রুবেলময় বাংলাদেশের বিশ্বকাপ

রুবেলময় বাংলাদেশের বিশ্বকাপ

বিশ্বকাপ মিশন শেষ করে দেশে ফিরে গেছে বাংলাদেশ দল। দেড় মাসের বেশি লম্বা সময়ের সফরে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের শহরে শহরে নানান অভিজ্ঞতা হয়েছে টাইগারদলের। বাংলাদেশ ছাড়ার আগে লক্ষ্য ছিল কোয়ার্টার ফাইন্যালের খেলা। সে লক্ষ্য পূরন হয়েছে। স্বপ্ন সৃষ্টি হয়েছিল সেমি ফাইনালের। মেলবোর্নে ভারতের বিরুদ্ধে কোয়ার্টার ফাইন্যালে আম্পায়ারদের বিতর্কিত সিদ্ধান্তে সে স্বপ্ন হোঁচট খাবার পর টিম বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছে গোটা দেশ এবং সারা পৃথিবীর নানা প্রান্তে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা। এ নিয়ে বিশ্ব ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসির সঙ্গে যে বিরোধের সৃষ্টি হয়েছে এর জল শেষ পর্যন্ত কোথায় পর্যন্ত গড়াবে তা কেউ জানেনা।

জানুয়ারির শেষভাগে অস্ট্রেলিয়ার কন্ডিশনে খাপ খাওয়াতে দল যখন ব্রিসবেন আসে, প্রথম দিনগুলোর অভিজ্ঞতা সুখকর ছিলোনা। প্রথমে ব্রিসবেনে অস্ট্রেলিয়া একাদশের বিরুদ্ধে দুটি ও পরে সিডনির ব্ল্যাকটাউনে পাকিস্তান-আয়ারল্যান্ডের বিরুদ্ধে গা-গরমের মোট চারটি ম্যাচেই বাংলাদেশ হেরেছে। বিশ্বকাপ শুরুর আগ মূহুর্তে মাশরাফি বিন মুর্তজাকে অধিনায়ক করাতে দলের ঐক্য সংঘদ্ধ হতে পেরেছে কীনা সে প্রশ্ন-বিতর্কও ওঠে। কিন্তু ক্যানবেরায় প্রথম খেলায় আফগানিস্তানকে হারানোর পর চাপা পড়ে সে বিতর্ক। দ্বিতীয় ম্যাচ ছিল ব্রিসবেনে অন্যতম স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে। বৃষ্টির কারনে ম্যাচটি হতে না পারায় ভাগাভাগিতে একটি পয়েন্ট পেয়ে যায় বাংলাদেশ। কিন্তু ব্রিসবেনে দলকে বিব্রত-ক্ষতবিক্ষত করে অন্য আরেক ঘটনা। দলীয় শৃংখলাভঙ্গের অভিযোগে দেশে ফেরত পাঠানো হয় কোন ম্যাচ না খেলা পেসার আল আমিনকে। মিডিয়ার রিপোর্টের অভিযোগে বলা হয় অনুমতিবিহীন রাত দশটার বেশি হোটেলের বাইরে ছিলেন তরুন এই পেসার। সন্দেহজনক চলাফেরার জন্য আল আমিনকে অনুসরন-সন্দেহ করছিল আকসু। পুরো বিষয়টি এখনো ধোয়াশাচ্ছন্ন! কারন এখনও অফিসিয়েলি কিছু বলেনি আকসু। আল আমিনের বদলে দেশ থেকে উড়িয়ে আনা হয় শফিউলকে। কিন্তু বিশ্বকাপের কোন খেলায় তাকে খেলানো হয়নি।

আফগানিস্তানের পর নেলসনে স্কটল্যান্ডের বিরুদ্ধে প্রত্যাশিত জয় পায় বাংলাদেশ। কিন্তু সে খেলায় ইনজুরিতে পড়ে বিশ্বকাপ শেষ হয়ে যায় দলের নিয়মিত ওপেনার এনামুল হক বিজয়ের। এনামুলের জায়গায় দেশ থেকে আসেন ইমরুল কায়েস। বিশ্বকাপে ব্যাট হাসেনি তার। আরেক ওপেনার তামিম ইকবাল শুধু স্কটল্যান্ডের বিরুদ্ধে ৯৫ রানের একটি বড় ইনিংস খেলেছেন। ভারতের বিরুদ্ধে কোয়ার্টার ফাইনালে তামিম আবার ঝলসে উঠবেন মনে করা হচ্ছিল। হয়নি। উল্টো বিশ্বকাপে এসে ঝলসে উঠেছেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। এডিলেইডে আর হ্যামিল্টনে পরপর দুটি সেঞ্চুরি হাঁকান বাংলাদেশের এই অলরাউন্ডার। এরমাঝে এডিলেইডের সেঞ্চুরিটি নিজের ওয়ানডে ক্যারিয়ারেরও প্রথম সেঞ্চুরি রিয়াদের। ভারতের বিরুদ্ধে কোয়ার্টার ফাইন্যালেও জ্বলে উঠছিলেন রিয়াদ। আম্পায়ারের বিতর্কিত এক সিদ্ধান্ত তাকে থামিয়ে দেয়।

রিয়াদ ছাড়াও দলের কিপার মুশফিক পুরো বিশ্বকাপ মিশনে ধারাবাহিক ভালো খেলেছেন। প্রথম বিশ্বকাপ খেলতে আসা সৌম্য সরকার আর সাব্বিরও তাদের জাত চিনিয়েছেন। এই দুই তারুন্যের সাফল্য বিশ্বকাপ মিশনে বাংলাদেশের অন্যতম বিশেষ অর্জন। দলের অন্যতম প্রধান শক্তি অন্যতম বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। পুরো বিশ্বকাপ মিশন জুড়ে ব্যাট-বল হাতে তার ভূমিকা পালন করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সাকিব কী স্বমহিমায় সঠিক জ্বলে উঠতে পেরেছেন? মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। হ্যামিল্টনে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ম্যাচে মাশরাফিকে বিশ্রাম দিয়ে সাকিবকে অধিনায়ক করা হয়। তার অধিনায়কত্বে ম্যাচটির জয় কেন কী কারনে হাতছাড়া হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিসিবির সভাপতি নাজমুল হাসানও বলেছেন ওই ম্যাচটি আমরা জিততে ছিলাম। ওই অবস্থায় কেন হেরে গেলাম তা খতিয়ে দেখা হবে।

বাংলাদেশের বোলিং আক্রমনকে মোটামুটি স্পিন নির্ভর বলা মনে করা হয়। কিন্তু অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের কন্ডিশনে স্পিনাররা বিশেষ সুবিধা পাননি। ওই অবস্থায় পেস আক্রমনে জ্বলে ওঠেন মাশরাফি-রুবেল-তাসকিন ত্রয়ী। বিশেষ করে অনেক কিছুতে রুবেলময় হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের গোটা বিশ্বকাপ মিশন! বিশ্বকাপের আগে দেশে বিতর্কিত এক ঘটনায় জেলে যাওয়া রুবেলের বিশ্বকাপ মিশনই অনিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। তার জামিনের সময়ও বিশ্বকাপের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের খেলাগুলোয় জান দিয়ে খেলে সেই আস্থার দাম দিয়েছেন রুবেল। এডিলেইডে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধ তার পর পর নেয়া দুই উইকেটের কথা বাংলাদেশ ক্রিকেটের ভক্তরা অনেক দিন মনে রাখবেন। বাংলাদেশ বিশ্বকাপ মিশনে বড় যে দলটিকে হারানোর টার্গেট নিয়ে আসে সেখানে পয়লা নম্বরে ইংল্যান্ডের নাম ছিল। শেষ মূহুর্তে ইংলিশদের দিকে ঝুঁকে পড়া ম্যাচটি যেন সেই সময়ে রুবেলই জিতেছেন! সেই খেলায় বিশ্বকাপ থেকে ইংলিশদের বিদায় আর বাংলাদেশের কোয়ার্টার ফাইন্যাল নিশ্চিত হয়। ভারতের বিরুদ্ধে কোয়ার্টার ফাইন্যালে রোহিত শর্মার উইকেটটি বিতর্কিত ‘নো’ বলে রুবেলকে বঞ্চিত করেন আম্পায়ার। ওই ঘটনা দেশের মানুষের মনে রুবেলের জন্যে আরও সহানুভূতি এনে দিয়েছে। বিসিবির সভাপতি এসবের প্রতিদান দিতে গিয়ে বলেছেন, এবারের বিশ্বকাপে তার দেখা সেরা পেসারদের অন্যতম নামটি রুবেলের।

এবারে বাংলাদেশ বিশ্বকাপে আরেকটি চনমনে নাম নাসির হোসেন। খুব বেশি খেলার সুযোগ তিনি পাননি। কিন্তু বল-ব্যাট হতে তাকে যখন যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে সেটিই তিনি সঠিকভাবে পালন করেছেন। জ্বলে উঠতে পারেননি আরাফাত সানি, তাইজুল। কন্ডিশনের কথা মাথায় রেখে তাদেরকে সুযোগও বেশি দেয়া হয়নি। ঢাকা ছাড়ার আগে তরুন তাসকিন বলে গিয়েছিলেন বিশ্বকাপের টপ টেন উইকেট টেকার হওয়া তার স্বপ্ন। তাসকিন পুরো বিশ্বকাপ জুড়ে আলো ছড়িয়েছেন নিজের। এক ভারতের বিরুদ্ধের ম্যাচেই পেয়েছেন তিন উইকেট। রানটা তার বেশি দেয়া হয়েছে ঠিক। কিন্তু এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ভূমিকা-অর্জন লিখতে কোথাও বাদ দেয়া যাবেনা তাসকিনের নাম। এবং সবশেষে অথবা সবার আগে যার ভূমিকা সমুজ্জ্বল স্বমহিমায় তিনি অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা। দীর্ঘদিন ধরে ইনজুরির সঙ্গে লড়াই করে চলা মাশরাফির নেতৃত্ব, মাঠে দেশের জন্যে জানপ্রান দিয়ে লড়াই করা এসব খুবই প্রশংসিত হয়েছে। নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ম্যাচে তাকে বিশ্রাম দেয়া হয়েছিল। সবাই সেদিন টের পেয়েছেন মাশরাফির অনুপস্থিতি। অনেককে বলতে শোনা গেছে মাশরাফি থাকলে আজও দল জিততো। মেলবোর্নে প্রবাসীদের সম্বর্ধনায় মাশরাফি বলেছেন, পায়ের অপারেশনের জন্যে এখানে বারবার এসে খুঁড়িয়ে হেঁটেছি। এবার এদেশ মাথা উঁচু করে খেলে গেলাম। তার প্রাণের কথাগুলো স্পর্শ করেছে সবার হূদয়। সেখানে অনেকেই বলেছেন এই লড়াকু বাংলাদেশ দলটাকে ধরে রাখতে আগামি অন্তত এক বছর যেন ওয়ানডে অধিনায়কত্ব মাশরাফির হাতে থাকে। গুডলাক টু ম্যাশ এন্ড ইউর টিম মেটস। আওর প্রাউড।


Place your ads here!

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment