দেয়াল

দেয়াল

সুনীল বাবু লাঠি হাতে বাস থেকে নামলো। উত্তেজনায় তার আপাদমস্তক বাঁশ পাতার মত কাঁপছে। কাঁপা শরীরের সমস্তটা লাঠির উপর ভর করেছে। ঝাঁঝালো রোদে আকাশের দিকে চেয়ে এক নিশ্বাসে প্রাণ ভরে দম নেয় সে। দমের সাথে বিড়বিড় করে বলে, এটা আমার জন্মভূমি।

তার পিছন পিছন ছোট্ট একটা হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে নামলো শোভন। বয়সের পার্থক্য যেমনি হোক সম্পর্কের বিচারে তারা একে অন্যের দাদু নাতি।

১৯৪৭ সালের দেশ বিভক্তের পর সুনীল বাবু এই প্রথম যশোরে এসেছে। এখানেই তার আদি নিবাস, জন্ম। বুকে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে দীর্ঘ সত্তর বছর পার করেছে কলকাতা শহরে। সে আগেও চেয়েছে কিন্তু আসতে পারে নি, কখনো ছেলেমেয়েরা বাঁধা দিয়েছে কখনো বা সময়ের সাথে আপোষ হয়ে উঠে নি। আসলে চাইলেই সব হয় না, তার বাবা বলাই বাবু সব ‘নাই পয়সায়’ বেঁচে দিয়ে পরিবার সমেত চলে গিয়েছিল কলকাতায়। সেসময় গোটা পরিবেশটাই ছিল থমথমে, ভয়াবহ। কিছু হিন্দু বিদ্বেষীদের কারণে শুধু বলাই বাবু নয় গ্রামের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুরা দেশত্যাগ করেছে জীবন বাঁচাতে, জীবন সাজাতে। সেই যে বাবার হাত ধরে চলে যাওয়া, আর আসা হয় নি।

সুনীল বাবু দেখতে দুধের মত ফর্সা, চুল দাঁড়ি চুনের মত সাদা, দেখতে অনেকটা মিলে যায় রবিঠাকুরের সাথে।

শোভন তার দাদুর মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে কোন দিকে যাবে? এই কাঠফাটা রোদে সুনীল বাবু ঠিক ঠাহর করতে পারে না, কোন দিকে যাবে। এতবছর পর তার কাছে সবকিছু কেমন অচেনা মনে হতে থাকে।

সুনীল বাবু মুখে কিছু না বলে এগোতে থাকে। তার কেন জানি মনে হয় এর আশেপাশে তার জন্ম, তার শেকড়। হাঁটতে হাঁটতে তারা একটা দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল। দোকানদারকে জিজ্ঞেস করল, মিঠাইপুর গ্রামটা কোন দিকে জানেন?

দোকানদার চোখ ছোট করে বলে গ্রাম? এটা তো মশাই যশোর শহর! আপনি যাবেন কোথায়?

মিঠাইপুর গ্রাম, এখানেই হওয়ার কথা সেটা। ওই যে মিঠাইপুর গ্রামের সাথেই একটা বিশাল বটবৃক্ষ ছিলো। ওখানেই তো প্রতি বছর বিশাল পৌষ সংক্রান্তি মেলা বসতো।

দোকানদারের স্মৃতির ফটক কিছুটা খুলেছে এবার। বাবার মুখে শুনেছি বটতলার বিশাল মেলার কথা। এটা তো এখানে না মশাই। ঐ ডানের রাস্তা ধরে দুই/তিন কিলোমিটার যেতে হবে অটো রিক্সায়। তবে বটগাছ, মেলা এসব আর নেই। জিহ্বায় তিতা স্বাদ নিয়ে বলে, পুরোটাই আবাসিক এলাকা।

সুনীল বাবুর কাছে এসব কথার ভ্রুক্ষেপ নেই। নিজের বাড়ীর কাছে চলে আসার আনন্দ তাকে ঘিরে ধরেছে আষ্ঠেপৃষ্ঠে।

তারা ঠিকানা অনুযায়ী এদিকটায় এসে দেখে এখানে বটবৃক্ষের কোনো অস্তিত্বই নেই। চারিদিক আবাসিক ভবনে ঘেরা, একটা পার্কও আছে মৈত্রী পার্ক নামে। এসব তার কাছে অচেনা লাগে। সম্পূর্ণ অচেনা। সে কি তাহলে তার বাড়ী হারিয়ে ফেলেছে? চাপা হতাশায় ঘর্মাক্ত শরীর নিয়ে সুনীল বাবু হাঁটতে থাকে।

হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্তি এসে ভর করেছে দেহে, তার চেয়ে বেশি মনে। পথে এক মাঝ বয়সী লোককে ডেকে জিজ্ঞেস করল সুনীল বাবু।
আচ্ছা দাদা, এখানে বলাই বাবুর বাড়ীটা কোথায় ছিলো বলতে পারেন?

লোকটা খানিক চিন্তা করে দুদিকে মাথা ঝাঁকায় ‘না’।

আচ্ছা, এদিকে আশেপাশে বীণাপানি নামে একটা স্কুল ছিলো। সেটা কোন দিকে বলতে পারেন?

লোকটা রাগ হয়ে বলল, ধুর ভাই ভুল ঠিকানায় এসেছেন। এদিকে এগুলো কিছু নাই।

সুনীল বাবু শোভনের দিকে একবার তাকালো তারপর আবার জোর পায়ে হাঁটতে লাগলো। তার তিন কদম পিছনেই ব্যাগ কাঁধে শুকনো মুখে হেঁটে চলছে শোভন।
তারা জানে না, এ পথের শেষ কোথায়?

বেলা বাড়ার সাথে সাথে সুনীল বাবুর চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। রাস্তাঘাট গাছগাছালি সবকিছুকে অস্পষ্ট মনে হয়। স্মৃতির জগত বাদে পুরনো সবটাই হারিয়ে গেছে নতুন অচেনায়। তবুও আশা ছাড়ে না সুনীল বাবু। বাড়ী না দেখে সে কলকাতা ফিরে যাবে না, ফিরতে পারে না।

বিকেল হয়ে আসছে প্রায়। সুনীল বাবুকে সন্ধ্যার বাসেই ফিরে যেতে হবে ঢাকা। সেখান থেকে ফিরতি পথে কলকাতা। এই কঠিন সত্য না মেনে উপায় নেই।

তারা একটা চায়ের দোকানে বেঞ্চে বসলো। শোভন চা চুমুক দিয়ে দাদুর মুখের দিকে তাকায়। সে কিছু খাচ্ছে না। চোখ বন্ধ করে মুখে কি যেন আওড়াচ্ছে।

চা দোকানদার দেখতে বুড়ো লোক, সে শোভনকে জিজ্ঞেস করলো, কোথায় আসছেন আপনারা?

শোভন বলল, এখানেই। আমরা আসছি কলকাতা থেকে। আচ্ছা, এদিকে বলাই সেনের বাড়ীটা কোথায় জানেন কিছু? কিংবা বীণাপানি স্কুল?

চা দোকানদার দু’বার না বোধক কাঁধ সাধলো। তবে আমার বাবা বীণাপানি স্কুলে পড়েছে। সেটা ভেঙ্গে বহু আগেই তো সরকারী হাসপাতাল হয়েছে।
শোভন অবাক হয়ে বলে, স্কুল ভেঙ্গে হাসপাতাল?

দাদুকে কিছু বলতে গিয়ে দেখলো দাদু পাশে নেই। দূরে এক মিষ্টির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে স্থির হয়ে। শোভন হেঁটে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, দাদু এখানে দাঁড়িয়ে আছো যে?

সুনীল বাবু মিষ্টির দোকানের নাম দেখিয়ে বলল এই দেখ, মরণচাঁদ মিষ্টি ভান্ডার। ছোটবেলায় খুব মিষ্টি পাগল ছিলাম। আমি বাবার হাত ধরে কতবার এসে মিষ্টি খেয়েছি এ দোকানে। আহা মরণচাঁদ মিষ্টি!
তারপর চোখ বন্ধ করে বলল, এখান থেকে আমি আমার বাড়ীতে যেতে পারবো মনে হয়। তুই আমার হাতখানি ধর, আমি চোখ বন্ধ করে আমার বাড়ীতে যাবো।

সুনীল বাবু চোখ বন্ধ করে ছোটবেলার সেই পথে ফিরে গেছেন, হাঁটছেন। তার এক হাত যেন বাবার হাতে ধরা, অন্য হাতে মিষ্টি। এভাবেই হেঁটে হেঁটে একটা বাড়ীর সামনে এসে চোখ বন্ধ রেখেই বলল, এটাই আমার বাড়ী। শোভন দেখলো, বাড়ীর সামনে বিশাল একটা খয়েরী গেট। এই বৃহদাকার গেট পেরিয়ে বাড়ী দেখা যাচ্ছে না।

সুনীল বাবুর বুক কাঁপছে। বুকে হাত রেখে হৃদযন্ত্রের আওয়াজ টের পাচ্ছে সে।

তারা দু’জনে গেটের ভিতরে প্রবেশ করল। বাড়ী দেখে সুনীল বাবু চিনতে পারে এই বাড়ীটি তাদের। বাড়ীটির সংস্কার হয়েছে তবে মূল কাঠামো বদলায় নি। নিজের আঙিনায় দাঁড়িয়ে নিজের বাড়ী দেখার মত প্রশান্তির অনুভূতি আর কিছুতে পাওয়া যায় না।

এরই মধ্যে একজন বয়স্কা মহিলা বাড়ীর ভিতর থেকে বেরিয়ে এল। সুনীল বাবু আমতা আমতা করে তাকে জিজ্ঞেস করল, এটা কি বলাই বাবুর বাড়ী?

বয়স্কা ভদ্র মহিলা পাল্টা প্রশ্ন করল, আপনি কে?

জ্বি, আমার নাম সুনীল বাবু। বলাই বাবু আমার বাবা।

ভদ্র মহিলা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, আপনি সুনীল বাবু? আমাকে চিনতে পেরেছেন? আমি রোকেয়া। মনে আছে আমরা এক সাথে পড়তাম। হঠাৎ আবহটা কেমন পাল্টে গেল। এর জন্যই যেন সে অনন্তকাল অপেক্ষা করে ছিল। শুধু এ দিনটির জন্য।

সুনীল বাবু এক এক করে সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠতে লাগল। তার কাছে কেমন এলোমেলো লাগছে সব। সে এঘর থেকে ওঘরে যায়। সবকিছু কেমন শৈশবের আলোয় স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়। তার কাছে মনে হয়, এ ঘরের প্রতিটা ইটবালির দেয়াল তাকে গভীরভাবে চিনে।

সুনীল বাবু লাঠি ফেলে পরম মমতায় দেয়াল ছুঁয়ে দেখে। দেয়ালে কান লাগিয়ে শুনতে পায় মা তাকে বলছে, ‘সন্ধ্যা হয়েছে পড়তে বস সুনীল, পা ধুয়ে ঘরে ঢোক সুনীল, দুপুরে বাইরের রোদে একদম খেলতে যাস না, রং দিয়ে দেয়ালে দাগ লাগিয়েছে কেরে সুনীল? সুনীল তুই কই?’

সুনীল বাবু দেয়ালে কান লাগিয়ে হাসে, অচেতন মনে দেয়ালে হাত বুলায় গভীর মমতায়। কথা হয় দেয়ালের সাথে সুনীলের আত্নার। এ যেন বহু বছর পর মায়ের কাছে ফিরে আসার সুখ, মায়ের কোলে শুয়ে থাকার নির্মল আনন্দ।

~ ফেরা /জেরী যাকোব
২৫/০৫/’১৭



Place your ads here!

Related Articles

তৃতীয়া

বিকেলের দিকে ঝেঁপে এক পশলা বৃষ্টি হ’ল। দুপুরে খাবার পর মরণ ঘুম পেয়েছিল সুমি’র। ঘরে আর কেউ ছিল না। বারান্দার

প্রবাসী বাঙালিদের মানসিক স্বাস্থ্য ! ভেবে দেখেছেন কি ?

আজকাল, সোশ্যাল মিডিয়াতে, বিশেষ করে ফেসবুকে এবং প্রধানত কম বয়সীদের মাঝে “দুঃখবিলাস” নামে একধরনের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে, কেউ

মেলবোর্নের চিঠি – ৪

[মেলবোর্নের চিঠি] যেকোনো ভিসার জন্যে অপেক্ষায় থাকা সময় থেকে ‘ভিসা প্রাপ্তির’ ক্ষণটি ভীষণই অন্যরকম একটা সময়। মুহূর্তেই বদলে যায় প্রেক্ষাপট

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment