগঙ্গায় গোসল করাতে আনা হতো হাতির পাল।

ঢাকার হাতি: উনিশ শতকে ঢাকায় হাতির বাণিজ্যও ছিল খুব লাভজনক। জমজমাট ‘হাতিবাণিজ্য’ একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ করত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। বছরে অন্তত ৩০০ হাতি বিক্রি হতো ঢাকা থেকে। হেবার জানিয়েছেন, ঢাকায় হাতি ছিল প্রচুর। কোম্পানি ত্রিপুরা ও কাছাড় থেকে দুই-তিন শ হাতি ধরত প্রতি বছর। এখান থেকে সেগুলো মুর্শিদাবাদ, ভগবানগোলা, দিনাজপুর অঞ্চলে চালান দেওয়া হতো। এ ছাড়া চট্টগ্রাম থেকেও বুনো হাতি ধরে ঢাকায় আনা হতো। জেমস টেলর তাঁর কোম্পানী আমলে ঢাকা গ্রন্েথ উল্লেখ করেছেন, চট্টগ্রাম থেকে প্রতিবছর প্রায় ৮০টি হাতি ধরা হতো। ঢাকা শুধু হাতির মোকামই ছিল না, হাতির বসতও ছিল এখানে। টেলর জানিয়েছেন, ঢাকার উত্তরাংশের জঙ্গল বিশেষ করে আটিয়ার পরগনা ছিল হাতির বাসভুমি। মাঝেমধ্যে হাতির পাল লোকালয়ে চলে আসত। গ্রামাঞ্চলে হানা দিয়ে ঘরবাড়ি ও ফসলের ক্ষতি করত প্রচুর। এসব হাতিকে তিনি এই অঞ্চলের ‘আদি বাসিন্দা’ বলে উল্লেখ করেছেন। বুনো হাতির সঙ্গে ঢাকা থেকে পালিয়ে যাওয়া পোষা হাতিও যোগ দিয়ে দল বাঁধত বলে এখানে হাতির সংখ্যা অনেক বেড়ে গিয়েছিল। হাতি ছাড়া এসব জঙ্গলে বাঘ-চিতাবাঘও ছিল যথেষ্ট। অনাবৃষ্টির সময় বা বর্ষা মৌসুমে বাঘ ও চিতাবাঘ আশপাশের গ্রামে হানা দিয়ে গবাদিপশু ধরে নিয়ে যেত। বাঘ ও চিতা মারার জন্য সরকারিভাবে পুরস্কার ঘোষণা করা হতো।

খেদা আফিয়াল: মুঘল আমলেই ঢাকায় হাতির ব্যবসা তথা বুনো হাতি ধরে পোষ মানানোর ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। এ জন্য তৈরি হয়েছিল হাতির খেদা বা ফাঁদ। ড. শরীফউদ্দিন আহমেদ তাঁর ঢাকা গ্রন্েথ জানিয়েছেন, মুঘল আমলে এ বিভাগটিকে বলা হতো ‘খেদা আফিয়াল’। উনশি শতক পর্যন্ত বিভাগটি চালু ছিল। বুনো হাতি ধরা হতো বিশেষ কায়দায়। পোষা হস্তিনী দিয়ে বুনো হাতিদের খেদা বা ফাঁদে ফেলা হতো। হস্তিনীগুলোকে বলা হতো ‘কুনকি’। তিনি উল্লেখ করেন, ‘ঢাকার পিলখানার হাতিগুলোকে ১৮৬০-১৮৭০-এর দশকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ি উপজাতিদের দমন অভিযানে প্রায়ই প্রেরণ করা হত। এগুলোকে স্থানীয় উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা তাঁদের যাতায়াতের জন্যও ব্যবহার করতেন এবং যখন দেশের সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তিটি যেমন লেফটেন্যান্ট গভর্নর বা ভাইসরয়রা পরিদর্শনের জন্য ঢাকা আসতেন তখন এইসব রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানে হাতিদের দিয়ে প্যারেড ও নানা ধরনের খেলাধুলা করানো হতো। ১৮৮১ সালে ঢাকার খেদা বিভাগে একজন সুপারিনটেনডেন্ট, একজন হেড এসিস্ট্যান্ট, দুইজন ভেটেরিনারি সার্জন, তিনজন ক্লার্ক, একজন পশু হিসাবকারী এবং বেশ কয়েকজন মাহুত নিযুক্ত ছিল।’

পিলখানা: এখন যেটি পিলখানা সেটি ছাড়াও ঢাকা শহরের দক্ষিণে মুঘল আমলে বড় একটি খেদার উল্লেখ থাকলেও তা ঠিক কোথায় ছিল সে সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেননি ঐতিহাসিকেরা। ঢাকা বিশারদ মুনতাসীর মামুন তাঁর ঢাকা: স্নৃতি বিস্নৃতির নগরীতে (দ্বিতীয় খন্ড) লিখেছেন, ‘পিলখানার সঠিক উচ্চারণ হবে ফিলখানা।…ব্রিটিশ সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করলে পিলখানা আরো সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। জমির পরিমাণ ৯০ একর।’ হূদয়নাথ মজুমদার রেমিনিসেন্স অব ঢাকা গ্রন্েথ লিখেছেন, ঢাকায় তখন প্রায়ই হাতির ডাক শোনা যেত। এখানে হাতির খেদা ছিল বিখ্যাত। লাভজনক ব্যবসা। আগে এই ব্যবসা করতেন নবাবেরা। পরে নবাবদের হাত থেকে ক্ষমতার সঙ্গে হাতির ব্যবসাও কোম্পানি নিয়ে নেয়। ১৮৬৪ সালে তিনি যখন ঢাকায় আসেন তখন পিলখানায় হাতির খেদার কাজ চলছিল পুরোদমে। আসাম থেকে হাতি ধরে এখানে পোষ মানানোর জন্য রাখা হতো। জমিদাররোও তাঁদের হাতি সামান্য খরচ দিয়ে পিলখানায় রাখতেন। হূদয়নাথ পিলখানায় দেড় শ হাতি দেখেন। সরাসরি ভারত সরকারের আয়ত্তে থাকায় পিলখানার ব্যাপারে স্থানীয় কোনো সংস্থা এখানে হস্তক্ষেপ করতে পারত না। তিনি বলেছেন, ১৮৮৫ সালে এখান থেকে পিলখানা সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল মিয়ানমারে। মুনতাসীর মামুন লিখেছেন, ‘১৯০৯ সালে সরকার এখানে মিলিটারি পুলিশের জন্য ব্যারাক নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। পিলখানার গুরুত্ব কমে যাচ্ছিল, হাতি আর সে পরিমাণে ধরা যাচ্ছিল না বা এর ব্যবহারও কমে যাচ্ছিল। অবশেষে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ৫০ বিঘা মিলিটারি পুলিশকে ব্যবহারের জন্য দিয়ে বাকী ২২০ বিঘা রেখে দেয়ার, যার দাম ছিল সে সময় ৪২,৬৬০ টাকা। প্রতি বিঘার দাম ধরা হয়েছিল ১৯৭ টাকা।’ হাতি আসা বন্ধ হয়ে গেলে এলাকাটি মিলিটারি পুলিশের হাতে চলে যায়। এখানে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের সদর দপ্তর স্থাপিত হয় পাকিস্তান আমলে। সেই পিলখানা এখন বিডিআরের সদর দপ্তর।

হাতির নামে: হাতি না থাকলেও হাতির স্নৃতির স্বাক্ষী হয়ে আছে ঢাকার বিভন্ন মহল্লা, সড়ক, ঝিল ইত্যাদি। ‘এলিফ্যান্ট রোড’ তো খুব বিখ্যাত। উনিশ শতকের শুরুর দিকে পিলখানা থেকে হাতিগুলোকে শহরের মাঝখান দিয়ে চরাতে নিয়ে যাওয়া হতো। হাতি চলাচল করায় পথের ক্ষতি তো হতোই, আরও নানা উপদ্রবের করলে পড়ত লোকেরা। ঢাকাবাসী হাতির উপদ্রব থেকে রক্ষা পেতে কর্তৃপক্ষের কাছে ঘন ঘন অভিযোগ করত। ১৮৬৪ সালে মিউনিসিপ্যালিটি প্রতিষ্ঠিত হলে শহরের বাইরে দিয়ে হাতির চলাচলের জন্য আলাদা একটি রাস্তা করা হয়। পথটির নাম রাখা হয় এলিফ্যান্ট রোড। এ পথ দিয়েই পিলখানা থেকে রমনা ও সিদ্ধেশ্বরীতে হাতি আনা-নেওয়া করানো হতো। হূদয়নাথ জানিয়েছেন, ঢাকেশ্বরী জঙ্গল ব্যবহূত হতো হাতির চরে বেড়ানোর জন্য। আজিমপুর গোরস্থানের পাশের পিলখানা রোডও ব্যবহূত হতো হাতির যাতায়াতে। এ ছাড়া হাতির স্নৃতিধন্য হয়ে আছে সোনারগাঁ রোডের হাতির পুল এলাকা। পুলটি এখন নেই। এর বর্ণনা দিয়ে নাজির হোসেন তাঁর কিংবদন্তির ঢাকায় লিখেছেন, ‘ঢাকা সোনারগাঁও রোডের যেখানে এলিফেন্ট রোড ও পরিবাগের সংযোগস্থল সেখানে একটি পুল ছিল বহুকাল যাবৎ। আর পুলটি হাতিরপুল নামে পরিচিত ছিল ঢাকাবাসীর কাছে। এ পুলের নিচ দিয়ে হাতী চলাচল করত বলে পুলটি খুবই উঁচু ছিল।’ হাজারীবাগের উত্তরে গজমহল। পিলখানার হাতি সেখানে চরাতে নেওয়া হতো। সেই থেকে নাম হলো ‘গজমহল’। মাহুতটুলি খুব পুরোনো এলাকা। মুঘল আমলে হাতির মাহুতেরা বাস করত সেখানে। সেই থেকে ‘মাহুতটুলি’। হাতিকে পানি খাওয়ানো এবং গোসলের জন্য ব্যবহূত হতো বেশ কিছু খাল ও ঘাট। এর মধ্যে নবাবগঞ্জে আছে ‘হাতিরঘাট’, ‘হাতির ঝিল’। ওই জন্যই ‘সাতমসজিদ ঝিল’, ‘কুড়িপাড়া ঝিল’ ও ‘জলকুড়ি ঝিল’। এসব ঝিল হারিয়ে গেছে, খোদ বুড়িগঙ্গাই যেখানে হারিয়ে যাবার পথে! সম্প্রতি সোনারগাঁ হোটেলের পাশে বস্তি উচ্ছেদ করে প্রায় লুপ্ত হাতির ঝিলটিকে আবার সংস্কার করা হচ্ছে, এটিই যা আশার কথা।

Link requested by Anim Rahamn | original source


Place your ads here!

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment