সাহিত্যে সম্পদ আহরণ ও সমাজ পরিবর্তনের ইঙ্গিত

সাহিত্যে সম্পদ আহরণ ও সমাজ পরিবর্তনের ইঙ্গিত

সাহিত্যিক গবেষক নন তবে তার পর্যবেক্ষণ খুব গভীর ও নিবিড়। সাহিত্যিক নিরাসক্তভাবেই তার চেতনে, অবচেতনে  চারপাশে বহমান জীবনের ও চলমান সমাজে  ঘটে যাওয়া, ঘটতে থাকা  নানা কাহিনী উন্মোচিত করেন বা উদ্ভাসিত করেন। আবার কখনো বা কাহিনী বর্ননার পরতে পরতে আগামীতে  ঘটতে যাওয়া ঘটনার ইঙ্গিতও রেখে যান, যা কখনো কখনো কোন কোন সাহিত্যিকের লেখায় ফুটে উঠে ।

এই স্বল্প পরিসরের লেখাতে তিনজন সাহিত্যিকের তিনটি সৃষ্টিকর্মের আলোতে বিষয়টি পর্যবেক্ষিত হয়েছে। বিশ্বসাহিত্যের বিশাল ভান্ডারে আরও উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে। তবে আপাতত বাংলা সাহিত্য নীরিক্ষনের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। রয়েছেন বাংলা সাহিত্য আকাশের সূর্য রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র ও ভিভূতিভূষণ। আর প্রাসঙ্গিকভাবে এসেছেন সমাজবিকাশের গভীর তাত্বিক কার্ল মার্ক্স।

আমাদের মাঝে অনেকেরই নিশ্চয় শরৎচন্দ্রের ‘মহেশ’ গল্পটির কথা মনে আছে। এই গল্পটি কোন এক সময়ে আমাদের বাংলাদেশের পাঠ্যসূচীতে অন্তর্ভূক্ত ছিল। ‘মহেশ’ নামের এক গরুর গল্প এটি। সামন্তবাদী সময়ে ছোটখাটো এক জমিদারের হত দরিদ্র প্রজা গফুরের বড় আদরের গরু ছিল মহেশ। গরু হলে কি হবে গফুরের আদরের মহেশকে নিয়ে গানও বাঁধা হয়েছে। ভারতের গায়ক ভূপেন হাজারিকার ‘শরৎবাবু তোমার মহেশ…’ গানটির কথা নিশ্চয় কারও না কারো মনে পড়বে। গফুর তার মেয়ে আমেনা ও গরু মহেশ এই তিনজনকে নিয়ে ওদের সংসার। গফুরের দারিদ্র সীমাহীন। তিনটি প্রাণীর খাবার জোটানো তার জন্য দুষ্কর কাজ ।  এরমাঝে ক্ষুধার্ত মহেশ যখন তখন এর, তার এমন নানাজনের  ফসলের ক্ষেতে ঢুকে পড়ে খাবারের সন্ধানে, আর নষ্ট করে ক্ষেতের ফসল। তখনই ক্ষেতের মালিক সেই সময়ের বিধান মত মহেশকে পাকড়াও করে খোয়ারে দিয়ে দেয়। খোয়ার থেকে নিজের সন্তানবৎ গরু মহেশকে ছাড়িয়ে আনতে পয়সা লাগে। সে পয়সাটুকু জোগার করতেও গফুরের প্রাণ বেরিয়ে যায়। তার উপর জমিদারের হম্ভিতম্বিতো আছেই। জমিদারটি ছিলেন হিন্দু । মুসলমান গফুরের গরু মহেশকে নিয়ে জমিদারের নানা কটু কথায় জর্জরিত হতে হতো গফুরকে। জমিদাররা হোক সে হিন্দু কি মুসলমান চরিত্রে তারা ছিল একই ঝাড়ের বাঁশ। প্রজাদের প্রতি তারা ছিল ভয়ানক অত্যাচারী, নিষ্ঠুর শোষক। শুরুতে প্রজারা ছিল ভূমিদাস মাত্র। পরবর্তী পর্যায়ে তাদেরকে ভূমিশ্রমিক হতে হয়।  তারপরও ঘোরতর অত্যাচারিত ভূমিদাস বা ভূমিশ্রমিক  গফুর মহেশকে খুব ভালবাসতো। যদিও নিদারুন দারিদ্রের কারনে সব সময়ে মহেশের মুখে সে খাবার তুলে দিতে পারতো না।

একে সে মুসলমান তার উপর হিন্দু জমিদারের অঞ্চলে গরু পোষার কারণে ‘ম্লেচ্ছ হারামজাদা গোফরার’(জমিদারের এটাই ছিল সম্বোধন )উপর ছিল জমিদারের প্রচন্ড  রাগ। এখানে লক্ষ্য করার বিষয় হল সাহিত্যিক শরৎচন্দ্রের চোখ এড়িয়ে যায়নি হিন্দু জমিদার কিভাবে গফুরকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে সম্বোধন করছেন। নিরাসক্ত ভঙ্গিতে সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র  সে সময়কার সমাজের বস্তুনিষ্ঠ ছবিটি তুলে ধরেছেন।

একদিন রোগাভোগা গফুর তার অত্যন্ত আদরের ধন জীর্নশীর্ণ মহেশকে বেমক্কা এমন আঘাত করলো, যে আঘাতে সন্তানতুল্য মহেশ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো। যে মহেশকে সে কন্যা আমিনার চোখ এড়িয়ে নিজের ভাঙ্গাচুড়া কুড়ে ঘরের শনের চাল থেকে শন টেনে এনে লুকিয়ে লুকিয়ে খাওয়াতো তাকেই গফুর মেরে ফেলতে পারলো কিভাবে?   

শরৎচন্দ্রের (জন্ম ১৫ই সেপ্টেম্বর ১৮৭৬-মৃত্যু ১৬ই জানুয়ারী ১৯৩৮) গল্প পড়ে মনে হয়েছে একদিকে দারিদ্রের  তীব্র চাবুক, অন্যদিকে জমিদারের অপমানের চাবুকে দিশেহারা মানুষটি নিজেকেই নিজে শাস্তি দিল। তার অন্তরস্ফূরিত অনুচ্চারিত কথাটি ‘গফুররে তোর কি এমন ক্ষমতা যে তুই ভালবেসে গরুকে পালাপোষা করবি গফুর?’ মনে হয়, যে মানুষ দরিদ্র তদুপরি যে ভূমিদাস তার ভালবাসার, স্নেহ করারও অধিকার নাই।

তারপর কি হল? নিঃস্ব গফুর।  বিক্রি করার মত যার আর কিছুই অবশিষ্ট নাই। তার কেবল আছে কাজ করার জন্য একান্ত ব্যক্তিগত সম্পদ দুটি হাত মাত্র। শেষে অনন্যোপায় গফুর তার কন্যা আমিনাকে নিয়ে গ্রাম ছেড়ে কলে(কারখানায়)  কাজের খোঁজে চললো । এভাবেই যে সামন্ত সমাজের ভূমিদাস ছিল সে একসময়ে পূজিবাদী সমাজে কল-কারখানার স্বাধীন শ্রমিক হয়ে  উঠলো বা শ্রমিকে পরিণত হল । এই কাহিনীতে লেখক একজন ভূমিদাসের কলের শ্রমিক হয়ে উঠার আখ্যান বর্ণনা করেছেন মাত্র। সাহিত্যিকের কোন রাজনৈতিক বিশ্বাস বা তাড়না এই কাহিনী তৈরীতে ইন্ধন জোগায়নি।

সাহিত্যিকের গভীর চোখে দেখা সাদামাটা সত্যই(Plain truth) গল্পটির উপজীব্য। এভাবে ধীরে ধীরে অত্যাচারিত কৃষিমজুররা কারখানায় ভিড় করলো। এখন তারা স্বাধীন শিল্প শ্রমিক। আর যাই হোক এখন অনবরত জমিদার ও তার পাইক পেয়াদাদের লাঠি ঝাঠা খাওয়ার ভয়ে কুকুরের মত ভীত সন্ত্রস্ত জীবন থেকে তারা রেহাই তো পেল ।  গল্পের আলোতে বলা যায় সামন্তবাদ থেকে রাতারাতি বিপ্লব ঘটিয়ে কৃষিমজুর ও জমিদারের ভূমিদাসেরা শিল্পশ্রমিক হয়ে উঠেনি। যদিও প্রজাবিদ্রোহের নানা ঘটনা পৃথিবীর নানা প্রান্তে ঘটেছে।  আমাদের উপমহাদেশেও অত্যাচারী জমিদারের বিরুদ্ধে প্রজা বিদ্রোহ সংগঠিত হয়েছে তবু  বিপ্লব বা বিদ্রোহ করে সামন্তবাদ ছুড়ে ফেলে পূজিবাদ বা ধনতন্ত্র কায়েম হয়নি। ধনতন্ত্র এসেছে গফুরের মত অনুপায় মানুষেরা যখন মাটির কোল ছেড়ে  পূজিপতির কলকারখানায় মেশিন চালাতে আসতে শুরু করলেন। ক্রমে ক্রমে জমিদাররাও ব্যবসা বানিজ্যে জড়িয়ে পড়ে শহরমুখী হতে শুরু করে।

সমাজবিজ্ঞানী কার্ল মার্ক্স তার গভীর পর্যবেক্ষণ, অধ্যায়ন ও বিশ্লেষণ করে সমাজবিকাশের ধাপ সামন্তবাদের পরবর্তী স্তর পূজিবাদ আসবে বলেছেন, ব্যাখ্যা করেছেন। এই কাজের জন্য তাকে পড়াশুনা করে প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করতে হয়েছে, ও তা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত দিতে হয়েছে। সামন্তবাদ ইউরোপে ছিল কয়েক শতাব্দী ব্যাপি। ইউরোপে ব্যবসার ব্যপ্তি ও শিল্পবিপ্লবের ফলশ্রুতিতেই সামন্তবাদের বিদায় ঘন্টা বাজে। রাজরাজরা, ভূস্বামী, লর্ড, বায়রনদের কর্তৃত্ব ক্ষয় হয়। তবে ইউরোপে ঐতিহ্য বাঁচানোর নামে পুতুল খেলার মত সামন্ততন্ত্র নয় তবে রাজতন্ত্রকে এখনো কোন কোন দেশে টিকিয়ে রাখা হয়েছে ।

ভারতীয় উপমহাদেশে মোঘলদের সময়েই ফরাসী, ওলন্দাজ বা দিনেমার(ডাচ) ও ইংরেজরা আসে বানিজ্য করতে । ইংরেজ বানিজ্য প্রতিষ্ঠান ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী একসময়ে স্থানীয় নবাব ও রাজাদের  যুদ্ধে হারিয়ে এদেশের হর্তা-কর্তা হয়ে উঠে। ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে ১৭৫৭সাল অবিস্মরণীয় অধ্যায়। এই বছর স্থানীয় বিশ্বাসঘাতকদের সাহায্য ও সহযোগিতায় ইংরেজ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী পলাশীর প্রান্তরে বাংলার নবাব সিরাজদ্দৌলাকে ক্ষমতাচ্যুত করে হয়ে উঠে এ অঞ্চলের দন্ডমুন্ডের কর্তা। বানিজ্য করতে আসা ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বিজয় লাভের পরবর্তী সময়ে ইংরেজরাই হয়ে উঠে ভারতীয় উপমহাদেশের সর্ববিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের মালিক। ইংরেজ শাসক লর্ড কর্নওয়ালিস ১৭৯৩এ ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ প্রথা প্রতিষ্ঠা করে । যা সাধারন জনমানুষ বা আজকের ভাষায় বলতে গেলে আমজনতা ও ইংরেজ শাসকের মাঝে এক মধ্যস্বত্ব ভোগী জমিদার শ্রেণী তৈরী করে। ‘জমিদার হিসেবে ইংরেজরা বেছে নেয় প্রথম পর্যায়ে ‘হাড়ু ডাকাত’(‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলন বিষয়ক আলোচনার এক পর্বে অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের ভাষ্য থেকে পাওয়া) গোছের মানুষকে, যারা শক্তি সাহস নিয়ে নিষ্ঠুরভাবে লুঠতরাজ করে অর্থবিত্তের মালিক হয়েছিল’।

সায়ীদ স্যার উল্লেখিত ‘হাড়ু ডাকাত’ শ্রেণীর ষন্ডাদের জমিদার হয়ে উঠার বিস্তারিত সংবাদ পাওয়া যায় আরেক সাহিত্যিকের লেখনীতে।

সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ (জন্ম ১২ই সেপ্টেম্বর ১৪৯৪-মৃত্যু ১ নভেম্বর ১৯৫০) রচিত  ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসেই আমরা জানতে পারি জমিদার শ্রেণীর অর্থবিত্ত আয়ত্বের বিষয়ে পেছনের সব ঘটনা । ‘তখনকার কালে অনেক সমৃদ্ধশালী গৃহস্থও ডাকাতি করিয়া অর্থ সঞ্চয় করিতেন। বাংলা দেশে বহু জমিদার ও অবস্থাপন্ন গৃহস্থের অর্থের মূলভিত্তি যে এই পূর্বপুরুষ-সঞ্চিত লুণ্ঠিত ধনরত্ন, যাঁহারাই প্রাচীন বাংলার কথা জানেন, তাহারা ইহাও জানেন’ উপন্যাসের এই অংশটুকু পড়তে পড়তে মনে হল অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের রয়েছে অনুসন্ধিৎসু মন(curious mind) প্রাচীন বাংলার কথা তাঁরই তো জানার কথা, তাই তো তাঁর ভাষ্যে জানা যায় প্রথম পর্যায়ে ডাকাত শ্রেনীর নিষ্ঠুরতায় পারদর্শী শক্তিশালীরাই  ইংরেজদের কাছ থেকে জমিদারী পেয়েছিল। বিভূতিভূষণ ‘পথের পাঁচালী’তেই আরেক জায়গায় লিখছেন ‘বিষ্ণুরাম রায়ের পুত্র বীরু রায়ের এইরূপ অখ্যাতি ছিল । তাহার অধীনে বেতনভোগী ঠ্যাঙারে থাকিত। পথিককে মারিয়া তাহার যথাসর্বস্ব অপহরণ করিত ।’ বিষ্ণুরাম রায় ও বীরু রায় এরা দু’জনই অপূর্ব রায়ের অন্য কথায় আমাদের প্রায় সবার পরিচিত ‘পথের পাঁচালী’র  অপুর পূর্বপুরুষ ।

বিশবসাহিত্য কেন্দ্রের ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন ধারাবাহিক আলোচনা’ চলাকালীন সুপরিচিত অর্থনীতির অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ আমাদের আরও একটি কথা আবার স্মরণ করালেন তা হল এই জমিদার শ্রেণী বিষয়ে কর্নওয়ালিসের স্বপ্ন ও ভাষ্য হচ্ছে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে আমরা এমন এক শ্রেণী সৃষ্টি করবো যারা নিজেদের স্বার্থেই আমাদের রক্ষা করবে’।

  ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ নামের ভূমিব্যস্থাপনা সৃষ্টি করে কর্ণওয়ালিসের  স্বপ্ন পূরণ হয়েছিল তা অনস্বীকার্য, জমিদাররাই ইংরেজ শাসকদের রক্ষায় নানা ভূমিকা নিয়েছিল। তারা চাষীদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করে তা থেকে বিনা প্রশ্নে খাজনার ৮৯শতাংশ ইংরেজ শাসকদের হাতে তুলে দিয়েছে । জমিদাররা  সব করেছে বশংবদ চেলার মত । খাজনা দেওয়ার এই উদ্ভট নিয়ম ন্যায় কি অন্যায় তা নিয়ে জমিদাররা কখনো কি ভেবেছিল?  শুরুতে অবশ্যই ভাবেনি।  খাজনা আদায়ের জন্য প্রজাদের উপর যতো রকম জোরজুলুম করা দরকার জমিদাররা সবই করতো। প্রভু ইংরেজদের রক্ষার জন্য  সব সময় ‘জো হুকুম জাঁহাপনা’ বলে তৈরী থাকতো।

পরাধীন ভারতে ১৮৫৭ সাল আরও একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনবহুল বছর। ব্রিটিশ কলোনী ভারতে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ১৮৫৭সালে যখন সিপাহী বিদ্রোহ হয় তখন জমিদারশ্রেণী  ইংরেজ শাসকেরই পক্ষ নিয়েছিল। এইজন্যই  প্রথম পর্যায়ে ইংরেজ শাসকরা নিজেদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বিত্তবান, শক্তিমান, নিষ্ঠুর, লোভীগোছের মানুষদের হাতে জমিদারী অর্পন করার  মাধ্যমে জমিদার শ্রেণী গড়ে তুলেছিল।

  জমিদাররা কর(ট্যাক্স, খাজনা) আদায় করা ছাড়াও নিজেদের স্বার্থে সুবিধামত দরিদ্রপ্রজাদের যৎসামান্য সম্পদও জবরদখল করতো। জমিদারী লাভের আগে লুঠ-তরাজ, রাহাজানি করে সম্পদ অর্জনের কথা জানা যায় সাহিত্যিক বিভূতিভূষণের লেখনীর মাঝে আর জমিদার হওয়ার পর প্রজাদের জমিজমা কেড়ে নেওয়ার খবর জানান আরেক সাহিত্যিক আর ইঁনি হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবীন্দ্রনাথ (জন্ম ৭ই মে ১৮৬১-মৃত্যু ৭ই আগষ্ট ১৯৪১) স্বয়ং নিজে জমিদার ছিলেন তারপরও জমিদারের লোভী চরিত্র উন্মোচনে লেখক রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সংকোচহীন ও সৎ।

রবীন্দ্রনাথের ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতায় জমিদার নিজের বাগান দৈর্ঘে প্রস্থে  সমান করতে প্রজা উপেনের শেষ সম্বল দুই বিঘা জমি কিনে নিতে চাইলেন। দরিদ্র উপেন বাপ-দাদার সামান্য সম্পদ হাতছাড়া করতে নারাজ। তবে কে শুনে উপেনের কাতর আবেদন-নিবেদন? জমিদারের বজ্রকণ্ঠে ঘোষনা ‘ও জমি লইবো কিনে’। শেষ পর্যন্ত অসহায়, ভীত-দরিদ্র প্রজা উপেন জমিদারের লোভের থাবায় সব হারায়। জমিদার বিষয়ে লেখক বলেন ‘এ জগতে হায়, সেই বেশী চায়, আছে যার ভূড়ি ভূড়ি, রাজার হস্ত করে সমস্ত  কাঙালের ধন চুরি’। তারপর উপেনের কি হল? সেও কি গফুরের মত কারখানায় কাজের খুঁজে গিয়েছিল? রবীন্দ্রনাথের উপেন জমিজমা হারিয়ে সর্বহারা হল। সন্যাসীর বেশে সাধুর শিষ্য হয়ে দেশে, দেশে ঘুরে কত মনোরম দৃশ্য দেখে বেড়ালো। তবে কোন মনোরম দৃশ্যই তার মন থেকে পিতৃপুরুষের সূত্রে প্রাপ্ত দুই বিঘা জমির আকর্ষণ বা বাসনা ভুলিয়ে দিতে পারলো না। কিভাবে তা জমিদারের লোভের থাবায় সামান্য ভূমি হারিয়ে  উপেন ‘সর্বহারা’ সন্যাসীতে পরিণত  হল রবীন্দ্রনাথের এই কবিতা সর্বহারার উদ্ভবের কাহিনী বলে যায়।

লেখাটা এখানেই শেষ করা যেতো তবে শেষে এসে বলা যায় সাহিত্যিকেরা  গল্প বুনার ফাঁকে ফাঁকে সমাজ জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতের যে নানান চিত্র তুলে ধরেছেন তাতে সাহিত্যিকের চোখে ধরা পড়ে সমাজকাঠামোর নিবিড় ছবি। সে সমাজকাঠামো পরিবর্তনের ইশারা বা ইঙ্গিতও সাহিত্যিকের দৃষ্টিও এড়ায়নি। গফুর ও উপেন দুজ’নের কেউই জমিজমা হারিয়ে শহরে এসে শিল্প মালিক বা ধনী হয়নি। তারা সর্বস্ব হারিয়ে হয়েছে সর্বহারা শিল্প শ্রমিক।

কার্ল মার্ক্সের (জন্ম ৫মে ১৮১৮-১৪ মার্চ ১৮৮৩) মত সমাজবিজ্ঞানী গভীর অধ্যায়ন ও পর্যবেক্ষণের আলোতে সেগুলোর বিশ্লেষন সাপেক্ষে সমাজ পরিবর্তনের তত্ত্ব উপস্থাপন করেন,  অর্থনৈতিক ব্যবস্থার  এক ধাপ থেকে আরেক ধাপে  উত্তোরণের ভাষ্য গ্রন্থন করেন।


Place your ads here!

Related Articles

এ সবই আমি ছিলাম, এখন কিছুই নয়

দিলরুবা শাহানা: এক সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, আন্তর্জাতিক সংস্থা আইএলও এর উন্নয়ণ পরিকল্পনা বিশেষজ্ঞ মোহম্মদ আনিসুর রহমানের লেখা

ক্রিকেট ভক্ত

ফজলুল বারী, নেপিয়ার থেকে আমার এক বন্ধু লিখেছেন বাংলাদেশের ক্রিকেট কী এখনো হোয়াইটওয়াশের পর্যায়ে আছে? উত্তরটি বাংলাদেশের কন্ডিশনে না, বিদেশের

A Cardiological Sojourn in Bangladesh writes Dr Ian Jeffery from Canberra

Associate Professor Atifur Rahman is a cardiologist at the Gold Coast Hospital. A medical graduate from Bangladesh he continues to

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment