মিউজিয়ামে মানবিক অবমাননার বালতি

মিউজিয়ামে মানবিক অবমাননার বালতি

সময় এখন ২০২৩ সালের শেষের দিকে। বড় দুঃসময়। যুদ্ধ চলছে। ঘোর যুদ্ধ। এমনি এক সময়ে আরেক যুদ্ধের কথা মনে করাচ্ছি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে হিটলার পৃথিবীর কোল থেকে ইহুদীদের নিশ্চিহ্ন করার পণ করেছিল। যদিও শেষ পর্যন্ত সে সফল হয়নি । এই সময়ে অর্থাৎ বর্তমানে ইজরাইয়েলের নেতা বেনিয়ামিন নেতিনিয়াহু পৃথিবীর বুক থেকে, তার বয়ানে “wipeout Hamas from the face of the earth” বা ফিলিস্তিনী মুক্তিকামী দল হামাসদের মুছে ফেলবে বা নিশ্চিহ্ন করবে বলে ঘোষনা দিয়েছে। সমগ্র বিশ্ব রুদ্ধ শ্বাসে হামাস আয়ত্বাধীন গাজায় পলকে পলকে ইজরাইয়েলের হাতে নিরপরাধ, নিরস্ত্র মানুষের মৃত্যু দেখছে। হামাস অবশ্য ৭ অক্টোবর বহুল আলোচিত সুরক্ষিত ইজরাইয়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করে আচমকা দেশটিতে আক্রমণ চালিয়ে ঢুকে পড়ে। যা ইজরাইয়েলকে হতভম্ব ও বাকী বিশ্বেকে বিস্মিত করে।
কেন হামাস এমন অতর্কিত আক্রমণ করলো? পেছনের কাহিনী একটু স্মরণ করি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারী নৃশংস তান্ডবে অনেক মানুষ মৃত্যুবরণ করে। গ্যাস চ্যাম্বার তৈরী করে তাতে মানুষকে বিশেষ করে ইহুদীদের ঢুকিয়ে কলের নল দিয়ে গ্যাস ছেড়ে নিমেষে শ’য়ে শ’য়ে মানুষ হত্যা করা হয়।
যুদ্ধ শেষে ইহুদীরা একটি নিজস্ব বাসভূমির আবেদন করে। হিটলারকে হারিয়ে জয়ী শক্তি যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স তাদের সাঙ্গপাঙ্গোরা প্যালেস্টিনীয়দের বাসভূমিতে জবরদস্তি করে ইহুদীদের থাকার জন্য রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। তাই প্রথম থেকেই ইজরাইয়েল রাষ্ট্র ছিল এবং এখনও আছে প্যালেস্টিনীয় বা ফিলিস্তিনিদের নিজ ভূমি থেকে উৎখাত করে প্রতিষ্ঠিত এক রাষ্ট্র। তারপর থেকেই ফিলিস্তিনীদের রিফিউজী হিসাবে নানা জায়গায় ঠাই নিতে হয়। ফিলিস্তিনীরা শুধু মুসলমান নন। তাদের মাঝে মুসলিম, খ্রীস্টান সবাই আছে। কিন্তু জিয়নবাদী ইহুদীরা(উগ্র জাতীয়তাবাদীরা) ইজরায়েলকে চেয়েছে শুধুমাত্র ইহুদীদের জন্য। সেই থেকে অনবরত ফিলিস্তিনিরা অত্যাচার ও উৎখাতের শিকার। তাদের সন্তানরা তাবুতে জন্মায়, তাবুতে বড় হয় ইজরাইয়েলের কঠোর নজরদারী ও নিপীড়নের মাঝে। দশকের পর দশক অত্যাচারিত নিপীড়িত মানুষ দাঙ্গা হাংগামার মাঝেই কাটাচ্ছে জীবন।
৭ অক্টোবর তারা জ্বলে উঠে, জীবন বাজি রেখে আক্রমণ করে ইজরাইলকে যারা তাদের ঘরবাড়ি থেকে, বাসভূমি থেকে উচ্ছেদ করে নিজের জন্য উন্নত জীবন সাজিয়েছে। পশ্চিমা শক্তি বার বার বলেছে ইহুদী ও ফিলিস্তিনিদের দু’টো রাষ্ট হবে। সাত দশক কেটে গেছে ফিলিস্তিনিরা আজও তাদের দেশ পায়নি। উদ্বাস্তু জীবন থেকে মুক্তি পেয়ে একটি দেশ পাওয়ার আকাংখায় তারা জীবন বাজী রেখে লড়ে যাচ্ছে, লড়েই যাচ্ছে।
এর ফলশ্রুতিতে শুরু হল অসম দুই প্রতিপক্ষের মাঝে যুদ্ধ। অসম বলা হচ্ছে এই কারনে যে ইজরাইয়েল সর্বাধুনিক সমরাস্ত্রের অধিকারী আর গাজার বাসিন্দা প্যালেস্টীনিয়দের বিমান আক্রমণ ঠেকানোর মত সামান্য এ্যান্টি এয়ারক্রাফ্ট অস্ত্রও নেই।
তবে যুদ্ধ শুধু অস্ত্র দিয়ে প্রাণ সংহার নয়। মৃত্যুতো আছেই তারই পাশাপশি ভয়ংকর মর্মস্পর্শী, বেদনাদায়ক হল মানবের অবমাননা, অপমান।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে হিটলার বাহিনীর হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য কিশোরী এ্যান ফ্রান্ক তার পরিবার ও আরও কিছু পরিচিত ঘনিষ্ঠ জনদের সংগে নেদারল্যান্ডের আমস্ট্যার্ডাম শহরে ছোটখাটো এক কারখানার উপরতলায় প্রায় আড়াই বছর আত্মগোপনে ছিল। শেষ পর্যন্ত ওরা হিটলার বাহিনীর হাতে ধরা পরে। নাজী কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্পে এ্যান, তার মা ও বোনের মৃত্যু ঘটে। এ্যানের বাবা অটো ফ্রান্ক বেঁচে যান।
আমস্ট্যার্ডামে এ্যান ফ্রান্ক একটি কারখানার দোতলায় যে ছোট্ট পরিসরের কয়েক কামরার বাসস্থানে জীবনের আড়াই বছর কাটিয়েছিল আর প্রতিদিন ডায়েরী বা দিনলিপি লিখতো সে বাসস্থানটি এখন এ্যান ফ্রান্ক মিউজিয়াম।
যারা অল্প সময়ের জন্য ওই শহরে বেড়াতে যান ভীষণ স্বল্প পরিসরের মিউজিয়ামে যেতে হলে আগেই টিকিট কেটে রাখতে হবে তাদের। তা না হলে যাওয়া সম্ভব নয়। কারন প্রায় সব সময় এই মিউজিয়াম দেখার জন্য দর্শকরা ভীড় করে আসে।
কিছু সময় লাইনে দাড়িয়ে থেকে ঢুকার পর মাত্র পনেরো মিনিটের মাঝে মিউজিয়াম ভ্রমণ শেষ। এক এক গ্রুপের জন্য সময় বরাদ্দ পনেরো মিনিট।
দোতলায় উঠার সিড়ি ভীষণ সংকীর্ণ। দু’জন মানুষ পাশাপশি সিড়িতে পা রাখতে পারবে না। একটি ছোট অডিও ডিভাইস ফিতাতে আটকানো তা গলায় দুলিয়ে মিউজিয়ামের বিষয়ে ধারা বর্ণনা শুনতে শুনতে নিমিষে পনেরা মিনিট শেষ। এতো ছোট পরিসরে গাইডেড ট্যুর সম্ভব নয় ।
দোতলায় উঠার পর দরজা জানালা বন্ধ মৃদু আলো জ্বলা পরিসরে প্রবেশ। সব কিছু ১৯৪২-১৯৪৪ বা ১৯৪২-১৯৪৫এ যেমন ছিল তেমনিভাবে সংরক্ষন করা আছে। দেয়াল, চেয়ার-টেবিল, তৈজসপত্র তেমনি রংচটা ধূসরবর্ণ।
আমার নিঃশ্বাস আটকে আসছিল বদ্ধ ঘরে। কি করে এতো দীর্ঘ সময় ওরা এমন দম আটকানো বদ্ধ পরিসরে বেঁচে ছিল! ভাবলে মাথা ঘুরে যায়।
এ্যান ফ্রান্কের ডায়েরী অনেকেই পড়েছেন, তবে এই দমবন্ধ পরিবেশ না দেখলে যুদ্ধের সময়ে তাদের বেঁচে থাকার দারুন কষ্টের সংগ্রাম অনুভব সম্ভব নয়। আমাকে স্থম্ভিত করে দিল ঘরগুলোর কোন এক কোণে রাখা এলুমিনিয়ামের হাতল বা কড়াওয়ালা এক পুরানো বালতী ও অডিওতে তার বর্ণনা শুনে।
দিনের বেলা এ্যানরা টয়লেট ব্যবহার করতে পারতো না। কারণ দিনে নীচের কারখানায় চার-পাঁচ কি পাঁচ-ছয় জন লোক কাজ করতে আসতো। তারা যেন ঘুনাক্ষরেও না বুঝে যে উপরে কেউ লুকিয়ে আছে। তাই যতদূর সম্ভব প্রাকৃতিক ক্রিয়াকর্ম বা মল-মূত্র ত্যাগ বন্ধ রাখতে হতো। তা না হলে নীচে পাইপ দিয়ে ছড় ছড় করে পানি পড়ার শব্দে প্রাণ সংহয় হওয়ার মতো বিপদ ঘটতোই। যদি কারোর অবস্থা সাংঘাতিক বেগতিক হতো তখন বালতিই ছিল একমাত্র ভরসা।
যুদ্ধ মানুষকে চরম অবমাননায় ফেলে দেয়। মানুষ তার সম্ভ্রম বজায় রাখা ও শালীনতা রক্ষার জন্য অন্য প্রাণীর চেয়ে সতন্ত্র । মানুষ পশুপাখীর মতো সবার সামনে যত্রতত্র মলমূত্র ত্যাগ করে না এবং রতিক্রিয়াও জনসমক্ষে মানুষের কর্ম নয়, কুকুর যা সহজেই করে যায়। অথচ যুদ্ধ মানুষের শালীন, সুসভ্য আচরণকে বিসর্জন দিতে বাধ্য করে।
হিটলারের হাত থেকে লুকাতে গিয়ে এ্যানাদের অবমাননায় পূর্ণ ছিল সে বালতি।
মিউজিয়ামের ভিতরে ছবি তুলা নিষেধ তাই বালতির ছবি দেওয়া গেল না।
কিভাবে কিশোরী এ্যানা পানি খরচ না করে তার ঋতুকালীন সময় কাটাতো? ভাবতে ভয়ে, অপমানে গা রি রি করে উঠলো। যুদ্ধ মানুষকে তার সব সুসভ্য, শালীন আচরণ বিসর্জন দিতে বাধ্য করে অনায়াসে।
আজ গাজাতে পানি, খাদ্য, ওষুধশূণ্য অবস্থায় মানুষ কি করছে? মরছে আর ওখানে রজঃস্লা কিশোরী রক্তাক্ত বসনে মানুষের সভ্যতাকে বিদ্রুপ করছে।
যুদ্ধ জয়-পরাজয়ের বেশী যুযুধান দু’পক্ষকেই দেয় অমানবিক অবমাননা।

বিবেকবান ইহুদী বান্ধবী ইয়ায়েল হাজার মাইল দূরে থেকেও সমগ্র বিশ্বে নেতিনিয়াহুর কার্যকলাপের consecuence কি হবে ভেবে ভয় ও ঘৃণায় কাঁপছে। এর মাঝেই ওর আশংকা যে ভুল নয় তা ১/১১/২০২৩ নিউইয়র্ক টাইমসএ প্রকাশিত খবরটিই প্রমান
To Nitzan Mintz, one of the artists behind the fliers, watching them go viral in the first place was a shock. Seeing people rip down the posters has revealed what she said was clear antisemitism. “By accident this campaign did more than bring an awareness of the kidnapped people,” she said. “It brought awareness of how hated we are as a community.”
নিতজান মিন্টজ নামে আমেরিকা একজন হামাসের হাতে আটক ইজরাইয়েলীদের ছবি একে পোস্টার তৈরী করেন। সে পোস্টার আমেরিকার না না জায়গায় সেটে দেওয়া হয়েছিল। এখন সে পোস্টার যে যেখানে পারছে টেনে নামাচ্ছে, ছিড়ে ময়লার বিনে ফেলছে। আটকদের প্রতি সহানভূতির বদলে পোস্টার ধূলিস্মাত করা দেখে শিল্পী বলছেন, “এই কাজ একটি বিষয়ে সচেতন করছে যে সম্প্রদায় হিসেবে আমরা কত ঘৃনিত।

তার অনুভব ও বোধ এইযে নিরস্ত্র অসহা্য় মানুষের প্রতি এমন নিষ্ঠুরতা ও অপমান দেখে শুধু ফিলিস্তিনী নন বাকী বিশ্বে সচেতন মানুষ মাত্রই সবাই রাগে দুঃখে, অপমানে এক একটি ফুটোণ্মুখ আগ্নেয়গিরি। এটাকে বলা যাবে The warlords are pushing people to become terrorist to…
কখন কোথায় কোন আগ্নেয়গিরি বিস্ফোরিত হবে তা কেউ জানে না।
আজ ২ নভেম্বর অষ্ট্রেলীয় টিভির নিউজ ২৪ চ্যানেলে এদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী পেনি ওয়াং অত্যন্ত সতর্ক ভাবে রুলস্ অব ওয়ার ও যুদ্ধের বিধান ইন্টারন্যাশনাল ল’, ইন্টারন্যাশনাল হিউম্যানিটারিয়ান ল’ বা আইন মানার বিষয়টি উল্লেখ করলেন।
আরও যা বললেন তা হল গাজা ও ওয়েস্ট ব্যাংকে নিরস্ত্র জণগন বা অসামরিক প্যালেস্টীনিয়দের উপর যে আক্রমণ চলছে তা ইজরাইয়েলের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলবে।
আসলে গাজায় হামাসকে নিশ্চিহ্ন করতে যে জঘন্য অপরাধ চালানো হচ্ছে তা প্রত্যক্ষ করে পৃথিবীর নানা প্রান্তে ইহুদী জাতির বিরুদ্ধে ক্ষোভ জন্ম নিচ্ছে।
যদিও সব ইহুদী এই জঘন্য কর্মের সংগঠক নন, সমর্থকও নন।
নেতিনিয়াহুর কাজকর্মের কারনে বা পরিনামে পৃথিবী ইহুদীদের জন্য যেমন অনিরাপদ, ভয়ংকর হয়ে উঠবে, অগুণতি নিরপরাধ ফিলিস্তিনীদের মৃত্যু বেচেঁ থাকা অবশিষ্ট ফিলিস্তিনীদের বদলা নেওয়ার ইচ্ছার বারুদ বোমায় পরিণত করবে।

দিলরুবা শাহানা


Place your ads here!

Related Articles

ধলেশ্বরী-২

আমাদের ছোট নদী চলে বাকে বাকে বৈশাখ মাসে তার হাটু জল থাকে………… আমর ছেলেটা যখন এদেশটা আসলো তখন সবে হাটা

আমাদের মঞ্জুর মোরশেদ

১৯৯১ সালের এক বিকেলের ঘটনা৷ হার্ডডিস্কের তথ্য সংরক্ষণের নতুন কার্যপদ্ধতি (অ্যালগরিদম) নিয়ে একটি বৈজ্ঞানিক নিবন্ধের খসড়া করে সেটি সম্পূর্ণ করার

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment