মধুর আমার মায়ের ভাষা

মধুর আমার মায়ের ভাষা

আমার জন্ম পদ্মার পলিবিধৌত চর এলাকায় গ্রামের নাম চরভবানীপুর। তখনও বুঝিনি আমাদের গ্রামের এবং আশেপাশের সব গ্রামের নামের আগে কেন চর কথাটা জুড়ে দেয়া। বড় হওয়ার সাথে সাথে বুঝেছি এই এলাকা দিয়ে একসময় প্রমত্তা পদ্মা নদী বয়ে যেতো। পরবর্তিতে নদীর বুকে চর পরে এই এলাকাগুলো গঠিত হয়েছিলো তাই প্রত্যেকটা গ্রামের নামের আগে চর জুড়ে দেয়া হয়েছিলো। সেখানে সভ্যতার ছোঁয়া বলতে ছিল ব্যাটারি চালিত রেডিও আর টর্চ লাইট। জীবনের বাকিসব উপকরণ সংগ্রহ করা হতো প্রকৃতি থেকেই। আর বাকিগুলো জোগাড় করা হতো হাট থেকে। মজার ব্যাপার হচ্ছে মৌজার হিসাবে এই গ্রামগুলো কুষ্টিয়া সদর থানার অন্তর্ভুক্ত হলেও সব ধরণের কার্যক্রমের জন্য আমরা ছিলাম পাবনার উপর নির্ভরশীল কারণ স্থলপথে সোরারসরি পাবনার সাথে যোগাযোগ ছিলো কিন্তু কুষ্টিয়া যেতে চাইলে প্রথমে প্রমত্তা পদ্মা নদী এবং পরে পদ্মার শাখা গড়াই নদী পার দিতে হতো। এতেকরে দিন শেষে হয়ে যেতো। একইদিনে কুষ্টিয়া যেয়ে ফিরে আসা যেতো না। 

বাংলা ভাষার আদিগ্রন্থ চর্যাপদের কয়েকটি পদ

কুষ্টিয়া সদর থানার অন্তর্গত হলেও আমাদের কথ্য ভাষায় আলাদা একটা টান ছিলো। আমরা অনেক শব্দ আমাদের মতো করে উচ্চারণ করতাম। কিছু উদাহরণ দিলে বিষিয়টা আরো পরিষ্কার হবে। লুঙ্গিকে আমাদের গ্রাম্য ভাষায় আমরা বলতাম তপন বা তফন, গেঞ্জিকে বলা হতো গুঞ্জি, নৌকাকে বলা হতো নাও, নদীকে গাঙ এমন আরো অনেক শব্দই ছিলো। এছাড়াও সময়েরও বিভিন্ন নাম ছিলো যেমন সকালবেলা কে বলা হতো বিয়ানবেলা আবার বিকেলবেলাকে বলা হতো ভাটিল। এছাড়াও নিজেদের মধ্যে কথাবার্তাতেও অনেক আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার করা হতো। যেমন বাড়ির বাইরে এসে কেউ হাঁক দিলে ভিতর বাড়ি থেকে জিজ্ঞেস করা হতো “কিডা গো?”  বাংলা বছরের দিনপঞ্জি অনুযায়ী কৃষিকাজ পরিচালিত হতো। বাংলা মাসের নামগুলোও উচ্চারিত হতো আঞ্চলিকতায় যেমন বোশেখ, জষ্ঠি, আষাঢ়, শাওন, ভাদর, আসীন, কার্তিক, অগ্রহন, পুষ, মাঘ, ফাগুন এবং চৈত। আমরা আইসক্রিমকে জানতাম মালাই হিসেবেই। গ্রামে গ্রামে প্রায়ই জমি নিয়ে মারামারি লেগেই থাকতো সেটাকে বলা হতো কাইজ্যা। এমন আরো বহু শব্দ এখনও প্রচলিত আছে। শস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রেও ছিলো আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার যেমন কোন ক্ষেতে আগেই ফসল হলে বলা হতো ফলন “আগুর” হয়েছে আর দেরি হলে বলা হতো “নাবী”।

বাংলা ব্যাকরণ বইয়ের প্রচ্ছদ

সম্পর্কের সম্বোধনগুলোতেও ছিলো আঞ্চলিকতার টান। আমরা মাকে মা বলেই সম্বোধন করতাম পরে যখন কুষ্টিয়ার শহরতলিতে এসে আমরা বসবাস শুরু করলাম তখন আমরা জানলাম মা আসলে আম্মু। আর আব্বাকে সম্বোধন করতাম আব্বা। আর চাচা চাচিরা পরিবারে তাঁদের অবস্থান অনুযায়ী ছিলেন আব্বা এবং মা যেমনঃ বড় চাচা হচ্ছেনা বড় আব্বা আবার বড় চাচি হচ্ছেন বড় মা। অবশ্য দাদা দাদির আব্বা মাকেও আমরা এই একই নামে সম্বোধন করতাম। ফুপুদেরকে ফুপুই ডাকতাম কিন্তু কেনজানি ফুপাদেরকে আমরা জামাই বলে সম্বোধন করতাম। এছাড়াও দাদীদেরকে আমরা সম্বোধন করতাম বু বলে যেটা আসলে ছিলো বুবুর সংক্ষিপ্ত রূপ।এসব সম্পর্কের বাইরে যেয়ে আরো কিছু সম্পর্ক ছিলো যেখানে রক্তের কোন সম্পর্ক ছিলো না, যেমনঃ সই, দোস্ত বা মিতে। একই বয়সী মেয়েদের একে অপরের সাথে সামাজিকভাবে বন্ধুত্ব করিয়ে দেয়ার নাম ছিলো সই পাতানো এবং সেই সই সম্পর্ক সারাজীবন অটুট থাকতে দেখেছি। আর ছেলেদের মধ্যে  ছিলো দোস্ত পাতানোর চল তবে একই নামের ছেলেদের মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ককে বলা হতো মিতে। আর একটা সম্পর্ক ছিলো যেটাকে বলা হতো ধর্ম সম্পর্ক যেখানে কেউই আগে থেকে কাউকে চিনে না কিন্তু পরিণাস্থিতির কারণে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। আমার দাদির এমনই একজন ধর্ম সম্পর্কের ভাই ছিলো যাকে আমরা দাদা বলে সম্বোধন করতাম। আমাদের গল্প শুনতে শুনতো ঘুমাতে যাওয়ার চল ছিলো। সেই গল্পগুলোকে বলা হতো কিচ্ছা। ঘুমাতে যাওয়ার আগে কিচ্ছা শুনে নাই এমন শিশু পাওয়া মুশকিল ছিলো একসময়।

লেখকের আঙিনায় ইট দিয়ে তৈরি শহীদ মিনার

এক সময় আমরা কুষ্টিয়ার শহরতলী বাড়াদিতে এসে থাকা শুরু করলাম তখনই প্রথম অনুভব করলাম আমাদের গ্রামের ভাষাটা ছিলো আসলে গরীব মানুষ বা চাষার ভাষা। আমরা যেহেতু নদীর অন্য পার থেকে উঠে এসেছিলাম তাই আমাদেরকে বলা হতো পাইরু। আমাদেরকে রীতিমতো ক্ষেপানো শুরু হলো পাইরু বলে যেটাকে ভদ্রলোকদের ভাষায় বলা হয় বুলিইং। যাইহোক শব্দের বিবর্তনগুলো বলি। মাকে ডাকা হতো আম্মু সেটা তো আগেই বলেছি আর আব্বা হয়ে গেছেন আব্বু, আপা হয়ে গেছেন আপু, দাদা হয়ে গেছেন দাদু, নানা হয়ে গেছেন নানু এমন আরো অনেক। একটু শহরের দিকে গেলে সম্বোধনগুলো হয়ে গেছে ইংরেজি। মা হয়ে গেছেন মামী বা মাম্মি আর আব্বা হয়ে গেছেন ড্যাডি আর চাচা, মামা, খালু নির্বিশেষে হয়ে গেছেন আংকেল, চাচি, ফুপু, খালা নির্বিশেষে হয়ে গেছেন আন্টি। আবার অনেকেই আরো আহলাদ করে বলতো আন্টু। আমরা কিন্তু সেই আব্বা মাতেই আটকে থাকলাম তাই আমাদের মাথার উপর থেকে পাইরু উপাধি আর কাটা গেলো না। কুষ্টিয়া সরকারী কলেজে আমাদের এক বন্ধু ছিলো যে খোকসা থেকে এসেছিলো। আমার দেখা অন্যতম তুখোড় ছাত্র। ওর কথায় একেবারে খোকসার স্থানীয় টান ছিলো। ও একটা করে কথা বলতো আর তার মাঝে বলতো “হলিগা সিন” অর্থ করলে দাঁড়ায় “তার মানে হলো”। আমরা অনেকেই ওর পিছনে এটা নিয়ে হাসাহাসি করতাম তবে ভালো ছাত্র হওয়াতে কেউ আর ওকে সামনাসামনি ঘটানোর সাহস করেনি।     

আঞ্চলিক ভাষার অভিধান

এরপর মোবাইল কোম্পানিতে চাকুরীর সূত্রে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া ঘুরে বেড়ানো শুরু করলাম একেবারে থানা পর্যায় পর্যন্ত। তখন হঠাৎ করে আবিষ্কার করলাম বাংলাদেশের আসল সৌন্দর্য। প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য এবং খাদ্যাভাসের বৈচিত্র্যের পাশাপাশি প্রত্যেকটা এলাকার ভাষা আলাদা। বুয়েটে থাকতে রুমমেট তৌহিদের বদৌতলে চট্টগ্রামের ভাষা বেশ কিছুটা আয়ত্ত করে ফেলছিলাম তবে ওর ভাষ্যমতে ও যে চাটগাঁইয়া ভাষা বলে সেটা অনেকখানি বিশুদ্ধ কিন্তু ওর বাবা মা বা দাদা দাদি যেটা বলেন সেটা নাকি ওরাই মাঝেমধ্যে বুঝতে পারে না। আমি চট্টগ্রামে কাজ করতে যেয়ে ওর কথার সত্যতা হাড়েহাড়ে টের পেলাম তাই বাংলদেশে চট্টগ্রামের ভাষা একটা আলাদা জায়গা নিয়ে আছে। সিলেটি ভাষার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আবার বরিশালের ভাষার ধরণ পুরোপুরি আলাদা। এছাড়াও নোয়াখালী, কুমিল্লা এবং ফেনীর ভাষাতে সামঞ্জস্য থাকলেও পুরপুরি এক নয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে আমাদের কুষ্টিয়া অঞ্চলের লোকেরা কুষ্টিয়া অঞ্চলের বাইরের লোক বুঝাতে বাঙাল শব্দটা ব্যবহার করতো আবার ঠিক একইভাবে চট্টগ্রাম অঞ্চলের লোকেরা চট্টগ্রামের বাইরের লোক বুঝাতে বইংগা বলে একটা শব্দ ব্যবহার করে। আবার উত্তরবঙ্গে গেলে একেবারে অন্যরকম ভাষারীতি দেখা যায়।

চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান

এলাকাভেদে ভাষা এবং সংস্কৃতির এই পার্থক্য আমি খুবই উপভোগ করতাম এবং আমার কথার মধ্যে বিভিন্ন এলাকার বিভিন্ন শব্দ চলে আসলো একসময়। আমার কথা শুনে সবাই বিভ্রান্ত হয়ে যায় আমার গ্রামের বাড়ি আসলে কোথায়? কারো উপর রেগে গেলে এখনও মজা করে বরিশালের ভাষায় বলি, গেডির উপর একটা থাবর দিবানে। আবার চট্টগ্রামের কারো সাথে দেখা হলেই বলি, বদ্দা কেন আছেন? আবার সিলেটের কারো কথা সায় দিতে গেলে বলি, অয় অয়। রংপুরের কারো সাথে দেখা হলেই বলি, আংগো বাড়ি অংপুর। আর আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুদের একজন হচ্ছে রাজশাহীর ছেলে শিবলী। ওর সাথে কথার শুরুতেই বলি, মামুর ব্যাটা কেমন আছো? আবার আমার বন্ধু পাবনার আলামিনের সাথে যখন কথা হয় তখন বলি, খাবুলা তো মাখালু ক্যা? আর যখন কুষ্টিয়ার কারো সাথে কথা হয় তখন একেবারে কুষ্টিয়ার আঞ্চলিক টানেই কথা বলি। এতে যে সুবিধা হয় সেটা হলো দ্রুতই আপনার সাথে কথা বলা মানুষটা আপনাকে আপন করে নেবে এবং তখন আপনাদের মধ্যে অনেক ফলপ্রসূ আলাপ হবে। 

সিলেটের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান

প্রবাস জীবনে এসে আমার এই ভাষাজ্ঞান খুব কাজে লেগেছে। প্ৰত্যেকটা এলাকার মানুষই আমাকে তাঁদের আপনজন মনেকরেন। আমিও আমার সীমিত ভাষাজ্ঞান দিয়ে উনাদের সাথে কথা বলি তবে যখন দেশ থেকে কেউ ফোন দেন তখন আমি পুরোপুরি কুষ্টিয়ার আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করি। ছোটবেলার বন্ধু যারা এখন এলাকাতেই থাকে তারা ফোন দিলে একেবারে ছোটবেলার মতো করে কথা বলি কারণ এই মানুষগুলোর সাথে বন্ধন যুগযুগান্তরের। আমি মনেমনে খুবই সাবধান থাকার চেষ্টা করি যেন আমার সাধু ভাষা বলার কারণে ওঁদের সাথে দূরত্ব না তৈরি হয়ে যায় কারণ ওরা খুবই ভালো মানুষ কিন্তু একবার যদি বুঝতে পারে ওঁদেরকে অবজ্ঞা করা হচ্ছে তাহলে আর কোনোদিনই আমাকে কল দিবে না। এখনও দেশ থেকে প্রতিবেশী কাকিমা কর্তারা ফোন দিয়ে যখন বলেনঃ ইয়াকুব গরম গরম লুচি ভাজিছি আসি খায়ে যাও তখন মানব জন্মটাকে সার্থক মনেহয়। আমরা তিনভাইই এখন জীবিকার প্রয়োজনে বাড়ির বাইরে থাকি তাই উনাদের সাথে সবচেয়ে সহজে যোগাযোগ করার মাধ্যম হলো মোবাইল ফোন। আমি সবচেয়ে খুশি হয় যখন আব্বা মাকে ফোন দেয়ার পর উনারা কল ধরেই জিজ্ঞেস করেন, কিডাগো?

Md Yaqub Ali

Md Yaqub Ali

আমি মোঃ ইয়াকুব আলী। দাদি নামটা রেখেছিলেন। দাদির প্রজ্ঞা দেখে আমি মুগ্ধ। উনি ঠিকই বুঝেছিলেন যে, এই ছেলে বড় হয়ে বেকুবি করবে তাই এমন নাম রেখেছিলেন হয়তোবা। যাইহোক, আমি একজন ডিগ্রিধারী রাজমিস্ত্রি। উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করতে অস্ট্রেলিয়াতে আমার আগমন ২০১৫ সালের মার্চে। আগে থেকেই ফেসবুকে আঁকিবুকি করতাম। ব্যক্তিজীবনে আমি দুইটা জীবের জনক। একটা হচ্ছে পাখি প্রকৃতির, নাম তার টুনটুনি, বয়স আট বছর। আর একজন হচ্ছে বিচ্ছু শ্রেণীর, নাম হচ্ছে কুদ্দুস, বয়স দুই বছর। গিন্নী ডিগ্রিধারী কবিরাজ। এই নিয়ে আমাদের সংসার। আমি বলি টম এন্ড জেরির সংসার যেখানে একজন মাত্র টম (আমার গিন্নী) আর তিনজন আছে জেরি।


Place your ads here!

Related Articles

On democratic autocracy

The concepts of democracy and autocracy are apparently contradictory. Democracy is a system of government where people elect their representatives

সাঈদি রাজাকার ছিলো কিনা!

একটা সত্য আমি বিভিন্ন সময়ে লিখেছি। আবারও লিখছি। আমাদের দেশের কিছু মানুষের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে ঈমানি কমজোরির কারনে মাঝে মাঝে

শুভমিতার অপার্থিব কণ্ঠে আমার সুরের মূর্ছনা

(প্রায় মাস ছয়েক আগে লিখা এই নিবন্ধটি শেষ পর্যন্ত পোস্ট করা হল। এর কিছু কিছু অংশ ইতিপূর্বে প্রকাশিত আমার একটি

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment