Farewell : Mitul Apa

Farewell : Mitul Apa

মনে রবে কিনা রবে আমারে

যতটা সম্ভব, যে কোন ‘বিদায়’ অনুষ্ঠানকে ‘না’ বলার চেষ্টা করি। যেতে চাইনা। ভালো লাগে না। কাউকে বিদায় বলতে ভালো লাগে না। বিদায় দিতেও না। এমনকি নিজে বিদায় নিতেও আমার সহজ বোধ হয় না। জীবনে যতগুলো বিদায় অনুষ্ঠান হয়েছে ‘আমাকে নিয়ে’ প্রায় সবগুলো থেকে রক্ষা পেয়েছি কিছুদিন আগ পর্যন্তও। গত বছরই প্রথম ‘ধরা’ খেলাম। প্রশাসন জানালো আমার অনুরোধ ক্রমেই কোন বিদায় অনুষ্ঠান হবে না এবং আমাকে না জানিয়েই সারপ্রাইজ দেয়া হল। ১৯ বছরের চাকরী বলে কথা! হাসি হাসি মুখে, আবেগ ঘন কথা বলতে ভালো লাগেনি।

মিতুল (সাকিবা রহমান) আপার বিদায় অনুষ্ঠান! ই-মেইল পেলাম। যাব না। রওশন, বাচ্চাদের কিছুই বললাম না। ২৯শে মে, রোববার সকালে জিল্লুর চাচা ফোনে বললেন ‘মানিক তুমি বাচ্চাদের নিয়ে আড়াইটার মধ্যেই চলে এসো’। হায় হায় বলে কি? আমিতো যাবই না। এখন কি করি?! অনেক চিন্তা করলাম। অপশন খুঁজলাম। কোনটাই মনের মতো হল না। ঠিক করলাম যাবো। বাচ্চাদের বললাম রেডি হতে।

মিতুল আপা ক্যানবেরায় ২০ বছরের বেশি সময়। আপার সাথে আমার পরিচয় ১০ বছরের বেশি হবে না। নিখাত শিল্পী মনের এই মানুষটিকে আমি যতটুকু চিনি, সংগীত তার ধ্যান, সংগীত তার জ্ঞান। সংগীত সবকিছু তার। হাজার ব্যস্ততায়ও ‘না’ নেই গানের জন্যে। কি নিজে গাইবেন, কি শেখাবেন। তা যেখানেই হোক, যখনই হোক। আমাদের সবগুলো অনুষ্ঠানেই উনাকে পেয়েছি আমরা সবার আগে। শেষ মুহূর্তে বলেও নিরাশ হইনি কখনো। ক্যানবেরায় এমন কোন সফল সংগীত অনুষ্ঠান ছিল না, যে খানে মিতুল আপা গান গাননি। অন্তত আমি আসার প্রথম ৫/৬ বছর।

প্রিয়অষ্ট্রেলিয়া পুরো পরিবারের সবার পক্ষ থেকে মিতুল আপাকে জানাই বিদায় শুভেচ্ছা। প্রার্থনা করছি, আবার আপনাকে আমাদের মাঝে পাবো, ক্যানবেরায় পাবো, কয়েক বছরের মধ্যেই। ভালো থাকবেন সব সময়। আমাদের সবার দোয়া রইলো, আপনার সাথে, আপনার জন্যে।

হঠাৎ শুনলাম মিতুল আপা ‘স্পন্দন’ নামের একটা গানের দল করেছেন। শুনে খুবই উৎসাহিত হলাম। ‘স্পন্দন’এর ডেবু অনুষ্ঠানে যাবার সৌভাগ্য হল আমার। সত্যি বলতে কি – আমি, আমরা যারা সে দিন উপস্থিত ছিলাম সবাই ‘স্পন্দন’কে এ প্লাস দিয়ে দিলাম। বাংলাদেশের যে কোন উঁচু মানের সঙ্গীত দলের সংগে তুলনা দেয়ার মতো যোগ্যতা আছে এ দলের। হিংসা হচ্ছিলো – ইস কোন ভাবে যদি এ দলের সাথে সংযুক্ত হবে পারতাম! তবে আমার যা গানের গলা!! আমি এ দলে যোগ দিলে – এ দলে আর অন্য কাউকে খোজে পাওয়া যেত কিনা সন্দেহ!!! সন্দেহ না, নিশ্চিত। সে যাই হোক।

দু:খ পেলাম, যখন শুনলাম, আপা আর ‘স্পন্দন’ এ নেই। হাসি হাসি মুখটি, হাসি হাসি ভরাই থাকলো। তার উপর, ভালো লাগলো ‘স্পন্দন’ এর ব্যাপারে উনার পজিটিভ ধ্যান ধারনায়। আসা করছি, মিতুল আপাকে ‘স্পন্দন’ থেকে ফেয়ার ওয়েল দেয়া হবে। সুন্দর একটা বিদায় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। প্রার্থনা এবং অপেক্ষায় থাকলাম।

এবার আসি বাংলা স্কুল থেকে দেয়া ‘ফেয়ার ওয়েল’ মুল প্রসঙ্গে। খুব একটা যে আশা নিয়ে বসেছি, তা বলা ঠিক হবে না। নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে আরম্ভ হল অনুষ্ঠান (যা কিনা ক্যানবেরার জন্যে নিয়মিত ব্যাপার এখন এবং কোন বাঙ্গালী আয়োজকই অংশগ্রহণ কারীদের ‘দেরিতে’ না আসার কৌশল এখনো আয়ত্ত করতে পারেননি) ভাবছিলাম, রবিবার বিকেল (কালকে অফিস) যত তাড়াতাড়ি শেষ হয় ততই ভালো।

বাংলা স্কুলের শিক্ষিকা হাবিবা আহমেদ স্বপ্না এই বিদায় অনুষ্ঠানের পরিচালনায় থাকলেন। সুন্দর সাবলীল ভূমিকার মাধ্যমে আরম্ভ হল অনুষ্ঠান। বক্তব্য রাখলেন বাংলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক জিল্লুর রহমান। শিক্ষকদের পক্ষ থেকে কথা বললেন শিরিন আহমেদ, অভিভাবকদের পক্ষ থেকে এহসান উল্লাহ। সামি, সেঁজুতি, ফারাহ এবং আদিবা বাংলা স্কুলে মিতুল আপাকে নিয়ে তাদের স্মৃতি’র কথা বলল। বাংলা স্কুল, বাংলার প্রতি শিক্ষক, অভিভাবক এবং ছাত্রদের আগ্রহ, সন্দেহ নেই, অন্য ধরনের এক বিশেষ মাত্রা এনে দিল এই ‘ফেয়ার ওয়েল’ অনুষ্ঠানের।

এবার মিতুল আপার ছাত্র/ছাত্রীদের গানের পালা। ষ্টেজে সামি এলো প্রথম, দু’টি গান গেল। কি বলবো? মন ভালো হয়ে গেল। খোলা, উদার, মেজাজি গলা। গানের সব কথার অর্থ সামি’র জানা আছে কিনা জানি না। ভেতর থেকে উঠে আসা গান বোধ হল। সেঁজুতি’র ভাওয়াইয়া গান ছিল – অনবদ্য। আমার পছন্দের প্রিয় গানগুলোর একটি। মনে হল বাংলাদেশে বসে ‘ক্লোজআপ ওয়ানের’ টপ ২০ প্রতিযোগিতা দেখছি। মাহিন এলো, গেয়ে গেল, জয় করে নিলো সবাইকে। খুবই বোল্ড তার গাওয়া। সবাই আরও কিছুক্ষণ গাইলে খারাপ লাগতো না। এদের সবার ব্যাপারে একটি কথা না বললেই নয়। এরা সবাই ভালো বাংলায় কথা বলতে পারে এ দাবি করবো না কিন্তু সব কটা গানের বাংলা উচ্চারণ ছিল নিতান্তই অসাধারণ! জানি না কি ভাবে সম্ভব করেছে তারা। কঠিন চর্চা, একাগ্রতা ছাড়া এ সম্ভব নয় কিছুতেই। এই গানের পাখিদের জন্যে রইলো দোয়া, রইলো একটা বাড়তি ধন্যবাদ। অভিভাবকদের সময়, ত্যাগের কথা নাইবা তুললাম এখন।

এবার লুনা (ভাবীর) গাইবার পালা। কখনো ওনার সলো গান গুনছি, মনে পড়ে না। পর পর চারটি গান গাইলেন। ছিল রবীন্দ্র, নজরুল আর অতুল প্রসাদ। কি আর বলবো, মনে হল ‘এ শুধু গানের দিন’। ঘড়ির দিকে তাকাতে মন চাইলো না আর। চমৎকার গান গাইলেন লুনা।

অনুরোধে ঢেঁকি গিললেন (সামসুল) হুদা ভাই; ষ্টেজে উঠে দরাজ গলায়, গাইলেন উনার ট্রেডমার্ক গান ‘স্কুল খুইলাছেরে মওলা, স্কুল খুইলাছে’। গুরুকে মনে পড়ে গেল। ঢাকার হাসপাতালে, লাইফ সাপোর্টে আছেন এখন। গুরু আজম খানের জন্যে দোয়া রইলো। সুস্থ হয়ে ফিরে আসুন, আবার সবার মাঝে, এ কামনায় থাকলাম।

সবার শেষে এলেন মিতুল আপা। বাংলা স্কুলে তার দীর্ঘ দিনের অনেক স্মৃতির কথা বললেন। অনেক ভালোবাসার কথা বললেন। কথা বলতে গিয়ে সংগত কারণেই আবেগে আপ্লুত হলেন। চারটি গান গাইবেন বললেন, চারটি গানই গাইলেন। এমন মানসিক অবস্থায় গাওয়া, খুব একটা সহজ নয়। তবুও গাইলেন, চমৎকার গাইলেন। শেষে গাইলেন ‘এই কথাটি মনে রেখ – আমি যে গান গেয়েছিলাম’ গাইতে গিয়ে বার বার আবেগে গলা ভিজে আসছিল উনার। পছন্দের কাউকে বিদায় দেয়া – সহজ কাজ নয়। যেমন সহজ নয়, বিদায় নেয়া। কান্না ধরে রাখতে হয়ত আমার মতো অনেকেরই কষ্ট হচ্ছিল তখন।

নারাবান্ডা কলেজে বাংলা অন্তর্ভুক্তির প্রয়োজনীয়তা এবং বাংলা স্কুলের পরবর্তী পরিকল্পনার কথা জানালেন শিক্ষিকা হাবিবা আহমেদ স্বপ্না তার সমাপ্তি বক্তব্যে।

অনুষ্ঠান পরবর্তী চা সহ হালকা খাবারের ব্যবস্হা ছিল। নানান ধরনের। বিশেষ করে ঝাল মুড়ির কথা না বললেই নয়। বলতে গেলে আমার স্কুল জীবনের ঝাল মুড়ির স্বাদ পেয়েছি।

প্রথমেই বলেছি, খুব একটা আশা নিয়ে অনুষ্ঠান দেখতে বসিনি। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, অনুষ্ঠান শেষে, অনেক সুন্দর ভবিষ্যতের বুক ভরা আশা নিয়েই বাসায় ফিরেছি এখন। অন্তত এই ক্যানবেরায়, দু,তিন প্রজন্মে, বাংলা পুরোপুরি মিলিয়ে যাবার কোন সম্ভাবনা নেই। আমি নিশ্চিত।

মায়ের ভাষা বাংলাকে এই প্রবাসে, বর্তমান প্রজন্মের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলে ধরবার জন্যে, ধন্যবাদ বাংলা স্কুলকে। ধন্যবাদ, প্রধান শিক্ষক সহ সকল শিক্ষক শিক্ষিকা, এতে জড়িত সবাইকে, বাংলা স্কুলের পরিচালক মন্ডলিকে। ক্যানবেরায়, আমরা সত্যিই ভাগ্যবান বাংলা স্কুলের মত একটি নিবেদিত প্রাণ প্রতিষ্ঠানকে পেয়ে।

০১ জু ২০১১ । ‘ফেয়ার ওয়েল’ ২৯ মে ২০১১

[লেখাটি ব্যক্তিগত উপলব্ধি মাত্র, কারও প্রতিনিধিত্ব করে লেখা নয়]

PriyoAustralia.com.au

Photo courtesy Ehsan Ullah

2011/pdf/mone_robe_kina_robe_amare_353043770.pdf ( B) 


Place your ads here!

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment