প্রবাসীর ফড়িঙের জীবন

টানা কয়েকদিনের বৃষ্টিতে দাবানলের আগুন নিভে গেছে। বুভুক্ষ, তৃষিত ধরিত্রী শান্ত হয়ে এসেছে। ঘাসেরা, গাছেরা প্রাণ ফিরে পেয়েছে। বৃষ্টির অভাবে খোলা প্রান্তরগুলো পুড়ে বাদামি বর্ণ ধারণ করেছিলো। বৃষ্টির পানির আদরমাখা স্পর্শে সেগুলোই রাতারাতি সবুজ হয়ে উঠেছে। এতদিন বৃষ্টি ছিলো না তাই বাসার পিছনের এবং সামনের ঘাস কাটার দরকার পড়েনি কিন্তু বৃষ্টি শেষ হবার পরই সেগুলো কাটতে নেমে পড়তে হলো কারণ এই কয়েকদিনেই সেগুলো লকলকিয়ে বেড়ে উঠেছে। ঘাস কাটার পর নাকে একটা সবুজ গন্ধ আসে। আমার খুবই ভালো লাগে। ঠিক তেমনি প্রচন্ড খরার পর যখন বৃষ্টি নাম তখনও আমি নাকে এক ধরণের গন্ধ পাই। তবে মাটি এবং পিচ ঢালা রাস্তা থেকে আলাদা আলাদা রকমের গন্ধ বের হয়। আবার ঘাস শুকিয়ে গেলে ধান মাড়াই করে রেখে দিলে খড় থেকে যে ধরণের গন্ধ আসে সেই গন্ধ পাই।

ছোট বেলায় আমরা দেখতাম বৃষ্টির পরপরই কোথা থেকে জানি রাজ্যের ফড়িং বেরিয়ে পড়তো আর আমরাও বিভিন্ন কায়দা করে ফড়িং ধরতে নেমে পড়তাম। অনেকেই খালি হাতে ফড়িং ধরতো। খালি হাতে দুইভাবে ফড়িং ধরা যেতো। এক, খুবই আস্তে আস্তে ফড়িঙের পিছনে যেয়ে দাঁড়িয়ে তার চেয়েও আস্তে আস্তে হাত দুটোকে ফড়িঙের পাখা বরাবর নিয়ে পাখা চেপে ধরে ফেলা হতো। এই প্রক্রিয়ায় ফড়িং ধরলে ফড়িংটা আহত হতো না। আর দ্বিতীয়টা ছিলো একটু ধ্বংসাত্মক প্রক্রিয়া। ফড়িঙের মোটামুটি কাছাকাছি দাঁড়িয়ে সপাটে হাতটা ঘুরিয়ে ফড়িংটাকে তালু বন্দি করা হতো। এতে ফড়িংটা আহত হওয়ার সমূহ সুযোগ থাকতো। এছাড়াও আমরা পাঠাকাঠির মাথায় জিগে গাছের আঠা লাগিয়ে সেটা দিয়ে ফড়িং ধরতাম। আঠা সমেত পাঠকাঠির মাথাটা কোনভাবে ফড়িঙের গায়ের সাথে লেগে গেলে আর সেটা উড়তে পারতো না। আবার অনেকসময় ফড়িং ভুল করে আঠা সমেত মাথাটার উপর নিজে থেকে এসে বসেই আটকে যেতো।
রঙে এবং আকৃতিতে ফড়িঙের অনেক প্রকার ছিলো। হরেক রঙের হাজার হাজার ফড়িং মাথার উপর দিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে এটা কল্পনা করলে এখনও মনটা উদাস হয়ে যায়। আর আকৃতিতে যেগুলো বড় ফড়িং ছিলো সেগুলোকে আমরা বলতাম ধামা ফড়িং। একটা ধামা ফড়িং ধরতে পারলে সহপাঠীদের সবাই ঈর্ষান্বিত দৃষ্টিতে তাকাতো। তারপর সেটার লেজে সুতো বেঁধে দিয়ে ছেড়ে দেয়া হতো। সুতোর ভারে সেটা উড়ে বেশিদূর যেতে পারতো না। কিছুদূর যাওয়ার পর কোথাও বসলেই আমরা সুতার অন্যপ্রান্ত ধরে টেনে নিচে নামতাম। এছাড়াও অনেকেই ফড়িংকে খেতে দিতো। ঢল কলমির পাতা ছিড়লে যে কস বের হয় সেটা ফড়িঙের মুখের কাছে ধরা হতো। ওরা খেতো না খেতো সেটা মুখ্য ছিলো না মুখ্য ছিলো আমরা ফড়িংকে খেতে দিচ্ছি। আবার অনেকেই ফড়িং দিয়ে তরকারি রান্না করে সেটা দিয়ে রান্না-বাটি খেলতো। এখানে বলে রাখা ভালো আমাদের এলাকায় ফড়িংকে বগুল বলে ডাকা হয়।

সিডনিতে আসার পর যখনই বৃষ্টি হতো এর পরপরই আমি মনেমনে ফড়িং খুঁজে ফিরতাম কিন্তু এখন পর্যন্ত ফড়িঙের দেখা পাইনি তবে বনে জঙ্গলে ফড়িং দেখেছি বেশকবার। বৃষ্টির পর অবশ্য এখানেও প্রকৃতিতে এবং মানুষের মনে পরিবর্তন লক্ষ্য করেছি। দেশ ছেড়ে আসা আমার জন্য মোটেও সহজ ছিলো না। সেটার কারণ অবশ্য অর্থনৈতিক না কারণ আমি বস্তুবাদী মানুষ না। আমি প্রকৃতিবাদী মানুষ। মনে শংকা ছিলো অন্য গোলার্ধের একটা দেশের প্রকৃতি কেমন হবে তবে এখানে আসার পর সেই ভুল ভেঙে গেছে। এখানকার আবহাওয়া এবং প্রকৃতির সাথে সহজেই খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছি আমরা। পাশাপাশি এখনকার সবকিছুর মধ্যেই আমরা বাংলাদেশের সবকিছু আবিষ্কারের চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমি শৈশবটা কাটিয়েছি বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে তাই গ্রাম, প্রকৃতির প্রতি আলাদা একটা ভালো লাগা কাজ করে। বিদেশে আসার পর অনেকেই রাতারাতি নিজেকে আপগ্রেড করে ফেলেন। নিজেকে বিদেশি প্রমাণের চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে উঠেন। সেটা নিয়ে আমার সমস্যা নেই। গা জ্বালা করে যখন দেখি নিজের দেশকে ছোট করে নিজেকে মহান প্রমাণিত করার চেষ্টা করছেন।
যাইহোক মানুষ ভেদে মতবাদও ভিন্ন হবে এটাই স্বাভাবিক। আমরা আমাদের কথা বলি। ঠিক কার মাধ্যমে রামিনস ফার্মের সন্ধান পেয়েছিলাম সেটা আর আজ মনেপড়ে না তবে রামিনস ফার্ম এখন আমাদের পরিবারের অংশ হয়ে গেছে। আমরা কারণে অকারণে রামিনস ফার্মে যায়। সবাই যখন অবসরে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যায় আমরা তখন রামিনস ফার্মে বেড়াতে যায়। অবশ্য রামিনস ফার্মের হারুন ভাইয়ের মিষ্টি ব্যবহারও এটার একটা কারণ। রামিনস ফার্ম রায়ানের সবচেয়ে পছন্দের জায়গা। ধুলার মধ্যে পা ডুবিয়ে রায়ান সারা ফার্ম হেটে বেড়ায়। আর সেচ দেয়ার পর কাদার মধ্যে পা ডুবিয়ে হেটে বেড়ায়। আর আমি আমার ফেলে আসা শৈশবকে খুঁজে ফিরি। শিমের আর বেগুনের বেগুনি ফুল, লাউয়ের গাছের শ্বেতশুভ্র ফুল আর প্রাণজুড়ানো সবুজ গন্ধ, উচ্ছের হলুদ ফুল হঠাৎ দেখলে সবুজ পাতার মধ্যে হলুদ প্রজাপতি বলে ভুল হয়, হলুদ পাকা উচ্ছে আর তার লাল টকটকে বীজ , মিষ্টি কুমড়ার হলুদ ফুলের পেটের মধ্যে কমলা রঙের ভ্রূণ সবকিছুই আমাকে মুগধ করে। কখন যে ঘন্টা পার হয়ে যায় বুঝেই উঠতে পারি না।

গত বছরের টানা খরা আর অনাবৃষ্টির ফলে রামিনস ফার্মের গাছগুলোর অবস্থা ছিলো শোচনীয়। যেখানে প্রতি বছর অক্টবরের মাঝামাঝি উৎপাদন শুরু হয়ে যেতো সেখানে এইবার নভেম্বরের মাঝামাঝি এসেও উৎপাদন হয়নি তেমন একটা। পরবর্তীতে বৃষ্টির পানির পরশ পেয়ে গাছগুলো লকলকিয়ে বেড়ে উঠেছিলো এবং রাতারাতি উৎপাদন লক্ষমাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিলো। মানসমনেও বৃষ্টির প্রভাব লক্ষ্য করলাম। দাবদাহের সময় মানুষের মেজাজ অনেক তিরিক্ষ হয়েছিলো। বৃষ্টির পরপরই দেখি তাঁদের মধ্যে প্রেম ভাব প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। স্টেশনের চলন্ত সিঁড়িতে প্রেমিক প্রেমিকারা একে অপরকে প্রেম নিবেদন করতে শুরু করে দিয়েছিলো। বাসেও যুগলদের বসার ভঙ্গি ছিলো যতেষ্ট রোমান্টিক। এর মধ্যেই আমাদের ক্যাম্পাসের সুতাবু’র ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে জানলাম উনার সহপাঠি এক প্রবাসী ভাই কানাডাতে মারা গেছেন। উনি আমাকে বললেনঃ এই যে তোদের সুখের সন্ধানে প্রবাসে আসা, আসলেই কি তোরা সুখে আছিস। আমি বললামঃ সবাই একসাথে থাকাটাই আসল সুখের বিষয় সুতাবু। উনি বললেনঃ তোরা চলে আয়, যাই সামান্য আয় করি সবাই একসাথে থাকবো, একসাথে সুখ দুঃখ শেয়ার করবো। আমি বললামঃ সুতাবু সেটা পারলে খুবই ভালো হতো। বলেই বুকে আটকে থাকা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।

অন্যদিকে আমার ছাত্র রানা তাঁর চিকিৎসার মাঝপথেই সিঙ্গাপুর দেশে ফিরে গেছে। প্রথমবারে বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছিলো। এরপর এক বছরের মাথায় ওর শরীর স্টেম সেলগুলোকে রিজেক্ট করতে শুরু করে। তখন আবার সবকিছু নতুন করে শুরু করতে হয়েছিলো। সম্ভাব্য বোনম্যারো ডোনারও পাওয়া যাচ্ছিলো না। অবশেষে ওর এক চাচাতো ভাইয়ের সাথে শতকরা প্রায় ষাট ভাগ ম্যাচিং হওয়াতে তার ভিসার জন্য আবেদন করা হয় কিন্তু সিংগাপুরের সরকার তাকে ভিসা দেয়নি কারণ তার দাড়ি টুপি আছে। কি অদ্ভুত এক যুক্তি! বর্তমানে প্রযুক্তির উৎকর্ষতার যুগেও আমাদের উৎকর্ষতা সাধিত হয়নি মোটেও। এরপর রানা তার পরিবারের সবাইকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছিলো যে দ্বিতীয়বারের সফলতার হার মাত্র শতকরা দশ ভাগ আর ওর শরীরও সায় দিচ্ছে না তাই ও আর এই প্রক্রিয়ার জন্য অপেক্ষা না করে দেশে ফিরে যাবে। যদি আল্লাহ চান তো সাধারণ কেমোথেরাপিতেই ও ভালো হয়ে যাবে আর নাহলে কিছু করার নেই। যাওয়ার আগে আমার সাথে কথা হলো। আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না কি বলবো কারণ ও এমনিতেই মানসিকভাবে আমার চেয়ে অনেক পরিপক্ক আর গত এক বছরে আরো বেশি পরিপক্ক হয়েছে তাই সাধারণ কথাবার্তা বললাম। কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি সৃষ্টিকর্তা যেন ওর জীবনকে সরিয়ে তুলেন ঠিক যেমন বৃষ্টি প্রকৃতির মাঝে প্রাণের সঞ্চার করে।

আমি মাঝেমধ্যে ভাবি মানুষ হিসেবে না জন্ম নিয়ে পাখি বা ফড়িং হয়েও তো জন্ম নিতে পারতাম তাহলে নির্ভাবনায় ঘুরতে পারতাম সারা পৃথিবীময়। আমি অবশ্য নিশ্চিত না যে তাদের জীবনেও সমস্যা আছে কি নেই কিন্তু অবারিত আকাশে তাদের উড়াউড়ি সত্যিই আমাকে ঈর্ষান্বিত করে। অথবা আমাদের জীবনও কি কম বর্ণময়। আমরা পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ওপর প্রান্তে চষে বেড়াচ্ছি এমনকি ভূগর্ভ থেকে মহাকাশে সবখানেই আজ মানুষের রাজত্ব। আমিও অনেকটা পথ উড়ে বাংলাদেশ থেকে এই সিডনিতে এসে পরে আছি কিন্তু এখনও দুর্বল মুহূর্তগুলোতে কেন জানি দেশের কথায় বারবার মনেহয়। পাখি অথবা ফরিঙ হলে দূরদেশে প্রিয়জনের প্রয়োজনের মুহূর্তে উড়াল দিয়ে হাজির হয়ে যেতে পারতাম। শিয়রে বসে মাথায় হাত রেখে বলতে পারতাম, এইতো আমি এসে গেছি আর কোন ভয় নেই কিন্তু বাস্তবে তা আর হয়ে উঠে না। তবুও হঠাৎ হঠাৎ মনেহয় ফড়িং যেমন বৃষ্টির পর উৎসব করে উড়তে বের হয় সারা পৃথিবীর সকল মানুষেরা হয়তোবা কোন একদিন বেরিয়ে পড়বে রাস্তায় বিশ্বের সকল হানাহানি থেকে সভ্যতাকে রক্ষা করতে কারণ শুধু নিজে বা নিজের দেশের লোক ভালো থাকা মানে আসলে ভালো থাকা নয় কারণ অন্য দেশের সমস্যা কোন না কোনভাবে অন্য আরেকটা দেশকে ছুঁয়ে যাবেই।

Md Yaqub Ali
আমি মোঃ ইয়াকুব আলী। দাদি নামটা রেখেছিলেন। দাদির প্রজ্ঞা দেখে আমি মুগ্ধ। উনি ঠিকই বুঝেছিলেন যে, এই ছেলে বড় হয়ে বেকুবি করবে তাই এমন নাম রেখেছিলেন হয়তোবা। যাইহোক, আমি একজন ডিগ্রিধারী রাজমিস্ত্রি। উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করতে অস্ট্রেলিয়াতে আমার আগমন ২০১৫ সালের মার্চে। আগে থেকেই ফেসবুকে আঁকিবুকি করতাম। ব্যক্তিজীবনে আমি দুইটা জীবের জনক। একটা হচ্ছে পাখি প্রকৃতির, নাম তার টুনটুনি, বয়স আট বছর। আর একজন হচ্ছে বিচ্ছু শ্রেণীর, নাম হচ্ছে কুদ্দুস, বয়স দুই বছর। গিন্নী ডিগ্রিধারী কবিরাজ। এই নিয়ে আমাদের সংসার। আমি বলি টম এন্ড জেরির সংসার যেখানে একজন মাত্র টম (আমার গিন্নী) আর তিনজন আছে জেরি।
Related Articles
পরবাসিনী রোজার ‘বাংলা আগুন’এ কবি গুরুর ‘আলোক-লোক ফাঁকা’
পরবাসের জীবন একেক জনের কাছে এক এক রকম হয়ে ধরা দেয়। তার কারণ হল একেক জনের দেখার চোখ এক এক
অস্ত্র আইনে বিশ্বের পথিকৃৎ হতে পারে অস্ট্রেলিয়া
আমেরিকার পথে ঘাটে, ইস্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের ব্যবহার এবং সাধারন মানুষের মৃত্যু দেখলে অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন প্রধান মন্ত্রী জন হাওয়ারড
এভারেস্টের উচ্চতায় আলোকিত অন্ধকার! – লুৎফর রহমান রিটন
এ বছর জানুয়ারির শুরুতে প্রথম আলোর রস-আলোর জন্যে একটা ছড়া চেয়ে ফোন করেছিলো অনুজপ্রতীম মাহফুজ রনি। রনি আমার বিশেষ স্নেহভাজন।