নেলসনে লাল সবুজ পতাকা
ঢাকার টিয়াস-সামিনা দম্পতি খেলা দেখতে এখন অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড ঘুরছেন। মেলবোর্নের এমসিজিতে শ্রীলংকার সঙ্গে খেলাটা দেখতে গিয়ে দল হেরে যাওয়ায় মন খারাপ হয়েছিল। নিউজিল্যান্ড এসে একটা গাড়ি ভাড়া করেন। সেটিতে করে চলে আসেন নেলসনে। বৃহস্পতিবার খেলার মাঠে দলের বিজয় মূহুর্তে তারা আনন্দ আড়াল করে রাখতে পারেন না। টিয়াস বলেন, দল হারলে মনে হয় জীবনটা ষোল আনাই মিছে। আজ মনে হচ্ছে উসুল ষোল আনাই! বৃহস্পতিবার নেলসনের স্যাক্সটন ওভালে উপস্থিত বাংলাদেশি দর্শকদের সবারই যেন মনের কথা ফুটে উঠেছে এই দম্পতির কথায়।
স্যাক্সটন ওভালে উপস্থিত প্রবাসী বাংলাদেশিদের বেশিরভাগ এসেছেন ক্রাইস্টচার্চ থেকে। এদের বেশিরভাগ ভূমিকম্পে বিধবস্ত শহরটার নির্মান শ্রমিক। এক রকম পাত্তা না দেয়া স্কটল্যান্ড দল যখন দাপটে ৩১৮ রান করে ফেললো তখন তাদের অনেকে টস জিতে আগে ব্যাট না নেয়ায় মাশরাফিকে দুষছিলেন। কিন্তু মজার ব্যাপার এদের কারোরই মনে হয়নি যে দল হারবে। বেশ ক্রিকেট বোদ্ধার মতোই বলছিলেন, মাঠটা ছোট। একটু বুঝে শুনে মারলে সহজে চার-ছয় করাটা কোন ব্যাপারইনা। ক্রাইস্ট চার্চ থেকে আসা আমিনুল বলছিলেন, সৌম্য একাই চারটা ক্যাচ নেবার পর মনে হচ্ছিল, আজ দিনটা সৌম্য’র। সে নিশ্চয় সেঞ্চুরি করে ফেলবে। সৌম্য আউট হবার পর এই আমিনুলের চোখেমুখেই দেখা মেলে দুশ্চিন্তার কালো মেঘ! কিন্তু তামিম-মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ জুটি দাঁড়িয়ে যাওয়াতে এই মুখগুলো আবার উজ্জ্বল হতে শুরু করে। বৃহস্পতিবারের নেলসনের আকাশও ছিলো অনেক রোদেলা উজ্জ্বল। তামিম, রিয়াদ, মুশফিক, সাকিব, সাব্বির কেনা উজ্জ্বল দাপট দেখিয়েছেন বৃহস্পতিবার! ২৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রার সঙ্গে স্কটিশ রানের পাহাড়েও পারদ ছড়িয়েছে! ওয়ানডে আর বিশ্বকাপ ইতিহাসের নিজেদের সবকটি রেকর্ডও ভেঙ্গেছে স্কটিশরা। কিন্তু এরপরও দলের প্রতি বড় আস্থায় গ্যালারির দর্শকদের এতটুকু হতাশ-হতদ্যম মনে হয়নি। গ্যালারির সবার আস্থা ছিল ব্যাটসম্যানদের ওপর। ফিল্ডিং’এর সময় তামিমকে কেউ কেউ ফার্মের মুরগি বলেও কটাক্ষ করছিলেন। আবার তামিম ব্যাট হাতে নেবার পর এদের অনেকে বলছিলেন, ভাতিজারে তুই আজ অন্তত একটা লম্বা ইনিংস খেলে দেখা। পাঁচটি রানের জন্যে তামিম যখন সেঞ্চুরি করতে পারলেন না, তখন তাদেরকে ইশ-উফ-আহ প্রতিক্রিয়া দেখাতে দেখা গেছে।
স্যাক্সটন ওভালের দুই প্রান্তের দুই অংশে বসে ছিলেন বাংলাদেশ সমর্থকরা। গ্যালারির বাকি অংশের বেশিরভাগ এলাকাজুড়ে ছিলেন নেলসনবাসী স্কটিশ দলের সমর্থকরা। এসব স্কটিশ সমর্থকদের আশেপাশে ছিল শুধু বিয়ারের বোতল আর বোতল! ক্রিকেটের সঙ্গে এদের বিয়ার এমন ওতোপ্রোতো জড়িত! কিন্তু গ্যালারিতে অবাক করার মতো নেলসনবাসী বিস্তর সংখ্যক বাংলাদেশ সমর্থক সাদা চামড়ার ছোট ছেলেমেয়ে, বয়স্করাও ছিল। এদের অনেকে কাগজে হাতে বানানো বাংলাদেশ দলের পতাকাও ছিল! এমন এক স্কুল পড়ুয়া মাইকেলকে বাংলাদেশকে সমর্থনের কারন জিজ্ঞেস করলে বলেছে, বাংলাদেশ ওসাম। এরপর আবার বলেছে টিভিতে সে দেখেছে অস্ট্রেলিয়ার বিগব্যাশ লীগে সাকিব আল হাসানের খেলা! এরপর থেকে সে সাকিবের ভক্ত। সাকিবের কারনে সে বাংলাদেশ দলকে সমর্থন করতে এসেছে।
ক্রিকেট মাঠে গ্যালারিতে যারা সেজেগুজে, বাঘের পুতুল নিয়ে আসেন তাদের অনেকের টার্গেট থাকে টিভি ক্যামেরার দৃষ্টি আকর্ষন! বৃহস্পতিবার যেহেতু বাংলাদেশ দলের সমর্থক দর্শক কম ছিলো সে কারনে একই লোকজনকেই একাধিকবার দেখিয়েছে! কাকে কতবার দেখানো হয়েছে সেটিও ছিলো আলোচনা-গবেষনার বিষয়! ‘তুমি কে আমি কে বাঙ্গালি বাঙ্গালি, তোমার দেশ আমার দেশ বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ বলে বিদেশের মাটিতে যখন বসে প্রবাসীরা শ্লোগান দেয়, আর বিশাল পতাকা মাথায় নিয়ে মিছিল করে, নেলসনবাসী ভিড় করে মোবাইল ফোনে তাদের ছবি তুলেছে আর হাত উচিয়ে চীয়ার্স করে শুধু বলেছে, বাংলাদেশ ওসাম।
নেলসনের গ্যালারিতে একের পর বাংলাদেশের নানা গানও চলেছে। যে যা গান জানে, তাই। ‘গ্রামের মানুষ হিন্দু মুসলমান আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’ বলে যখন প্রবাসী ছেলেমেয়েরা নাচছে দুলছে তখন এক বিদেশিনী এই গানের কথাগুলোর অর্থ জানতেন চাইলেন। তাকে বলা হয়, এর ভাবার্থটা হলো আমরা সেক্যুলার, আমরা সব ধর্মের মানুষ মিলে মিশে থাকতে পছন্দ করি। সেই বিদেশিনীর তখন প্রতিক্রিয়া ছিল, ওয়াও! বাংলাদেশ ওসাম! ক্রিকেট এমনই নানান ব্যঞ্জনায় দেশকে তুলে ধরছে বিদেশের মাটিতে। মুশফিকের বাবা, দুই চাচাও বৃহস্পতিবার নেলসনের দর্শক গ্যালাতিতে বসে খেলা দেখেছেন। আপনারাও এসেছেন বলে বাংলাদেশ জিতেছে বললে আরও উজ্জ্বল হয় মুশফিকের বাবার মুখ। খেলা শেষে মিছিল করে ফিরে যাচ্ছিলেন ক্রাইস্টচার্চের প্রবাসীরা। বিদায় নেবার আগে তাদের অনেকে জড়িয়ে ধরে বলছিলেন, ভাই সব কষ্ট ভুলে গেছি। পয়সা উসুল। কারন আমাদের দল যে জিতেছে।