আপনি ঘুমান কী করে, প্রধানমন্ত্রী? ফাহাম আব্দুস সালাম, ক্যানবেরা থেকে:

আপনি ঘুমান কী করে, প্রধানমন্ত্রী? ফাহাম আব্দুস সালাম, ক্যানবেরা থেকে:

কর্নেল এনশাদের দীর্ঘ চাকরিজীবনের বাকি ছিল মাত্র এক সপ্তাহ। সেদিন ছিল তার জš§দিন। কথা ছিল সে রাতে তারা যাবেন আইসক্রিম খেতে, সবাই মিলে। কর্নেল এনশাদের জীবনে সে রাত আর আসেনি।

কর্নেল গুলজারের পরিবার মুক্তিযুদ্ধের সময় দল বেধে পালাচ্ছিলেন। পানির প্রয়োজন হলে খোঁজে বের হন গুলজারের পিতা ও অন্য আরেকজন। দ্বিতীয়জন ফিরে আসেন। প্রথমজন আসেননি। গুলজারের মা চিরজীবন এই আশায় ছিলেন যে তার স্বামী একদিন ফিরবেনই। কর্নেল গুলজারের লাশ এখনো মেলেনি সম্ভবত। এমন দুঃসহ অপেক্ষার প্রহর আরো কতগুলো জীবনকে অসহনীয় করে তুলবে কে জানে?

পমি ভাইয়ের (মেজর গাজ্জালী) সঙ্গে ছেলেবেলায় তাদের ড্রাম ফ্যাক্টরির অফিসার্স কোয়ার্টারে কতই না খেলেছি সোলজার সেট নিয়ে। খেলার নাম হলো গানস অব নাভারন। গুলি হবে মুখ দিয়ে আওয়াজ করে। একপক্ষ যদি মনে করে অন্যপক্ষের অমুক সোলজার তার মুখের গুলিতে মারা গেছে, তাহলে তাকে সঙ্গে সঙ্গে শুইয়ে দিতে হবে। এ নিয়ে ঝগড়াও হতো। ঝগড়ায় জিতলে শুইয়ে দেয়া সোলজারকেও দাঁড় করানো যাবে। পমি ভাই, আজ বড্ড কষ্ট হচ্ছে, ভিজে আসছে চোখ। আপনাকে যদি দাঁড় করানো যেত, আর একটি বার।

হায়দার (ক্যাপ্টেন তানভীর) ছিল আমার চেয়ে এক ব্যাচ জুনিয়র। খাড়া খাড়া চুলের শান্ত, লিকলিকে লম্বা এই ছেলেটাকে কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজে কোনোদিন হার্ডলস রেসে হারাতে পারেনি কেউ।

আমি কেবল জানতে পারিনি আমার এ ছোট ভাইটি ঠিক তার নামের মতোই সুপুরুষ বীর। হায়দার সেই ভয়ঙ্কর মুহূর্তটিতেও কেড়ে নিয়েছিল অস্ত্র, পাশের সৈনিক থেকে। কিন্তু গুলি করেনি। ভাই কেন ভাইকে গুলি করবে। সরল ভাইটি বুঝতে পারেনি যাকে সে ভাই মনে করছে, ওরা ছিল দানব।

আমার আরেক ছোট ভাই ক্যাপ্টেন মাজহার প্রাণভিক্ষা চায়নি। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বোঝাতে চেয়েছিল শান্ত হতে। আর অপেক্ষা করেছিল সাহায্যের। মেজর জেনারেল শাকিলও অপেক্ষা করেছিলেন সাহায্যের। কিন্তু সে সাহায্য পৌঁছেনি।

প্রধানমন্ত্রী, এ সৈনিকেরা আশা করেছিল সাহায্য আসবে। শেষ নিঃশ্বাসটুকু তারা ফেলেছিল হয়তো এই আশা নিয়ে যে এক্ষুণি সাহায্য আসবে। আপনার জীবনে গৌরব ও সম্মানের মূল্য কতটুকু জানি না। কিন্তু ওদের জীবনে ও দুটোই সব। ওরা প্রতিজ্ঞা করেছিল এ দেশের সঙ্গে, ঋরমযঃ ঃরষষ ফবধঃয। ওরা ওদের প্রতিজ্ঞার মূল্য দিয়েছে, আপনি দেননি। আপনি সাহায্য পাঠাননি। সৈনিক কখনো হতাহতের সম্ভাবনা বুঝে লড়াই করে না। করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে, ন্যায়ের পক্ষে।

অন্যায় ও অনিষ্টের দমন করার জন্যই যে শক্তির প্রয়োজন। আপনি অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেছেন, লড়াই করেননি। আমি দুঃখিত। আপনি এদেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন, কিন্তু আপনি আমার নেতা হওয়ার যোগ্যতা হারিয়েছেন। আপনি কৌশলী হতে পারেন, কিন্তু অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার আত্মিক শক্তি আপনার নেই। অসুন্দর আর অন্যায়ের সঙ্গে চিরকাল সমঝোতা করতে করতে আজ বিপদের মুহূর্তে কেবল আপসের কথাই আপনাদের মাথায় আসে।

আপনার কারণে আমার মাথা হেট হয়ে আসে। আমরা সেই অযোগ্য জাতি যারা তাদের বীরদের সাহায্য করার চেষ্টাটুকু করেনি। রাগে আমার শরীর অসার হয়ে আসে, যখন দেখি পরদিন আপনার গুণকীর্তনে ভরে যায় পত্রিকার পাতা। আপনি নাকি জীবন বাঁচিয়েছেন। এমনসব কাপুরুষের জন্য কলম হাতে নেয়াটাই শ্রেয়। এগুলোর অন্য কিছু বহন করবার শক্তি নেই।

আপনার অনন্য বিচক্ষণতার সুযোগে হত্যাকারীরা হত্যা, লুণ্ঠন ও নির্যাতনের যথেষ্ট সময় পায় এবং তারপর পালিয়েও যায়। একবার ভাবুন তো, আজ যদি আপনার ওপর কেউ গুলি চালায় এই সৈনিকেরা কি Casuality’র পাটিগণিত কষে এগিয়ে আসবে? আক্রমণকারীকে পাল্টা গুলি চালাতে গিয়ে যদি মারা যায় কোনো নিরপরাধ সাধারণ মানুষÑ একবার প্রশ্নও করা হবে না তার জন্য। এই বাচ্চা ছেলেগুলো তাদের বুক পেতে দেবে আপনার জন্য। হিসাব করবে না তারা death toll-এর। ওদেরও প্রয়োজন হয়েছিলÑ একবার আপনার সাহায্যের। মনে রাখবেন, সেদিন আপনি হাত গুটিয়ে নিয়েছিলেন।

হায়দার, মাজহার আর পমি ভাইয়ের চেহারা মনে এলে আজ আমি চোখের পানি আটকে রাখতে পারি না। তবু আমার গর্ব হয়, এমনসব বীরের সঙ্গে আমি কাটিয়েছি অনেকগুলো বছর, চিনেছিলাম তাদের, কাছ থেকে। আর আমার লজ্জা হয়, আমি আপনাকেও চিনেছি। ghumkumar@yahoo.com

Link requested by Anim Rahman | original source


Place your ads here!

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment