কর্পোরেইট প্রতিষ্ঠান আমাদের সংস্কৃতিকে রক্ষা করছে ‘আফটার অল’ উদিসা ইসলাম
সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণঃ এটাকে কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গা থেকে ঝগড়া হিসেবে দেখলে হোঁচট খেতে হবে। এ-লেখা কেবলই একজনের মতামত এবং অবশ্যই সেটাকে লেখক দায়িত্বশীলতার সাথেই ধারণ করেন।
আমরা এখন বেশ উদ্দীপনার সাথে বৈশাখ পালন করছি। একুশে শহীদ মিনারে ছুটছি। বসন্ত-বরণ, এমনকি নবান্ন উৎসবে এখন মানুষের ভিতর থেকে হঠাৎই ডাক আসা বেড়ে গেছে। এখন আমরা অনেকেই জানি, বসন্তে কী রঙের পোশাক পড়তে হয়, নবান্নে ভোরবেলা চারুকলায় অনুষ্ঠান হয়, শহীদ মিনারে সাদা বা কালো পোশাকে যেতে হয়। তবে প্রভাত ফেরিতে পায়ে জুতা পড়তে হয় কি-না সেটা অবশ্য জানি না। আমি সেটাকে নেতিবাচক হিসেবে দেখি না। একটা সময় ভাটা গেলে তারপরই জোয়ারের সম্ভাবনা থাকে বৈকি। কিন্তু আপত্তির জায়গা অন্যখানে। কারা কী উদ্দেশ্যে এ-সংস্কৃতি রক্ষার দায়টা নিলো? বিভিন্ন কর্পোরেইট প্রতিষ্ঠান ও বুটিক দোকান মানুষের মধ্যে চেতনার বৈচিত্র তুলে আনার মহান প্রয়াস করে যদি ব্যবসাটা তুঙ্গে তুলতে পারে, তাহলে ক্ষতি কী? মূল জায়গা ব্যবসা। শুধু দুটো ঈদ দিয়ে এ-বিশাল মার্কেটকে ধরতে না পারার ব্যবসা। প্রতি মাসে যদি পার্বণ লাগিয়ে রাখা যায়, আর শেখানো যায় যে, এক-একটি দিনের একেক রকম পোশাক ও এবং এ-পোশাকগুলো কেনা ও পড়াটাও সে-উৎসবের অংশ, তাহলে তাদের চাওয়া পূর্ণ হয়। কেনো-না, তারা চেতনা শান দেওয়ার ঠিকা নেয়নি। এটা ধ্রুব সত্য।
চারিদিকে বিজ্ঞাপনের তোড়জোড়, জামা-কাপড় কেনার ধুম দেখে যখন গেলো-গেলো রব ওঠে, তখন এক-শ্রেণীর ভাড়াটে চিৎকার দিয়ে বলেন, ‘আরে কর্পোরেইট প্রতিষ্ঠান যদি বোধোদয় ঘটায়, তাহলে আপত্তি করবে কেনো? আমরা সব ভুলতে বসেছিলোম। জামা-কাপড় কেনানোর মধ্য দিয়েও যদি কিছু শেখানো যায়, তাহলে আপত্তি করবে কেনো? এ-ব্যাখ্যার জায়গাতেই আমার বা আমরা যারা সহমত জানাই, তাদের আপত্তি।
একুশ নিয়ে আগে কী ছিলো, সে-হা-পিত্তেস করার সুযোগ আছে বলে আমার মনে হয় না। সময়ের দাবী বলে একটা কথা আছে। কিন্তু যখন দেখা যায় একুশের সকালে আপনি কীভাবে সাজবেন, সেটা নিয়ে সংবাদপত্রের পাতা ছবিতে ভরে ফেলা হয়, একুশের পোশাক কোনো দোকান কীভাবে তৈরি করেছে, তা-ই আপনার জন্য যখন মুখ্য হয়ে যায়, শোক যখন উৎসবে পরিণত হয়, তখন ভাবনার আছে। একুশের চেতনা, কেনো একুশ সেটা এখনকার ছেলেমেয়েরা যতোটা না জানে, একুশের দিন-যে সাদা-কালো পোশাক পরতে হয়, সেটা অনেক বেশি জানে ও বুঝে। ঢাকার বেশ কিছু ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ছেলে-মেয়েদের কাছে একুশের ৫ শহীদের নাম জিজ্ঞেস করে উত্তর পাওয়া যায়নি। যে-শিক্ষার্থীরা ক্লাসে প্রথম-দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে বসে থাকে, তারা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস জানে না বললেই চলে।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা ২১ ফেব্রুয়ারী পাওয়ার পর জানাজানির পরিধি কিছুটা বেড়েছে। তবে সে-পরিধির ব্যাপ্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। ৫টি প্রথম সারির স্কুল ঘুরে ছেলেমেয়েদের কাছে ভাষা দিবসের ইতিহাস পাওয়া গেলো, সেটাকে এ-ভাবে সাজানো যেতে পারে, ‘আমরা উর্দুতে কথা বলতাম। বাংলায় কথা বলার জন্য আমরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই করে জিতেছি। সেটা করতে গিয়ে অনেকে গুলি খেয়েছে। প্রাণ হারিয়েছে। তাই এই দিনটাকে আমরা স্মরণ করি।’ ভাষা শহীদ কয়জন তাদের নাম বলো প্রশ্নের উত্তরে একটু লজ্জা পেয়ে চোখমুখ বাঁকিয়ে বললো, ‘উ….ম, সা…আ..আ..লাম, মোবা-র-রক…রফিক…আর যেনো কে…স্যরি।‘ নতুন-নতুন পোশাক কেনো কিনতে হয়, এ-প্রশ্নে তাদের উত্তর ছিলো, ‘এ-দিনটাকে স্মরণ করে সবাই একসাথে হতে পারি। সবাই নতুন পোশাক পড়ি। সাদা-কালো পোশাক পরে শোকের দিনটিকে স্মরণ করি। দ্যাটস ইট। নাথিং এলস।‘
তাহলে বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে কি কেনো আমরা এ-পোশাকী শোকের আপত্তির জায়গা নিয়ে কথা তুলছি?
ঈদ, বৈশাখ, ভ্যালেন্টাইন ডে, বন্ধুত্ব দিবস এলেই মোবাইল কৌম্পানীগুলো পুরো উৎসবটার মাতব্বরে পরিণত হয়। অনুষ্ঠান দেখতে চান? সমস্যা কী? মোবাইল কৌম্পানীগুলো কনসার্টের আয়োজন করবে। একটু বেড়াতে যাবেন? কোনো সমস্যা নেই। মোবাইল কৌম্পানীগুলো বিশেষ ছাড় দিবে। ফ্যান্টসী কিংডম কিংবা নন্দন ঘুরে আসুন।
বন্ধুকে শুভেচ্ছা জানাবেন? মুশকিল আসান। এসএমএস ফ্রী। সেটুকু হলেও হয়তো চোখ বন্ধ করে রাখা যেতো। আমাদের চারুকলা প্রতিষ্ঠানসমূহ বৈশাখের শোভা যাত্রার ব্যবস্থা করে আসছে বছরের পর বছর। একসময় নিজেরা চাঁদা তুলে যার যার সামর্থ অনুযায়ী সেটা করা হতো। এরপর এলো বিভিন্ন কর্পোরেইট প্রতিষ্ঠানের সহায়তার হাত। কতো টাকা লাগবে? আরেকটু জাঁকজমক করা যেতে পারে। বাংলা লিঙ্ক যদি স্পন্সর করে, তাহলে আপনার শোভাযাত্রার সব বাংলা লিঙ্কের কর্পোরেইট কালার (কমলা-কালোর ডোরাকাটা) দিয়ে সাজাবেন।
আপনাদের যতো টাকা লাগবে আপনারা পাবেন আর আমাদের বিজ্ঞাপনটাও হয়ে যাবে। দু-দলেরই পারপাস সার্ভ হলো আর কি! কিন্তু আরও অনেক দল থাকতে পারে, সে-কথা ভাববে কে? আরও দল বলতে, তাদের কথা বলছি, যারা সে-ঐতিহ্যবাহী বৈশাখকে নিজের সংস্কৃতির আদলে সাজাতে চায়। যারা চায় মোরগের রং বাংলা লিঙ্কের কর্পোরেইট কালার যেনো না হয়ে যায়। ড্রাগন যেনো ড্রাগনের রঙেই তৈরী করা হয়, সেটা যেনো ডোরাকাটা বাঘ না হয়ে যায়। হালখাতার প্রচলন যেনো নির্দিষ্ট একটা ঘরানার ভিতর আটকে না যায়। সে-দলগুলোর কথা বলছি যারা এ-দৌরাত্ম্য চায় না।
এখন কথা হলো দৌরাত্ম্য চায় না কেনো? একটা অংশ তো এ-সংস্কৃতি মেনে নিয়েছে। মৌবাইল কৌম্পানীগুলো যদি আমাদের শোক, উৎসব, আনন্দের দিনগুলো আনন্দময় করে তোলে, দিবসগুলো সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান বাড়িয়ে তোলে, তাহলে সমস্যা কোথায়? কাজগুলো যদি সত্যিকার অর্থে করতে চাইতো বা করতো, তাহলে আসলেই সমস্যা ছিলো না। কিন্তু যখন মূল উদ্দেশ্য ব্যবসা, তখন নিয়ম বলে সেখানে চেতনাতে ঢেউ লাগানোটা কখনোই মূখ্য উদ্দেশ্য না। এমনকি গৌনও না, বরং এ-দিনগুলোকে ব্যবহার করে আমাদের আবেগের জায়গাগুলোকে নিয়ে ব্যবসা করাটাই লক্ষ্য। যার কারণে এখন পোশাক কৌম্পানী, স্পন্সরড সঙ্গীত শিল্পী, মৌবাইল টেলিফৌন কৌম্পানীগুলো এখন বছর-জুড়েই বাজার চাঙ্গা রাখতে পারছে। আর আমরা শিখছি কোনদিন কী কী করতে হবে। আমরা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছি। কিন্তু সেটা এমনভাবে করা হচ্ছে যে, আমরা বুঝতেও পারছি না বেশিরভাগ সময়। আর সে-শিক্ষার হাত ধরে আমরা ভাষা শহীদদের নাম বলতে হিমশিম খেলেও বাজারের আনকোরা সাদা-কালো পোশাক পরি, বৈশাখের সকালে সাদা-লাল শাড়ি পড়ি-পাঞ্জাবি পরি। কিন্তু সাদা-লালই কেনো বৈশাখে পরবো সেটাও জানি না। ৩০০টাকা করে পান্তা-ইলিশ মাছ ভাজা খাবো, কিন্তু এটা কি বাঙালিয়ানা কি-না সেটা বুঝবো না। ভেবে নিবো একটা দিন আমি অন্য সবার মতোই বিরিয়ানী খেলাম না, পান্তা খেলাম – আমরা সবাই বাঙালী।
২০০৭ সালের বৈশাখে গ্রামীণ ফৌন-ডিজুস নিজেদের লোগো-সহ পোশাক তৈরী করে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিনামূল্যে বিতরণ করলো। একদল আগ্রহী যুবক সারাদিন সেটা পরে ঘুরে বেড়ানোয় গ্রামীণ ফৌনের কী উদ্দেশ্য হাসিল হচ্ছে, এটা নিয়ে আমরা এক-মুহূর্তের জন্য ভাবি না। ভাবি না যে, আমরা নিজেরা পণ্য বিক্রির অংশ হয়ে যাচ্ছি এ-প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। বন্ধু-আড্ডা-গান, এরমধ্যে হারিয়ে যাও যারা বলে তারা আপনাকে সব-ধরনের দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে উপড়ে ভাসমান করে তুলছে। এটা আমাদের নিজেদেরকে বুঝে নিতে জানতে হবে। তা না-হলে সামনের দিনগুলোতে আমরা ভুলেই যাব আসলে কেনো আমরা দিনগুলোকে স্মরণ করি। এবং এ-কর্পোরেটওয়ালারা আমাদের সংস্কৃতি রক্ষার নামে মেরুদণ্ডের যে-কয়েকটি কশেরুকা অবশিষ্ট আছে, সেগুলোও গুড়িয়ে ফেলবে। এ-অনুধাবনে একটা কথাই বলার আছে। এ-যদি হয় সংস্কৃতি রক্ষার নমুনা, তাহলে যারা মনে করছেন যে, এ-সব করে তারা দ্বীনে দয়া করছেন তাদের উদ্দেশ্যে বলবো, ‘ভিক্ষা চাই না, কুত্তা সামলাও’।