প্রকৌশলী দেলোয়ার হত্যা – প্রেক্ষিত অস্ট্রেলিয়া

প্রকৌশলী দেলোয়ার হত্যা – প্রেক্ষিত অস্ট্রেলিয়া

বছর দুয়েক আগের ঘটনা। বাংলাদেশ থেকে অস্ট্রেলিয়া ফিরে আসার পর প্রথম দিন অফিসে। টেবিলের উপর একটা টেন্ডার ডকুমেন্ট রাখা; খুলে দেখলাম অনেক বড় একটা ডেভেলাপমেন্ট প্রোপোজাল (value: প্রায় 5 বিলিয়ন ডলার) অডিট করবে আমার কনসালটিং ফার্ম। প্রোপোজল পড়তে পড়তে পাশে এসে দাড়ালো আমার সিনিয়র কলিগ; বলল এটা আমরা জিতেছি; তুমি project manager and lead auditor। আমি রাজী হলাম; আমরা দেখবো Transport infrastructure assessment। দুদিন পর মিটিং, প্রজেক্ট শুরু হবে। সরকারী ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা থাকবেন।

মিটিং শেষ হলো। মিটিং-এ ডেভেলাপারের Project manager ও ছিলো। বেশ চালু লোক। তার কথায় সব কিছু-ই সঠিক আছে ,আমরা যেন সময় নষ্ট না করি। আমার সাথে আমার কনসালটিং ফার্মের আরেকজন সিনিয়র ইন্জিনিয়ার ছিল। আমাদের অফিসের কাছেই ডেভেলাপারের অফিস হওয়াতে ডেভেলাপার তার গাড়ীতে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানাল, আমরা ট্রেনে এসেছিলাম শুনে। আমার সিনিয়র কলিগ দেখলাম রাজী। আমি ও রাজী হলাম। গাড়ীর ভিতরে আলাপ শুরু হওয়ার একটু পর বুঝলাম আমার সিনিয়র সেই কলিগ ডেভেলাপারের পরিচিত। হতেই পারে। কিন্তু না, কথাবার্তায় মনে হলো একটু বেশি-ই পরিচিত।জিজ্ঞেস করতে বললো ডেভেলাপার উনার মেয়ের জামাই। বাহ্, কী সুন্দর! মনে মনে অবাক হলাম। গাড়ীতে আবার সে ডেভেলাপার বুঝাতে চাইল, প্রজেক্টে কোন সমস্যা নাই। তাড়াতাড়ি রিপোর্টটা যাতে জমা দেই। এই প্রজেক্ট পাশ হলে উনার অনেক অনেক বোনাস… আরও কী কী যেন বলে চলল…. কিন্তু আমার তখন অন্য চিন্তা মাথায়!

অফিসে পৌঁছে সরাসরি এক ডিরেক্টরের কাছে চলে গেলাম, বললাম আর্জেন্ট কথা আছে।ওকে ঘটনা বুঝালাম। বললাম, ওই শ্বশুর মশাই যদি এই অডিট প্রজেক্ট এ থাকে, তবে আমি নাই। ডিরেক্টর আশ্বস্ত করলো এই রকম হওয়ার কথা না।উনি প্রজেক্ট-এ থাকার কথা না! শ্বশুর মশাই পরের দিন বাদ। এমনকী আমার টীমের কোন সদস্যের সাথে তার কথা বলা বারণ!

এরপর প্রজেক্ট রিভিউর কাজ শুরু হলে দেখলাম assessment এ প্রচুর টেকনিকাল issue! সব রিভিউ করার পর বুঝলাম কেন ডেভেলাপারের এত তাড়া! Draft report review করার পরের মিটিং-এ ডেভেলাপার বেটা তো মেরে-ই ফেলবে এমন একটা ভাব! আমি আর আমার আরেক সিনিয়র কলিগ চুপচাপ ভদ্রভাবে উনাকে বুঝালাম, কোথায় কেন সমস্যা। কিন্তু বেটা নাছোড়বান্দা; রিপোর্ট বদলে ফেলার দৃষ্টতা দেখাল! আমি প্রথমে ঘাবড়ে গেলাম, কিন্তু রিপোর্ট তো বদলাবে না। সেই ডিরেক্টর কে আবার রিপোর্ট করলাম, উনি রিভিউ করলেন, পরে পরামর্শ দিলেন সরকারি মন্ত্রনালয়ে যেন এই রিপোর্ট-ই জমা হয়। যদি পরের কোন মিটিং -এ ডেভেলাপার কিনচিৎ পরিমান অশোভন আচরন করে, আমরা line of action বের করলাম।

সরকারী অফিসে রিপোর্ট জমা হওয়ার পর আমাদের ডাক পরলো present করার; PM হিসাবে আমি করলাম। উনারা অবাক হলেন; এত বড় প্রজেক্টের কেন এই দশা! ডিসিশান হলো ডেপেলাপারের আবার কাজটা ভালোভাবে করে জমা দেয়া! জমা দেয়ার পর আমরা-ই আবার রিভিউ করব। মিটিং-এ সেই ডেভেলাপার PM ও ছিলো! কিন্তু কত চুপচাপ শান্ত! কোনো হইচই নাই!

পরে প্রজেক্টর successful জমা হয়েছিল, কিন্তু সব ঠিক করার পর। এইদেশে ডেভেলাপমেনট প্রজেক্টে সরকারকে একটা টাকা দিতে হয়। Assessment এর কাজটা এইজন্য critical।অনেক হেরফের করা যায়, কোর্ট কেস ও হয় দুর্নীতির কারণে!

চিন্তা করি মাঝেমাঝে, যদি আমার সেই সাপোর্ট না থাকতো নিজের অফিসে বা সরকারি অফিসে, যদি কমপ্রোমাইজ করতে বাধ্য করতো, হয়তো চাকরি ছাড়তে হতো!

দেলোয়ার ভাই ও সেই সাপোর্টটা হয়তো খুঁজছিল। ভালো করে দেশের কাজটা যেন হয়, পারেননি। জীবন দিতে হল।কিন্তু তেমন কোন প্রতিবাদ নাই! ফেইসবুক প্রোফাইল বদলে ফেললেই প্রতিবাদ হয়? এত-ই মেরুদন্ডহীন ইনি্জনিয়ার সমাজ! একজন শিক্ষানবিশ ডাক্তার কে চড় দিলে (যেটা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়) পুরা দেশ অচল করে দেয়া হয়, আর একজন সৎ ইনজিনিয়ারকে খুন করা হয় দিনের আলোয়, তখন ‘আমার তো কিছু হয়নি’ বলে চুপ করে থাকা আমাদের সবাইকে-না আমার খুনি মনে হয়! সর্ষের ভিতর ভূত আছে, স্বীকার না করে পারবেন?

এত উড়াল সড়ক বানিয়ে কী লাভ, যদি নৈতিকতা পাতালে ঠেকে! বিশাল পদ্মার দুই পাড়ের সংযোগ ঘটিয়ে কী বাহবা-ই বা পাওয়া যাবে, যদি মন আর মনুষত্ব্যের সংযোগ ঘটানো না যায়!

ওপারে ভালো থাকবেন দেলোয়ার ভাই! সৎ লোক রাখার মতো যোগ্যতা আমাদের হয়নি। আপনি হারেননি, হেরেছি আমরা!

# দেলোয়ার ভাই হত্যার বিচার চাই।

(লেখকঃ Principal Transport Modeller at AECOM)

প্রতীকী ছবি

Place your ads here!

Related Articles

ঈদ নিয়ে যত কথা

… পত্রিকার পাতা উল্টালে আমার মনে হয় শপিং বাদ দিয়েও বাংলাদেশে মেয়ে / মহিলাদের ঈদ (ক্ষেত্র বিশেষে কিছু পুরুষেরও ঈদ)

পড়াশুনায় খরচ বেড়ে যাচ্ছে অস্ট্রেলিয়ায়

দুই হাজার দশ সালে আসাদ দম্পতি অস্ট্রেলিয়ায় আসে। বিয়ে থা করে ফেললেও তখন দু’জনের বেশ পিচ্চি। স্ত্রীর পড়াশুনা উপলক্ষে স্পাউস

বঙ্গবন্ধু, বাকশাল ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস

মুহম্মদ জে এ সিদ্দিকী: গত কিছুদিন ধরে একটি বই পড়ছিলাম—‘বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ নির্মাণ’। বইটির প্রতি দুটি কারণে আকৃষ্ট হয়েছিলাম। প্রথম কারণটি

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment