ক্যানবেরার অনন্য বাঙালি জিল্লুর রহমান চলে গেলেন।

ক্যানবেরার অনন্য বাঙালি জিল্লুর রহমান চলে গেলেন।

বাংলা ভাষার স্কুল নিয়ে বাঙালি সমাজের সাথে যিনি নিয়মিত যুদ্ধ করতেন সেই জিল্লুর রহমান আর নেই। শিক্ষকদের অভিজ্ঞতায় দেখেছি বাবা মায়ের আদরের সন্তানকে নিজের সবটুকু ভালোবাসা উজাড় করে দিয়েও প্রায়শই বাংলা স্কুলে মেলে না তাঁদের সন্তান। নিজের স্কুলে সেই রকম একটা জায়গায় কাজ করেছেন তিনি। যারা বাংলা শিক্ষার এমন কঠিন পরিশ্রমে জড়াননি তাঁদের ব্যক্ষা করে বোঝানো সম্ভব নয়। অসংখ্য মানুষ অস্ট্রেলিয়ায় আসেন উন্নত জীবন আর পাশ্চাত্যের আমোদে নিজেদের ভাসিয়ে দিতে। তারা কি বুঝবেন একজন জিল্লুর রহমান এর এই চলে যাওয়ায় বাঙালি কমিউনিটি কি হারালো। একটা সময়ে আমি দীর্ঘদিন তাঁর সাথে কথা বলেছি ক্যানবেরার স্কুলগুলো চলছে কি না, কেমন চলছে, ইত্যাদি নিয়ে।

সত্যি বলতে তিনি একজন পরম সহিষ্ণুতার মানুষ ছিলেন, তবুও মাঝে মাঝে বাঙালি কমিউনিটির দৈন্যতার কথা বলতেন। ক্যানবেরা, সিডনী, মেলবোর্ন, ব্রিসবেন, এডেলেড, পার্থ বা ডারউইন ঘুরে আপনি ৫% মানুষ পাবেন না যারা সন্তানকে দিয়ে বাংলা বলাতে না চান বা বাংলা ভাষা শেখাতে না চান। দুঃখজনক হলেও সত্যি ঠিক তেমনি ভাবে ৫% মানুষ পাবেন না যারা সত্যি সত্যি এ কাজে নিজেদের নিয়োজিত করেছে। প্রবাস জীবনে ব্যস্ততা আর ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থ সংশ্লিষ্টতাই এ জন্য দায়ী। অস্ট্রেলিয়া সহ বিশ্বের অসংখ্য শিক্ষকের সাথে মতবিনিময় করে দেখছি অন্ধকার দেখছেন অনেকেই, প্রায় প্রত্যেকের অভিযোগ অভিভাবকদের বিরুদ্ধে। কিন্তু উন্নত দেশে কেউ কারো বিরুদ্ধে আঙুল তুলে কথা বলতে পারে না। আর তাই সব চেয়ে বেশী যে ক্ষতি হয়েছে, তা প্রবাসে বেড়ে ওঠা সন্তানদের নিজের মাতৃভাষা বলতে, লিখতে বা পড়তে না পারার বেদনা। অবশ্য এ নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গিয়ে আমার মন্তব্য এবং বক্তব্য জানিয়েছি। ইতিবাচক সাড়া দিয়েছেন তাঁরা।

শ্রদ্ধেয় জিল্লুর রহমানকে দেখেছি অহর্নিশি নিজে উপস্থিত থেকেছেন স্কুলগুলোতে, সে ক্ষেত্রে নিজের সন্তানকে নিয়মিত স্কুলে নিতে হয়েছে, ফলশ্রুতিতে তাঁর সন্তান নিয়মিত বাংলা বলতে পারেন, যেমনটা বলতে পারি আরও কিছু শিক্ষকের ক্ষেত্রে। অত্যন্ত দুঃখজনক যে আজ তিনি চলে গেলেন চিরদিনের জন্য। গত বছর যখন বাংলা একাডেমি অস্ট্রেলিয়ার উদ্যোগে ‘সিডনী থেকে ক্যানবেরার পথে পথে’ ভ্রাম্যমাণ শিক্ষাকেন্দ্র নিয়ে ঘুরেছি, তখনো জিল্লুর রহমান এর সাথে ফোনে কথা হয়েছে, উনার স্ত্রীর সাথে কথা হয়েছে। শারীরিক অসুস্থতার জন্য সময় দিতে পারেন নি। জানিয়েছিলেন হার্ট অ্যাটাকের কথা। একই ভাবে আর এক বয়োজ্যেষ্ঠ কামরুল ভাইকে (কামরুল আহসান খান) ফোন করেছিলাম কিন্তু তিনিও তখন উঠে দাঁড়াতে পারেন না। ফোন করেছিলাম ডালিয়া নিলুফার আপাকে, তিনিও তখন বেশ অসুস্থ। তবে অত্যন্ত কঠিন পথে হেঁটে আমাদের কাজ আমরা ঠিকইই করেছিলাম।

ভীষণ কষ্ট হচ্ছে জিল্লুর রহমান এর জন্য, তাঁর মত শিক্ষাবিদরা বাঙালি সমাজকে যা দিয়ে গেছেন তা বুঝতে পারবেন কতজন তা জানিনা, তবে তাঁকে হারিয়ে আমি আরও অসহায় হয়ে পড়েছি। অনেক আশা ছিল ক্যানবেরায় আমিও স্কুল কার্যক্রম শুরু করবো। এ বিষয়ে তাঁর সাথে যেমন কথা বলেছিলাম, তেমনি ক্যানবেরার অনেকের সাথে কথা বলেছি।

আজ তাঁর মেয়ে ডাক্তার মণিকার সাথে কথা হলো। মনিকা এ মুহূর্তে ক্যানবেরায় চিকিৎসা বিদ্যার ভাস্কুলার সার্জারি বিষয়ে স্পেশালাইজেশন করছে। খুব শীঘ্রই ও একজন সার্জন হবে। নিজের চিকিৎসা বিদ্যা দিয়ে নিশ্চয়ই এমন মহৎ এক বাবাকে ধরে রাখতে চেয়েছন মনিকা, কিন্তু তাঁর বাবা আগের নিউমোনিয়া থেকে সেরে উঠতে পারেন নি। দীর্ঘদিন ডায়াবেটিস এবং হৃদ রোগে ভুগেছেন। অনেকদিন আইসিইউতে ছিলেন। ছয় সপ্তাহ আগে উনার শরীর সঙ্কটজনক হয়ে ওঠে। মৃত্যুর আগে খাবার গ্রহণ করতে পারতেন না, তবে হার্ট ফেইল করেই উনার মৃত্যু হয়েছে মনে করছেন মনিকা। বাবার সুবিধার জন্য মা সহ ওদের বড় বাড়ি ছেড়ে একটা ছোট বাড়িতে উঠে যাবার কথা ছিল, সে বাসা বদলের সময়ই চলে গেলেন তিনি। আরও কষ্ট হচ্ছে যে উনাদের বাসা বদল হচ্ছে আজকে, আর তিনি চলে গেলেন অন্য জগতে বসবাসের জন্য।

মৃত্যুকালে তাঁর স্ত্রী নাজমা বেগম নিলু এবং একমাত্র কন্যা মনিকাকে রেখে গেছেন। ষাট এর দশকে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে অনার্স সহ মাস্টার্স করেন। পরে তিনি কম্পিউটার বিদ্যা অর্জন করেন এবং দীর্ঘদিন অস্ট্রেলিয়া সরকারের সরকারী অধিদফতরে কাজ করেছেন। তিনি ক্যানবেরাস্থ বাংলাদেশ সিনিয়রস ক্লাবের সভাপতি ছিলেন, যতদূর মনে পড়ে তিনি ছিলেন ক্যানবেরা বাংলা স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ। বাংলাদেশ কমিউনিটির বহু বছরের অত্যন্ত পরিচিত মুখ। আজ সকাল আটটায় ক্যানবেরা হাসপাতালে চিরবিদায়ে চলে গেলেন। তাঁর পরিবার পরিজন, বন্ধু স্বজন সবার প্রতি রইল সহানুভূতি। তাঁর চিরশান্তি কামনা করি, প্রার্থনা করি প্রিয়জন হারানোর বেদনা সবাই সইতে পারুক। বিশ্বাস করি তিনি বেহেশতের শ্রেষ্ঠতম স্থানে অধিষ্ঠিত হবেন। ওপারে ভালো থাকুন শ্রদ্ধেয় জিল্লুর রহমান ! বিদায় !

Akash Deen | নটিং হিল ~ অস্ট্রেলিয়া


Place your ads here!

Related Articles

অলৌকিক অনুভব

দিশা সব্জীর দোকানে ঢুকতেই দীর্ঘাঙ্গী দোকানী মহিলা আজ যেন ওর প্রতি বেশীই আগ্রহ দেখালো। জাতে সে লেবানীজ বা সিরিয়ান হবে।

হারমোনি ডে

গেল সপ্তাহে আমার পুত্র কন্যার স্কুলে ব্যাপক আগ্রহ আর উদ্দীপনা নিয়ে পালিত হল হারমোনি ডে। এই বিশেষ দিনটিতে বিভিন্ন জাতী

জীবন ভ্রমন ২২ , ২৩

জীবন ভ্রমন ২২ : ১৯৭২ সালে ঢাকা  এসে মতিঝিল  পোস্ট অফিস প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হই । ডিপামেনটাল  স্কুল । অগ্রাধিকার

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment