প্রবাসে বারোয়ারী পূজা

প্রবাস জীবনেও শারদীয়া দুর্গাপূজা এখন পর্যন্ত বাংলা ভাষাভাষী মানুষের সবচেয়ে বড় উৎসব হিসেবে প্রতিবছরই পালিত হয়ে আসছে। শারদীয়া দুর্গাপূজার সার্বজনীনতা এখানেও বিদ্যমান রয়েছে। দুর্গাপূজার মৌসুম আসার সাথে সাথেই সকল ধর্মাবলম্বী মানুষদের মধ্যে উৎসবের আমেজ বিরাজ করতে থাকে। কে কবে কোন পূজা দেখতে যাবে। কে কোন পোশাক পরে পূজা দেখতে যাবে এগুলো নিয়ে চলে বিস্তর গবেষণা। সিডনিতে এইবারই সর্বোচ্চ সংখ্যক চৌদ্দ জায়গায় পূজা উৎসব পালিত হচ্ছে তবে যেহেতু পূজার জন্য আলাদা ছুটি নেই তাই সবাই সাধারণত সাপ্তাহিক ছুটির সাথে মিল রেখে এক বা দু’দিনের জন্য পূজা উৎসব পালন করে থাকে। এর বাইরে যেয়ে দু’একটা সংগঠন বাংলাদেশের এবং পশ্চিম বাংলার আদলে একেবারে বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী পূজা উৎসব পালন করে থাকে তন্মধ্যে শঙ্খনাদ অন্যতম। শঙ্খনাদ সিডনিতে সবচেয়ে তরুন সংগঠন বয়সের দিক দিয়ে। তাই তারা বাংলাদেশের এবং পশ্চিম বাংলার পূজার আদলে পুরো পূজা উৎসবটি সাজিয়েছে এবং সত্যিকার অর্থেই তাদের পূজা পাড়ার বারোয়ারী পূজার রুপ নিয়েছিল।

উইকিপিডিয়া বলছে বারোয়ারি বলতে বোঝায় বাঙালি হিন্দুদের সর্বজনীন পূজা বা উৎসব। শব্দটি মূলত পশ্চিমবঙ্গে প্রচলিত। “বারোয়ারি” শব্দটির উৎপত্তি “বারো” (১২) ও “ইয়ার” (বন্ধু) শব্দদুটি থেকে। ১৭৯০ সালে হুগলির গুপ্তিপাড়ায় বারো জন ব্রাহ্মণ বন্ধু একটি সর্বজনীন পূজা করবেন বলে মনস্থ করেন। প্রতিবেশীদের থেকে চাঁদা তুলে আয়োজিত হয় সেই পূজা। এইভাবেই বাংলায় যে সর্বজনীন পূজানুষ্ঠানের সূচনা হয় তা লোকমুখে “বারোয়ারি পূজা” নামে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। প্রথম দিকে, দুর্গাপূজা কেবল কলকাতার ধনী বাবুদের গৃহেই আয়োজিত হত। কিন্তু বারোয়ারি পূজা চালু হওয়ার পর ব্যক্তি উদ্যোগে পূজার সংখ্যা হ্রাস পায় এবং দুর্গাপূজা একটি গণউৎসবে পরিণত হয়। বর্তমান যুগে ‘বারোয়ারি’ শব্দটির পরিবর্তে অনেক ক্ষেত্রেই ‘সর্বজনীন’ বা ‘সার্বজনীন’ শব্দদুটি ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। বাড়ির পূজায় বহিরাগতদের প্রবেশাধিকার থাকলেও এই পূজা মূলত পারিবারিক বা ব্যক্তি উদ্যোগে হয়ে থাকে। কিন্তু বারোয়ারি পূজা পুরোটাই গণ উদ্যোগে চাঁদা তুলে করা হয়। সেই অর্থে শঙ্খনাদের আয়োজন ছিলো একটা সার্থক বারোয়ারী বা সার্বজনীন আয়োজন।

শঙ্খনাদের পূজায় প্রতিদিনই বিভিন্ন ধর্মের শ্রেণী পেশার মানুষের আগমন ছিলো চোখে পড়ার মতো। এর অবশ্য একটা কারণও ছিলো। আর সেটা হলো তাদের আন্তরিক আপ্যায়ন। তাই যেই একবার এসেছে সে পরবর্তীতে পূজা চলাকালীন আরো অনেকবার এসেছে বন্ধু বান্ধবসহ। এভাবেই শঙ্খনাদের পূজা পরিণত হয়েছিলো একটা সার্বজনীন উৎসবে। শঙ্খনাদের প্রত্যেকটা সদস্য তাদের দৈনন্দিন কাজের বাইরে যেয়েও প্রত্যেকটা অতিথির আগমন প্রত্যাগমনের দিকে নজর রেখেছেন। কেউ আসার সাথে সাথেই তাঁকে বা তাঁদেরকে প্রসাদ দিয়ে আপ্যায়ন করেছেন। আর প্রসাদেও ছিলো বৈচিত্রের ছোয়া। একটা প্রসাদ ছিলো একেবারে দেশীয় আদলে যার মধ্যে অনেক রকমের ফল, নারিকেলের নাড়ু, লুচি, সুজির পাশাপাশি ছিলো কলাইয়ের সদ্য গজিয়ে উঠা বীজ। আর ছিলো কলা দিয়ে মাখানো আতপ চালের গুড়া। এটা মুখে দিয়ে যেকেউ তাদের শৈশব কৈশোরের পূজার দিনের প্রসাদ খাওয়ার দিনগুলোতে ফিরে যেতে পারেন মুহুর্তের তরে। এছাড়াও ছিলো খিচুড়ি তাই প্রত্যেককে তাদের রুচি অনুযায়ী প্রসাদ দেয়া সম্ভব হয়েছিল। এছাড়াও পূজায় আগত প্রত্যেককে রাতের খাবার খেয়ে যাওয়ার জন্য বারবার অনুরোধ করা হয়েছিল যারফলে অনেকেই রাতের খাবারটাও শঙ্খনাদ থেকেই খেয়ে এসেছেন।

এইবার আসি তাদের পূজার বর্ণনায়। পূজা মণ্ডপের প্রবেশপথের উপরেই আমের পাতা দিয়ে গেট তৈরি করা হয়েছিল যেটা দুর্গা পূজার হাজার বছরের ঐতিহ্য। এরপর মণ্ডপে ঢুকেই বাম দিকে রাখা ছিলো অভ্যর্থনা টেবিল। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো তারা অভ্যাগতদের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের মতামত চেয়েছিলো আয়োজনের কোন দিকটা আরো ভালো করা যায় বা কোনটা বাদ দেয়া যায় সেই বিষয়ে এবং সেটা জানানোর জন্য টেবিলে রাখা ছিলো সাদা কাগজ ও কলম। আর ছিলো তাদের স্মরণিকা “উন্মেষ”। উন্মেষ নিয়ে কিছু কথা আলাদাভাবে বলা দরকার। বত্রিশ পাতার উন্মেষ ছিলো খুবই বাহারি ডিজাইনের এবং পাতাগুলো খুবই উন্নতমানের কাগজের। আর উন্মেষ সমৃদ্ধ হয়েছিল বিভিন্ন ধরনের লেখকের লেখার মাধ্যমে। তার মধ্যে আবাল বৃদ্ধ বণিতা সবাই ছিলেন। তবে সবচেয়ে লক্ষনীয় ছিলো দুটো বিষয় সেগুলো হলো বড়দের পাশাপাশি শিশুদের লেখা। তারা কে কিভাবে মা দুর্গাকে অনুভব করে তারই বর্ণনা আবার কেউ বা লিখেছে ছোট গল্প। আর দ্বিতীয়টা হলো অন্যান্য ধর্মাবলম্বী মানুষদের লেখা। হিন্দুদের পাশাপাশি অন্যান্য ধর্মাবলম্বী মানুষদের লেখা ছিলো উল্লেখ করার মতো। এরপর রাখা ছিলো ঢাক আর কাসর। বাচ্চা থেকে শুরু করে সবাই মোটামুটি দু’একবার ঢাকে আর কাসরে কাঠি ছুইয়ে সুর তুলেছেন। এরপরই ছিলেন সপরিবারে দুর্গা দেবি। তার ডানপাশেই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য মঞ্চ সাজানো। আর মঞ্চের এবং দুর্গা দেবির সামনের অংশে বিছিয়ে দেয়া হয়েছিল মাদুর। আর তারপরেই রাখা ছিলো অভ্যাগতদের জন্য চেয়ার। একেবারে পাড়ার পূজার আদলে ছোটরা বসেছিল মঞ্চের সামনের মাদুরে আর তার পিছনেই ছিলেন বড়রা।

শঙ্খনাদের সাংস্কৃতিক পরিবেশনার কথা আলাদাভাবে বলা দরকার। তাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের উল্লেখযোগ্য অংশজুড়ে ছিলো নিজেদের পরিবেশনা। কি ছিলো না সেখানে। শিশুদের কবিতা আবৃত্তি, গান, নাচ, পিয়ানো বাজানো সবকিছুতেই শিশুরা তাদের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছে। আর বড়োরা যেটা করেছে এককথায় সেটা ছিলো দুর্দান্ত। গান, কবিতা, নাচ, বারোয়ারি আবৃত্তি আর ছিলো মনোমুগদ্ধকর ফ্যাশন শো। বড়োদের সকল পরিবেশনায় ছোটরা মঞ্চের সামনের মাদুরে বসে উপভোগ করার পাশাপাশি ভবিষ্যতের জন্য পাঠ নিয়েছে। তবে যে বিষয়টার কথা না বললেই নয় সেটা হলো তাদের নিজেদের রচিত নাটিকার মঞ্চায়ন। মোট দুটো নাটিকা মঞ্চায়িত হয়েছিল আর তাতে শিল্পী থেকে শুরু করে কলাকুশলী সবাই ছিলেন আয়োজকদলের সদস্য। হাস্যরসের মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরার পাশাপাশি তার সমাধানের পথও বাতলে দেয়া হচ্ছিলো নাটিকাগুলোতে। দর্শকেরা প্রাণভরে উপভোগ করেছেন নাটকগুলো। আর শেষে মুহুর্মূহু করতালি দিয়ে উৎসাহিত করে গেছেন সবাইকে।

সত্যিকার অর্থেই শঙ্খনাদের পূজা বারোয়ারি বা সার্বজনীন শব্দ দুটির দাবিদার। আর একটা বিষয় লক্ষণীয় তাদের আয়োজন বা পরিবেশনা দেখে বুঝার উপায় ছিলো না যে এটা সবেমাত্র তাদের প্রথম আয়োজন। প্রবাসের এই ব্যস্ত জীবনে এমন আয়োজন করার দুঃসাহস কজনই বা দেখতে পারেন। তাই অভ্যগতরা তাদেরকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন অকুণ্ঠভাবে এবং আশীর্বাদ করে গেছেন ভবিষ্যতে তাদের এমন আয়োজনের ধারাবাহিকতা ধরে রাখার জন্য।





Md Yaqub Ali
আমি মোঃ ইয়াকুব আলী। দাদি নামটা রেখেছিলেন। দাদির প্রজ্ঞা দেখে আমি মুগ্ধ। উনি ঠিকই বুঝেছিলেন যে, এই ছেলে বড় হয়ে বেকুবি করবে তাই এমন নাম রেখেছিলেন হয়তোবা। যাইহোক, আমি একজন ডিগ্রিধারী রাজমিস্ত্রি। উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করতে অস্ট্রেলিয়াতে আমার আগমন ২০১৫ সালের মার্চে। আগে থেকেই ফেসবুকে আঁকিবুকি করতাম। ব্যক্তিজীবনে আমি দুইটা জীবের জনক। একটা হচ্ছে পাখি প্রকৃতির, নাম তার টুনটুনি, বয়স আট বছর। আর একজন হচ্ছে বিচ্ছু শ্রেণীর, নাম হচ্ছে কুদ্দুস, বয়স দুই বছর। গিন্নী ডিগ্রিধারী কবিরাজ। এই নিয়ে আমাদের সংসার। আমি বলি টম এন্ড জেরির সংসার যেখানে একজন মাত্র টম (আমার গিন্নী) আর তিনজন আছে জেরি।
Related Articles
আন্দোলনটা নিজের চারপাশ থেকেই শুরু করুন না কেনো ?
একদল পশু তাদের অপরাধের জন্য কখনোই অনুতপ্ত হয় না, ভি সাইন দেখিয়ে আপনাকে – আমাকে আমাদের সবাইকে কটুক্তি করে –
Justice of the Peace – origin and role
A Justice of the Peace (JP) is essentially an officer appointed by the government (federal or state) to carry out
“নিউক্যাসল বাংলাদেশী প্রিমিয়ার লীগ” এর প্রথম আসর অনুষ্ঠিত
অস্ট্রেলিয়ার নিউক্যাসল এ প্রথম বারের মতো অনুষ্ঠিত হলো ” নিউক্যাসল বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ” ২০১৮ (NBPL 2018). গত ১১ ই নভেম্বর