এক বীরাঙ্গনা নূরজাহানের উপাখ্যান

এক বীরাঙ্গনা নূরজাহানের উপাখ্যান

বীরাঙ্গনা নূরজাহানকারো বাড়ির ঝি হিসেবে কাজ করা, কখনো একজন সফল ধাত্রী, আবার কখনোবা কোনো মৃত নারীর শেষ গোসল করিয়ে যা পান তা দিয়েই চলে বীরাঙ্গনা নূরজাহানের অন্ন-বস্ত্রসহ জীবনের যাবতীয় জোগান। এখন আর মুক্তিযুদ্ধ নয়, একমাত্র সন্তানকে আঁকড়ে ধরেই বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে চান সব হারিয়ে বেঁচে থাকা এ গর্বিত মুক্তিযোদ্ধা। মহান মুক্তিযুদ্ধে গুপ্তচরের দায়িত্ব পালনকারী নূরজাহান এখনো এ দুয়ার ও দুয়ার ঘুরে বেড়াচ্ছেন নারী মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় নাম লেখানোর চেষ্টায়। নূরজাহানের আদি নিবাস বরিশালের গৌরনদী উপজেলার বাটাজোর ইউপির বংকুরা গ্রামে। তবে এখন তার ঠিকানা ঢাকার মিরপুর কাজিপাড়ার বস্তি। বংকুরা গ্রাম থেকে কাজিপাড়ার বস্তি এর মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে একজন নূরজাহান ওরফে নূরীর জীবনের সব গল্প। কারণ মুক্তিযুদ্ধে সব হারানোই তাকে ঠেলে দিয়েছিল বংকুরা থেকে কাজিপাড়ার বস্তিতে। জীবনের সঙ্গে নিরন্তর লড়ে যাওয়া এ মুক্তিযোদ্ধা শুক্রবার এসেছিলেন যায়যায়দিন বরিশাল অফিসে। বলেছেন অনেক কথা। তার দেখা পাকহানাদারদের নির্যাতন, যুদ্ধে যোগ দেয়ার ইচ্ছা আর সব হারানোর কথা। নূরজাহান জানান, একদিন তার সবই ছিলÑ একটি গ্রাম, একটি পরিবার এবং মা-বাবা, ভাই সবই। কিন্তু যে যুদ্ধ আমাদের একটি দেশ, মানচিত্র, স্বাধীনতা আর নতুন স্বপ্ন দিলেও তাকে হারাতে হয়েছে সব।

বংকুরা গ্রামের কৃষক মোহাম্মদ ফকিরের মেয়ে নূরজাহান বেগম। দুই ভাই-বোনের মধ্যে সে ছোট। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে নূরজাহান বলেন, ১৯৭১ সালে এক বর্ষাস্নাত দিনে গ্রামে এলো পাকহানাদারের দল। তারা গ্রামের বহু বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিল। প্রাণ বাঁচাতে গ্রামের মানুষ পালাচ্ছে। পালাননি নূরজাহানের বাবা। তাকে রাইফেলের বাট দিয়ে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে হানাদাররা। কয়েকদিন পর মারা যান তিনি। পাকহানাদাররা গ্রামে অনেক গৃহবধূর ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। সেসবই কিশোরী নূরজাহানকে প্রতিবাদী হতে উদ্বুদ্ধ করে। এরপর যোগাযোগ করে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে।

নূরজাহান গৌরনদীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প কমান্ডার নিজাম উদ্দিন, বাবুগঞ্জের আগরপুরের কমান্ডার নূর হোসেন ওরফে নুরু কমান্ডারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। অনুনয়-বিনয় করেন তাকে দলে নিতে। একদিন নুরু কমান্ডার তাকে দায়িত্ব দেন পাকহানাদার, রাজাকারদের অবস্থান ও তৎপরতা সম্পর্কে গোপনে তথ্য জেনে তা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছানোর। রাজি হয়ে যান নূরজাহান। একদিন তাকে পাঠানো হয় উজিরপুর উপজেলার শিকারপুর পাকহানাদারদের ক্যাম্প এলাকায়। সেখানে ক্যাম্পের পাচক হিসেবে কাজ করতো এক স্থানীয় বাঙালি। তার কাছে একটি চিঠি দিয়ে পাঠানো হলো নূরজাহানকে।

সেপ্টেম্বর মাসের এক বিকালে নূরজাহান পৌঁছায় সেই ক্যাম্প এলাকায়। তাকে দেখে পাকহানাদাররা গুলি করলে গুলিটি পায়ে লাগে। পরে ধরা পড়ে পাকহানাদারদের হাতে। এরপর সেখান থেকে তার ঠাঁই হয় গৌরনদীতে পাকবাহিনীর স্থানীয় সদর দপ্তরে। শুরু তার বন্দিজীবন আর নির্যাতনের এক অধ্যায়। নূরজাহান জানান, সেখানে গিয়ে সে আরো অনেক নারীকে দেখতে পান। তাদের মধ্যে মনোয়ারা, সন্ধ্যা, গৌরীকে তিনি চিনতে পেরেছিলেন।

১১ ডিসেম্বর ওই ক্যাম্পের পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। আত্মসমর্পণের দিন মুক্তিযোদ্ধারা প্রায় ১২ নারীকে উদ্ধার করেছিল ক্যাম্প থেকে। তবে বেশকিছু নারী ৮ ডিসেম্বরের পর ধীরে ধীরে ক্যাম্প থেকে পালিয়ে আসার সুযোগ পেয়েছিল। নূরজাহানও ছিলেন তাদের মধ্যে।

এরপর দেশ স্বাধীন হলেও স্বাধীন দেশে নূরজাহানের শুরু হয় আরেক যুদ্ধ। লাঞ্ছিত নূরজাহানদের ঠাঁই দিতে চায়নি পরিবার ও সমাজ। নূরজাহান বলেন, অনেকে অপমান ও গঞ্জনার কারণে আত্মহত্যা করেছিল। কিন্তু সেপথে যেতে রাজি হননি তিনি। ১৯৭৩ সালের দিকে তার সঙ্গে পরিচয় ঢাকার ধানম-ি লেকের কাছে জনৈক দেলোয়ার হোসেনের। তিনি নূরজাহানকে জীবনে বেঁচে থাকার সাহস ও সহায়তা করেন। নূরজাহান মিরপুর পূর্ব কাজীপাড়ার মাতুব্বর পুকুরপাড়ের বস্তিতে একটি বাসা নিয়ে বসবাস শুরু করেন।

নূরজাহান বাসাবাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে নতুন জীবন শুরু করেন। এক পর্যায়ে পরিচয় হয় গোপালগঞ্জের পিতৃমাতৃহীন মুক্তিযোদ্ধা কামরুজ্জামানের সঙ্গে। পেশায় রিকশাচালক কামরুজ্জামান সবকিছু জেনেই বিয়ে করেন নূরজাহানকে। কোলজুড়ে আসে ফুটফুটে পুত্রসন্তান। কিন্তু সে স্বপ্নও বেশি দিন থাকেনি। ১৯৭৮ সালে মারা যান স্বামী কামরুজ্জামান। মাত্র তিন মাসের সন্তান নিয়ে দুঃখের সাগরে ভাসলেও সাহস হারাননি। তিনি বলেন, সন্তানকেই একমাত্র অবলম্বন ও তাকে বড় করার স্বপ্ন দেখেন। ছেলের পড়াশোনার সব ব্যবস্থা করেন বীরাঙ্গনা নূরজাহান সামান্য আয়েই। একটি এনজিওর মাধ্যমে ধাত্রী বিদ্যায় প্রশিক্ষণও নেন তিনি। ছেলে একদিন ভর্তি হয় মিরপুর বাঙলা কলেজে। ১৯৯৬ সালে একদল সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে নূরজাহানের ছেলে সাদেকুজ্জামান সুমনের ডান হাত কেটে ফেলে। ফলে আরেকদফা স্বপ্নভঙ্গ হয় অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা নূরজাহানের। এখনো একমাত্র ছেলেকে নিয়েই বস্তিতে পড়ে আছেন।

আত্মীয়স্বজন ও প্রিয় মুক্তিযোদ্ধাদের ছেড়ে নীরবে-নিভৃতে পালিয়ে থাকা বীরাঙ্গনা নূরজাহানের কথা বরিশালের কেউ মনে রাখেনি। ২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে বাবুগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নূর হোসেন ওরফে নুরু কমান্ডারের মাধ্যমেই তার কথা জানতে পারেন বরিশালের মুক্তিযোদ্ধা এনায়েত হোসেন চৌধুরী। এরপর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় নূরজাহানের নাম অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নেয়া হয়। আবেদন করা হলেও নাম ওঠেনি আজো। সম্প্রতি মুক্তিযোদ্ধাদের মাধ্যমে আবার আবেদন করেন নূরজাহান। তিনি জানান, আবেদন করা হলেও খোঁজখবর নেয়ার জন্য সরকারিভাবে তাদের গ্রামে গিয়ে নূরজাহানের খোঁজ পায়নি কেউ। কারণ গ্রামের মানুষ ভুলেই গেছে এ গ্রামের সন্তান এক বীরাঙ্গনা নূরজাহানকে। ফলে তালিকায় আর নাম ওঠেনি। তাই নূরজাহানের সজল চোখের প্রশ্ন, এবার কি হবে।

original source


Place your ads here!

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment