তরুণ আলোকচিত্রী এবং লেখক সাদাত হোসাইন এর একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘বোধ'
হুট করেই শর্ট ফিল্মটি তৈরি। আমার প্রথম কাজ। শর্টফিল্মের ‘শ’-ও জানি না বলে বুকভরতি শংকা আর দ্বিধা। কি বানাতে কি বানিয়ে ফেলি! তারপরও ভাবলাম, শখের তোলা আশি টাকা। একটা শখ যখন করেছি, সাধ্যের মধ্যে থাকলে দোষ কি?
সেই সাধ্য কে ত্বরান্বিত করতে এগিয়ে এলো আমার বুকের ভেতরে অহর্নিশ ভালোবাসায় লুটোপুটি খাওয়া কিছু পিচ্চি পাচ্চা ভাই বেরাদার। নেয়ামুল ফোন দিয়ে বলল, ‘এই হইলো আইডিয়া, চলেন সামনে শুক্কুরবার কাজ শুরু করি। টেকা পয়সা যা লাগে, আমি দিমু.।’
আমি কিছু বলি না। পাগলটার কথা শুনে হাসি। আসলেই পাগল। ওর মতো পাগল যদি সবাই হতাম! কথা নেই বার্তা নেই, রাত বিরেতে উদ্ভট সব আইডিয়া নিয়া ফোন, ‘ভাইয়া, চলেন শুরু করি’।
আমি হাসি। আর ভাবি।
এবার অবশ্য নেয়ামুল জোর করেই আমার ভাবনা বন্ধ করে মাঠে নামায়। কোন এক অদ্ভুত কারণে ওর বিশ্বাস, পারলে আমি-ই পারবো। সমস্যা হচ্ছে, সেই বিশ্বাস আমার নেই। কিংবা থাকলেও নানান আশংকায় জর্জরিত আমি সেই ভাবনা বিশেষ একটা পাত্তা দিতে চাই না।
নেয়ামুল সেইদিনই ট্রাইপড কিনে ফেলে। কিন্তু ক্যামেরা? ক্যামেরা কই পাবো? অনিরুদ্ধ সব কাজ টাজ ফেলে রেখে তার নতুন কেনা জানের টুকরা ক্যানন ফাইভ ডি মার্ক টু নিয়ে ছুটে আসে। যাক বাবা, বড় ঝামেলাটা তাহলে মিটেই গেল!
আমি এর ফাকে গল্পটা পুরো করি। চিত্রনাট্য সাজাই। কল্পনার সিনেমাটোগ্রাফিতে ফ্রেমিং ভাবি। অথচ, ভেতর ভেতর তুমুল শংকা। আসল সমস্যা, অভিনয় করবে কে? আমার তো ৭-৮ বছরের এক ছেলে চাই, আর ২-৩ বছরের এক পিচ্চি মেয়ে। কই পাই?
বাসার পাশে হাঁটতে বেরুলেই চোখ শুধু আঁতিপাঁতি করে আশেপাশের বাচ্চাদের মুখের ওপর ঘোরে, চোখের ওপর ঘোরে। ইশ! যদি মনের মতো একটা বাচ্চা পেয়ে যাই! এবং পেয়েই গেলাম। মুন্না! পাশের বস্তিতে থাকে। ওকে নিয়ে ওর বাসায় গেলাম। কথা বলতেই ওর বাবা মাও রাজী। আর কি!! শুরু হয়ে গেলো ‘বোধ’ নামের আমার প্রথম শর্ট ফিল্মের শুটিং।
এবং একদিনের মধ্যে আমরা শুটিং শেষ করে ফেললাম। আমি রীতিমত মুগ্ধ এবং ক্লান্ত আমাদের কর্মক্ষমতা দেখে। প্রান্ত নামের কলেজ পড়ুয়া ছেলেটিও হাড়ভাঙা খাটুনি খেটেছে আমাদের সাথে। কিন্তু সার্বিক কাজ নিয়ে আমি ভয়াবহরকম হতাশ। যা চেয়েছি, তার কাছাকাছিও যেতে পারি নি। কিছু কিছু বিষয়ে এতো আনাড়ি ভুল করেছি যে রীতিমত কান্না পেয়ে যায়। কিন্তু এখন এডিটিং? এডিটিং কিভাবে হবে? আমাদেরতো প্রফেশনাল এডিটিং করানোর টাকা নেই। তাহলে?
ফাহিম আর সৌরভ ছুটে এলো, সাথে ওদের এক বন্ধু আবির। সে বনানী থেকে মোহাম্মদপুরের আমার বাসায় মাথায় করে নিয়ে এলো বিশাল মনিটর আর হাইডেফিনিশন পিসি। শুরু হোল রাত দিন জেগে এডিটিং। আমরা কেউই প্রায় কিছুই জানি না। ফলে একে ওকে ফোন করে, নেট ঘেঁটে যতক্ষণে আমরা এডিটিংএ এক পা আগাই, ততক্ষণে হয়তো প্রফেশনাল কেউ হলে পুরো কাজই শেষ করে ফেলত। শেষ অবধি কাজ শেষ হয়।
দেখে-টেখে মনে হয়, নাহ! খুব খারাপ কিছুতো হয় নি!! মোটামুটি চলে। চলে নাকি? দ্বিধারা যায় না। আমি শংকিত থাকি, এটা অনলাইনে দিব? নাকি দিব না? আমার ফেসবুক অবশ্য তখন ডিএকটিভ। কিন্তু কি দিব? কিছু কি আসলেই হয়েছে?
নেয়ামুল হুট করে একদিন ফোন দিয়ে বলে, ‘ভাইয়া, আরিফ (ফেসবুকে তুমুল জনপ্রিয় আরিফ আর হোসাইন) ভাই শর্টফিল্মটা তার প্রফাইল থেকে পোস্ট করছে, শিরোনাম, When all noise is gone! এরপর আরিফ ভাই লিখেছেন, কিছু ভিডিওতে ভয়েস ওভার না থাকাই ভালো, এতে ভেতরের ভয়েসটা শোনা যায় না। উল্লেখ্য, এটি একটি ৫ মিনিত ৪২ সেকেন্ডের নির্বাক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র।
এরপরেরটুকু ইতিহাস। বোধ নিমিষেই ছড়িয়ে পড়ে ফেসবুকের এপ্রান্ত থেকে অপ্রান্ত। জলোচ্ছ্বাসের মত। অজস্র পেজ, গ্রুপ, পার্সোনাল প্রোফাইল থেকে হাজার হাজার বার নামে বেনামে শেয়ার হতে থাকে বোধ। আমি হতভম্ব হয়ে যাই। ফেসবুকেই প্রায় ৫০ হাজার বারেরও বেশি শেয়ার হয়েছে বোধ। ইউটিউবে শতাধিক মানুষ নামে বেনামে পোস্ট করেছেন এই শর্টফিল্মটি। মানুষের গ্রহণযোগ্যতায় আমি অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে ভাবছি, আসলেই কি কিছু হয়েছে?
আসলেই কিছু হয়েছে কি না জানি না। তবে এটুকু জানি, বোধ ছুঁয়ে গেছে অজস্র মানুষের হৃদয়, কাঁদিয়েছে, হয়তো ছুঁয়ে গেছে তাঁদের একান্ত অনুভূতি- বোধ।
—– সাদাত হোসাইন