হিমু ভাবনা – জিল্লুর ভাই

হিমু ভাবনা – জিল্লুর ভাই

ক্যানবেরাতে এখন গ্রীষ্মকাল। এবারের গরম গত বছরের মতো নয়। গত বছর এই সময় জনপদ ছিলো তীব্র দাবানলে পর্যদুস্ত। একেবারে তথৈবচ অবস্থা। ক্যানবেরার গা লাগোয়া হাজার হাজার কিলোমিটার জায়গা জুড়ে জনবসতি , বনবাদাড় পুড়ে হয়েছিলো ছাই। এই আগুনের সূত্রপাত হয় বনের রাস্তায় গাড়ি থেকে ছুড়ে ফেলা সিগারেটের আগুন , শুকনো বজ্রপাত ও রুক্ষ -শুষ্ক গাছে গাছে ঘর্ষণের ফলে। এই কোনো এক কারণে একজায়গায় আগুন লাগে। মোগো , বেগা-ভ্যালি ,ব্যাট্সম্যান বে , কোবার্গ , মলুয়া বে , ন্যালিগ্যান , কারওয়ানেয় লক্ষ লক্ষ একর বিস্তৃত বনের শুকনো ঘাষের ডগায় ভর করে এই দাবানল মুহুর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। এক বনের আগুন অন্য বনের আগুনকে আগলে ধরে। হয়ে যায় সর্বগ্রাসী এক বিভীষিকা।

ওই গ্রীষ্মের দিন গুলোতে দুপুরে রোদে গিয়ে দাড়ালে মনে হতো একটা আগুনের কুণ্ডলির মাঝে পড়ে গিয়েছি বুজি। ওই অবস্থায় কেউ যদি একটা দিয়াশলাই জ্বালিয়ে ছুড়ে দিতো তবে হয়তো বাতাসেই আগুন ধরে যেত । এই তীব্র গরমের আঁচে , আমার বাসার সীমানা ঘেঁষে অস্ট্রেলিয়ান নেটিভ পাতা বাহারের যে ১৫-২০ টা গাছ ছিলো , তার সব পুড়ে মরে গিয়েছিল।

“এল-নীনা” আবহাওয়ার কারণে গেলো শীত-বসন্তে বৃষ্টি হয়েছিল বেশ। শুস্ক -রুক্ষতা পিছু হটেছে। বন বাদাড়ে নুতন প্রাণের হাওয়া লেগেছে।পুড়ে যাওয়া গাছের কোটরে নতুন গাছ গজিয়েছে। মৃতপ্রায় বনের মাটিতে এখন কচি সবুজ ঘাসের আচ্ছাদন। জীবন ফেরী পেয়েছে জীবন ! হাজার বছরের ওল্ড ফরেস্টকে প্রকৃতি আবারো স্বাজিয়েছে নূতন করে।

গরমের এই সময়টাতে খুব ভোরে , রাত ও দিনের সন্ধীক্ষনে একটা ইন্টারেষ্টিং ব্যাপার দেখা যায়। দ্রুত অগ্রসমান দিনের আলোয় গত রাতের তারা গুলো হারিয়ে যায়। কিন্তু চাঁদের প্রায় অদৃশ্য অবয়বটা তখনও নিজের উপস্থিতির জানান দেয়। ধূসর আকাশের ক্যানভাসে চাঁদের খুব হালকা অবয়ব প্রতিয়মান হয় পেন্সিল স্কেকে আঁকা কোনো ছবির মতন। খুব ভোরে শুনসান নীরব নিথর জনপদে এই দৃশ্য কেমন বোহেমিয়ান , ভাব জাগানিয়া।

গত রাতের জ্বলজ্বল করা তারা গুলো যেমন দিনের আকাশের গভীরতায় হারিয়ে গিয়েছি ঠিক তেমনই যেন ক্যানবেরা বাংলাদেশী সমাজের মাঝ থেকে গত মাসে হারিয়ে গিয়েছেন ” জিল্লুর ভাই “।

জিল্লুর ভাই, ক্যানবেরা প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রথম জেনেরেশনের একজন। এখানে বসতি করেন বোধকরি ১৯৭০ এর দশকে। ক্যানবেরার বাংলাদেশীদের কাছে উনি বোধকরি ছিলেন ক্যাপ্টেন কুক বা ক্রিস্টোফার কলম্বাসের মত। দিগ্বিজয়ী , পথ প্রদর্শক। বাংলা ভাষা , সংস্কৃতি , বাংলাদেশের মানুষের প্রতি উনার নিবিড় ভালোবাসা ও টানে উনার হাত ধরে যাত্রা শুরু হয় , বাংলা স্কুল , বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়া এসোসিয়েশন। গভীর ভালোবাসা ও মমতায় উনি একহাতে দাড় করিয়েছিলেন এই প্রতিষ্ঠান গুলো। পরিচালনা করেছেন দীর্ঘ দিন। পরিণত বয়সে উনি আবার পঞ্চাশঊর্ধ বাংলাদেশিদের জন্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেনিয়ার্স ক্লাব। প্রবাসী পরিবারের সন্তানরা আজ বাংলা স্কুলে গিয়ে ভাষা শেখার সুযোগ পেয়েছে , আমরা সবাই সংস্কৃতি চর্চা ও উপভাগ করার সুযোগ পাচ্ছি এসোসিয়েশনের কর্ম কাণ্ডের মাদ্ধমে। এর সব কিছুর গোড়া পত্তন করেন আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় জিল্লুর ভাই।

জিল্লুর ভাইকে আমি চিনি ১৭-১৮ বছর। সদাহাস্যময় , মৃদু ভাষী। উনাকে আমি কখনো কারো সাথে উঁচু গলায় কথা বলতে শুনিনি , উষ্মা প্রকাশ করতে দেখেনি ! উনার পদাচরণ এতো হালকা ছিলো যে দেখে মনে হতো উনি হয়তো চাননা উনার পায়ের নিচে পৃথিবী যেন কোনো কষ্ট পায় ! প্রবাসী বাংলাদেশীদের জন্য যে মানুষটির এতো এতো অবদান তার জন্য কোনো গরিমার ছোঁয়া তার মদ্ধ্যে পড়েনি। হাল আমলের মানুষেরা যদি উনার ছিটে ফোটাও অবদান রাখতো তবে উনারা বোধকরি গাড়িতে “ আই এস্টাব্লিশড দিছ স্কুল /এসোসিয়েশন /মস্ক “ ইত্যাদি বাম্পার স্টিকার লাগিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। জিল্লুর ভাই হেড নান অফ ইট। কারণ উনি আমাদের বাঙালিদের জন্য , বাংলাদেশীদের জন্য যা কিছু করে গিয়েছেন তার সবটাই করেছেন গভীর ভালোবাসায়। উনি অকাতরে দিয়ে গিয়েছেন, পাবার আশাহীন। উনি মহান হবার উদ্দেশ্যেও এতো সব প্রতিষ্ঠা করেননি। মনে করেননি আমি যদি এটা করি , ওটা করি , একে তেল মারি , ওকে বাস দেই বা সপ্তাহান্তে লোকের সমাগম করে ভুঁড়ি ভোজের আয়োজন করি বা ঢাকঢোল পিটিয়ে কিঞ্চিৎ দান খয়রাত করি তবে লোক জন আমাকে মনে রাখবে , আমার নাম চাউর হবে। আমাকে সবাই চিনবে। না উনি তা করেননি। উনি যা করেছেন তার সবই ছিলো গভীর মমতা মাখা। উনি “ ফেইম ” এর পিছনে ছুটাননি। আর এই কারণেই উনি না চাইলেও হয়ে গিয়েছেন লেজেন্ড। অবিস্মরণীয়। মহান।

আমি , আপনি , আর হাল আমলের সবাই বাগানে লাগানো পাতাবাহারের মতো।কালের গহ্বরে আমাদের কোনো চিহ্ন ও থাকবে না। আর জিল্লুর ভাই হাজার বছরের ওল্ড ফরেস্টের মতো। দিনের আকাশের গভীরে হারিয়ে যাওয়া তারার মতো। বর্তমানের চাকচিক্কে উনার উপস্থিতি হয়তো আমরা উপলব্ধী করতে পারবো না।

কিন্তু যদি বলি আজ থেকে হাজার বছর পর ও যদি ক্যানবেরার বাংলাদেশীদের নিয়ে কোনো ইতিহাস লিখা হয় তবে জিল্লুর ভাইয়ের কথা উপরের স্তরেই স্থান পাবে বলে আমি মনে করি, তবে কি একটুও ভুল বলা হবে ?

জিল্লুর ভাই, আমাকে সেল্ফলেস হতে শিখিয়েছেন।
আপনাদের ?

আমার মাঝে জিল্লুর ভাই কেমন যেন আছেন , কিন্তু নাইও। কেমন যেন রবিন্দ্রনাথের এই গানের মতো

“এসেছিলে , তবু আসো নাই জানায় গেলে
স্বমুখের পথদিয়ে ,
পলাতকা ছায়া ফেলে “

ফটো কার্টিসি – Anamul Bhuiyan ভাই

হিমু /ক্যানবেরা
২৫ জানুয়ারী , ২০২১


Place your ads here!

Related Articles

দেশে ফিরতে পারেন এনআরসির শিকার বাংলাদেশীরাও

ফজলুল বারী: আমার এ লেখার শিরোনামটি দেখে অনেকে চমকে যেতে পারেন। বিরক্তও হতে পারেন। আমি আমার লেখার প্রশ্নে যুক্তি দেবো।

Sarkar Ki Bolche, Jonogon Ki Bujche

সরকার কি বলছে, জনগন কি বুঝছে অধ্যাপক বিজন বিহারী শর্মা ১৯৭১এ স্বাধীনতা লাভের পর থেকে বাংলাদেশে অনেক সরকার এসেছে, গেছে

উইকেটে প্রথম দিন পেস বোলারদের দাপট থাকবে

ফজলুল বারী, ক্রাইস্টচার্চ থেকে: নিউজিল্যান্ড সফর উপলক্ষে প্রস্তুতি নিতে হবে এরজন্যে বাংলাদেশ দল দু’ভাগে অস্ট্রেলিয়ার সিডনি আসে ডিসেম্বরের ৯ এবং ১২

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment