জীবন থেকে জীবনে

জীবন থেকে জীবনে

আজ থেকে ১০ বছর আগের কথা। ৫ই নভেম্বর আমি জানতে পারলাম আমার আর শুভর জীবনে নতুন কেউ আসছে, ঐ দিন ছিল আমার জন্মদিন, মনে হলো জীবনে এর চেয়ে বড় উপহার আর কি হোতে পারে! ৯ সপ্তাহের আলট্রাসাউন্ডের দিন, আমরা দুজন অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি বেবীর হার্টবিট শোনার জন্য, কোন ধারনাই ছিলো না ,এতটা জোরে যে শুনতে পাব ভাবতেই পারিনি, মনে হচ্ছিল আমার হার্টের ঢিপ ঢিপ শব্দই যেন শুনতে পাচ্ছি, ডাক্তার হেসে বললো -“কি কয়টা হার্টবিট শুনতে পাচ্ছ?”হাতের দুটো আঙ্গুল তুলে দেখালো। আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই বললো-“দুইটা হার্টবিট পাওয়া যাচ্ছে, তোমার তো টুইন্স হবে।” দুইটা হার্টবিট আলাদা করে ভিষন ভাবে বোঝার চেষ্টা করলাম কিন্তু কিছুতেই আলাদা করে বুঝতে পারলাম না ।খুশিতে আমরা দুজনই কোন কথা বলতে পারছিলাম না, সব সময় আমার টুইন্সের অনেক সখ ছিল, আর সত্যিই যে আমার হবে তা ভাবতেই পারিনি।

যাই হোক তারপর একটু একটু করে ওরা খুব ভাল ভাবে বেড়ে উঠছিলো আমার ভিতর, নতুন নতুন ভাল লাগার অভিজ্ঞতায় পূর্ণ হয়ে যাচ্ছিল প্রতিটা মুহূর্ত। আয়নাতে একটু একটু করে নিজের পরিবর্তন দেখে নিজেই অবাক হয়ে যেতাম। ভেবেছিলাম ছেলে না মেয়ে জানতে চাইব না; কিন্তু পারিনি, পচিশ সপ্তাহের আলট্রাসাউন্ডের দিন জেনে গেলাম দুইটা মেয়ে হবে। শুভ খুশীতে নাম ঠিক করতে লেগে গেল। ঠিক হলো, যে আগে আসবে তার নাম হবে অপলা আর যে পরে আসবে তার নাম অরূপা। এরপর ২ সপ্তাহ পর পর স্ক্যান করতে যেতাম আর আলো-আধারিতে ওদের নানান কীর্তিকলাপ দেখতাম দুজন মিলে। কিন্তু ৩৪ সপ্তাহের স্ক্যানের দিন, নার্স মুখ কাল করে ডাক্তারকে ডেকে আনলো, আরও কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষার পর ডাক্তার বললো “তোমার আজকে আর বাড়ী যাওয়া হবে না, আজকেই তোমার বেবী হবে, ইমার্জেন্সি সিজার করতে হবে।” আমার মনটা খুবই অস্থির হয়ে গেল। স্ক্যানের আগ মুহূর্তেও জানতাম বাচ্চাদের গ্রোথ-পজিশন সব ঠিক আছে সিজার করতে হবে না। আমাদের তখনো তেমন কনো প্রস্তুতি নাই, আর মনে হলো সময়ের আগেই কেন ওদের আমার শরীর থেকে বের করা হবে, আর একটু থাকত আমার ভিতরে! শুভ বললো- “চিন্তা করছ কেন? স্ক্যান করার সময়,ওদের দেখার জন্য এত অস্থির হও, এখন বরং পৃথিবীর আলোয় ওদের চেহারা দেখতে পাবা! ভাবো তো আজকেই দুই কন্যা কোলে নিয়ে বসে থাকতে পারবা। ভয় পেয়ো না ,যা হতে যাচ্ছে তা অবশ্যই ভালই হবে- ইনশাআল্লাহ।” অজানা আশঙ্কায় মনটা ভারী হয়ে গিয়েছিল, শুভ’র কথায় আবার সাহস ফিরে পেলাম, বাচ্চাদের দেখার লোভে মনটা ভাল হয়ে গেল।

কিছু সময়ের ব্যবধানে, অপলা- অরূপা চলে আসল আমাদের কাছে। প্রিম্যাচিওর হওয়ায় ওদের ইন্কেবিউটারে রাখা হলো। জ্ঞান ফিরে শুভর কাছে শুনলাম ওরা ভাল আছে, অনেক সুন্দর হয়েছে। ওদেরকে যখন প্রথম দেখলাম বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে ফুটফুটে বাচ্চা দুইটা আমার। প্রথমবার নিজের বাচ্চাদের একটু ছুঁয়ে দেখার জন্য নার্সের অনুমতি চাইতে হলো, কিন্তু ইন্কেবিউটারের ছোট্ট জানালা দিয়ে ওদের উষ্ণ তুলতুলে শরীর দুটো ছুঁয়ে আমার সারা শরীরে যেনো ঠান্ডা আনন্দের বাতাস বয়ে গেলো।

সপরিবারে লেখিকা

কিন্তু ওদের পাওয়ার সব আনন্দ ছাপিয়ে আল্লাহ্ আমাদেরকে চরম কঠিন পরীক্ষার মধ্যে ফেলে দিলেন, ওরা একই প্লাসেনটাতে থাকার কারনে, টুইন টু টুইন ব্লাড ট্রান্সফিউশন হয়েছিল, আইডেন্টিক্যাল টুইন্সের ক্ষেত্রে এমনটা হতে পারে সেই আশঙ্কার কথা ডাক্তার আগেই বলেছিল, তবে এটা আগে থেকে বোঝার কনো উপায় নাই, আবার কোন প্রতিকারও নাই। জানতে পারলাম অপলা আল্লাহর রহমতে একদম ঠিক আছে আর অরূপারও সব ঠিকই আছে শুধু কিডনিতে একটু সমস্যা হচ্ছে।

ঐ সময় ৭ দিন পর আমাকে হসপিটাল থেকে ছেড়ে দিল, কিন্তু অপলা-অরূপা কে ছাড়লো না,জানালো যে ওদেরকে আমার সাথে নিয়ে যেতে দিবে না। বুঝে পেলাম না বাচ্চা দুটোকে হসপিটালে রেখে কি করে বাসায় চলে যাব! কোন মায়ের পক্ষে কি এমনটা করা সম্ভব! যাই হোক, কঠিন বাস্তবতার কাছে মায়ের মনের মায়া বা আবেগ সব কিছু ধুয়ে মুছে গেলো। শুভ আমাকে বাসায় নিয়ে আসল,হসপিটাল থেকে শুধু নিয়ে আসলাম একটা এক্সপ্রেস পাম্প। বাড়ী থেকে যখন বেরিয়েছিলাম তখন দুটো বাচ্চা আমার শরীরের অংশ ছিল। নিজের শরীরের ভিতর সব সময় ওদের অস্তিত্বকে অনুভব করছিলাম। আর বাড়ীতে ফিরলাম ওদের ছাড়া শূন্য হাতে। সখের সপ্ন গুলো কেমন যেনো সব এলোমেলো হয়ে গেল। তারপরও শুভ যেন কিছুতেই আমার মনের মধ্যে গড়া স্বপ্ন গুলো ভাঙতে দিবে না। ও এমন ভাবে ব্যাপারটা হালকা করার চেষ্টা করল যেন এটা কোন ব্যাপারই না, একটু সময় গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। ঠান্ডা মাথায় বসে আমাকে অনেক বুঝাল বলল- “আল্লাহ্ আমাদের ভালবাসেন, তাই আমাদের পরীক্ষা করছেন। আল্লাহ পরীক্ষা যেমন দিয়েছেন সাহায্যও করবেন। সবই এখন নির্ভর করছে আমাদের উপর। এই পরীক্ষায় আমরা ঠিকই ভালভাবে উত্তীর্ণ হবো কখনই ভাগ্যকে দোষারোপ করে হা হুতাশ করে হাল ছেড়ে দেব না। আল্লাহর উপর ভরসা রাখো, তুমি দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে।” শুভ আমার অশান্ত মনকে শান্ত করার জন্য আরো বললো “মনে করো- এই বিদেশ বিভূঁইয়ে তোমার বাচ্চার হাত কেটে গেলে কি তুমি নিজের বাচ্চার রক্ত দেখে অজ্ঞান হয়ে যাবা! নাকি নিজে শক্ত থেকে ডাক্তারের কাছে নিবা! আমি জানি, তুমি মা, এই দুর্বল সময়ে তোমার পক্ষে মাথা ঠিক রাখা কঠিন কিন্তু এখন এই জটিল সময়টার মোকাবেলা করার জন্য আমাদের নিজেদেরকে প্রস্তুত করতে হবে, মনটাকে আরো শক্ত করতে হবে, যাতে আমরা আমাদের বাচ্চেদের সম্পূর্ণ সুস্থ করে তুলতে পারি।আর আমাদের সপ্ন গুলো পূরণ করতে পারি।”

অনেক কথার পর ঐ রাত থেকেই সংকল্প করলাম, শুভর বিশ্বাস আমি কিছুতেই নষ্ট হতে দেব না। বাবা হিসাবে ওর কষ্টটা তো কোন অংশে কম না, তার মধ্যেও এত দৌড়া দৌড়ি করছে সাথে আমাকেও সামলাচ্ছে, আর আমি মা, আমাকে তো পারতেই হবে। যত যাই হোক কিছুতেই ভেঙে পরব না। শুভর মত একজন মানুষ পাশে থাকতে যত ঝড়ই আসুক না কেন সব সামলে নেবো। তারপর থেকে কখনো চোখের পানি ফেলিনি, ক্লান্ত হয়ে পরিনি কোন কিছুতে, খাওয়া-ঘুম কোন কিছুরই যেন কোন চাহিদা ছিল না। তাতে কোনো সমস্যাও হত না। তখন মনে প্রানে শুধু আল্লাহ্কে ডেকেছি, যা কিছু সামনে এসেছে সামলানোর চেষ্টা করে গেছি, আর মনে করেছি সব ঠিক হয়ে যাবে।

ঐ কঠিন সময়ে হসপিটালের সোসাল ওয়ার্কার আমাকে অনেক সাহায্য করেছে।ও আমার অবস্থা দেখে আমার থাকার ব্যাবস্থা করে দিল হসপিটালের হোস্টেলে। শুভ রাতে বাসায় যেত, রান্না সহ সবকিছু করত, সকাল হলে আমার খাবার নিয়ে আবার হসপিটালে আসত। এভাবে ১ মাস যাবার পর অপলাকে ছেড়ে দিল, কিন্তু বাচ্চা নিয়ে ওই হোস্টেলে থাকার কোন নিয়ম নাই। তাই আবারো কোনো উপায় না পেয়ে বাস্তবতার চাপে বাধ্য হয়ে অরূপাকে হসপিটালেএকা রেখে শুধু অপলাকে নিয়ে বাসায় আসলাম। প্রতিদিন সকালে শুভ আমাকে আর একমাসেরঅপলাকে হসপিটালে দিয়ে কাজে চলে যেত, আবার বিকালে কাজ থেকে হসপিটালে ফিরলে, রাতে তিন জন বাসায় চলে যেতাম। এভাবে ৩ মাস যাবার পর অরূপাকে পাঠিয়ে দিল সিডনি ওয়েস্টমিড চিল্ড্রেন হসপিটালে, এমবুলেন্সের জানলা দিয়ে আমার ছোট্ট অরূপা এই প্রথম বাইরের আলো দেখলো।

এত দিন ভাবছিলাম সময়ের সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে, কিন্তু নতুন হসপিটালে আসার পর প্রথম জানলাম অরূপাকে বাঁচাতে হলে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট ছাড়া আর কোন উপায় নাই। কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট সম্পর্কে কোন ধারনাই ছিল না, এইটুকু বাচ্চার কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট কি করে সম্ভব, এখানে বাংলাদেশ – ইন্ডিয়ার মত অর্গান পাওয়ার তেমন কোন সুযোগ নাই, মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। তখন এটাও জানলাম যে ডাক্তার যদি আরও সতর্ক হতো অর্থাৎ দুই সপ্তাহ অন্তর আলট্রসাউন্ড না করে যদি আরও ঘন ঘন আলট্রসাউন্ড করতো, তবে টুইন টু টুইন ব্লাড ট্রান্সফিউশন আরো আগে বোঝা যেতো তাহলে হয়ত এত বড় ক্ষতি হত না। চাইলে রয়াল প্রিন্স আলফ্রেডহস্পিটালের ডাক্তারের বিরুদ্ধে আইনি ব্যাবস্থা নিতে পারতাম কিন্তু সব কিছু সামলাতে গিয়ে ওসব কিছু আর করা হয়ে উঠেনি। কিন্তু আমি যে ডাক্তারের তত্তাবধানে ছিলাম ঐ ডাক্তারকে কোন দিন ক্ষমা করব না , তাতে অবশ্য কিছুই আসে যায় না।

তারপর দফায় দফায় মিটিং করে আমাদের সব জানালো যে কিভাবে কি করা সম্ভব, অনেক কথার পর, যখন জানলাম আমার বা শুভর যার সাথে ম্যাচ করবে তার একটা কিডনি দিয়ে অরূপাকে সম্পুর্ন সুস্থ করে তোলা সম্ভব, তখন একটু সস্তি পেলাম। তবে অপারেশনের জন্য ওর ওজন কমপক্ষে ১১ কেজি হতে হবে। ডাক্তার আমাদেরকে নানা ভাবে বুঝালো। বলল-“তোমরা তো অনেক সৌভাগ্যবান যে তোমাদের দুটো করে কিডনি আছে যার একটা তোমার বাচ্চাকে দেয়ার কথা ভাবতে পারছ, তাতে তোমার বাচ্চাও নতুন জীবন পাবে আর তুমিও ভাল ভাবেই তোমার জীবন পার করে দিতে পারবা। ভাবতো ঐ সব বাবা- মার কথা যাদের বাচ্চাদের হার্ট বা কর্নিয়া ট্রান্সপ্লান্ট দরকার তারা কত অসহায়, নিজে বেঁচে থাকতে তারা বাচ্চাকে অর্গান দিয়ে বাঁচাতে পারছে না।” আরো বললো- “যে কোন ট্রান্সপ্লান্টই কঠিন তবে ট্রান্সপ্লান্ট সফল হলে মানুষ কিন্তু তথাকথিত সাভাবিক মানুষের চাইতে খারাপ থাকে না বরং অনেকাংশে ভালো থাকে কেননা তাকে নিয়মিত ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে থাকতে হয়, নিয়ম অনুযায়ী জীবন যাপন করতে হয়।” ডাক্তার আমাদেরকে কিছু ছবি সহ আরটিকেল দেখালো যারা হয়তো অরূপার চাইতেও কঠিন অবস্থা থেকে জীবনে অনেক সফল হয়েছে। কেউ ক্রিকেটার কেউ সাতারু কেউ আবার কিডনি স্পেসালিস্ট ইত্যাদি হয়েছে, জীবনে কোন কিছুতেই বাধা আসেনি। ‘সুতরাং দুশ্চিন্তা বাদ দিয়ে বরং আশা রাখো যে তোমাদের বাচ্চা অনেক ভালো ভাবে বড় হবে, জীবনে ও যা হতে চায় হবে, একদিন সেও মা হবে।” কথাগুলা মনের মধ্যে একদম গেঁথে গেলো, আশায় মনটা ভরে গেলো। ডাক্তারের বিদ্যা আর ক্ষ্মতার উপর আশ্বাস রেখে আল্লাহর উপর সব ছেড়ে দিলাম। তখন থেকে আমার মনে সম্পুর্ন বিশ্বাস চলে আসল যে আমার একটা কিডনি দিয়েই সব কিছু সমাধান হয়ে যাবে।

মায়ের সাথে অরূপা অপলা

তারপর সিদ্ধান্ত হলো অরূপাকে বাসায় যেতে দিবে, তখনCPR, ফিডং টিউব লাগানো সহ আরো অনেক ইমারজেন্সি ট্রেনিং দিলো আমাদের, তখন ক্ষনিকের জন্য মনে হয়েছিলো বাচ্চাকে প্রথম বাড়ীতে নেয়ার সময় বাবা মায়েরা কত সপ্নমাখা পরিকল্পনা করে, আর আমরা করছি ইমারজেন্সি ট্রেনিং। ক্ষনিকের ওসব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে মনে অনেক আশা নিয়ে ৪ মাস পর প্রথম বারের মত আমাদের অনেক সখের টুইনস্ নিয়ে বাসায় ফিরলাম। তারপরও হস্পিটালের গন্ডি পেরোতে পারলাম না, প্রতিদিনই দৌড়ের উপর থাকতে হতো, অর্থাৎ যখন তখন হসপিটালে যেতে হত। কিন্তু তারপরও মনে হতো দিন শেষে বাড়ীতে তো আছি। এভাবেই ওদের দুজন কে নিয়ে হাসি কান্নায় আমাদের মত নতুন মা-বাবার না বলা কাহিনির ভাণ্ডার দিনে দিনে বাড়তে থাকে।

অরূপার ওজন ১১ কেজি ওজন হওয়ার অপেক্ষায় দিন গুনতে গুনতে অপলা আধো আধো কথা বলতে শিখে গেল, গুটি পায়ে হাটা শিখে গেল, আর অরূপা কিছুটা পিছিয়ে থাকল। ওকে সেটুকু এগিয়ে নিতে আমাদের চেষ্টার সীমা ছিল না। দিনে দিনে আমিও হয়ে উঠছিলাম আরো মজবুত, বাচ্চার দোহাই দিয়ে আমাদের পারিবারিক- সামাজিক কোন কিছুই বন্ধ রাখিনি। শরীরের অসুস্ততাকে কখনো মনের অসুস্ততা হতে দেইনি, যাতে বাচ্চাদের মানসিক বিকাশে কোন বাধা না আসে। আমরা নিজেদের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলাম অবস্থা যাই থাকুক আমাদের ভাল থাকতে হবে। কিন্তু তারপরও কখনো কখনো ছোট ছোট ব্যাপারে মন খারাপ লাগত, বিশেষ করে যখন কোন কাছের মানুষ সব জেনেও আমাদেরকে দুর্বল করে দেয়ার জন্য অবুঝের মত আচরন করতো। একদিনের কথা মনে পড়ে- একদিন অরূপার শরীর হঠাৎ খারাপ হওয়ায় ওকে হস্পিটালে নিয়ে যচ্ছি, শুভ বাইরে থেকে খাবার কিনলো, এটা দেখে একজন অরূপার প্রতি অনেক ভালোবাসা দেখিয়ে বললেন ‘ বাব্বাহ তোমরা পার কি করে এই অবস্থায় খাওয়ার কথা ভাবতে! আমার গলা দিয়ে তো একটা খাবারও নামবে না।’ আবার ঐ একই মানুষ যখন সমালোচনা করে নাক শিটকাতেন-আমরা বাসি ভাত কেনো খাই, প্রতিদিন কেনো রান্না করি না সব কিছু পরিপাটি কেনো থাকে না,তখন খুব খারাপ লাগতো। মেলানো কঠিন মানুষের এধরনের ভালবাসার আচরন, কিন্তু উনার মত মানুষেরা না বুঝলেও আমাদেরকেতো ভাবতে হচ্ছে যে, মনের আর শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে অরূপাকে সামলাতে হয়, অপলা তখনো বাইরের কোন খাবারই খায় না, ওর খাওয়া আমার খাওয়ার উপর নির্ভর করে, বাচ্চা খাওয়া না পেলে কেমন লাগে তা শুধু ঐ মা’ই জানে, সব সামলাতে আমাদের এতো লোক দেখানো সৌজন্যতা করার সুযোগ ছিলো না। ঐ সময় আসলেই আমাদের জীবনে কোন রকম বিলাসিতার অবকাশ ছিল না। যা পেতাম তাই খেতাম, যেমন অবস্থা হতো তেমনি মেনে নিতাম। অরূপার এতো বড় বড় বিষয় সামলাতে আমার একটুও কষ্ট হতো না, কিন্তু কিছু মানুষের এই রকম ব্যবহার গুলো চাবুকের মত গায়ে বিধতো আর বোকার মতো কষ্ট পেতাম। যাই হোক এসব উদাহরনের তো আর শেষ নাই।

এভাবে চলতে চলতে একটা সময় হঠাত করে অরূপার কিডনির অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গেল, ডাক্তার বললো- ‘এখনি ট্রান্সপ্লান্ট অথবা ডায়ালাসিস ছাড়া কোন উপায় নাই।’ ডায়ালাসিসের জন্য আমাদেরকে প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করল আর তড়িঘড়ি করে আমাদের দুজনের কিডনি ম্যাচিং এক জন্য টেস্ট শুরু করল। আমি তো তেমন টেনশন করছি না, ভাবছি আমি যেহেতু মা, কাজেই আমার সাথেতো মিলবেই আর একবার ট্রান্সপ্লান্ট হলেই তো অরূপা ঠিক হয়ে যাবে। একদিনের কথা কোনদিন ভুলবো না – ম্যাচিং এর জন্য যে পরিমান রক্ত লাগবে তা আমাদের কাছ থেকে নেওয়া তো কোন সমস্যানা, কিন্তু ঐ পরিমান রক্ত অরূপার ছোট্ট শরীর থেকে নিতে হলে তা ভেইন থেকে নিলে হবে না আর্টারি থেকে নিতে হবে। এজন্য পরিকল্পনা অনুযায়ী একজননার্স ওর মুখে লাফিং গ্যাসের মাস্ক চেপে ধরে ছিল আর আরেকজন নার্স ওর পা এর আর্টারি থেকে রক্ত নেওয়ার চেষ্টা করছিল। আমি অরূপার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম একটু পরে দেখি ওর মুখ দিয়ে সাদা ফেনা বের হচ্ছে আর শরীরটা নীল হয়ে গেছে, আর চোখের সুধু সাদা অংশটা দেখা যাচ্ছে। আমি চিৎকার করে নার্সদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছি কিন্তু কেউ শুনছে না, ভাবছে আর্টারি থেকে বাচ্চার রক্ত নেয়া হচ্ছে তাই দেখে মা কাতর হয়ে হয়ে চেঁচামেচিকরছে। ততক্ষনে আমি ওই নার্স এর হাত ধরে ধাক্কা দিতে শুরু করেছি আর নার্স টা খুবই বিরক্ত হয়ে আমাকে সরানোর চেষ্টা করছে। তারপর যাহোক এক পর্যায়ে নার্স অবস্থা বেগতিক দেখে ইমার্জেন্সি বোতাম চাপ দেবার সাথে সাথে ঐ ঘরে পাঁচ -ছয়জন ডাক্তার এসে গেলো,তাদের চেষ্টাতেই অরূপা আবার নিঃশ্বাস নেয়া শুরু করলো। ঐ দিন আমি প্রথম অরূপাকে হারানো আর একই সাথে ফিরে পাওয়ার মিশ্র অনুভুতি অনুভব করলাম। এমন উদাহরনের অবশ্য অভাব নাই ছোট্ট অরূপার জীবনে।

কিন্ত মাথার উপর আকাশ ভেঙে পরল যখন ম্যাচিং রিপোর্ট আসল, আমার সাথে সব কিছু মিলছে কিন্তু আমার শরীরে এন্টিবডি অনেক বেশী। প্রেগনেন্সির পর সব মেয়েদের শরীরে এন্টিবডি বেড়ে যায়, কিছুতেই আমার কিডনি অরূপার জন্য নেবে না। আমার অনেক অনুরোধের জবাব হিসাবে বললো- “তুমি হাজার চাইলেও কোন লাভ নাই তোমার কিডনি অরূপার শরীরে কয়েক দিন পর আর কাজ করবে না, কারন অরূপার শরীরেও তখন এন্টিবডি বেড়ে যাবে, পুনরায় ম্যাচিং এর জন্য অবস্থা তখন আরো কঠিন হয়ে পরবে”. আবার এদিকে শুভর সাথে সব কিছু ম্যাচ করেছে কিন্তু শুভর সুগার লেভেল অনেক বেশী তাই ওর কিডনিও অরূপার জন্য দিতে পারবে না। একেবারে দিশাহারা হয়ে পরলাম, এত দিনের আশায় ছাই পরে গেলো। তার পর জানতে পারলাম ‘পিয়ার ডোনেশন’ এর ব্যাপারে। আমাদের মত আরও যেসব পরিবার আছে যাদের কিডনি প্রয়োজন তাদের সাথে যদি আমাদের ম্যাচিং হয় আর আমাদের সাথে যদি তাদের ম্যাচিং হয় তাহলে কিডনি অদল- বদল হবে। তাছাড়া মরনোত্তর অরগান ডোনেশনের সিদ্ধান্ত যারা নেয় তাদের কারো সাথে ম্যাচ করলে ট্রান্সপ্লান্ট সম্ভব, কিন্তু এই ধরনের ম্যাচিং খুঁজে পাওয়া অনেক কঠিন। তারপরও অনেক অনিশ্চয়তার বোঝা মনে নিয়ে আমরা ‘পিয়ার ডোনেশন’ এর জন্য প্রস্তুতি নিলাম। এর মধ্যে শুভ আর একবার ওর সাথে ম্যাচ করে দেখার জন্য অনেক অনুরোধ করে অনুমতি পেল। আল্লাহর অশেষ রহমতে দ্বিতীয়বার শুভ’র সুগার লেভেল ভাল আসল, তক্ষনি সিদ্ধান্ত হলো যত দ্রুত সম্ভব শুভর কিডনি দিয়ে অরূপার ট্রান্সপ্লান্ট করা হবে। এই সিদ্ধান্ত যেদিন হলো, সেদিন ছিল ৩ জুন অপলা- অরূপার ২য় জন্মদিন।উপহার হিসাবে শুভ অরূপাকে দিল নিজের কিডনি আর অপলাকে ফিরিয়ে দিল ওর জন্মান্তরের সাথী অরূপাকে।আর আমি ওদেরকে উপহার দিলাম আরো মজবুত একজন মা। ট্রান্সপ্লানটের তারিখ কাকতালীয়ভাবে ঠিক হল ১৬ই জুন– ওই দিন আমাদের বিয়ে বার্ষিকী, উপহার হিসাবে আল্লাহর কাছে আমরা অরূপার সাভাবিক জীবনটা চাইলাম। এখন ভাবলে অবাক হই যে আমাদের জীবনের বিশেষ তারিখ গুলা কিভাবে আরও বিশেষ হয়ে গেছে।

যাই হোক, মনে অনেক আশা নিয়ে বাসায় আসলাম, কিন্তু মনের আশঙ্কা তো আর যায় না। ২ বছর বয়সের মাত্র ১১ কেজি ওজনের একটা বাচ্চার ঐ টুকু শরীরে কি করে বড় মানুষের কিডনি লাগানো হবে? শুভ এ বিষয়ে অনেক তথ্য নিয়ে ঘাটাঘাটি করল, কিন্তু কোন কিছুতেই মনের ভয় কাটলো না, বরাবরের মতো আল্লাহর উপরে সব কিছু ছেড়ে দিলাম। এত কিছুর ভিতরেও শুভর মাথা সব সময় খুব ঠান্ডা, সব পরিস্থিতির জন্য ও যেন প্রস্তুত, সব কিছু যেন ভালই হবে। অবশেষে অনেক প্রতিক্ষার পর শুভর কিডনি দিয়ে অরূপার ট্রান্সপ্লান্ট হলো।

এখন ঐ অবস্থাটা ভাবলে শিউরে উঠি। ঐ সময় নানা দুঃসপ্নের মধ্যে দিয়ে জীবন কেটেছে, মনের অজান্তে যা দেখেছি তা আজও আমার পিছু ছাড়েনি। অরূপা ছিলো চিলড্রেন হসপিটালে, শুভ পাশের এডাল্ট হসপিটালে, ছোট্ট অপলা আমার সাথে সারাক্ষন লেপ্টে থাকে। দিনের পর দিন বাড়ীতে যেতে পারি না, নাওয়া-খাওয়ারও কোন ঠিক ছিল না, একজন নার্স সারাদিন আমার সাথে থাকতো, সাহায্য করতো। অপলার কোন সমস্যা হত না, ও যেন ওভাবেই নিজেকে খুশী রাখতে শিখে গেছিল, কখনো আমাকে বিরক্ত করত না বরং অরূপাকে সামলাতে আমাকে সাহায্য করত। ওই সময় এখানে কাছের বন্ধুদের সাহয্যের কথা তো আর বলে শেষ করা যাবে না, তার সাথে ছিল দেশে পরিবার আর স্বজনদের দোয়া। এই হস্পিটালে অপলাকে নিয়েই হোস্টেলে থাকার সুযোগ করে দিল সোসাল ওয়ার্কার। মনে পড়ে, শুভর অপারেশন এর আগে ওর ডাক্তার হেসে বলেছিল “চিন্তা করো না আমরা সাবধানে তোমার কিডনি বের করব, অন্য সময় তো অসুস্থ কিডনি বিনে ফেলে দেই তোমারটা তোমার মেয়ের জন্য যত্ন করে পাঠাব।” ৪ ঘন্টা ধরে শুভর কিডনিটা ওর শরীর থেকে বের করে বরফ দিয়ে নিয়ে আসল, এনেস্থসিয়া রুমে অরূপাকে নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম, ডাক্তার গর্ডন থমাস যিনি অরূপার অপারেশন করবেন, উনার মা বাঙালী ছিলেন, উনি ভাঙা ভাঙা বাংলা বলতে পারতেন, বললেন- “ভালো ভালো, তোমার হাসবেন্ডের কিডনি অনেক ভালো অবস্থায় পেয়েছি।” তার ২ মিনিটের মধ্যে অরূপাকে এনেস্থসিয়া দিল ও আমার দিকে একভাবে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়ল। ওকে নিয়ে অপারেশন থিয়েটারের ভিতরে চলে গেল।

তারপর আসলাম শুভর কাছে। তখনো ওর জ্ঞান ফেরেনি, শুভকে দেখে কেমন যেন হুহু করছিল মনের মধ্যে, ওর জায়গায় আমি থাকতে না পারার কষ্টটাও হচ্ছিল খুব, তবে জ্ঞান ফেরার পর শুভর চেহারায় যে প্রশান্তি ছিলো তাতে মনে হলো শরীরের সব কিছু দিয়ে দিতেও যেন ওর কোনই সমস্যা নাই। ৯ ঘন্টা পর অরূপাকে দেখতে গেলাম ICU তে, কাঁচের জানালা দিয়ে দুর থেকে অরূপাকে দেখলাম, ছোট্ট দুটো ঝুটি করা, ঘুমিয়ে আছে চুপ করে।

ডাক্তার জানালো শুভর কিডনি বড় থাকার কারনে আর ওর কাটা জায়গা ফুলে থাকার কারনে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ৩ দিন পেট সম্পূর্ন খোলা রাখবে, সেলাই করবে না, আর জ্ঞানও ফিরাবে না। শুভ যেহেতু তখন অরূপার কাছে আসতে পারবে না তাই অরূপার একটা ছবি তুললাম শুভর জন্য। পরের দিন শুভকে হুইল চেয়ারে নিয়ে অরূপার কাছে আসলাম, শুভ ঘুমন্ত অরূপাকে একটু ছুঁয়ে দেখতে পারল, কষ্টের মধ্যেও মনের মধ্যে একধরনের শান্তি।

জ্ঞান ফেরার ৪ দিন পর সকালে অরূপাকে ওয়ার্ডে দিল, দুপুরে ওকে নরম খাবার দিল। আমাকে অবাক করে ও মুখে একটু খাবার খেলো, আর সন্ধ্যার মধ্যে ওর শরীরে লাগান সব যন্রপাতি সহ বেবী কট ধরে একাই উঠে দাঁড়াল। খুব ভয় লাগছিল- আমার মনে হচ্ছিল যদি ও ব্যাথা পায়? পেটের মধ্যে লাগানো শুভর কিডনিটা যদি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়? অথচ সবাইকে অবাক করে দিয়ে অরূপা হাসছিল, দুষ্টুমি করছিল, অপলার সাথে কথা বলছিল। অপলা তখন ভাঙা ভাঙা কথা বলতে পারত কিন্তু অরূপা বলতো না, অপলাই শুধু অরূপার ভাষা বুঝত। আমি রাতারাতি এই পরিবর্তন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। যেই অরূপা মুখে কিছু খেত না বলে টিউব দিয়ে খাওয়াতাম আর ফিডিং ক্লিনিকে দৌড়াদৌড়ি করতাম, হাটত না তাই ফিজিও থেরাপিস্টের কাছে নিয়ে যেতে হত, কথা বলত না তাই স্পিচ্ থেরাপিস্টের কাছে নিয়ে যেতাম, আরো কতো জায়গায় দৌড়াতাম তা বলার না, অথচ শুভর একটা অর্গান নিমিষে অরূপাকে ওর সাভাবিক জীবনটা ফিরিয়ে দিল। ঐ দিন শুভ এসে যখন এই নতুন অরূপাকে দেখলো ওর সেই আনন্দটা সব কিছুর উর্ধে, ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, শুধু অনুভব করা যায়।

এর কিছুদিন পর শুভকে ওর হসপিটাল থেকে ছেড়ে দিল, এরপর আরও ৩ সপ্তাহ সপরিবারে হসপিটালের হোস্টেলে থেকে প্রথমবারের মত হাসি খুশি অরূপা-অপলাকে সাথে নিয়ে বাসায় ফিরলাম। তবে এখন এসব কিছু ম্যাজিকের মত শোনালেও সবসময় এর সাথে কঠিন বাস্তবতা তো আছেই, যে কোন ট্রান্সপ্লান্টই শেষ কথা না তার চেয়েও বড় কথা মেনটেইন করে যাওয়া। এসব বিষয়ে আগে অনেক ভুল ধারনা ছিলো, এখন কিছুটা পরিষ্কার আইডিয়া হয়েছে।

এখন আমাদের ১০ বছরের অরূপা নিজেই নিজের স্বাস্থ্য সম্পর্কে এত সচেতন যে, কোন খাবারে কি গুন আছে তা আমার চেয়ে ও ভালো জানে। ওর কোন ঔষধ ভুল করলে ফার্মাসিস্টকে পর্যন্ত ভুল ধরিয়ে দিয়ে ওদের লজ্জায় ফেলে দেয়। জীবনের প্রথম ২ বছর কথা না বললেও পাবলিক স্পিকিং এ ক্লাস উইনার হয়, নিজের ইউটিউব চ্যানেলে অনেক বক বক করে, দৌড়ে সবার আগে থাকে, পিয়ানো বাজায়, ভালো সাতার কাটতে পারে, স্কুল থেকে ক্রিকেট খেলতে যায়, নামাজ পড়তে পারে, দাবা খেলায় শুভকে চিন্তায় ফেলে দেয়, কখনো আবার হারিয়েও দেয়! এদেশে বাচ্চারা খুব একটা বাঙলা চর্চার সুযোগ না পেলেও স্কুলের পড়ার পাশাপাশি বাংলাটা লিখতে পড়তে শিখছে। আরো কত কি, ওর বয়সী একটা বাচ্চার যা করা উচিত ও সবই করে আল্লাহর রহমতে। অথচ ওর জীবনের শুরুটা যেন থেমে ছিলো। মনে মনে বলি আল্লাহ্ যেন সব সময় সহায় থাকেন।

জানি আমার লেখাটা পড়লে অনেকেরই নিজেদের জীবনের অনেক কঠিন সময়ের কথা মনে পরবে। অনেক বাবা- মা আছেন যারা আমাদের চাইতেও অনেক কঠিন পরিস্থিতি পার করেছেন, আল্লাহ যেনো সবাইকে শক্তি দেন সব কিছু সামলে নেবার। হসপিটালে থাকার সময় আরও অনেক বাচ্চাকে কিডনির জন্য কষ্ট পেতে দেখেছি তখন মনে হয়েছিল শুভর মত আমার একটা কিডনি দিয়েতো ঔ বাচ্চা গুলার কাউকে হয়তো সাহায্য করতে পারি। একদিন আমার কাউন্সিলার কে আমার ইচ্ছার কথা বললাম, ও আমাকে মানষিক ভাবে সুস্থ থাকতে সাহায্য করতো, ও আমাকে বকাবকি শুরু করলো বলল- ‘তোমার জীবনে যা ঘটছে তা কি কম? তোমার এখন এসব ভাবতে হবে না, বাসায় যাও- নিজের যত্ন নাও, সুস্থ থাক, পরিবারকে সুস্থ রাখ এখন এটাই বেশী জরুরী।’ ওর কথা শুনে বাসায় চলে আসলাম ঠিকই কিন্তু মন থেকে শান্তি পেলাম না, মনে হলো বেঁচে থাকতে না হলেও মৃত্যুর পর তো দিতেই পারি। শুভকে আমার ইচ্ছার কথা জানালাম। ও প্রশংসা করল। তারপর শুভর সাথে পরামর্শ করেই পরে কথা বললাম অস্ট্রলিয়ান অর্গান ডোনার রেজিস্টার অর্গানাইজেশনে সাথে। রেজিস্ট্রশন করলাম আমার চোখ, হার্ট, হার্ট ভাল্বস্, কিডনি, লিভার, লাংস, পেনক্রিয়াস, স্কিন টিস্যু, বোন টিস্যু ডোনেট করার জন্য, যা ট্রান্সপ্লান্ট ছাড়াও রিসার্চের জন্য কাজে লাগানো যাবে। শরীরটা ডোনেট করি নাই, আমার পরিবারের জন্য রেখে দিয়েছি। তারপর থেকে অনেক শান্তি পাই মনে, নিজেকে ভাল রাখার মধ্যে অনেক ভাল লাগা খুঁজে পাই। মজার কথা হলো ঐ সময় আমার অফিসের বস উনসত্তর বছরের যুবক আমার হার্টটা বুকিং দিয়ে রেখেছে, ওর বয়স এখন সাতাশি, এখনো মাঝে মাঝে ও ফোন দিয়ে খোঁজ নেয় যে আমার হার্ট ঠিক ঠাক আছে কি না, আর এই ঠিক ঠাক রাখার গুরু দায়িত্বটা বর্তেছে শুভর উপর। যাই হোক আসলেই কাজটা করার আগে বোঝা যায় না যে কত আনন্দ হয়। মনটা কত হালকা হয়ে যায়।

এ বিষয়ে একদিন কথা হচ্ছিল হঠাৎ অরূপা আমাকে জিজ্ঞেস করলো- “আচ্ছা মা তোমার হার্ট তো একটা তাহলে কেমন করে তুমি ডোনেট করবা? আর চোখ ডোনেট করলে দেখবা কেমন করে? তুমি কি একটা চোখ নিজের জন্য রাখবা আর একটা ওন্য কাউকে দিয়ে দিবা ?যেমন বাবা আমাকে একটা কিডনি দিয়েছে?’ আমি কিছু বলে ওঠার আগেই আবার জিজ্ঞেস করলো – ‘মা আমার কিডনিটা তো বাবার তাহলে কেমন করে আমি ডোনেট করতে পারবো? আমার কি বাবার পারমিশন নিতে হবে?” আমি অবাক হয়ে ওর দিকে শুধু তাকিয়ে থাকলাম, কারন আমি এভাবে কোনদিন ভাবিনি। ভেবে পেলাম না যে ওর ছোট্ট মাথায় কিভাবে! এমন প্রশ্ন আসলো আর ও কতটুকুইবা ও বোঝে! বুঝলাম যে ও ভাবছে যে ওর বাবা ওকে কিডনি দিয়েছে তাতে তো বাবার কোন সমস্যা হচ্ছে না কিন্তু মা চোখ ডোনেট করলে দেখবে কিভাবে? এই বিষয়টার সাথে যেহেতু মৃত্যু জড়িত তাই এখন ওকে খুব বেশি বুঝিয়ে বলতে পারলাম না, শুধু বললাম কিছু অর্গান বেঁচে থাকতে দেয়া যায়, আর কিছু দেয়া যায় মৃত্যুর পর। তোমার বয়স যখন ১৮ হবে তখন তুমি নিজেই অনেক কিছু জেনে নিতে পারবা আর সিদ্ধান্ত নিতে পারবা।

ঐ সময় হসপিটালে একটা বাঙালী বাচ্চার বাবা-মা কে দেখেছিলাম। মা ভয়ে ম্যাচিং এর জন্য টেস্টই করেনি আর বাবার সাথে বাচ্চার কিডনি মিললেও ভয়ে দেয়নি। আমার মনে আছে অরূপাকে একবার রক্ত দিতে হয়েছিল। ঐ বাচ্চার মা খুব সমবেদনার সুরে উপদেশ দিয়ে অরূপার রক্তের ব্যাগের দিকে তাকিয়ে বলেছিলো “ইস্‌স্‌ কার না কোথাকার যে রক্ত! যাই করেন ভাবী বাচ্চাকে হালাল খাবার খাওয়াইয়েন।” আমি একদম বুঝতে পারছিলাম না যে রক্ত দেবার সাথে হালাল খাওয়ার প্রসংগ আসছে কেন? এখানে যে খাবার গুলা হালাল বলে পাওয়া যায় আমরা সেটাই তো আমরা খাই। পরে অবশ্য বুঝেছি, যে রক্ত অরূপাকে দিতে হয়েছিল উনি তার কথা বলেছিলেন। পরে অবশ্য ঐ ভদ্র মহিলার বাচ্চার কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট হয়েছে, অবশ্যই কোন অজ্ঞাতনামা মানুষের দান, কারন উনারা যেহেতু বাচ্চাকে দেয়ার কথা ভাবতে পারেন নাই। আমি যতটুকু জানি অস্ট্রেলিয়ায় ডোনারের কোন পরিচয় পাওয়া যায় না। জানি না উনারা দৈবক্রমে জেনে নিয়েছেন কি না, যেই মানুষটার কিডনি দিয়ে তাদের বাচ্চার জীবন বাঁচানো হয়েছে তাঁর ধর্মটা কি ছিলো, হালাল খাবার খেতো কিনা!

অরূপা অপলা

ঐ সময় আমার অবস্থা দেখে অনেকেই তাদের মনের মত করে আমাকে অনেক উপদেশ দিয়েছে। কেউ বলেছে- ‘সারা দিন রাত জায়নামাজে বসে থাকবা’, কেউ বলেছে- ‘খেয়াল রাখবা কক্ষনো যেনো তোমার ওজু না ভাঙ্গে’,কেউ বলেছে- ‘কাফেরের দেশে থাকো বাচ্চাকে অন্য ধর্মের কু প্রভাব থেকে আগলে রেখো, তাহলেই তোমার দোয়া কবুল হবে ।তুমি মা তোমাকেই তো এসব ভাবতে হবে’। ভালোর জন্য হলেও এরকম উপদেশ গুলো আমার বাস্তব জীবনে মেনে চলতে পারিনি। চোখ বন্ধ করে উনারা এমন উপদেশ দিয়েছেন কিনা বুঝতে পারিনি। কারন আমাকে সারা দিন দৌড়ের উপর থাকতে হয়, সর্বক্ষণ জায়নামাজে বসে থাকলে কেমন করে জীবন চলবে! সব সময় পরিষ্কার- পরিচ্ছন্ন তো থাকি কিন্তু অরূপা সারাক্ষন বমি করতো, রাতেও আমি নাহয় শুভ ওকে সোজা করে কলে নিয়ে বসে থাকতাম। প্রত্যেক বার অরূপার ন্যাপি বদলানোর পর ওজন করে লিখে রাখতে হতো ,এসব কি আর বলে শেষ করা যায়! সাথে অপলা তো ছিলই। কি করে সর্বক্ষণ অজু রাখব! অরূপাকে সুস্থ করে তুলতে ডাক্তার সহ যাদের সাহায্য নিচ্ছি মোটামুটি সবাই অন্য ধর্মের কেমন করে তাদের প্রভাব কে কু প্রভাব মনে করব! খুব অস্থির লাগতো এসব বেপার গুলাতে।আমার একজন চাচা অনেক পরহেজগার, উনার সাথে কথা বললাম, উনি বললেন-‘ আল্লাহ্‌ কে তুমি যে কনো পরিস্থিতিতে যে কোন ভাবে ডাকতে পার, অন্তর থেকে মনে মনে সব সময় আল্লাহ্‌কে ডাকো, ঠিক আল্লাহ্‌ সাহায্য করবেন, আর তুমিও মনে শান্তি পাবা। বাহ্যিক আয়োজনের চাইতে তোমার অন্তরের বিশুদ্ধতা আর বিশ্বাসই বেশী জরুরী। আল্লাহ্‌ কোন অবস্থায় কার দোয়া কবুল করবেন তা কেউ বলতে পারে না’। চাচার কথা গুলো শুনে মনের অস্থিরতা কমে গেল। চাচা এখন আর নেই কিন্তু উনার কথা গুলা সারা জীবন মেনে চলবো। আর এক জন খালাম্মা আমাকে সাহস দিয়ে বলেছিলেন-‘ তুমি তোমার সংসার বাচ্চাদের জন্য যেভাবে যা করছ, মনে রেখো এটাই তোমার সব থেকে বড় ইবাদত, আল্লাহ্‌র উপর ভরসা রাখো, মন দিয়ে তাঁকে ডাকো সব ঠিক হয়ে যাবে, এখনো খালাম্মার কথা গুলা মনে পড়লে মনে অনেক সাহস পাই।

আমি যখন আমার অর্গান ডোনেট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তখন অনেকে অনেক রকম কথা বলেছে। আমাকে একজন দায়িত্বের সাথে বলেছিলেন যে, অর্গান ডোনেট করা উচিৎ না কারন আল্লাহ্ তো চাইলে দিতেই পারতেন, আমাকে দিতে হবে কেনো?” আমার আর তার সাথে কোন কথা বলতে ইচ্ছে করেনি তখন, কিন্তু পরবর্তীতে এই কৌতূহলী মনে একটা প্রশ্ন জেগেছিল যে অসুখ হলে তিনি কি ডাক্তারের কাছে যান? নাকি আল্লাহ অসুখ দিয়েছেন আল্লাহ ই অসুখ সারিয়ে দিবেন বলে বসে থাকেন? নাকি ডাক্তারের ধর্ম বিচার করতে বসেন! আল্লাহ্ না করুক কখনো যদি তার বা তার পরিবারের কারও কোন অর্গান দরকার হয় যা ছাড়া মৃত্যু অনিবার্য তখন কি করবেন? এসব কথা অন্যকে মুখে বলা যত সহজ নিজের জীবনে বাস্তবায়ন তত সহজ না।

সম্প্রতি আমাদের খুব কাছের, অনেক শ্রদ্ধার, অনেক ভালবাসার বড় ভাই, আমাদের অভিভাবক, সিডনীর বাংলা সংস্কৃতি প্রচার-প্রসারের অন্যতম সফল সংগঠক নাজমুল আহসান খান এর হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট হতে দেখলাম। উনার হার্ট মাত্র ১৭% কাজ করছিল আর বাকীটা ছিল উনার মনের জোর। কিন্তু বাস্তব বড় কঠিন। মনকে কি আর বেশীক্ষন শান্তনা দেওয়া যায়? সারাক্ষন ওনার স্ত্রী সন্ধ্যা ভাবী আশঙ্কার ভিতরে থাকতেন, রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে কাটাতেন। হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট এর আগে নাজমুল ভাই কে একটা ব্যাটারী পরিচালিত যন্ত্রের উপর নির্ভর করে চলতে হচ্ছিল। ভাবী তাই মাঝেমাঝেই বলতেন “ব্যাটারীর চার্জ দিতে ভোলা চলবে না, চার্জ শেষ হলেই তো জীবন শেষ।” ভাবতেও অবাক লাগে অবশেষে অচেনা অজানা একজন মানুষ, যে জীবিত থাকতে নিঃস্বার্থ ভাবে তার হার্ট ডোনেট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আর তার মৃত্যুর পর তা নাজমুল ভাইয়ের সাথে মিলেছে বলে আজ আমরা উনার দীর্ঘ জীবন কামনা করতে পারছি। এ যে কত বড় পাওয়া যাদের জীবনে এই কঠিন সময় পার করতে হয় তারাই বোঝেন। ঐ সময় প্রয়োজনীয় অরগান পাওয়া আর প্রিয় মানুষকে বাঁচানো ছাড়া আর কোন চিন্তা মাথায় আসা সম্ভব কি? এরপর জেনেছি নাজমুল ভাইও তাঁর মেজর অর্গান গুলো ডোনেট করেছেন।

আজ থেকে ৮ বছর আগে আমি যখন আমার অর্গান ডোনেট করার জন্য রেজিস্ট্রেশন করেছিলাম, তখন কাজটা করেছিলাম শুধুমাত্র একজন মা হিসাবে, এই বিষয়টা নিয়ে তখন আর তেমন কারো সাথে সেভাবে আলাপ করিনি কারন তখন মনে হয়েছিল এটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত ব্যপার। এছাড়া এসব বিষয় নিয়ে আমরা ভাবতে পারি না বা চাই না। আর সত্যি বলতে কি, আমাদের বাঙালি মুসলিম সমাজের মানুষ অনেক সময় না জানার কারনে ভয় পায় বা ভুল বোঝে। অথচ অর্গান ডোনেশনের ব্যাপারটাতো সবাই জানে, সব দেশেই অরগান ডোনেশনের ব্যাবস্থা আছে।

কিন্তু এখন নাজমুল ভাই এর দ্বিতীয় জীবনকে এতো কাছ দেখে মনে হচ্ছে, শুধু মা হিসাবেই না একজন মানুষ হিসাবেও আমার একটা দায়িত্ব আছে। নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে এটুকু অনুরোধতো করতেই পারি যে, যারা এখনো অর্গান ডোনেট করেন নাই তারা যদি বিষয়টা একবার ভেবে দেখেন। অনেকের মনে হতে পারে এরকম একটা সিদ্ধান্ত গ্রহন করতে মনে হয় অনেক সাহস থাকা লাগে কিন্তু আমি বলতে পারি যে আমি কিন্তু মোটেও অতটা সাহসী মানুষ না, আসলে যেটা লাগে সেটা শুধু একটু মানসিক ইচ্ছা।

কোন মৃত্যুই কাঙ্খিত না, কিন্তু কোন অবস্থাতেই মৃত্যুকে এড়িয়ে যাওয়াও সম্ভব না, মৃত্যু জীবনেরই শেষ অংশ, তার মেয়াদ আমাদের কারোর জানা নাই। একটু গভীর ভাবে ভাবলে এটাই মনে হয় যে আমরা আমাদের শরীরের মধ্যে অমুল্য সম্পদ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। বেঁচে থাকতে যেগুলো ছাড়া আমাদের এক মুহূর্ত চলে না অথচ সেই সম্পদ গুলাই আমাদের মৃত্যুর পর আর কোন কাজেই লাগে না, সব নষ্ট হয়ে যায় মাটির সাথে মিশে যায়, কারো হয়ত পুড়ে ছাই হয়ে যায়। তাই মনের ভয় সংশয় দূরে ঠেলে আমাদের সেই এক একটা অর্গান যদি আমরা জীবিত থাকতে ডোনেট করার সিদ্ধান্ত নেই, তাহলে আমরা এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেও আমাদের অর্গান নিয়ে বেঁচে থাকবে আরও কিছু মানুষ, আরও কিছু প্রিয়জন। একথা ভাবলে বেঁচে থাকতে এই অনুভবটা পাওয়া সম্ভব যে মৃত্যু মানেই সব শেষ হয়ে যাওয়া না। প্রিয়জনের মনে যেভাবে বেঁচে থাকা যায়, প্রয়োজনে অন্য কারো শরীরেও বেঁচে থাকা যায়।

নওরোজ খালিদ বর্ণী

নওরোজ খালিদ বর্ণী


Place your ads here!

Related Articles

Ajoy Kar's Article on Geoengineering

পৃথিবীর তাপমাত্রা কমাতে জিও-ইঞ্জিনিয়ারিং -এর প্রয়োগঃ সমাধান নাকি সমস্যা? পৃথিবীর তাপমাত্রা ২-১ ডিগ্রি বাড়লে রাশিয়ার ক্ষতি না হলেও প্রাকৃতিক দুর্যোগের

Durga Puja and Religious Practice in Australia

Durga Puja is the most holy festival of Hindus. In Australia, only 12 families in New South Wales started Durga

Rajon: I lose one more time…

A major challenge that children of migrants, at least of first generation, face growing up in a new country is

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment