পৃথিবীর পথে পথে, সেই পথ যেন না শেষ হয় (পর্ব ২)

পৃথিবীর পথে পথে, সেই পথ যেন না শেষ হয় (পর্ব ২)

সেই ছোটবেলায় প্রাইমারীতে পড়ার সময় একবার স্কুল পালিয়েছিলাম- ক্লাশে এসে ডাক্তার টিকা দিবে- সে কথা শুনে। মাধ্যমিক স্কুলে বার কয়েক স্কুল পালিয়ে, অবশেষে ভর্তি হলাম কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে; অনেকে সেটাকে আবার ডাকেন নটর ডেম কলেজ নামে। সেখানটাতে পালানো শব্দটাই ভুলিয়ে দিলো। আর, বিশ্ববিদ্যালয়েতো পালানো দূরে থাক, ক্লাশ হওয়াটাই ছিলো বিরাট এক সৌভাগ্যের ব্যাপার। তারপর কত পূর্ণিমা অমাবস্যা চলে গেলো, পড়াশোনার দিন ফুরিয়ে অফিসে এলো, আর সাথে সাথে হারিয়ে গেলো পালিয়ে যাওয়ার দিনগুলি। তবুও, এই ব্যস্ত বর্তমানে, কেমন করে যেন একদিন হঠাৎ করে পেয়ে গেলাম অফিস পালানোর সুযোগ।

শুক্রবারের দুপুর, আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সহপাঠী “প্রতীক” ফোন দিয়ে বললো- “অফিস থেকে বের হতে পারবি?” আমি বলি, “কেন?” সে বলে, “পাহাড়ের দিকে যাবো”। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা একসাথে পড়াশোনা করেছিলাম। সে মাইক্রোসফটে কাজ করছে বেশ কয়েক বছর ধরে; বাংলাদেশ থেকে সরাসরি মাইক্রোসফটে নিয়োগ পাওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম স্টুডেন্ট। আমি মাইক্রোসফটে সামার ইন্টার্নশিপ করছি, মাত্র দেড় মাস হলো। তার জন্য অফিস থেকে বের হয়ে যাওয়া যতটা সহজ, আমার জন্য ততটা সহজ নয়। পাখা গজানোর জন্য দেড় মাস সময় যথেষ্ট নয়। কিন্তু, সবুজ-ধূসর পাহাড়ের হাতছানি উপেক্ষা করে অফিস করার মত বাস্তববাদী এখনো হয়ে উঠতে পারিনি। তাই, অনেক বছরের পুরোনো অভ্যাসের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে শুরু করলাম অফিস পালানোর আয়োজন।

ছবিঃ এই পথ যদি না শেষ হয়…

আমাদের গন্তব্য মাউন্ট সেইন্ট হেলেনস্। যাত্রা শুরুর কিছুক্ষণ পরেই, আকাশের সর্বশেষ কোণটিতে তাকিয়ে প্রতীক বলে, দেখতো, “ওই যে পশ্চিমের কোণে, সেখানে কি মেঘ দেখা যায়।” আমি বলি, “কিছুটা মেঘ আছে।” সে মিনমিন করে কি সব হিসেব করে বলে, “এই মেঘটা আমরা পাহাড়ে যেতে যেতে সেখানে পৌঁছে যাবে। অতএব, আজকে যাওয়ার জন্য ভালো দিন না।” আমি মনে মনে ভাবি, “কাবিল ব্যাটা বলে কি! পাহাড় এখনো শত মাইল দূরে, এখান থেকে মেঘ দেখেই সে বুঝছে, আজকে যাওয়ার জন্য ভালো দিন না।” রাস্তার পাশের কোনো দোকানে গাড়ী থামিয়ে আমাদের খাওয়ার কথা। সে বলে, “যে পরিমাণ আলো আছে, তাতে আমাদের রাস্তায় খাওয়া যাবে না। তাহলে বিকালের সূর্যাস্তের সময়ের ছবি তুলতে পারবো না ক্যামেরায়।” এবার মনে মনে বলি, “ব্যাটা কাবিলের কাবিল, তুই ছবি তোলার কি বুঝিস! ভারী ভারী কয়েকটা লেন্স ব্যাগে নিয়ে ঘুরলেই বুঝি মানুষ ফটোগ্রাফার হয়ে যায়।”
যাত্রাপথে একটা ভিজিটর সেন্টারে গাড়ী থামানো হলো। সেই সঙ্গে তার বিশেষজ্ঞসুলভ মতামত সহ্য করার হাত থেকেও বাঁচা গেল। ভিজিটর সেন্টারে থাকা বোর্ডে সেইন্ট হেলেনস্ যাবার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দেয়া আছে। বোর্ডে চোখ বুলিয়ে সেগুলো দেখে নিলাম। সেখানে মাউন্ট সেইন্ট হেলেনস্ এর ছবিও দেয়া আছে। চমৎকার সেই ছবি দেখে যে কারোরই লোভ হবে সে জায়গায় চলে যেতে। ছবি দেখে মুগ্ধ হতে না হতেই অবাক হবার পালা। ছবির ঠিক নীচ দিয়ে স্পষ্ট করে লেখা- Photo By: Protik Mohammed Hossain। ততক্ষণে, আমার হুঁশ হলো, আমার সাথের কাবিলতো দেখি আসলেও কাবিল।
তার তোলা ছবি এখানে এলো কি করে জিজ্ঞেস করতেই সে ব্যাখ্যা করলো, কিছুদিন আগে কর্তৃপক্ষ তার ছবি ব্যবহার করার অনুমতি চেয়ে যোগাযোগ করে। সে সানন্দে অনুমতি প্রদান করে এবং বর্তমানে বেশ কয়েকটি ভিজিটর সেন্টারে তার ছবি ব্যবহার হচ্ছে। কিন্তু, তাতে কি! তাই বলে কি একশো মাইল দূর থেকে সে মেঘ দেখে বলবে, এ মেঘের কারণে ঠিক মতো সেইন্ট হেলেনস্ দেখতে পারবো না, আর আমি বুঝি সেটা মেনে নেব! তাছাড়া, আজকালকার এই ইন্টারনেটের যুগে কার ঠেকা পড়েছে বোর্ডে টাঙ্গানো তার এই ছবি দেখবে। যাদের দরকার তারা ইন্টারনেটে গিয়ে ব্রাউজ করে দেখবে। কিন্তু, সে পথেও খুব একটা সুবিধা হলো না। তথ্য খুঁজতে সেখানে গিয়েও দেখা গেলো, হোমপেইজে দেয়া আছে মাউন্ট সেইন্ট হেলেনস্ এর ছবি, আর ডান কোণে ছোট্ট করে লেখা Protik M. Hossain। ততক্ষণে আমার বুঝা হয়ে গেছে, ভালো লোকের পাল্লাতেই পড়েছি। আজকে আর সেইন্ট হেলেনসের নাড়ী-নক্ষত্র না দেখে বাড়ী ফেরা হচ্ছে না।
ছবিঃ পাহাড় চূড়া থেকে নেয়া সূর্যাস্ত

মাউন্ট সেইন্ট হেলেনস্। কুখ্যাতির মাধ্যমে বিখ্যাত হয়ে উঠা এক সক্রিয় আগ্নেয়গিরির নাম। ১৯৮০ সালের ১৮ই মে ক্যাসকেইড মাউন্টেইন রেঞ্জের অন্তর্ভূক্ত এই পর্বতের অগ্নুৎপাত এবং তার ফলে সৃষ্ট ধ্বংসযজ্ঞ আমেরিকার অগ্নুৎপাতের ইতিহাসে আজও সবচেয়ে ভয়াবহ এক অধ্যায় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে। সকাল ৮টা ৩২ মিনিটে ঘটে যাওয়া সেই তান্ডবলীলায়, সেদিন মৃত্যু হয়েছিলো ৫৭ জন মানুষের, ধবংস হয়েছিলো ৪৭টি ব্রিজ এবং নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো তিনশো কিলোমিটার রাস্তা। বিস্ফোরণের ফলে চূড়া উড়ে গিয়ে সেখানে সৃষ্টি হয়েছিলো দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ গহবরের। আজও যখন মাউন্ট সেইন্ট হেলেনসে্র পথ ধরে যাওয়া হয়, লাইনের পর লাইন ধরে উঁচু উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় শুধু দেখতে পাওয়া যায় পড়ে থাকা মৃত গাছের সারি। অগ্নুৎপাতের তীব্রতায় সেদিন পাহাড়ের গায়েই সমাধি ঘটে এই সমস্ত হাজার হাজার বৃক্ষরাজির।
ছবিঃ পাহাড়ের গায়ে গায়ে অগ্নুৎপাতের নিদর্শন, ধ্বংস হয়ে যাওয়া গাছের ধ্বংসাবশেষ

কিন্তু, প্রকৃতির চেয়ে বড় যোদ্ধা আর নেই। কালের বিবর্তনে প্রকৃতি ঠিকই আবার সব কিছু সাজিয়ে নেয় নিজের মত করে। পাহাড়ের গায়ে আবার তৈরী হতে শুরু করেছে সবুজ বৃক্ষের বন। যে পর্বত গর্ভে ধারণ করে আছে লেলিহান আগুণের আকরিক, সেই পর্বতের গায়েই আবার প্রতিবছর ফুটতে শুরু করেছে আছে লাল-গোলাপী, আসমানী-নীল ফুল; ক্ষুধার্ত পাখি এসে নিয়ে যাচ্ছে সে ফুলের মধু।
বিকালের পর্বতে ছুটোছুটি করে অপেক্ষা করতে থাকলাম পার্বত্য রজনীর জন্য। সমতল থেকে কয়েক হাজার ফুট উপরে আমাদের ক্যাম্প। ক্যাম্প মানে গাড়ী। আমাদের পার্কিংয়ের জায়গায় আরো দু-তিনটে গাড়ী আছে। তারাও আমাদের মত পার্বত্য রাত্রির রূপ দেখতে এসেছে। এখানে সূর্যের আলো নিভে গিয়ে পুরোপুরি সন্ধ্যা নামতে নয়টার উপর বেজে যায়। সন্ধ্যা হতে না হতেই চারপাশ থেকে মেঘ এসে ঘিরে ফেলে আমাদের। দশহাত দূরের মানুষটিকেও দেখা যাচ্ছে না আর।
ছবিঃ মেঘ আরা পাহাড়, কে কার উপরে থাকবে সে প্রতিযোগিতা চলছেই

ছবিঃ আমাদের রান্নার আয়োজন

চারপাশে শহরের কটকটে আলো নেই, শহুরে কোলাহল নেই। গাড়ীতে বসেই আমাদের অপেক্ষা করতে থাকা এবং সেভাবেই কিছুক্ষণের জন্য ঘুমিয়ে নেয়া। রাত একটার সময় যখন ঘুম ভেঙ্গে, কাঁথা গায়ে বের হলাম, তখন রাতের আকাশে গঙ্গার মত বয়ে চলছে ফুটফুটে আকাশগঙ্গা- আমাদের মিল্কিওয়ে, আমাদের আপন ছায়াপথ। সামনে গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাথাভাঙ্গা মাউন্ট সেইন্ট হেলেনস্। সেইন্ট হেলেনসের একেবারে চূড়ার উপর সেজে থাকা ছায়াপথে অগণিত তারারা যেন মিছিল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে, আলোর মিছিল। অপার্থিব সে দৃশ্য।
ছবিঃ মেঘ পাহাড়ের লুকোচুরির গল্প

কিন্তু, কে জানতো, সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পর্বতের থেকে মুখ ঘুরিয়ে পেছনে তাকালেই দেখা যাবে প্রকৃতির আরেক লীলাখেলা- নর্দার্ন লাইটস্; কেই-বা জানতো, আকাশগঙ্গার আলোর মিছিলে এসে যোগ হবে অরোরার সেই আলোর নাচন। প্রথমে যখন সবুজাভ আলো পাহাড়ের অপর পাশে মৃদুমন্দ দ্যুতি ছড়াতে শুরু করলো, মনে হয়েছিলো এই বুঝি মেঘের আস্তরণ ভেদ করে কোনো শহরের আলো এসে পৌঁছে গেছে পাহাড়ের গায়ে। কিন্তু, ক্রমেই সে আলোর দ্যুতি যখন তার আপন মহিমায় স্বর্গীয় হয়ে উঠেলো, বুঝতে বাকী থাকলো না- সে আলো জাগতিক নয়, মহাজগতিক।
নর্দার্ন লাইটস্ এর ছবি আমার মিস হয়ে গেলেও, ক্রিস্টিনার কিন্তু মিস হয়নি। তার তোলা ছবিটিই দিলাম।

জীবনের যে সমস্ত অনুভূতির অনুশীলন কখনো হয়নি, তার মধ্যে এই অরোরা বা মেরুজ্যোতি তথা নর্দার্ন লাইটস্ দেখবার অনুভূতি একটি। কথা ছিলো সেটা না দেখে নিশ্চিন্তে মরতেও পারবো না। কিন্তু, কথা ছিলো না, এই সেইন্ট হেলেনসের কোলে বসেই দেখতে পাবো সে আলোকিত সুখরশ্মি। এই অঞ্চল থেকে নর্দার্ন লাইটস্ খুব একটা দেখা যায় না; কিন্তু, অফিস পালানো অতিথির মনের কথা বুঝতে পেরেই হয়তো সেইন্ট হেলেনস্ নিজ থেকেই আমন্ত্রণ জানিয়েছিলো আরোরার আলোর কণাকে।
প্রকৃতির সে অনিন্দ্য আয়োজন দেখে কিছুক্ষণের জন্য গাড়ীতে ফিরে গেলাম। খানিক পরেই ফিরে এসে দেখি অন্য রূপ। মনে হলো- “কত রঙ্গ জানো রে পাহাড়, কত তোমার রূপ / রূপ দেখিয়ে করে পাগল, থাকতে কও চুপ।” সব আলো যখন একযোগে তাদের প্রদর্শনীর মেলা বসিয়েছে, চাঁদেরই বা আর তখন তর সইবে কেন! এবারে দশ দিগন্ত ভাসিয়ে দিয়ে চাঁদ উঠলো।
.
ওদিকে, সেইন্ট হেলেনসকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরেছে দুধের মত ঘন সাদা মেঘ। সে মেঘের উপর চাঁদের আলো প্রতিফলিত হয়ে এসে আঘাত করছে স্বপ্নভূকদের স্বপ্নীল চোখে। মেঘের নীচ থেকে আবার ভেসে আসছে পাহাড়ের বরফ গলে নেমে আসা ঝর্ণার কলধ্বণি। আর কোনো শব্দ নেই, আর কোনো আয়োজন নেই। সব আয়োজন কেবলই প্রকৃতির।
না, শেষের রাত্রিতে আর সম্ভব হলো না ঘুমোতে যাবার। ভোরের সূর্য উঠার অপেক্ষায় থেকে, সেইন্ট হেলেনসের দিকে চেয়ে থেকেই কাটিয়ে দিলাম রাত্রি শেষের প্রহর। এক সময় কোমল চাঁদের আলো স্তিমিত হয়ে গিয়ে শক্তিমান সূর্য এলো। দিনের প্রথম রশ্মি এসে পরশ বুলিয়ে গেলো পর্বত শিখরে। আলোয় আলোকিত হলো সেইন্ট হেলেনস্। বাকী থাকলো সেই অনিন্দ্যলোককে বিদায় জানিয়ে আমাদের ফিরে আসার আয়োজন।

ছবিঃ ওয়াক ইন দ্যা ক্লাউডস্
আশ্চর্য রকমের সুন্দর আমাদের এই পৃথিবী। এত এত রহস্য ধারণ করে থাকা সেই বসুন্ধরা পৃথিবী এখনো পর্যন্ত নিজের সম্পর্কে খুব কমই জানতে দিয়েছে আমাদের; কিন্তু, যেটুকু জানতে দিয়েছে, যেটুকু সৌন্দর্য নিজ থেকেই সে তুলে ধরেছে, সেটুকু ধারণ করার ক্ষমতাও হয়তো আমাদের নেই। সেই সৌন্দর্যের শুধুমাত্র সূচীপত্রে চোখ বুলাতে হলেও, একজীবন খুব অল্প সময়। সহস্র জীবন দিয়ে যদি বলা হতো, কোন গ্রহে ফিরে যেতে চাও; তাহলে, সহস্রবারই ফিরে ফিরে আসতাম রূপসী পৃথিবীতে, প্রিয় বসুন্ধরায়।

Place your ads here!

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment