বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ও তার ‘হৃৎপিন্ডের খড়কুটো’ নিয়ে আলোচনা

ভারতের পশ্চিম বঙ্গের কবি বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় বর্তমান সময়ের অন্যতম সুপরিচিত লেখক ও কবি। সম্প্রতি কবি বিনায়ক এসেছিলেন মেলবোর্নের বাংলা সাহিত্য সংসদের অতিথি হয়ে। কোভিডের দীর্ঘ ভ্রমণ বিরতি ও সঙ্গরোধ(আইসোলেশন) নীতির পরে যখন লোকজন নানা আয়োজনে সম্মিলিত হওয়ার জন্য আগ্রহী, দেশ-বিদেশে পাড়ি জমাতে উদ্যোগী তখন লেখক-কবি বিনায়কও আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে মেলবোর্নে এসেছিলেন মে মাসে। যথাযথ নিয়ম অনুযায়ী পাঠকেরাও উপস্থিত হলেন কবির কথা শুনতে। সবাই লেখকের কবিতা পাঠ শুনলেন, তার পরিচিতি পাঠ শুনলেন। পাঠকেরা মুগ্ধ হলেন লেখক কবি বিনায়কের স্বকণ্ঠে গল্প, কবিতা শুনে। তাঁর কবিতার উপর সংক্ষিপ্ত একটি আলোচনাও উপস্থাপিত হয়। আলোচনাটির উপস্থাপক ছিলেন বর্তমান প্রবন্ধকার।
পশ্চিম বঙ্গের ‘দেশ’ সাময়িকীতে ‘হৃৎপিন্ডের খড়কুটো’মূল শিরোনামের আওতায় বিভিন্ন নামে পঁচিশটি কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল। মেলবোর্নের লেখিকা টুকু দি এই কবিতাটি নিয়ে আলোচনা করতে উৎসাহিত করেন। ‘হৃৎপিন্ডের খড়কুটো’ আদতে এক গুচ্ছ কবিতার সম্ভার। যারা কবিতা পড়তে ভালবাসেন, পছন্দ করেন তাদের কাছে কবিতার হ্রষ্ব, দৈর্ঘ কোন বিষয়ই না। বা কবিতার অবয়ব নিয়েও মাথা খুব একটা ঘামান না। কবিতার কাজ পাঠকের অনুভূতির ভূবন আলোড়িত করা, মস্তিস্কে অনুধাবন করার তীব্র ভাবনা বা আকাঙ্খা জাগানো। আনন্দ আস্বাদনে, দুঃখ অনুধাবনে, সংকট-সমস্যার গভীরতা বুঝতে ইশারা দেয় কবিতা।
এটি ছাড়াও ‘দেশ’ সাময়িকীতে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত বিনায়কের কিছু কবিতা পেলাম। আলোচনার জন্য ‘হৃৎপিন্ডের খড়কুটো’ নামের কবিতার সম্ভার বেছে নিলাম। শিরোনাম দেখে কবিতাগুলো পড়ার আগেই নামটা নিয়ে গভীর ভাবনায় নিমজ্জিত হলাম।
নাম নিয়ে কেন ভাবনায় পড়লাম তা বলছি এবার। পাখীদের দেখেছি প্রতি বছরই একটা সময়ে ঠোঁটে খড়কুটো নিয়ে ওড়ে ওড়ে যাচ্ছে। বাসা বাঁধবে বলে। গাছের ডালে, ঘরের চালে সুবিধামত জায়গায় ওই খড়কুটো দিয়ে বাসা বানানোর স্বপ্নে সে বিভোর। কবি বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় তার হৃদপিন্ডের খড়কুটো দিয়ে কি নির্মানের স্বপ্নে আচ্ছন্ন ছিলেন জানতে উদগ্রীব হলাম। কবিতা পড়তে শুরু করে দেখি কবি তার হৃদপিন্ডে সঞ্চিত খড়কুটো দিয়ে বিচিত্র সব অনুভূতির ইমারত নির্মাণ করছেন। হৃদয়ে অনুভূত নানা বিষয় তার কবিতাতে নিজস্ব আঙ্গিকে দল মেলেছে।

হৃদয়ের খড়কুটো দিয়ে বিভিন্ন শিরোনামে নানা অনুভূতির মনকাড়া সব উপস্থাপন। শুরুর কবিতার নাম করন হয়েছে গ্রীক মিথ থেকে আন্তিগোণের নাম ব্যবহার করে। প্রথম কবিতা ‘সেই তো আন্তিগোণে’। তাতে বিবৃত অনুভূতির শুরু ও শেষ টুকু
‘মেহেন্দী যে হাতে আঁকা, যে গলা গান জানে
বান্দা তাকেই গেয়ে বেড়ায় আখ্যানে আখ্যানে
…………………………………………
বান্দা তবে বলতে পারে, নাও যদি কেউ শুনে;
রাজার মুখোমুখি যে মুখ, সেই তো আন্তিগোণে…’
শেষ লাইন হলেও এখানেই শেষ নয়। খেয়াল করে দেখা যায় কবিতার শেষ লাইনে শেষ তিন ডট বা বিন্দু ইঙ্গিত দিচ্ছে না বলা কথার। থেকে গেছে অনুচ্চারিত কিছু যা কবি বলেন নি। বোধহয় পাঠককে স্বাধীনতা দিয়েছেন যার যার মত করে ভেবে নিতে। আন্তিগোণে কে ছিলেন? গ্রীক মিথোলজীতে রাজার স্ত্রী, প্রেমিকা না আর কেউ? পাঠকের কৌতূহল উসকে দিয়েছেন কবি। গ্রীক মিথোলজীতে গুরুত্বপূর্ণ এক নারী আন্তিগোণে। রাজা ইডিপাসের কন্যা ছিলেন। সিংহাসন নিয়ে ইডিপাসের দুই পুত্রের লড়াই, দ্বন্ধ। তারা আন্তিগোণের দুই ভাই। কথা ছিল এক এক বছর একেক ভাই রাজ্য শাসন করবে। একটা সময়ে এসে এক বছর ভাই পলিনেসকে রাজ্যের শাসন ভার দেওয়া হলো না। পলিনেস সংগঠিত বাহিনী নিয়ে রাজ্য শাসনের দাবীতে লড়াই শুরু করে। সংঘর্ষের এক পর্যায়ে দুই ভাই হাতাহাতি লড়াইতে পরস্পরকে হত্যা করে। সিংহাসন আসীন ভাইয়ের রাজকীয় মর্যাদায় শেষকৃত্য সমাপন হয় আর সিদ্ধান্ত হয় পলিনেসের মরদেহ ফেলে রাখা হবে জন্তু জানোয়ারের খাবার হিসেবে। আদেশ জারী হয় কেই তার শেষকৃত্যের চেষ্টা করলে তার জন্য মৃত্যুদন্ড বিধান। ভাই পলিনেসের মরদেহের অপমান ও লাঞ্চনা বোন আন্তিগোণে মানতে পারলোনা। নারী মৃত্যুদন্ডের তোয়াক্কা না করে যথাযথ নিয়মে পলিনেসের মরদেহ সমাহিত করে। কোন ভয়ভীতি আন্তিগোণেকে তার সিদ্ধান্ত থেকে বিরত করতে পারে নি। আদেশ অমান্য করে পলিনেসকে সমাহিত করার অপরাধে তাকে জ্যান্ত কবর গহ্বরে ফেলে পাথর ছুড়ে মারার কথা ছিল। কিন্তু হায়! দন্ড কার্যকর করার সুযোগ শাসকরা পেল না তার আগেই আন্তিগোণে নিজেই আত্মহত্যা করে নিজের জীবন অবসান করে। রাজার মুখোমুখী আন্তিগোণে, রাজাদেশ তুচ্ছ করে আন্তিগোণে। এই কবিতায় কবি নারীর শক্তির ইঙ্গিত দিচ্ছেন, এখানে পাঠক ন্যায্যাতার পক্ষে নারীর শক্তির প্রকাশ বা উদ্ভব দেখতে পান। আরও একটি বিষয় সচেতন পাঠকের বিবেককে বিব্রত করতে পারে, আঘাতও করতে পারে। গ্রীক মিথের নারী একজন আন্তিগোণে নিজ মৃত্যু ভয় তুচ্ছ্ব করে মৃতকে রীতি মেনে সম্মানের সাথে যথাযথ ভাবে সমাহিত করেন অথচ নিকট অতীতে কেউ একজনকে হত্যা করা হয়। সে হতে পারে সমাজের জন্য হুমকি, তবুও কোন রীতিনীতির ধার না ধেরে তার মরদেহ সাগরের পানিতে ডুবিয়ে দেওয়া কি নায্য হয়েছিল? তখন এই বিশাল বিশ্বে কেউ একজনও মানুষের মরদেহের প্রতি সামান্য সম্মান দেখানোর দাবী দূরের কথা প্রস্তাবও তুলেন নি। আন্তিগোণের মত এমন কেউ ছিলনা যে শক্তিমানের মুখোমুখী হবে। কবিকে ধন্যবাদ এই নারীকে স্মরণ করানোর জন্য।
কবিতা অংক নয়, জ্যামিতি নয়। সবার পাঠের শেষে ফলাফল কখনোই এক হবে না। পাঠক বুঝে নেবেন কবিতাকে নিজের মতো করে, এখানেই কবিতা পাঠকের রয়েছে স্বাধীন সন্তরণের অধিকার।
এরপর কবি নানা শিরোনামে নানা অনুভূতি প্রকাশ করেছেন। তেমন পঁচিশটি শিরোনামে রয়েছে নানা ভাষ্য। তবে কোন কোন লাইন হয়তো সবারই মন ছুঁয়ে যাবে আর কোনটা হয়তো কাউকে না কাউকে ভাবাবে। কয়েকটি কবিতার শিরোনাম উল্লেখ করা হল। ‘মৃত্যুতে যে রং করেনি’, ‘আমিই দায়ী’, ‘বদলে যাওয়ার কাছে’, ‘জংশন’, ‘আদিম’, ‘তোমার পাশে’, ‘আটঘন্টা মাত্র’, ‘বিনা বাঁধায়’ ‘কুহু একাই গাইতে পারতো’, ‘জিভের নীচে যে প্রার্থনা’, ‘দেউলিয়া’, ‘মেঘের পাঁজড় ফুঁড়ে যখন’, ‘কার্তিক’, ‘বায়না’, ‘নির্বাসিত’, ‘সারাৎসার’, ‘তীরের ফলা’, ‘এলিজি’, ‘সম্বল’, ‘বড় ব্রীজের তলায়’, ‘অন্ধের সঙ্গমে’, ‘ট্যাটু’, ‘কার নিকটে’, ‘ভগবানের পাপে’, । প্রতিটি কবিতাই নিজস্বতায় পরিপূর্ণ। এদের মাঝে যোগসূত্র খুঁজতে যাওয়ার প্রয়োজন নেই । কবিতার শিরোনাম দেখে পাঠকের হয়তো কৌতূহল জাগবে কোন একটি কবিতা বিষয়ে। সেটা হতে পারে ‘কুহু একাই গাইতে পারতো’ শুনে ভাববে একা কেন কুহু কেকা কই? যাক পাঠক নিজের মত করে আনন্দ খুঁজে পাক বা দুঃখকে ছুঁয়ে দেখুক কবিতায় কবিতায়।
মিথের নারী যেমন ধরা দিয়েছে বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতায় তেমনি বর্তমান সমাজ জীবনের বাস্তবতা কবি তুলে ধরেছেন ‘অন্ধের সঙ্গম’ কবিতার ক’টি লাইনে
‘বাগান হাতের বাইরে বলে
ফুল ফোটাচ্ছি টবে
…………………
টবের মত দাড়িয়ে আছি
ফ্লাটের বারান্দাতে
চিরদিনই বাগান যখন
অন্য কারো হাতে’
সবার জানা বর্তমান সময়ে বসবাসের জায়গার বড় অভাব। বাগানতো দূরস্ত। তবু মানুষের মনে সাধ থাকে ফুলের জন্য, গাছের জন্য। মানুষ তার সাধ পূরণ করার জন্য বর্তমানে ভিন্ন উপায় বের করেছে। ছাদ বাগানের না না খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়। ঝুলন্ত বারান্দা বা ব্যালকনীতে কি গাছ লাগানো যায় সে সব তথ্য ফলাও করে প্রচার করা হয়। সব কিছুর পেছনে কাজ করে যে বোধ তা হল মানুষের মনের গভীরে লুকানো সাধকে সাধ্যের আওতায় আনার চেষ্টা। এক টুকরো জমিও খালি নেই তাইতো বর্তমানের মানুষ গাছ লাগানোর বা বাগান করার সাধ মেটায় ফুল ফুটিয়ে টবে। তবে কবি বলছেন বাগান যখন অন্য কারো হাতে তবুও ফুলের অধিকার মানুষ রাখতে পারে হিয়ায় বা অন্তরে। কি সে অধিকার? গভীর ধ্যানে ধরা দেয় সে অধিকার। তা ভাল লাগার, ভালবাসার অধিকার। কাকে? ফুল, লতা-পাতাকে ভালবাসার। আইন আমাদের নানান অধিকার নিশ্চিত করে যা সময়ে অসময়ে খর্ব হয় মাঝে মধ্যে। তবে যে অধিকার হৃদয় থেকে বা অন্তরের আকুতি থেকে উৎসারিত, তা অন্য কারোর অধিকার যেমন কেড়ে নেয় না অন্যদিকে তার ভালবাসার অধিকারও কেউ কেড়ে নিতে পারে না।
‘সম্বল’ কবিতার দু’টি লাইন
‘ দেখতে না হলে পরে চোখে বাঁধো বস্ত্র
দৃষ্টি বিপথে নিলে অন্ধতা অস্ত্র’
খুব চমৎকার ভাষ্য! কি যুক্তি! কি করে সুপথে চলা সম্ভব যখন চোখ অন্ধ। আর সেই অন্ধত্ব তৈরী হয়েছে স্বেচ্ছায় চোখ আচ্ছাদিত করে। অন্ধ যে সে পথ তো হারাবেই। বেপথু হবে অন্ধত্বের অযুহাতে। অন্যায়, অনায্যতা দেখতে পাবে না। কারন সে অন্ধ। সময় এখন অন্ধত্বের। পুরস্কার আর পারিতোষ পাওয়ার আশায় অন্যায় অবিচার না দেখার ভান করাই উত্তম। একটি সাধারন উদাহরণ মানুষের লোভের থাবায় বন জঙ্গল উজার হচ্ছে, মাটি ফেলে ভরাট করে নদীকে মৃত্যুর মুখে ফেলা হচ্ছে তবুও প্রতিবাদ উঠে না। ভয় যদি এ প্রতিবাদের কারনে সম্পদশালীর দেওয়া পুরস্কার না জুটে কপালে। বরং চোখ বুজে থাকাই ভাল। এই কবিতায় কবি যা বলছেন বা বলতে চেয়েছেন তা গুণীরা বুঝে নেবেন অবশ্যই।
শেষ কবিতার শিরোনাম ‘ভগবানের পাপে’। তা থেকে শেষ ক’টি লাইন দিয়ে বক্তব্য শেষ করবো তবে এই শেষ লাইনগুলো দিয়ে পাঠক হিসেবে কবিকে জানাই কবি যেন কবিতার চৌহদ্দিতে আরও অনেক অনেক কিছু নির্মান করে চলেন।
‘বেরিয়ে যাবার সমস্ত পথ
দাও করে দাও বন্ধ
তোমার মঞ্চে কথা বলুক
আমার হাতের ছন্দ।’ পাঠক কবিকে বলুক ‘আমার মঞ্চে কথা বলুক তোমার হাতের ছন্দ’।
Related Articles
Former President General Pervez Musharraf faces criminal prosecution
It is marvellous what a difference a couple of years makes in politics. General Musharraf was an undisputed leader of
যে সব কারনে ক্ষমতায় থাকছে আওয়ামী লীগ
ফজলুল বারী: নির্বাচন নিয়ে দেশজুড়ে যে পরিস্থিতি তাতে এখনই বলে দেয়া যায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এই নির্বাচনেও ক্ষমতায় থাকছে। কেনো
Exhibition of Contemporary Art of Bangladesh in Canberra
High Commission of Bangladesh in Australia; University of Canberra and Bengal Gallery of FineArts, Dhaka in collaboration with Bangladesh Australia