ভূমিখেকো হচ্ছে ধনী দেশঃ নয়া-উপনিবেশের আশঙ্কা গরীব বিশ্বে
কতিপয় ধনী দেশ আর কর্পোরেইট সেক্টরগুলো নিজেদের জন্য দীর্ঘ-মেয়াদে খাদ্য-সরবরাহের নিশ্চয়তার লক্ষ্যে উন্নয়নশীল বিশ্বজুড়ে যেভাবে ভূমি-গ্রাসের দৌড়ে লিপ্ত হয়েছে, তা দেখে নয়া-উপনিবেশবাদের আশঙ্কা ব্যক্ত করেছে প্রধানতম আন্তর্জাতিক সংস্থা জাতিসংঘ। গরীব দেশের সরকারগুলো নিজেদের ভূমি লিজ দেয়ার সপক্ষে কথা-বার্তা বললেও বিশেষজ্ঞরা ভিন্নমত প্রদান করেছেন।
শনিবার ইউএন ফুড এ্যান্ড এ্যাগ্রিকারচারাল অর্গানাইজেশনের প্রধান জ্যাকুয়েস ডিউফ বিদ্যমান পরিস্থিতির ব্যাপারে আশঙ্কা প্রকাশকালে জানান নিজেদের ক্ষুধার্ত জনগণের ভাবনা বাদ দিয়ে ধনী দেশগুলোর জন্য খাদ্য উৎপাদন সংক্রান্ত ডীলর প্রবণতা ইদানীং গরীব দেশগুলোর ক্ষেত্রে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে নয়া-উপনিবেশবাদের একটি ধারা তৈরী হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
খবরে প্রকাশ, চলতি সপ্তাহেই দক্ষিন কোরিয়ার কৌম্পানী ডাইয়ু লজিস্টিক জানিয়েছে আফ্রিকার মাদাগাস্কারে কয়েক-মিলিয়ন হেক্টর জমি নিরানব্বুই বছর লীজ নেয়ার ব্যাপারটি তারা চূড়ান্ত করতে সক্ষম হয়েছে। স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুসারে, ২০২৩ সাল নাগাদ বছরে ৫ মিলিয়ন টন ভূট্টা উৎপাদন করবে। এছাড়াও এর বাইরে ১ লক্ষ বিশ হাজার হেক্টর জমিতে পাম ওয়েল উৎপাদিত হবে ডাইয়ুর জন্য। এ-ব্যাপারে ব্রিটেইন ক্যামব্রিজ-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক ল্যান্ড ডীল বিষয়ক প্রতিষ্ঠান বিডওয়েল এ্যারিবিজনেসের কনস্যালট্যান্ট কার্ল এ্যাটকিন জানান,একটা পর্যায় পর্যন্ত একে একটি বাণিজ্যক প্রক্রিয়া হিসাবে দেখা যায়, তবে এর পিছনে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যাপারে একটি সরকারের যুক্ততাও লক্ষ্য করা যায়। দাইয়ুর সাথে মাদাগাস্কার সরকারের চুক্তিটির ব্যাপারে নিজের মত প্রকাশকালে এ্যাটকিন আরও জানান, চাষযোগ্য জমির দিক থেকে দেখলে এটি অদৃষ্টপূর্ব। সাধারণতঃ এসব ক্ষেত্রে ১০ হাজার হেক্টর পর্যন্ত চুক্তি হতে দেখা যায়।
নিজেদের জমি-জমা কম কিন্তু ধনী এমন দেশগুলোর পক্ষ থেকেও নিজেদের জন্য খাদ্য-নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যাপারে তোড়জোড় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ইতোমধ্যে উন্নয়নশীল বিভিন্ন দেশের সাথে সামনের দিনগুলোর খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করার রফাতে পৌঁছার চেষ্টা করে যাচ্ছে। খবর মতে, সৌদি আরবের বিন-লাদেন গ্রুপ বাসমতি চাউল উৎপাদন করার জন্য ইন্দোনেশিয়াতে বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছে। এছাড়াও আবুধাবির বিনিয়োগকারীদের কাছে হাজার-হাজার হেক্টর জমি বিক্রি হয়ে গেছে পাকিস্তানে। এদিকে আবুধাবি ফান্ড ফর ডেভেলাপমেন্ট এখন সুদানের কৃষিখাতের সরাসরি অংশীদারের পরিণত হয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট খালিফা বিন জায়েদ জানিয়েছেন, খাদ্য-সরবরাহ নিশ্চিত রাখার লক্ষ্যে তার দেশ কাজাখস্তানে বৃহদাকার কৃষি-প্রকল্পের ব্যাপারটি বিবেচনা করছে। চীনের মতো দেশও, যার জমির সমস্যা না থাকলে শিল্পায়নের দূরন্ত গতির কারণে ইদানীং কৃষিজমিতে জল-সরবরাহজনিত সমস্যায় ভূগছে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একাধিক দেশের সাথে ভূমি-বিষয়ক চুক্তি করার চেষ্টা করছে। এর মধ্যে লাওসের সাথে দু থেকে তিন মিলিয়ন হেক্টর জমির ব্যাপারে চুক্তিতে পৌঁছে গেছে দেশটি।
এদিকে উক্রাইনের সাথে আড়াই লক্ষ একর জমি নিয়ে যুক্তি করেছে লিবিয়া। মিশরের পক্ষ থেকেও দেশটির সাথে একই ধরণের চুক্তি চলছে। কম্বৌডিয়ার সাথে চাউল উৎপাদনের ব্যাপারে চুক্তিতে সাধনের চেষ্টা করছে কুয়েত ও কাতার। সুদান ও ইথিওপিয়ার পক্ষ থেকে সৌদী বিনিয়োগকারীদের কাছে কৃষি জমি লীজ দেয়ার ব্যাপারে চেষ্টা-চরিত্র করা হচ্ছে। এসব সরকারের দাবী হচ্ছে এ-ধরণের চুক্তি করা গেলে আখেরে তা বিনিয়োগ, মূল্যস্থিতি এবং বাজারের স্থিতিশীলতা রক্ষার ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কিন্তু আন্তর্জাতিক চ্যারিটি অক্সফ্যামের গবেষণা-বিভাগের প্রধান ডানকান গ্রীন মনে করেন ভিন্ন কথা। তিনি মনে করেন, এ-ধরণের চুক্তির মধ্য দিয়ে ক্ষুদে কৃষকদের লাভের আদৌ সম্ভাবনা নেই। নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার অন ইন্টারন্যাশনাল কৌঅপারেশনের এ্যালেক্স ইভান্স বলেন, ‘ক্ষুদে কৃষকরা ইতোমধ্যেই ক্ষতির মধ্যে পড়ে গেছে।’ প্রবণতার কারণে সাধারণ লোকেরা জমির অধিকার থেকে ছিটকে পড়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন তিনি।
আশঙ্কার ব্যাপার, ধনী দেশ ও কর্পৌরেশনগুলোর সাথে গরীব দেশের সরকারগুলো যে-সব চুক্তি করছে, তার বিস্তৃত বিবরণ জনসমুখে প্রকাশ করা হচ্ছে না। জাতিসংঘ জানিয়েছে, আগামী জুনে অনুষ্ঠিতব্য খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ক সম্মেলন থেকে আফ্রিকার কৃষকদের জন্য অধিকতর বিনিয়োগ ও উন্নয়ন সাহায্য প্রদানের ব্যাপারটি ঠিক হয়ে গেছে। সংস্থার দাবী, এতে করে অধিক উৎপাদনের ভেতর দিয়ে উচ্চমূল্যের সাথে পাল্লা দিতে সমর্থ হবেন আফ্রিকান কৃষকরা।
লন্ডনঃ ২২ নভেম্বর ২০০৮ | original source