এখন তুমি অস্ট্রেলিয়া থেকে চলে যাবেনা রুবি
রবিবার রুবি যায়নি। এর আগে রবিবারের মধ্যে রুবিকে চলে যেতে বলেছিল অস্ট্রেলিয়ার পুলিশ। কিন্তু তার যাওয়া আটকে দিয়েছে অস্ট্রেলিয়ার মানবিক স্বাস্থ্য বিভাগ। বলেছে, এভাবে এ পরিস্থিতিতে রুবিকে যেতে বলা যায়না। এটা অমানবিক। অস্ট্রেলিয়ার মূল্যবোধের পরিপন্থী। এই পরিস্থিতিতে যাবার আগে রুবির সব নাবিকদের করোনা টেস্ট করাতে হবে। কারন তাদের স্বাস্থ্যরক্ষার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রুবির নেই। কাজেই পুলিশের কথা শুনে এখন রুবিকে চলে যেতে দেয়া হয়, তাতে সর্বনাশ হতে পারে। অনেক নাবিকের প্রান যেতে পারে সাগরেই। মানবিক অস্ট্রেলিয়া এটি করতে পারেনা। অস্ট্রেলিয়ার ডাক্তাররা অনেক মানবিক। রুবির সব নাবিকের টেস্ট শেষে আগামী সপ্তাহে তারা সিদ্ধান্ত দেবেন। তাদের ছাড়পত্রের ওপর নির্ধারিত হবে রুবির অস্ট্রেলিয়া ত্যাগের পরবর্তী তারিখ। আপাতত বলা হয়েছে আরও এক সপ্তাহ থাকবে রুবি থাকবে অস্ট্রেলিয়ায়।
প্রিয় পাঠক, আমার কারনেও আপনাদের অনেকে এই রুবির নাম জানেন। মনে পড়ে রুবি রায়, কবিতায় কবিতায়’ গানটির কথাও জানেন। মিনার মাহমুদের একটি গল্পগ্রন্থের নাম ‘মনে পড়ে রুবি রায়’। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার সাগরে দাঁড়িয়ে থাকা প্রমোদতরী এক সময় মানুষের স্বপ্নযাত্রার সঙ্গে জড়িত থাকলেও এখন ভিলেনের ভূমিকায় এই রুবি প্রিন্সেস। এই জাহাজের ৯০০’র বেশি যাত্রী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন ২০ জন। অস্ট্রেলিয়ায় এটির নাম হয়ে গেছে করোনার জাহাজ! করোনা ভাইরাস সংক্রমনের এপিক সেন্টার। কারন একটি সোর্স থেকে এত বেশি সংখ্যক রোগীর সংক্রমনের দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত আর নেই।
এরজন্য রুবির বিরুদ্ধে ফৌজদারী তদন্ত করছে অস্ট্রেলিয়ার পুলিশ। জাহাজের ব্ল্যাক বক্স সহ নানান তথ্য-উপাত্ত জব্দ করা হয়েছে। প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে জাহাজে খাদ্য সরবরাহকারী কোন কোম্পানির কোন একজন কর্মীর মাধ্যমে করোনা প্রথম ঢোকে রুবিতে। এরপর জাহাজের স্টাফ-কর্মীদের সংক্রমনে সেটি ঘাঁটি গেড়ে বসে। সেখান থেকে তা যাত্রীদের মধ্যে ছড়ায়।
অস্ট্রেলিয়ায় যে করোনা এসেছে এটি মেইড ইন চায়নার। বয়স্ক লোকজনকে এটি পছন্দ করে। অস্ট্রেলিয়ায় বয়স্ক লোকজনই বেশি করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। এ দেশের বয়স্ক লোকজন জাহাজে ভ্রমন করতে পছন্দ করেন। বাংলাদেশের বয়স্ক লোকেরা পেনশন বা জমানো টাকায় জীবনে একবার হলেও হজে যাবার চেষ্টা করেন। আর অস্ট্রেলিয়ার বুড়োবুড়িরা যান জাহাজ ভ্রমনে বা ক্রুজে। সময় কাটা্তে বুড়োবুড়িরা যা পছন্দ করেন এর সবই আছে থাকে এসব ক্রুজে। ভিতরে ছোটখাটো হাসপাতালও থাকে। আর থাকে আনলিমিটেড মউজ-ফুর্তির ব্যবস্থা। সব ধরনের খানাপিনার ব্যবস্থাও আনলিমিটেড। আমেরিকার জাহাজ কোম্পানির অস্ট্রেলিয়া শাখাও আছে রুবি প্রিন্সেসের। অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের বুড়োবুড়িদের টার্গেট করে এটি ক্রুজ পরিচালনা করে।
এই রুবি প্রিন্সেস যেটি নিউজিল্যান্ডের নেপিয়ার ঘুরে অস্ট্রেলিয়ার সিডনি আসতে আসতে করোনার সংক্রমনে জর্জরিত হয়েছে এটিই এখন পুলিশি তদন্তে জেরবার। ৫০ দেশের এক হাজারের বেশি ক্রু আছেন রুবি প্রিন্সেসে। তাদের মধ্যে এর আগে ৩০০ জনের টেস্টে করোনা পজিটিভ পাওয়া গেছে ১৪৯ জনের। জাহাজটি এখন সিডনি থেকে ১০০ কিঃমিঃ দূরের পোর্ট কেম্বলার বর্হিনোঙরে রেখে এর বাকি ক্রুদের করোনা টেস্ট করা হচ্ছে। সবার টেস্ট শেষ হতে ৪৮ ঘন্টা সময় লাগতে পারে। জাহাজটির ১১ জন ক্রুকে এরমাঝে অস্ট্রেলিয়ার স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হয়েছে। অনেকে অবস্থান করছেন জাহাজের কোয়ারিন্টান কেবিনে।
তদন্তে নেমে পুলিশ রুবি প্রিন্সেসে ভ্রমন করা ৫৫০০ যাত্রীর সঙ্গে অনলাইন জরিপে কথা বলেছে। যারা ফেব্রুয়ারির ২৪ তারিখ থেকে মার্চের ৮ তারিখ, এরপর মার্চের ৮ তারিখ থেকে মার্চের ১৯ তারিখ সময়ের মধ্যে রুবি প্রিন্সেসের যাত্রীদের মধ্যে এই অনলাইন জরিপ চালানো হয়। এসবে জাহাজের পরিবেশ পরিস্থিতির সঙ্গে জাহাজের টেলিমেট্রি বক্সের ফরসেনিক টেস্টের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হয়। অস্ট্রেলিয়া ছাড়াও আমেরিকা-কানাডা ও নিউজিল্যান্ডে করোনা কান্নার সঙ্গে জড়িত এই রুবি প্রিন্সেস। এই ক্রুজে গিয়ে অস্ট্রেলিয়ার ১৮, আমেরিকার ১ জন ও নিউজিল্যান্ডের ১ জন যাত্রী মারা গেছেন। এই মহামারীতে এখন পর্যন্ত প্রান হারিয়েছেন ৭০ জন অস্ট্রেলিয়ান।
তবে করোনা সংকট স্বত্ত্বেও এই ভাইরাসের সঙ্গে যুদ্ধে অস্ট্রেলিয়ার অর্জনও এখন বিশ্ব স্বীকৃত। জানুয়ারি মাসে এখানে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। এখন পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ৬৫৮৬ জন। কিন্তু এদের ৪ হাজার ১৬৭ জন এরমাঝে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। করোনায় আক্রান্ত হয়েও অস্ট্রেলিয়ায় সুস্থ হবার এই হারটি ৮৬%। এখন আক্রান্ত ২৩৪৯ জন রোগী চিকিৎসাধীন আছেন। এদের ৯৮ ভাগ অর্থাৎ ২২৯৪ জনের সংক্রমন মাঝারি প্রকৃতির। ৫৫ জনের অবস্থা এখন পর্যন্ত গুরুতর। ৪২৩৭ জনের ফাইল ক্লোজড করা হয়েছে। অর্থাৎ সুস্থ ও ডিসচার্জ করা রোগীর সংখ্যা ৪১৬৭ জন। এই হিসাবে অস্ট্রেলিয়ার করোনা চিকিৎসার সাফল্যের ৯৮%।
করোনা যুদ্ধের বিরুদ্ধে অস্ট্রেলিয়ার এই সাফল্য এদেশের মানবিক ও দক্ষ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, নাগরিকদের আইন মানার অভ্যাস অথবা আইন মানতে বাধ্য করার বাস্তবতা প্রমান করে। শুরুতে পিপিই-মাস্ক সহ নানা সমস্যা অস্ট্রেলিয়ারও ছিল। দাবানলের সময় বিপুল ব্যবহারের কারনে মাস্কের সংকট ছিল বেশি। মূলত চীন পরিস্থিতি সামাল দিয়ে সরবরাহ শুরু করার পরই সংকট কমে আসে। আড়াই কোটি মানুষের দেশে এরমাঝে প্রায় চার লক্ষ মানুষের করোনা টেস্ট করা হয়েছে। এবং এখন সংক্রমন কমে এসেছে ২ শতাংশের নীচে। কারন মানুষকে এখানে আইন মেনে চলতে হয়। সামাজিক দূরত্বের মতো আইন না মানার জরিমানায় যারা পড়েছেন তাদের ১৬৫২ ডলার করে গুনতে হয়েছে।
বাংলাদেশের রাস্তায় নানান অজুহাতে যারা আইন মানছেননা অস্ট্রেলিয়ায় তা অবিশ্বাস্য। ছবি দেখেও এখানে জরিমানা হয়। গত সপ্তাহে পুলিশ যে ৫ হাজার লোককে রাস্তায় বা গাড়ি থামিয়ে আইন মানা হচ্ছে কিনা তা পরীক্ষা করেছে সে হিসাবও তাদেরকে দিতে হয়ে। ইনডোরে ১০০’র বেশি জনসমাবেশ বন্ধ বলতেই এখানকার সব মসজিদ-মন্দির বন্ধ হয়ে যায়। সেই থেকে এগুলোয় তালা ঝুলছে। কোথাও এ নিয়ে প্রশ্ন তোলা বা ফতোয়া জাহিরের কোন সুযোগ নেই। সরকার নির্দেশ দিয়েছে মৃতের দাফনে দশজনের বেশি থাকতে পারবেনা। ব্যাস, এ নিয়ে কেউ আইন ভঙ্গের চিন্তা বা চেষ্টাও করেনি। ব্রাহ্মনবাড়িয়ায় জানাজার নামে যা ঘটেছে তা অবিশ্বাস্য অস্ট্রেলিয়ায়।
এমন বেআইনি মিথ্যাবাদী লোকজন অস্ট্রেলিয়ায় আইনের ফাঁকফোকর মাড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয় বলে এখানে করোনা নিয়ন্ত্রনে চলে এসেছে। বাংলাদেশের অনেক আগে রোগটি এখানে ধরা পড়ার পরও মৃত্যু মাত্র ৭০, রোগমুক্তি, চিকিৎসায় সাফল্যের হার ৯৮%, আর বাংলাদেশ এই দূর্যোগ নিয়ে এখন কোথায় যাচ্ছে তা কেউ জানেননা!
পাদটিকাঃ ব্রাহ্মনবাড়িয়ায় যারা আইন ভাঙ্গলেন সেই মোল্লা-মৌলভীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেই, পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা কেনো? আইন ভাঙ্গলে বাংলাদেশের পুলিশকে কী ফিলিপাইনের মতো গুলি করে ফেলে দেবার নির্দেশ দিয়েছেন? না যারা আইন ভেঙ্গেছেন তাদের কাউকে এখন পর্যন্ত গ্রেফতার করতে বলেছেন? অস্ট্রেলিয়াতো এমন কোন বেআইনি মোল্লা-মৌলভী নেই। কেউ কোথাও আইন ভাঙ্গলে ছবি দেখে বের করেও জেল জরিমানা হয়। পুলিশের বিরুদ্ধে এ ধরনের এক তরফা ব্যবস্থা পুলিশের মনোবল ভেঙ্গে দেবে। এই করোনায় দেশের কোথাও কোন মোল্লা-মৌলভী নয়, পুলিশই মানুষের জন্যে কাজ করছে। খাবার দিচ্ছে। এমনকি মৃতের জানাজা-দাফনও করাচ্ছে পুলিশ। মোল্লা-মৌলভী সেখানেও পালিয়ে যাচ্ছে। পুলিশের বিরুদ্ধে নেয়া ব্যবস্থা পাল্টান। পুলিশের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। নতুবা পরে পস্তাবেন। এই সুযোগে আরেকটা কথা বলে নেই। বিভিন্ন দেশে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা আইন মানে কম। বাংলাদেশে এটা করছে মোল্লা-মৌলভীরা। শুধু তাই নয়, এরা এক ধরনের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বলছে, পারলে আমাদের গায়ে হাত দিয়ে দেখ! যারা রাষ্ট্রের আইন মানেনা এরা কোন ধর্মের অনুসারী? কোন ধর্মে এমন বিধান আছে?
Related Articles
Music through the passage of time: A Canberra night by Dhrupad
“গানের ভেতর দিয়ে যখন দেখি ভুবন খানি” Music is the elixir of human soul. Eons and eons ago, when human
Post –poll violence on Hindu minorities: A Shame for the country
The inhuman violent attack on the minority Hindu community after the 10th parliamentary elections is a shame for the country