বিজয় দিবসটি হোক নতুন প্রজন্েনর – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

বিজয় দিবসটি হোক নতুন প্রজন্েনর – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

মাঝেমধ্যেই আমাকে অনেকে জিজ্ঞেস করে, আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় সময়টি কী ছিল। আমি এক মুহুর্তের জন্যও দ্বিধা না করে বলি, সেটা ছিল ১৯৭১ সালের ষোলই ডিসেম্বরআমাদের বিজয় দিবস। শুধু আমি নই; আমি নিশ্চিত, আমাদের প্রজন্েনর যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে বড় হয়েছেন, তাঁদের সবাই সেই দিনটির অবিশ্বাস্য আনন্দটি অনুভব করার জন্য বারবার জন্ন নিতে রাজি আছেন।

বিজয় দিবসের মতো দিনে সব সময়ই একটা হিসাব নিতে ইচ্ছে করে, আমরা কতটুকু পেয়েছি, কতটুকু পাইনি, যেটুকু পেয়েছি সেটা কীভাবে ধরে রাখা যায়, যা এখনো পাইনি সেটা পাওয়ার জন্য কী করতে হবে। এই বিজয় দিবসেও সবাই নিশ্চয়ই নিজের মতো করে হিসাব করবে। আমার ধারণা, এবার সবাই এক বাক্যে বলবে, অন্য সব হিসাব আপাতত থাকুক, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারটা আগে সেরে নিই। এ কাজটা শেষ না করা পর্যন্ত আমরা অন্য হিসাব করতে পারছি না, করতে ইচ্ছে করছে না।

একাত্তরে যারা আপনজনকে হারিয়েছে, তাদের কারও সঙ্গে কথা বললে বোঝা যাবে, যুদ্ধাপরাধীদের জন্য একেকজনের বুকের ভেতর কী রকম ভয়ঙ্কর ঘৃণা, ক্রোধ আর ক্ষোভ জমা হয়ে থাকতে পারে। কেউ যেন মনে না করে, আমরা শুধু সেই ঘৃণা, ক্রোধ আর ক্ষোভ শান্ত করার জন্য তাদের বিচার করতে চাই। আমাদের প্রতি মুহুর্তে মনে হয়, আমাদের সারা শরীরে বুঝি পূতিগন্ধময় ক্লেদ লেগে আছে; আমরা সেই অশুচি পূতিগন্ধময় ক্লেদ ধুয়েমুছে গ্লানিমুক্ত হতে চাই।

শুধু এটাও কিন্তু কারণ নয়, এর থেকেও বড় কারণ আছে। ১৯৭১ সালে যে অপশক্তি স্বাধীনতার বিরোধিতা করে যুদ্ধাপরাধ করেছিল, তাদের চরিত্রের কিন্তু একচুল পরিবর্তন হয়নি। একটিবারও কিন্তু তারা ক্ষমাভিক্ষা চায়নি। যে বদর বাহিনী আমাদের শিক্ষক, সাংবাদিক, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তারদের একজন একজন করে হত্যা করেছে, সেই বদর বাহিনীর কমান্ডার মতিউর রহমান নিজামী আর আলী আহসান মুজাহিদ এখনো সেই দলের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। শুধু তাই নয়, তাঁরা একাত্তরে যে ভাষায় কথা বলতেন, এখনো সেই একই ভাষায় কথা বলে আমাদের সব অর্জনকে হেয় করার চেষ্টা করেন। একাত্তরে তাঁরা ইসলাম রক্ষার কথা বলে এ দেশে গণহত্যায় অংশ নিয়েছেন। এখনো তাঁরা সেই একইভাবে ইসলামের দোহাই দিয়ে যাচ্ছেন। এ দেশে অনেক রকম সরকার এসেছে। কোনো সরকারের আমলেই কিন্তু কোনো মুসলমানেরই তাদের ইসলাম ধর্ম পালন করতে কোনো অসুবিধে হয়নি। তাহলে আলাদা করে কেন একটা রাজনৈতিক দলের ইসলামের নামে রাজনীতি করতে হবে?

আমরা নুতন সহস্রাব্দে পা দিয়েছি। এই সহস্রাব্দ হচ্ছে মানুষের জন্য মানুষের সম্মানবোধের সহস্রাব্দ। আমরা নতুন পৃথিবীর মানুষেরা এখন অনেক বেশি সংবেদনশীল, অনেক বেশি সহিষ্ণু, অনেক বেশি মানবিক। আমরা এখন এক ধর্মের মানুষ হয়ে শুধু যে অন্য ধর্মকে সহ্য করি তা নয়, অন্য ধর্মের মানুষ যেন তার ধর্ম কিংবা তার বিশ্বাসটা ঠিক করে পালন করতে পারে সে বিষয়টাও নিশ্চিত করতে চাই। শুধু কি মানুষ? আমরা এখন অবোধ পশুপাখি, এমনকি গাছপালাকেও বুক আগলে রক্ষা করি। অকারণে আমরা একটা ছোট পাখি, একটা ঘাসফড়িং কিংবা একটা দুর্বাঘাসকেও মরতে দিই না। সে সময় কেউ যদি শুধু তার নিজের ধর্ম আর নিজের ধর্মের মানুষের স্বার্থটা দেখেশুধু তাই নয়, নিজের ধর্মের অনুশাসন অন্য সবার ওপর জোর করে চাপিয়ে দিতে চায়, তাহলে বুঝবে সে এই নতুন পৃথিবীর মানুষ নয়। সে সমাজকে, পৃথিবীকে পেছনে টেনে রাখতে চাইছে। নতুন পৃথিবীতে এ ধরনের রাজনৈতিক দলের কোনো ভুমিকা নেই। তারা অপশক্তি, তারা যে ধর্মেরই হোক, নতুন পৃথিবীকে তারা জ্ঞানবিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, মুক্তবুদ্ধি তথা কিছুই দিতে পারবে না। তারা শুধু পেছনে টেনে রাখবে।

আমরা একটা আধুনিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি। তাই মধ্যযুগের এই রাজনৈতিক দলের চরিত্রটা সবাইকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাতে চাই। যুদ্ধাপরাধীর বিচার করে সবাইকে মনে করিয়ে দিতে চাই, তারা কী করেছিল, ভবিষ্যতে কী করতে পারে।

যুদ্ধাপরাধীর বিচার করার কাজটি কি খুব কঠিন? আমার ধারণা, কাজটি মোটেও কঠিন নয়। শুধু নতুন প্রজন্নকে তার দায়িত্ব নিতে হবে, তাদের অন্তর থেকে সেটা চাইতে হবে। নতুন প্রজন্েনর চারপাশে এখন নানা রকম প্রলোভন। তাদের প্রতি মুহুর্তে বোঝানো হচ্ছে যে তাদের হয় সুদর্শন নয় রূপবতী হয়ে জীবন উপভোগ করতে হবে। আশপাশে যারা আছে তাদের সবাইকে পরাজিত করে ওপরে উঠে যেতে হবে; কারণ অর্থ, বিত্ত, ক্ষমতা হচ্ছে জীবন! আসলে এগুলো সত্য নয়। নতুন প্রজন্নকে সবার আগে তাদের চারপাশে তাকিয়ে দেখতে হবে, যখন দেশের প্রয়োজন হবে তখন সবার আগে দেশের ডাকে সাড়া দিতে হবে। তারা শুনছে কি না জানি না; দেশ কিন্তু তাদের ডাকছে, আকুল হয়ে ডাকছে।

নতুন প্রজন্েনর অনেকেই দুঃখ করে বলে, ‘আহা! আমার যদি আরও আগে জন্ন হতো, তাহলে আমি মুক্তিযুদ্ধে যেতে পারতাম!’ তাদের দুঃখটা খাঁটি, কারণ তারা হয়তো ভবিষ্যতে কোনোদিন অলিম্পিকে স্বর্ণপদক আনতে পারবে, অস্কার আনতে পারবে, ফিল্ডস মেডেল, এমনকি নোবেল পুরস্কারও আনতে পারবে, কিন্তু শত চেষ্টা করেও মুক্তিযোদ্ধা হতে পারবে না! মুক্তিযুদ্ধে অংশ না নিতে পারার দুঃখটা তাদের অপূর্ণই থেকে যাবে।

মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ নিতে না পারলেও মুক্তিযোদ্ধারা যে লক্ষ্যের জন্য যুদ্ধ করেছিল তারা এখনো সেই একই লক্ষ্যে যুদ্ধ করতে পারবে। একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে সঙ্গে এই বিশ্বাসঘাতকদের নির্মূল করার জন্য যুদ্ধ করেছিলেন। এত দিন পর আবার সেই বিশ্বাসঘাতক যুদ্ধাপরাধীদের উপস্িথতি থেকে এ দেশকে মুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আমাদের সেক্টর কমান্ডাররা আক্ষরিক অর্থে পথে নেমেছেন, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো প্রচার-প্রচারণা করছে, পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হচ্ছে, তরুণেরা সংগঠিত হচ্ছে। আমাদের নতুন প্রজন্নকে এ প্রক্রিয়ায় যোগ দিতে হবে। যে যেটুকু পারে তাকে অবশ্যই সেটুকু করতে হবে। তারা যদি ভোটার হয়ে থাকে, তাহলে অবশ্যই সবাইকে নিয়ে ভোট দিয়ে আসতে হবে−তাদের নিশ্চিত করতে হবে যেন কোনো যুদ্ধাপরাধী এ দেশের মাটিতে আর নির্বাচিত হতে না পারে।

এ বছরের বিজয় দিবসে আমাদের নতুন প্রজন্ন আমাদের এ বিজয়টি উপহার দেবে, আমি বড় আশা করে তার জন্য অপেক্ষা করে আছি।

original source


Place your ads here!

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment