একটি অসমাপ্ত রাজনীতির গল্প
এজাজ মামুন: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক সিরাজুল আলম খান শুক্রবার ঢাকায় একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেছেন। কথিত আছে মুক্তি সংগ্রাম আন্দোলনের উষালগ্নে তিনিসহ তিনজনকে নিয়ে একটি চক্র বা সেল গঠন করা হয়েছিল। তিনি ছিলেন এর মূল উদ্যোক্তা। এই চক্রে আরো ছিলেন প্রয়াত জননেতা আবদুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমদ। এটি ‘নিউক্লয়াস’ নামে বহুল পরিচিত। লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদের লেখা ‘সিরাজুল আলম খান এবং স্বাধীনতার নিউক্লিয়াস’ শীর্ষক নিবন্ধে (২০১৯ সালে প্রথম আলোর ঈদ সংখ্যা) নিউক্লিয়াস সম্পর্কে জননেতা আবদুর রাজ্জাক’র সাক্ষাতকার উদ্ধৃতি করা হয়েছে। সেখানে আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, “চিন্তাটা হয়েছিল ১৯৬২ সালে। ১৯৬৪ সালে তার একটা কাঠামো দাঁড় করানো হয়। সিরাজ ভাই রূপকার, বিষয়টা এমন নয়। আমাদের মধ্যে কাজ ভাগ করা ছিল। সিরাজ ভাই ছিলেন আমাদের থিওরেটিশিয়ান। আমি রিক্রুটিংয়ের কাজ দেখতাম। আরেফ ছাত্রলীগের মধ্যে আমাদের চিন্তার প্রসার ঘটাত।” এই সেলে কাজগুলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর গোচরেই হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে আব্দুর রাজ্জাক আরো বলেন, “মুজিব ভাইকে সামনে রেখেই আমরা এটা শুরু করি। তিনিই আমাদের নেতা। এ ব্যাপারে তাঁকে আমরা কিছুটা জানিয়েছিলাম ১৯৬৬ সালে। ১৯৬৯ সালে তাঁকে ডিটেইল জানানো হয়।” সিরাজুল আলম খান অন্তর্মুখী নেতা ছিলেন। তিনি নিজে কিছু লিখতেন না। তাঁর পক্ষে কেউ লিখতেন তা তিনি দেখে দিতেন বা কখনো ডিকটেশন দিতেন। তাই তাঁর নিজের মুখে বা লেখায় ‘নিউক্লিয়াস’ গঠন বা কর্মকান্ড সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায় না।
সিরাজুল আলম খান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। বঙ্গবন্ধু নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করতেন আর সে কারনেই অনেক সময় সিরাজুল আলম খান কিংবা অন্য তরুণ বা ছাত্রনেতাদের অতি-বিপ্লবী আন্দোলনকে তাঁর রাজনীতির কৌশল হিসেবে সরাসরি গ্রহন কিংবা জনতার কাছে প্রকাশ করেন নি।
সিরাজুল আলম খান ছয় দফার সমর্থনে জনমত গঠনে ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বাতিল ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে আন্দোলন ও উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্র-শ্রমিকদের সম্পৃক্ত করতে অনন্য ভূমিকা পালন করেন। আন্দোলনের একপর্যায়ে ১৯৬৯-৭০ সালে বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ) এবং সশস্ত্র শাখা হিসেবে ‘জয় বাংলা বাহিনী’ গড়ে তোলা হয়। পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মনি, আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদকে নিয়ে বিএলএফ হাইকমান্ড পুনর্গঠন করা হয়। যেটি পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের সময় ‘মুজিব বাহিনী’ নামে পরিচিত লাভ করে।
বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে বিজয়ের পর সিরাজুল আলম খান ‘দাদা’ নামে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। যদিও ছাত্রলীগের মধ্যে দুটি স্রোতোধারা স্পস্ট হয়ে উঠে মুক্তি সংগ্রামের অনেক আগেই, যার একটির কেন্দ্রে ছিলেন শেখ ফজলুল হক মণি, অন্যটির সিরাজুল আলম খান, বিজয়ের অব্যহিত পরে ২১ জুলাই ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের তিন দিনের সম্মেলনে ছাত্রলীগ বিভক্ত হয়ে যায়। তদানীন্তন ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট নূরে আলম সিদ্দিকীর সংসদীয় গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র উত্তরণের ডাকে ও অপরদিকে সিরাজুল আলম খানের অনুসারী আ স ম রবের নেতৃত্ব বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণায় ছাত্রলীগ বিভক্ত হয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু নূরে আলম সিদ্দিকী আহূত ছাত্রলীগের সম্মেলনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে উপস্থিত হন। অন্যদিকে পল্টন ময়দানে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও সশস্ত্র সংগ্রামের দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা দেয় সিরাজুল আলম খানের পক্ষের ছাত্রলীগ। ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামের একটি নিবন্ধ থেকে জানা যায় ‘বিপ্লবী জাতীয় সরকার’ গঠনের প্রশ্নে আওয়ামী লীগ ও সিরাজুল আলম খানসহ তরুণদের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয় অস্থায়ী সরকার গঠনের সময় থেকে। এটিও অনেকেই বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের সাথে সিরাজুল আলম খানের দূরত্বের একটি কারণ বলেও মনে করেন।
বাংলাদেশ ছাত্রলীগের রাজনীতিতে মতাদর্শগত, অনেকের মতে, ব্যক্তিগত দূরত্বের কারনে সিরাজুল আলম খান নতুন রাজনীতির ধারা সৃষ্টি করেন। যুদ্ধ-বিদ্ধস্ত সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশে ছাত্রলীগের এই বিভাজন সবার মাঝে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। পরবর্তীতে ছাত্রলীগের এই সিরাজপন্থী গ্রুপ থেকে ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর ‘বিপ্লবে পরিপূর্ণতা প্রদান ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার স্লোগানে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের আহ্বায়ক কমিটি গঠিত করা হয়। প্রবীণ সাংবাদিক আবেদ খান ‘জাসদের জন্মরহস্য’ (জাগরণ ১১ সেপ্টম্বর ২০১৯) শিরোনামের একটি নিবন্ধে লিখেন, “ছাত্রলীগের এই ভাঙনে অচিরেই আওয়ামী লীগের শ্রমিক, কৃষক, মুক্তিযোদ্ধা ফ্রন্টগুলোতেও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। পরিণতিতে মুজিব বাহিনী, মুক্তিযোদ্ধা ও তরুণ সমাজের একটি বিরাট অংশ জাসদের কাতারে এসে শামিল হয়”। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন স্বাধীনতার পরাজিত শত্রুরা বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে জাসদকে ব্যবহার করে ও স্বার্থ হাসিলের জন্য জাসদকে নানা রকম সাহায্য-সহযোগিতা দিতে থাকে।
দেশের অভ্যন্তরে আসন্ন খাদ্য ঘাটতির মুখে ও বিদ্যমান আর্থসামাজিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে ১৯৭৪ সালের জুলাই মাসে জাসদ কর্নেল আবু তাহেরের নেতৃত্বে বিপ্লবী গণবাহিনী গঠন করে। এর নেপথ্য পরিকল্পনাকারী হিসেবে সিরাজুল আলম খানের নাম জড়িয়ে আছে। আবেদ খানের নিবন্ধের সূত্রমতে যাত্রা শুরুর পর থেকেই জাসদ প্রকাশ্যে অনিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন শুরু করে ও হত্যা, গুমসহ অসং্খ্য জানমালের ক্ষতি হয়। দেশব্যাপী চরম নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। বাকশাল গঠনের পর জাসদ জনগণের প্রতি সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতির ও সশস্ত্র বিপ্লবের পথে শাসনক্ষমতা দখলের আহবান জানিয়ে প্রচারপত্র বিলি করে। পনেরোই আগস্টের বিয়োগান্ত ঘটনার আগে ও পরে জাসদের যাবতীয় কর্মকাণ্ড অনেকেই বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্লোগানের আড়ালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে উৎখাতের প্রেক্ষাপট তৈরি করা ও পরবর্তীতে ক্ষমতার অংশীদার হবার অভিপ্রায় বলে বিশ্লেষণ করেন।
সিরাজুল আলম খান জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ৭৫’র ২৬ নম্ভেম্বর গ্রেফতার হোন এবং পাঁচ বছর কারা অন্তরিন থাকার পর ৮১’র মে তে লন্ডন চলে যান দীর্ঘদিন প্রবাসে স্বনির্বাসিত জীবন যাপন করেন।
সিরাজুল আলম খান ছাত্ররাজনীতি সমাপ্তির পরে কোন রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিকপদে ছিলেন না কিন্তু তাত্ত্বিক গুরু হিসেবে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কায়েমের লক্ষ্যে জাসদ ও পরে বহুবিভক্ত দলের নীতি নির্ধারক ও পরিকল্পনাকারী হিসেবে মূখ্য ভূমিকা পালন করেছেন।
মানুষের মুক্তি সংগ্রামের প্রস্তুতি ও মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অনবদ্য পুরুষ হঠাৎ করেই স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রার প্রারম্ভে অনেকের মতে খল নায়কের ভূমিকা পালন করেছেন। ইতিহাস বিশ্লেষণে হয়তো কোন এক কালে এর নেপথ্যের কারনগুলো উন্মোচিত হবে।
মুক্তি সংগ্রাম ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে তিনি তাঁর মতো করেই মূল্যায়িত হবেন।
Dr Ezaz Mamun
From Rangpur, Bangladesh. Agricultural Scientist. Studied Agriculture in Bangladesh and Australia. Involved in cultural movement, student politics and journalism. Worked at international agencies and government departments in Bangladesh, University of Sydney and Macquarie University. Currently working with Australian government department in agriculture and climate change areas.
Related Articles
মদিনা সনদ ও হযরত ওমর (রা.)র সেকুলারইজম এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার
ভেবেছিলাম অস্ট্রেলিয়ার রাজনীতি ও প্রবাসী বাঙালী চেতনা নিয়ে এবার লিখবো। সুন্দর হেমন্তে আমরা যারা বিদেশে আছি তাঁরা কতটা বাঙালী চেতনায়
Sonia Gandhi’s 24-hour visit to Dhaka: Manifestation of warm relations between the two nations
Ruling party Congress President Sonia Gandhi (64) paid a visit to Dhaka for twenty four hours (24-25th July) at the
যুবলীগের কমিটি ভেঙ্গে দিন
ফজলুল বারী: যে কারনে ছাত্রলীগের সৃষ্টি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে আদর্শ লক্ষ্য নিয়ে ছাত্রলীগ গড়ে তুলেছিলেন, জেলখানা