করোনার অভিশাপ নাকি আশির্বাদ

করোনার অভিশাপ নাকি আশির্বাদ

(করোনা নামের জাদরেল অসুখটা এখনও চলছে। আজ এই দেশকে পর্যুদস্ত করছে তো আগামীকাল আরেক দেশকে। প্রায় সবারই বন্ধু পরিচিতজনদের কেউ না কেউ কর্মহীন হয়েছেন করোনার ‘কল্যাণে’। এই কাহিনী বুননের পেছনে একটি শোনা ঘটনা। এক বাড়ীতে  সকালে কাজের বুয়া বেশ দেরী করে হাপাতে হাপাতে হাজির হল। তার  মাস্ক ঝুলছে থুতনির নীচে। দেরীর কারণ জানতে চাইলে সে জানালো সরকার করোনার সময়ে গরীবদের আড়াই হাজার করে টাকা দেবে তাই আজকে এক প্যান্টশার্ট পরা ভাই এসেছিলেন  নাম লিখে নিতে।  খাতায় নাম তুলতে মাথা প্রতি পাঁচ শ’ টাকা করে দিতে হয়েছে। মধ্যবিত্ত গৃহিনী শুনে হা হুতাশ করে বললেন গরীব হলে ভাল হতো। কত সহজে সরকারী টাকা পাওয়া যেতো। বুয়া শেষ পর্যন্ত সরকারী টাকা এবং ওই নাম লিখিয়ে ভাই কারোর চেহারা কোনদিন দেখেননি )

একদিন করোনা নামে প্যানডেমিক হয়তো শেষ হয়ে যাবে বা বিশ্ব থেকে বিদায় নেবে। তবে তার অভিশাপে বা আশির্বাদে, তার বদৌলতে বা বদদোয়াতে পৃথিবীতে অনেক অনেক কিছু ঘটেছে, ঘটে চলেছে। অতি সাধারন মানুষ অসাধারন কিছু কাজ করেছে। কোন কোন সৎ মানুষ অসৎ কাজে জড়িয়েছে। এসবই ঘটেছে। কেন এমন ঘটেছে কেউ সঠিক বলতে পারবে কি? উত্তর সোজা নয়। তবে যে কথা চিরন্তনী হয়ে থাকবে তা হল ‘করোনাতে ধনী বাড়ে, করোনা প্রাণ কাড়ে’।

এক রাতে ঢাকার কোন এক সরকারী কলোনীর ছোট্ট দুই কামরার বাসার সাবলেট সামির যখন ক্ষুধার যন্ত্রণায় চিনাবাদামের খোসা ছাড়িয়ে খুটে খুটে খাচ্ছিল আর চুমুকে চুমুকে পানি পান করছিল তখনই ভয়ংকর এক অপরাধের চিন্তা মাথায় আসলো। আজ সে পাচিল ঘেরা কলোনীর সামনের ফটক দিয়ে ঢুকতে সাহস পায়নি কারন গেটের কাছে টংএর মুদী দোকানীর কাছে অনেক দেনা হয়ে গেছে। ক্ষুধা মিটাতে ছোট ছোট চাঁপাকলা ও পাউরুটি কিনে খেতে হয়েছে গত কিছুদিন। ধার শোধের উপায় খুঁজে পাচ্ছে না। আজ সে পাওনাদারের হাত থেকে বাঁচার জন্য সদর দরজার উল্টা দিকে ভাঙ্গা দেয়ালের ফাঁক গলিয়ে বাসায় ঢুকেছে। শেষ সম্বল বউয়ের কানের সোনার দুলটি কাল বিক্রি  করতে হবে। কর্মহীন দু’মাস চলছে। বউকে বাপের বাড়ী পাঠিয়ে দিয়েছিল প্রথমেই। যাওয়ার সময় বউ জোর করে দুলটা রেখে গেছে। বলে গেছে

-দরকারে এটা বিক্রি করে দিও। চাকরী হলে আবার গড়িয়ে দিও কেমন।

 ছোটখাটো সরকারী চাকুরে বাড়িওলার উপর খুব রাগ হচ্ছে। যদিও গত দুই মাস ধরে সামির ঘরভাড়া দিতে পারছে না তথাপি লোকটা বাজে কথা কিছু বলে নি। সেও অভাবী লোক। একটা ছেলেকে নিয়ে ঢাকায় থাকে। ছেলে তার নাইট কলেজে পড়ে আর দিনে কোন দোকানে সেলসম্যানের সহকারী হিসেবে কিছু রোজগার করে।। সামিরের কাছে ঘরভাড়া দিয়ে  বাড়তি কিছু অর্থ লোকটি পায়। সে অর্থও তার খুব দরকার। সামিরও ইমামগঞ্জে এক ব্যবসায়ীর হিসাব দেখে। তাতেই তার জীবন ধারন করতে হয়। স্ত্রীর আসার পর কম তেল মশলায় সামান্য ভর্তা, ভাজি কিংবা কখনো সখনো ছোট মাছের ঝোল রান্না করে খেতো ওরা। তা থেকে বাড়ীওয়ালাকেও দিতো মাঝে সাঝে। তবে রান্না খুব সুস্বাদু। রাধতে বৌটি ভালবাসে। বাড়ীওয়ালা প্রস্তাব দিল সামিরের বউ যদি ওদের বাপ-বেটার রান্নাটা করে দেয় তবে খুব কৃতজ্ঞ থাকবে তারা। সারাদিন একলা থেকে থেকে বিরক্ত বউ এই কাজটা করার প্রস্তাব পেয়ে খুশী হল। নিজের রান্নার হাত ভাল, মানুষ তার রান্না খেতে চায় ভেবে আনন্দ হল। বাপ-ছেলে সন্ধ্যার পর ঘরে ফিরে রাধুনীর দেখা পেতো না। কারন সে তাদের সামনে কখনোই আসতো না। তবে রান্নার খুশবুতে তাদের মন ভরে উঠতো। মজার ঘটনা ঘটলো এক মাস পর। বাড়ীওয়ালা ঘরভাড়া দুই’শ টাকা কম নিলেন। পরের মাসে তিন’শ টাকা কম নিলেন। টাকাগুলো সামির বউয়ের কাছেই রাখতে বললো। সব মিলিয়ে এখানে বউ ছিল দশমাস। প্রায় তিন হাজার টাকার মালিক সে হয়ে গেল। সামিরের কাজ করোনার কারনে বন্ধ হল। বউকে গ্রামে পাঠাতে বাধ্য হল। যাওয়ার সময় বউ টাকাগুলো রেখে যেতে চাইলো কিন্তু সামির রাখলো না।

এখন সামির কলোনীর ছোট্ট ঘরের ভাড়াও দিতে পারছে না। বাড়ীঅলা ভাড়ার জন্য চাপ দিচ্ছে না, উঠে যেতেও বলছেনা। করোনার সময়ে নতুন ভাড়াটে পাবেনা এটা নিশ্চিত। এরমাঝে সামিরের মোবাইল ফোনটা ছিনতাই হয়ে গেল। প্রতিদিনই চারদিকে উদ্দেশ্যহীন হাঁটাহাঁটি করে। পরিচিত সব দোকানে খাবার কিনে ধারদেনা বাড়ছে। অবস্থাসম্পন্ন আত্মীয় বন্ধু কাছে নাই যাদের কাছে গিয়ে একবেলা পেটভরে খেয়ে আসতে পারবে।

বাড়ীঅলা ওর ক্ষুধার খবর পেয়ে গেছে। মুড়ি, বিস্কুট, বাদামের ছোট ছোট কৌটা প্রথমে রান্নাঘর থেকে সরিয়ে নিল। আজ সরিয়ে নিয়েছে চা-পাতা আর চিনির কৌটা। খুব রাগ হচ্ছে লোকটার উপর। আজ সারাদিনে টোস্ট বিস্কুট দুইটা খেয়েছিল। বাদাম কিনে ফিরেছে। ভেবেছিল লিকার চা বানিয়ে বাদাম চিবাবে তা আর হলোনা। ক্ষুধার যন্ত্রনায় অস্থির সে। এমন সময় দরজায় টুকা পড়লো। দরজা খুলতেই ফোন বাড়িয়ে দিয়ে বাড়ীঅলা বল্লো

-আপনার ভাইয়ের ফোন

মনে পড়লো ভাই একদিন বাড়ীঅলার ফোন নম্বরটা চেয়ে নিয়েছিল। ফোন নিয়ে নিজের ঘরের বিছানায় বসে কানে চেপে ধরলো। ভাই তার বেশ চালাকচতুর ছেলে। কত ঘাটের পানি খেয়ে মরক্কোর শহর তানজির থেকে ছোট্ট নৌকায় জিব্রালটার প্রণালীর প্রায় ত্রিশ কি উনত্রিশ মাইল পানি পাড়ি দিয়ে স্পেনের সিভিলে গিয়ে উঠেছে। স্থায়ী কাজকর্ম এখনো জুটাতে পারেনি তবে বুদ্ধি খাঁটিয়ে টিকে আছে ওই দেশে। আজ ভাই তাকে ক্ষুধা নিবৃত্তির পরামর্শ দিল।

-শোন তুমি একবার ঢাকার বস্তিতে বস্তিতে কি একটা কাজ করেছিলে না?

-করেছিলাম তো। ছুটির দিনে ঘুরে ঘুরে একটা এনজিওর জন্য বস্তিবাসীর শিক্ষাদীক্ষা ও কাজের ধরন বিষয়ে তথ্য  জোগার করতাম। তাতে বাড়তি কিছু রোজগার হতো।

-কাল আবার তুমি ওই বস্তিতে যাবে, খাতা আর কলম সঙ্গে নিয়ে

-কেন? কি করতে?

-সরকারতো বলছে গরীব মানুষজনকে আড়াই হাজার করে টাকা দেবে। তুমি বস্তিতে গিয়ে মানুষজনকে বলবে ওই টাকা পেতে হলে খাতায় নাম তুলতে হবে। খাতায় নাম তোলার জন্য মাথাপিছু প্রত্যেকের কাছ থেকে দুইশ’ টাকা করে নিবে।

-কাজটা কি ঠিক হবে? অন্যায় হবে না?

-তুমি ক্ষুধায় মরছো আবার ন্যায়-অন্যায়, ঠিক-বেঠিক নিয়ে ভাবছো কেন?

-ওরা দুইশ’ টাকা দিতে পারবেতো?

-আড়াই হাজার টাকা পাওয়ার আশায় ওরা চুরি করে হলেও দুইশ’ টাকা জোগার করবে বুঝেছ। পরিস্কার প্যান্টশার্ট পরে যাবো। ওদের নাম ইংরেজীতে লিখবে।

তারপর ভাই তাকে লম্বা চওড়া এক বক্তৃতা দিল। কিভাবে ইরাকে মারনাস্ত্র আছে এই ডাহা মিথ্যা বলে ওই দেশে হামলা চালিয়ে তেলের খনি উজার করে লুটে নিয়ে গেছে পৃথিবীর বলবান বদমাশরা। পিকে হালদার নামে বাংলাদেশের আরেক ধুরন্ধর শয়তান মোটা টাকা সুদ দিবে লোভ দেখিয়ে সাধারন মানুষের তিন নাকি চার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে অন্যদেশে গিয়ে মহাসুখে বসে আছে। এতো বড় বড় অন্যায় করে এরা পার পেয়ে যাচ্ছে। সামিরকে এটা পারতে হবে। তাছাড়া সামিরতো ওদের টাকা নিচ্ছেনা। সরকার করোনার সময়ে গরীবদের যে সাহায্য দেবে তা থেকে আগে ভাগেই সামির সামান্য কিছু বুদ্ধি করে হাতিয়ে নেবে।

বুদ্ধিমান ভাইয়ের কথামত সামির পরদিনই লম্বা এক খাতা ব্যাগে নিয়ে মিরপুর বস্তিতে গেল। এর আগেও সে এখানে ওই তথ্য সংগ্রহের কাজে এসেছে। চেনা মুখ সে। মানুষজন ভীষণ ব্যাকুল হয়ে খাতায় নাম তুলতে ছুটে আসলো। বহুকষ্টে জমানো টাকা থেকে দুইশ’ টাকাও সামিরের হাতে তুলে দিল। টাকার নোটগুলো ঝকঝকে নতুন নয়। পুরানো জীর্ণশীর্ণ। তারপরও টাকাতো। প্রায় তিন চার শ’ মানুষের নাম খাতায় তুললো। কাগজের নাকি চটের শপিং ব্যাগে খাতা কলম নিয়ে এসেছিল। সে ব্যাগেই টাকাগুলো নিয়ে ফেরার পথ ধরলো। রাস্তায় পরোটা ভাজি কিনে অনেকদিন পরে পেটপুরে খেলো। ঘরে ফিরে টাকা সামলে রেখে গোসল সারলো। তারপর কিছু টাকা হাতে নিয়ে বের হল।  মুদীর দোকানীর পাওনা মিটিয়ে দিল প্রথমে। তারপর বাজারে গিয়ে চা-পাতা চিনি, লবন ছাড়াও সব কিনলো। একটু গরুর কলিজীও কিনলো সে।

ফিরে এসে রান্না শুরু করলো। বাড়ীঅলা ফিরে আসার আগেই রান্না শেষ। বাড়ীভাড়া মিটিয়ে দিল। বাড়ীঅলার সপ্রশ্ন মুখ দেখে বললো

-ভাই টাকার ব্যবস্থা করেছে।

সন্ধ্যাবেলা হৃষ্ট মনে বের হয়ে ঘুরে ফিরে চারদিক দেখছিলো। নিত্যকার মত গেটের কাছে অন্ধ ফকিরকেও দেখতে পেল। তাকে সে পঞ্চাশটা টাকা দিল। বাজারের দিকে কলোনীর দেওয়ালে হেলান দিয়ে আলুথালু বেশে ‘রাতের রানীটি’ খদ্দের ধরার জন্য বসেছিল। তাকেও সে পঞ্চাশটাকা দিল। তারপর ঘরে ফিরে ঘুমাতে গিয়েও ঘুম আসলো না। টাকা গুণতে বসলো সে। এতো টাকা সে জীবনে কখনোই হাতে পায়নি। করোনার কল্যাণে একদিনেই সে হাজার হাজার টাকার মালিক। ওর মাথায় নানা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। বস্তির মানুষগুলো সরকারের সাহায্যের আড়াই হাজার টাকা পাবে তো? আগামীকাল সে সাঈদাবাদ বস্তিতে যাবে তো?

সহজ সরল মানুষগুলোকে অর্থপ্রাপ্তির আশ্বাস দিলেই খাতায় নাম লেখাতে আসবে। আর তাতে সামিরের চটের থলে ভরে উঠবে টাকায়। কি করবে না করবে ভেবে ঠিক করতে পারছে না সে। পরদিন ঘুম থেকে উঠে সামির কি করছিল? সে কি ধাপ্পাবাজি করে টাকা তুলতে আরেক বস্তিতে গিয়েছিল? সন্ধ্যায় থলে ভর্তি টাকা নিয়ে ঘরে ফিরেছিল? নাকি ধরা পড়ে জনতার গণপিটুনিতে…


Place your ads here!

Related Articles

নির্বাচন নয় আরাকান চাই

১৯৭০ সালে ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাঙ্গালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নির্বাচন পেছাতে বাধ্য করেছিলেন। ফলে সে নির্বাচনে

21st Century “Kunta Kinte”! Chapter 7: Turning point!

21st Century “Kunta Kinte”! Introduction: Revealing the “untold”! | Chapter 1: The realisation! | Chapter 2 : The beginning! |

আমি আলাদা নই – হতে চাই না – আমি জানি না!

হাইস্কুলে যখন নবম বা দশম শ্রেনীর ছাত্র, প্রায়ই জুনিয়রদের কাছ থেকে একটা প্রশ্ন শুনতাম, ভাইয়া ‘I don’t know’ শব্দগুলোর মানে

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment