কেনবেরার ২০১৯ সালের প্রভাতফেরি পৃথিবীর সকল বাংলাদেশ দুতাবাসের জন্য অনুকরনীয় হতে পারে
কেনবেরায় এবারই প্রথমবারের মত বিভিন্ন ভাষাভাষির মানুষ একত্রিত হয়ে ২১ ফেব্রূয়ারি ২০১৯-এর সকালে প্রভাতফেরি’র হাটায় অংশ নিয়েছিল । বাঙ্গালী অবাঙ্গালী সকলে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে সন্মান জানিয়েছিল ৫২’র ভাষা শহীদদের। শহীদদের আত্নার শান্তি কামনা করে পালন করেছিল এক মিনিটের নিরবতা। এভাবেই ‘বাঙ্গালীর প্রভাতফেরি’ হয়ে উঠেছিল ‘আন্তর্জাতিক প্রভাতফেরি’। এভাবেই ‘বাঙ্গালীর একুশ’ পরিনত হয়েছিল ‘আন্তর্জাতিক একুশে’।
আমার জানা মতে, কেনবেরায় প্রায় ১৭০টি ভাষাভাষির মানুষ রয়েছে এবং ২০১৩ সাল থেকে বাংলাদেশ দুতাবাস প্রতি বছর প্রভাতফেরি’র মাধ্যমে ৫২’র ভাষা শহীদদের সন্মান জানিয়ে আসছে। তবে, কোন অবাঙ্গালীকে সাথে নিয়ে প্রভাতফেরি’র মাধ্যমে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে ৫২’র ভাষা শহীদ’দের প্রতি সন্মান জানানোর উদ্যোগ এবারেই প্রথম নেওয়া হয়েছিল।
কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশি প্রয়াত রফিকুল ইসলামের উদ্যোগে এবং বাংলাদেশ সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতায় ১৮৯টি দেশের সমর্থনে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বরে ইউনেস্কো ২১ ফেব্রূয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসাবে ঘোষনা করে। গণসচেতনাতা জাগিয়ে ভাষার বিলুপ্তিরোধে ইউনেস্কো ২০০০ সাল থেকে ২১ ফেব্রূয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসাবে পালন করার সিদ্ধান্ত নেয়।
বিশ্বের প্রতিটি দেশে যথাযথ মর্যদার সাথে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ উদযাপন নিশ্চিত করন এবং ঝুঁকিপূর্ণ ভাষাকে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাতে এমএলসি মুভমেন্ট ইণ্টারন্যাশনাল কাজ করে যাচ্ছে। ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ উদযাপন ও ঝুঁকিপূর্ণ ভাষা’র বিলুপ্তিরোধে এমএলসি’র বিভিন্ন কৌশলগুলি বাংলাদেশ দুতাবাসের তৎকালীন রাষ্ট্রদূতেকে অবহিত করতে ২০১৩ সালের ১৯ জানুয়ারী এই সংগঠনটি বাংলাদেশ ভবনে রাষ্ট্রদূতের সাথে একটি মিটিং-এর আয়োজন করেছিল। সেই মিটিং-এর প্রস্তাবনা অনুসারে ২০১৩ সাল থেকে কেনবেরাতে প্রভাতফেরির শুরু (সুত্র : প্রিয়অস্ট্রেলিয়া,৩১.০১.২০১৩)। শুরু হয় দুতাবাস প্রাঙ্গনের অস্থায়ী শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে ৫২’র ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন।
ঢাকার শহীদ মিনারের আদলে ‘কাঠ’ আর ‘শোলা’ দিয়ে তৈরী এই অস্থায়ী শহীদ মিনারটিকে এবছর বাংলাদেশ দুতাবাস সাময়ীকভাবে দুতাবাস প্রাঙ্গনের বাইরে প্রতিস্থাপন করে। সকল ভাষাভাষির মানুষ যাতে শহীদ মিনারে এসে ৫২’র ভাষা শহীদ’দের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের সুযোগ পায় সেজন্যে দুতাবাস কর্তৃপক্ষ শহীদ মিনারটিকে অস্থায়ীভাবে কেনবেরার তেলোপিয়া পার্ক হাইস্কুল সংলগ্ন এলাকায় স্থাপন করেছিল। একুশের বিভিন্ন পোষ্টার ও লাল গালিচা পেতে সাজানো হয়েছিল শহীদ মিনার এলাকাটি। ভিন্ন ভিন্ন দুটি পোষ্টারে ছিল এসিটি লেজিস্লেটিভ এসেম্বলি ও অষ্ট্রেলিয়ান ফেডারেল পার্লামেণ্টে উত্থাপিত আইএমএলডি মোশনের কপি। এখানে উল্লেখ্য যে মোশন সংশ্লিষ্ট হ্যানসার্ড দুটিতে এমএলসি মুভমেণ্ট সংগঠনটির অবদানের কথা উল্লেখ রয়েছে।
অষ্ট্রেলিয়ায় ২১শে ফেব্রূয়ারি সরকারি ছূটির দিন নয়। এবং এবছর ২১শে ফেব্রূয়ারি বৃহস্পতিবার হওয়ায় অনেকের পক্ষেই সকালের প্রভাতফেরিতে অংশ নেওয়া সম্ভব হয়নি। এদের কথা বিবেচনা করে কর্তৃপক্ষ তেলোপিয়া পার্ক হাইস্কুল সংলগ্ন এলাকায় শহীদ মিনারটিকে দুই দিনের (২১-২২ ফেব্রূয়ারি) জন্যে উন্মুক্ত রেখেছিল। এতে করে অনেকেই তাদের নিজ নিজ সময়ে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শহীদদের আত্মার শন্তি কামনার সুযোগ পেয়েছিল।
দুতাবাসের বাইরে অস্থায়ী শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠা, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও সামাজিক সংগঠনের কর্মকর্তাবৃন্দ সহ বিভিন্ন ভাষাভাষির মানুষকে সাথে নিয়ে দুতাবাসের প্রভাতফেরি’র উদ্যোগ মানুষের মনে যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে তার নজীর এতিমধ্যেই লক্ষ্য করা গেছে।
শুক্রবার ২২ ফেব্রূয়ারি ২০১৯- তেলোপিয়া পার্ক হাইস্কুলের প্রিন্সিপ্যাল ‘শহীদ দিবস’ ও ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’-এর বিষয়ে স্কুল এসেম্বলিতে কথা বলেন। প্রিন্সিপ্যালের কথায় সেখানে উপস্থিত ছাত্রছাত্রীরা জানতে পারে মায়ের ভাষা রক্ষার জন্য বাঙ্গালী সন্তানের জীবন দানের কথা, জানতে পারে মাতৃভাষার প্রয়োজনীয়তা ও ভাষার বিলুপ্তিরোধে তাদের করনীয় বিষয়ে। জানতে পারে যে তাদের স্কুলের পাশেই রয়েছে অস্থায়ী শহীদ মিনারটি। তাই এসব ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই আগ্রহ নিয়ে ছুটেছিল অস্থায়ী শহীদ মিনার দেখতে। আমার ছেলে সেই স্কুলের ছাত্র। ওর কাছেই জানতে পারি ওর বন্ধুদের অনেকই শহীদ মিনারে গিয়েছিল।
শনিবার ২৩শে ফেব্রূয়ারি ২০১৯- এপিকের কেনবেরা শো’তে এক দম্পতি আমাকে তেলোপিয়া পার্ক এলাকার অস্থায়ী শহীদ মিনারটি সম্পর্কে বলছি্লেন। তারা সেখানে গিয়েছিলেন ৫২’র ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। তারা আমার কাছে ৫২’র ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে আরো জানতে চেয়েছিলেন। এপিকের কেনবেরা শো’তে এমএলসি’র স্টেজ পারফর্মেন্স-এ আমাকে কথা বলতে হয়েছিল ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ও ‘ইন্টারন্যাশনাল ইয়ার অফ ইন্ডিজেনাশ ল্যাঙ্গুয়েজ’ সম্পর্কে। তাই স্টেজ থেকে নেমে এলে এই দম্পতি আমার কাছে এসে শহীদ মিনার ও ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে জানতে চেয়েছিল। ভিন্ন ভাষাভাষির এসব মানুষের সাথে যখন কথা বলেছি একটা জিনিষ খেয়াল করেছি, তারা অবাক হয়ে বাংলার মানুষের আত্মদানের কথা মুগ্ধ হয়ে শুনছিল। বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষকে যেন নতুন ভাবে চিনল তারা।
একুশকে নিয়ে, শহীদ মিনারকে নিয়ে মানুষের জানার এই আগ্রহ নিঃসন্দেহে ইতিবাচ।
অস্থায়ী শহীদ মিনারটি’কে দুতাবাসের বাইরে সাময়ীক ভাবে স্থাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশ দুতাবাস কেনবেরার বিভিন্ন ভাষাভাষির মানুষকে বাংলাদেশ সম্পর্কে নতুন ভাবে ভাবতে শিখিয়েছে। যে দেশের মানুষ মায়ের ভাষাকে রক্ষা করতে নিজেদের প্রান দেয় সে দেশের মানুষের প্রতি অন্য মানুষের সন্মান তাদের নিজের অজান্তেই বেড়ে যায়।
বাংলাদেশ সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাব গড়ে তুলতে, বাঙ্গালীর একুশ’কে সকল মানুষের একুশে পরিনত করতে কেনবেরার বাংলাদেশ দুতাবাসের অনুকরনে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ দুতাবাসের উদ্যোগে ভিন্ন ভাষাভাষির সকল মানুষকে সাথে নিয়ে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে ‘শহীদ দিবস’ ও ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ পালন করা প্রয়োজন মনে করি।
Related Articles
কিশোর তিতাসকে দ্বিতীয় দফায় হত্যা করেছে তিন জানোয়ার
ফজলুল বারী: আব্দুস সবুর মন্ডল নামের এক যুগ্ম সচিবের জন্য সভ্য দুনিয়ায় অকল্পনীয় কায়দায় একটি ফেরী তিন ঘন্টা আটকে রাখায়
Bangla article on Humayun Ahmed
স্রষ্টার সাবকন্সাস্ মাইন্ড ও রহস্যপ্রিয় লেখকের মৃত্যু – দিলরুবা শাহানা 2012/pdf/Humayun_s_Tuni_184143340.pdf ( B)
লেখকের অনুভূতি
পরদেশে আসার পর থেকে ভাল করে লক্ষ্যকরি বয়স্ক মানুষের চালচলন। তাঁদের আচরণের মধ্যে কোন টা অসংগত কোনটা আঘাত প্রদ, ভাবতে
Thanks Dr Ajoy Kar for capturing and reporting such a good outcomes and Congratulations to all who has contributed to move the Monument at a public place to allow everyone to join and to observe IMLD, My special gratitude to the HE High Commissioner Mr Md Sufiur Rahaman who has taken this historical lead, and thankful for his kindness to consult me prior to finalising the decision as well as for inviting me personally to attend the whole event being the Founder of MLC Movement International Inc.