শৈশবের ওবামা কৈশোরের ওবামাঃ আজ মার্কিন প্রেসিডেন্ট-ইলেক্ট

শৈশবের ওবামা কৈশোরের ওবামাঃ আজ মার্কিন প্রেসিডেন্ট-ইলেক্ট

মার্কিন শ্বেতাঙ্গ মা আর কেনীয় কৃষ্ণাঙ্গ পিতার ঘরে হাওয়াইতে বারাক ওবামার জন্ম ১৯৬১ সালের ৪ অক্টৌবর। বারাক ওবামার পিতার নাম বারাক ওবামা সিনিয়র। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলেন ছাত্র হিসাবে। এ-সময় আন ডানহাম নামের এক শ্বেতাঙ্গ তরুণীর সাথে তার পরিচয় ঘটে। পরিচয় থেকে প্রেম ও তারপর বিয়ে। কিন্তু এদের সংসার টিকেনি বেশি দিন। বারাক ওবামার শৈশব-কৈশোর অতিক্রান্ত হয়েছে মা ও সৎ-পিতার সাথে।

শৈশব ও কৈশোরের দুঃখ-ভারাক্রান্ত স্মৃতিগুলো নিয়ে এ-বছরের ফেব্রুয়ারীর শুরুর দিকে ডেইলী মেইল পত্রিকাতে নিজ-অনুভবের হৃদয় ছোঁয়া কাহিনী প্রকাশ করেছিলেন বারাক ওবামা। ইউকেবেঙ্গলির পাঠকদের জন্য লেখাটির কিছু অংশ এখানে প্রকাশ করা হলোঃ

আমার একুশতম জন্মদিনের কয়েক মাস পরে, অপরিচিত কেউ একজন আমাকে খবরটি দিয়েছিলেন। আমি তখন নিউইয়র্কে ভাঙাচোরা মেঝে, অনিয়মিত হিটিং-ব্যবস্থাসম্পন্ন একটি ক্ষুদে ফ্ল্যাটের হতচ্ছাড়া নিচতলার ঘরে থাকতাম।

কেউ একজন টেলিফৌনে আমাকে বলে ] ব্যারী? তুমি কি ব্যারী? আমি তোমার আন্টি জেইন। নাইরৌবি থেকে। তুমি কি শুনতে পাচ্ছো? শোনো ব্যারী, তোমার বাবা মারা গেছেন। তিনি একটি গাড়ী দূর্ঘটনাতে মারা গেছেন।

এটুকুই সব। লাইন কেটে যায়, এরপর আমি একটি কাউচের উপরে বসে পড়ি, কিচেনে ডিম পুড়তে থাকার গন্ধ আসে, আমি [দেয়ালের] প্ল্যাস্টারের টুটো-ফাটাগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকি, আমার ক্ষতির পরিমাণ বুঝার চেষ্টা করি।

যখন মারা যান, তখন বাবা আমার কাছে মিথ হিসাবেই ছিলেন, কম-বেশি অন্য একজন মানুষের মতো। ১৯৬৩ সালে যখন আমি মাত্র দু-বছর বয়েসী, তখন তিনি আমাকে ও আমার মাকে হাওয়াইতে রেখে চলে গিয়েছিলেন। একজন শিশু হিসাবে, আমি তাকে জানতাম শুধুই আমার মা আর দাদু-দিদিমার কাছ থেকে গল্প শুনে।

ওবামা জানান, তাদের ঘরে তার বাবার স্টুডিওতে তোলা গোটাকয় সাদা-কালো ফটোগ্রাফ ছিলো যা তিনি ক্রিসমাসের সাজসজ্জা খুঁজতে গিয়ে ঘরের বাক্স-পেটরার মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলেন। এ-সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ওবামা বলেন, আমার স্মৃতি যেখানে শুরু হয়েছে তা হলো, আমার মা ততোদিনে একজন ব্যক্তির সঙ্গে কৌর্টশিপ শুরু করেছেন যিনি পরে তার দ্বিতীয় স্বামীতে পরিণত হন এবং এ-কারণেই আমি কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই বুঝতে পারি কেনো [বাবার] ফটৌগ্রাফগুলোকে বাক্সবন্দী করে রাখা হয়েছিলো। তবে কখনও-কখনও মায়ের সঙ্গে ঘরের মেঝেতে বসে ধূলো-গন্ধ আর মথে-ধরা ভেঙে পড়তে থাকা এালবামটির দিকে তাকিয়ে আমার সাথে তার সাদৃশ্যের দিকে নজর রাখতাম আর শুনতাম।

তিনি একজন আফ্রিকান ছিলেন। আমি জেনেছি, কেনিয়ার লুও গোত্রে লেইক ভিক্টৌরিয়ার তীরে জন্ম নিয়েছিলেন। আমার বাবা তার বাবার ছাগলের পাল চরাতে-চরাতে এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রশাসনের গড়ে তোলা স্থানীয় স্কুলে যেতে-যেতে বড়ো হয়ে উঠেছিলেন, যেখানে তিনি বেশ একটা প্রতিশ্রুতির স্বাক্ষর রেখেছিলেন।

এক-পর্যায়ে তিনি নাইরৌবীতে পড়তে যাবার একটি বৃত্তি পেয়ে যান এবং এর পরে পশ্চিমা প্রযুক্তি শিক্ষা করে এসে একটি নতুন ও আধুনিক আফ্রিকার গড়ে তোলার লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পড়তে যাবার জন্য মনোনীত হন। ১৯৫৯ সালে ২৩ বছর বয়সে তিনি প্রতিষ্ঠানের প্রথম আফ্রিকান ছাত্র হিসাবে হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে হাজির হন। তিনি সেখানে ইকৌনোমেট্রিক্স পাঠ করেন এবং তিন বছরের মধ্যে গ্র্যাজুয়েট হয়ে যান।

রুশ ভাষা শিক্ষার ক্লাসে আত্মবিশ্বাসহীন লাজুক আঠারো বছরের এক আমেরিকান বালিকার সাথে তার পরিচয় হয়। কন্যার মাতা-পিতা শুরুতে উদ্বিগ্ন ছিলেন, কিন্তু আমার বাবা মনোমুগ্ধকর ব্যক্তিত্ব ও মেধা দিয়ে তাদের জয় করে নেন। এ-তরুণ জুটি বিয়ে করে এবং তাদের ঘরে একটি ছেলের জন্ম হয়। তিনি [বাবা] তখন হাভার্ডে পিএইচডি করার জন্য একটি বৃত্তি পেয়ে যান, কিন্তু নতুন পরিবারটিকে নিজের সঙ্গে নিয়ে যাবার মতো আর্থিক সঙ্গতি তার ছিলো না – অথবা বলা যায় এমনটিই আমাকে জানানো হয়েছে। পরবর্তীতে [আমার মা-বাবার] বিচ্ছেদ হয়ে যায় এবং [তিনি] মহাদেশের প্রতি অঙ্গীকার রক্ষার জন্য আফ্রিকা ফিরে যান।

কাহিনী পর্যায়ের এক-পর্যায়ে এসে ওবামা বলেন, আমার বাবা আমার চারপাশের কোনো লোকের মতো দেখতে ছিলেন না – তিনি দেখতে পীচের মতো কালো ছিলেন, আর আমার মায়ের বরণ ছিলো দুধের মতো শাদা – এটাই আমার মনে গেঁথে আছে। ওবামা জানিয়েছেন, তার বাবা কেনো ফিরে আসছেন না সে-প্রশ্নটি নিয়ে তার মধ্যে সমস্যার জন্ম হয়। পাঁচ বা ছয় বছরের মধ্যে এ-স্মৃতিটি অক্ষত রেখেই সন্তুষ্ট থাকতে পেরেছিলেন বলে জানিয়েছিলেন ওবামা।

ওবামা বলেন, আমার একজন লিভ-ইন পিতা থাকা দরকার এটা বুঝার পক্ষে আমি বেশ ছোটো ছিলাম। আমার একটি বর্ণগত পরিচয় থাকার ব্যাপারটি বুঝার পক্ষেও আমি বেশ ছোটো ছিলাম। তার বাবা-মা যে-সময় বিয়ে করেছিলেন, সে-সময়টি বর্ণ-মিশ্রণের ব্যাপারটি যুক্তরাষ্ট্রের অর্ধেকেরও বেশি অঙ্গরাজ্যে গুরুতর অপরাধ হিসাবে বিবেচিত ছিলো। কৃষ্ণাঙ্গ-বিরোধী মনোভাবের ভয়াবহতা বুঝাতে যেয়ে ওবামা বলেন, [দেশের] দক্ষিণাঞ্চলের বহু স্থানেই আমার মায়ের [মতো কারও] দিকে শুধুই ভুলভাবে তাকানোর দায়ে আমার বাবাকে গাছে ঝুলিয়ে দেয়া হতো। উত্তরাঞ্চলের আধুনিক শহরগুলোতেও পরিস্থিতি ভয়াবহ ছিলো বলে উল্লেখ করেন ওবামা।

ছয় থেকে দশ বছর বয়স পর্যন্ত মা ও মায়ের দ্বিতীয় স্বামীর [লোলো সোয়েতোরো] সঙ্গে ইন্দোনেশিয়াতে কাটান ওবামা। পড়াশোনার জন্য হাওয়াইতে দাদী মার কাছে ফিরে আসার পরে স্কুলে বিরূপ ব্যবহারের মুখোমুখি হন তিনি। সে-সময়ের স্মৃতিতে ভারাক্রান্ত ওবামা বলেন, এমনকি রুখোমুখো এক সহপাঠী জানতে চায় আমার বাবা মানুষ-খেকো কি-না।

দশ বছর বয়সে পিতার সাথে হাওয়াইতে একবার সাক্ষাত হলে খুব একটা খুশী হতে পারেননি ওবামা। তারা মনে হয়েছিলো স্মৃতিতে ধরে রাখা বাবাটিই ভালো, কারণ চাইলে তা ইচ্ছেমতো উল্টে-পাল্টে নেয়া যায়। এ-সময় মায়ের মতো ওবামার বাবাও বিয়ে করে ফেলেছিলেন। ওবামার দশ থেকে পনেরো বছরের সময়কার জীবনে অনেক পরিবর্তন ঘটে যায়। এ-সময় তার মায়ের সাথে দ্বিতীয় স্বামীর বিচ্ছেদ হয়ে যায় এবং তার মা হাওয়াই ফিরে আসেন বোন লুলুকে-সহ।

কৈশোরের কঠিন দিনগুলোতে মারিজুয়ানা, যথেচ্ছ মদ্যপান আর সময়-সময় কৌকেইন সেবনের কথাও জানিয়েছেন এই ৪ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নতুন এক ইতিহাস সৃষ্টি করে প্রথম আফ্রৌ-আমেরিকান হিসাবে ওয়াইট হাউসের দরোজা নিজের জন্য উন্মুক্ত করে নেয়া ব্যক্তিত্ব বারাক ওবামা।

লন্ডনঃ ৫ নভেম্বর ২০০৮ | original


Place your ads here!

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment