বহে যায় দিন – ক্যানবেরা – দ্য ‘বুশ ক্যাপিটেল’, দ্য ‘মিটিং প্লেস’

বহে যায় দিন – ক্যানবেরা – দ্য ‘বুশ ক্যাপিটেল’, দ্য ‘মিটিং প্লেস’

> বহে-যায়-দিন সকল প্রকাশিত পর্ব >

।। দুই ।। ক্যানবেরা – দ্য ‘বুশ ক্যাপিটেল’, দ্য ‘মিটিং প্লেস’ (২০০৬ প্রকাশিত ধারাবাহিকের পুনঃ প্রকাশ)

অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী ক্যানবেরা শহরে আমার বাইশ বছর জীবনের নানান স্মৃতি-বিজরিত ঘটনাবলী সুহৃদয় পাঠক-পাঠিকাদের, বিশেষ করে যারা ক্যানবেরা সম্পর্কে খুবই সামান্য জানেন অথবা কিছুই জানেন না, সামনে তুলে ধরার আগে এই মনোরম রাজধানী শহরের প্রেক্ষাপট এবং খানিকটা ইতিহাস তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি ।

বৃটিশ পার্লামেন্টের ‘এ্যাক্ট’ অনুসারে ১৯০১ সালের পহেলা জানুয়ারী ‘কমনেয়েলথ্ অব অস্ট্রেলিয়া’ গঠন করা হয় এবং তখন থেকেই নতুন রাজধানী শহর তৈরী করার পরিকল্পনা নেওয়া হয় । কেনো না, সেই সময় থেকেই মেলবোর্ণ এবং সিডনীর মধ্যে বিবাদ লেগেছিলো কোথায় হবে স্থায়ী রাজধানী । অবশেষে এই দুই শহরের বিবাদ মিটিয়ে ১৯০৮ সালে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে বুশ ক্যাপিটেল’ হিসেবে ক্যানবেরা-ই হবে নতুন এবং স্থায়ী রাজধানী । ১৯১১ সালের পহেলা জানুয়ারী ক্যানবেরা অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী হিসাবে গোড়াপত্তন হয় । ১৯১৩ সালের ১২ মার্চ অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী ক্যানবেরা হিসেবে অফিসিয়ালী ঘোষনা করেন তৎকালীন গভর্নর জেনারেলের স্ত্রী লেডী ডেনম্যান। ক্যানবেরা শহরের নামকরন করা হয় অ্যাবোরিজিন্যাল (অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী) শব্দ ‘Kamberra’ থেকে, যার অর্থ ‘মিলন স্থান’ বা ‘মিটিং প্লেস’ । তখন ক্যানবেরার লোকসংখা ছিলো মাত্র ১,৭১৪ জন । ক্যানবেরা শহর সিডনী থেকে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং মেলবোর্ণ থেকে প্রায় ৬৫০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত । এই সুন্দর শহরের পরিকল্পনা এবং নকশা অর্থাৎ ‘আর্কিটেকচারাল ডিজাইন করেন ৩৬ বছর বয়স্ক শিকাগো শহরের তরুণ স্থপতি ওয়াল্টার বার্লি গ্রিফীন ।

চুড়ান্ত পর্যায়ে শেষ তিনজনের মধ্যে বার্লি গ্রিফীন ডিজাইন প্রতিযোগিতায় বিচারক মন্ডলীর রায়ে প্রথম স্থান অর্জন করে এই দুর্লভ সম্মানের অধিকারী হন । তার নাম অনুসারে ক্যানবেরা শহরের মধ্যিখানে তৈরী করা হয় লেক বার্লি গ্রিফীন, যা শহরের সৌন্দর্য বাড়িয়ে মোটামুটিভাবে দক্ষিণ এবং উত্তর ক্যানবেরাকে পৃথক করেছে । এই লেকের উপর ‘কমনওয়লথ্ এভিনিউ ব্রীজ’ (১৯৬৩ সালে তৈরী) এবং ‘কিংস ব্রীজ’ (১৯৬২ সালে তৈরী) দুই ক্যানবেরার মধ্যে সংযোগ স্থাপন করেছে ।

ওয়াল্টার বার্লি গ্রিফীনের মূল পরিকল্পনায় ‘ক্যাপিটেল হিল’কে কেন্দ্রবিন্দু করে তৈরী করা হয় ‘পার্লামেন্টারী ত্রিভুজ’ । এ ছাড়া সিভিককে ‘সেন্টার পয়েন্ট’ হিসেবে ইংরেজী ‘ওয়াই” আকারে গড়ে তোলা হয় আধুনিক ক্যানবেরা শহর । এই ‘ওয়াই’-এর প্রতিটি কোণায় এক একটি করে উপ-শহর গড়ে তোলার পরিকল্পনা করা হয়। মাউন্ট আইন্সলির পাদদেশে ১৯৪১ সালে উদ্বোধন করা হয় অস্ট্রেলিয়ান ওয়ার মেমোরিয়াল, যা দেশী-বিদেশী পর্যটকদের জন্য ক্যানবেরা শহরের প্রধান আকর্ষনীয় স্থান হিসাবে মর্যাদা লাভ করেছে । পুরোনো পার্লামেন্ট হাউজ উদ্বোধন করা হয় ১৯২৭ সালে ।

দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় অর্থনৈতিক মন্দার জন্য ক্যানবেরার বিস্তার অনেকটা থেমে যায় । তবে ১৯৬০ সালের দিকে সিভিকে বিভিন্ন সরকারী অফিস তৈরীর হিড়িক পড়ে । তার মধ্যে ১৯৬২ সালে ‘সিভিক স্কয়ার’ এবং সিভিক অফিসপাড়া, ১৯৬২ সনে ‘হোবার্ট প্রেস ও ‘ল’ কোর্ট’, ১৯৬২ সালে ‘রিজার্ব ব্যাঙ্ক এবং ১৯৬৫ সালে ‘ক্যানবেরা থিয়েটার সেন্টার’ উল্লেখযোগ্য । তাছাড়া লেকের দক্ষিণ পাড় ঘেঁষে ১৯৬৩ সালে তেরী করা হয় ‘ন্যাশনাল লাইব্রেরী অব অষ্ট্ৰেলিয়া, ১৯৮১ সালে উদ্বোধন করা হয় ‘হাই কোর্ট অব অস্ট্রেলিয়া’, ১৯৮২ সালে ‘ন্যাশনাল গ্যালারী অব অস্ট্রেলিয়া’ এবং ১৯৮৮ সালে ‘ন্যাশনাল সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি সেন্টার’ । তাছাড়া ডীকিন সাবার্বে ১৯৬৪ সালে রয়্যাল অস্ট্রেলিয়ান মিন্টু’-এর কাজ সমাপ্ত করা হয়। ১৯৬৩ সালের শেষ দিকে লোকজন ওয়াডেন উপ-শহরের হিউজ সাবার্বে, ১৯৬৭ সালে ব্যালকোনেন, ১৯৬৯ সালে ওয়েষ্টন ক্রীক এবং ১৯৭৩ টাগেরানং-এর আশেপাশের কয়েকটা সাবাবে নতুন বাড়ী তৈরী করে বসবাস করতে শুরু করে ।

১৯৩৯ সালে ক্যানবেরা শহরের জনসংখ্যা ছিলো মাত্র দশ হাজার । তখন হাতে গোণা কয়েকটা সরকারী দালান ছিলো । সেই সময় সিডনী এবং মেলবোর্ণের সঙ্গে শুধু সড়কপথে যোগাযোগের ব্যবস্থা তৈরী করা হয় । আজ এই সময়ে ক্যানবেরা শহরের জনসংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে প্রায় তিন শত বিশ হাজার ।

আমার চোখের সামনে এই বাইশ বছরে ক্যানবেরা শহরের অনেক পরিবর্তন হয়েছে বিশেষ করে ভৌগলিক । যার ফলে দিনে দিনে লোপ পাচ্ছে নৈসর্গিক সৌন্দর্য্য, হারিয়ে যাচ্ছে সবুজের মুগ্ধতা । আগে ক্যানবেরা শহর বলতে বোঝাতো সিভিক, ব্যালকোনেন, ওয়াডেন জুড়ে আশেপাশের লোকালয় এবং টাগেরানং-এর কয়েকটি সাবার্ব । আর এখন ? এখন ক্যানবেরা শহর ফুলে ফেঁপে মোটা হয়েছে অনেক, শহরের পরিধি বেড়েছে উত্তরে গাঙগালিন ডিস্ট্রিক বা উপ-শহর, পশ্চিমে ডানলপ সাবার্ব আর দক্ষিণে ব্যাঙ্কস্ সাবার্ব । টাগেরানং টাউন সেন্টার এবং দূরের সাবার্বগুলো গড়ে উঠেছে আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে নব্বই দশকের শেষ পর্যন্ত । অন্যদিকে পুরো গাঙগালিন উপ-শহর এবং তার আশেপাশের সাবার্বগুলোর কাজ শুরু হয়েছে নব্বই দশকের প্রথম থেকে । জনসংখ্যার জোয়ারের সাথে তাল মিলিয়ে দিনের পর দিন গড়ে উঠছে নিত্য নতুন সাবার্ব, চোখ-ধাঁধানো শপিং-সেন্টার, আলিশান অফিস বিল্ডিং, মাল্টিস্টোরিড এপার্টমেন্ট আর আবাসিক বাসস্থান । এই অগ্রগতির ধারা এখনও চলছে এবং আগামীতে আরও অনেক বছর চলবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই ।

(চলবে)

> বহে-যায়-দিন সকল প্রকাশিত পর্ব >


Tags assigned to this article:
বহে যায় দিন

Place your ads here!

Related Articles

এস হে বৈশাখ

নিশি অবসান প্রায় ঐ পুরাতন বর্ষ হয় গত আমি আজি ধূলিতলে জীর্ণ জীবন করিলাম নত !! বন্ধু হও শত্রু হও

Travel to the US and Europe – overview

Travel is self-fulfilling in many ways. Visiting new places provide us with the opportunity to learn new things and enable

বিদেশে দুই প্রজন্মের চিন্তাধারা এবং সাংকৃতিক পার্থক্য

৭ বছর হলো বর্না ও শুভ তাদের ৩ সন্তান সহ অস্ট্রেলিয়া মাইগ্রেট করেছেন।প্রথম সন্তান সোমা (১৭) দ্বিতীয় বাঁধন (১৩) আর

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment