আবুল বাজানদারের চিকিৎসা সংকট
ফজলুল বারী: বৃক্ষমানব আবুল বাজানদার এখনও আছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্লাস্টিক সার্জারি ও বার্ন ইউনিটে। আট মাস পর তার হাসপাতালে ফিরে আসা নিয়ে আবার অনেক মিডিয়ায় রিপোর্ট হয়। কিন্তু সর্বশেষ খবর হচ্ছে আবুল আর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে রাজি নন। তিনি অনুরোধ করে বলেছেন তাকে যাতে চিকিৎসার জন্যে বিদেশে পাঠানো হয়। আবুলের চিকিৎসার মূল নেতৃত্বের ব্যক্তিত্ব ডাঃ সামন্তলাল সেন এরমাঝে এ ব্যাপারে সিঙ্গাপুরে যোগাযোগ করেছিলেন। তারা আগ্রহ দেখায়নি। কারন খুব স্বাভাবিক, অর্থনীতি। নিজের নাগরিক ছাড়া এই অনির্দিষ্টকাল লম্বা সময়ের চিকিৎসার ব্যয়ভারের দায়িত্ব নেয়া উন্নত বিশ্বে বাস্তব সম্মত নয়। স্বচ্ছল নাগরিকের চিকিৎসাও বেশিরভাগ দেশে ইন্সুরেন্স কোম্পানির মাধ্যমে চলে। বাংলাদেশ যে রোহিঙ্গা শরনার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে এতে উন্নত বিশ্ব সারাক্ষন বাংলাদেশকে প্রশংসায় ভাসায়। তেল দিতে চায় দুধ দিতে চায়, কিন্তু এসব শরনার্থীদের একজনকেও নিতে চায় না। বাংলাদেশের গ্রামের নিরক্ষর বৃক্ষমানব আবুল মিডিয়ার কারনে সেলিব্রেটি হয়েছেন। কিন্তু বিদেশে চিকিৎসার আসল কাহিনীতো জানেন না।
এই যে আমাদের ভালোবাসার বৃক্ষমানব আবুল, তার বিদেশে চিকিৎসার জন্যে যেতে চাওয়া নিয়ে আগ্রহ, এ নিয়ে অনেকে এরমাঝে সোশ্যাল মিডিয়ায় তাকে ধুয়ে দিতে শুরু করেছেন। তাদের উদ্দেশেই এ লেখা। প্লিজ, মানবিক হোন। আবুলের শ্রেনী চরিত্র বোঝার চেষ্টা করুন। আপনারা যারা শিক্ষাদীক্ষার যে সব সুযোগ পেয়েছেন বা এখনও পাচ্ছেন, আবুল সে রকম কেউ নয়। গ্রামের ছেলে। পড়াশুনা করেননি। আমরা সবাই মিলে তাকে একটি স্বপ্ন দেখিয়েছি। কিন্তু সে স্বপ্ন হোঁচট খেয়েছে। কারন তার সমস্যটি জিনগত। এটি নিয়ন্ত্রনে রাখার চেষ্টা করা সম্ভব। কিন্তু পুরোপুরি নিরাময়ের কোন ম্যাজিক এখন পর্যন্ত আমাদের কারও জানা নেই। এখানে তিনি প্রায় দু’বছর হাসপাতালে ছিলেন। পঁচিশটি অপারেশন হয়েছে হাতে-পায়ে। আমাদের কারও কী হাসপাতালে এক-দু’সপ্তাহের বেশি থাকতে ভালো লাগে? নিজেদের গায়ে-গতরে পঁচিশটি অপারেশনের কথা কী আমরা কল্পনায় ভাবতে পারি? আবুলের মানসিক অবস্থা কল্পনা করে প্লিজ মানবিক হোন।
এক অনলাইনের রিপোর্টে দেখলাম আবুল বলেছেন আমরা তার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছি। এ বিষয়টির ব্যাখ্যা না দিলে ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে। আবুলকে চিকিৎসার জন্যে আমরা ঢাকায় নিয়ে এসেছিলাম ঠিক, কিন্তু চিকিৎসা দিয়েছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের প্লাস্টিক সার্জারি ও বার্ন ইউনিট। চিকিৎসার পিছনে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। বিদেশে এমন দীর্ঘ মেয়াদী রোগীদের রাষ্ট্র থেকে সোশ্যাল ওয়ার্কার দেয়া হয়। এই সোশ্যাল ওয়ার্কাররাও সরকারের পেইড। রোগীর কাউন্সিলিংও গুরুত্বপূর্ন বিদেশের চিকিৎসায়। কিন্তু বাংলাদেশে এসব ব্যবস্থা নেই। আমরা ছিলাম আবুলের চিকিৎসার পিছনের স্বেচ্ছাসেবী সোশ্যাল ওয়ার্কার। চিকিৎসার বাইরে আবুল, তার পরিবারের যখন যা লাগতো সে ব্যবস্থা আমরা করতাম। কিন্তু এ নিয়েও এক পর্যায়ে সমস্যা দেখা দেয়। আবুলের চিকিৎসার ক্রেডিট নিয়ে তখন এক রকম কাড়াকাড়ি অবস্থা। যেহেতু সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে জড়িত তাই রিপোর্টাররা মাঝে মাঝে কোথাও আমাদের নাম লিখলেই ডাক্তারদের কেউ কেউ ক্ষিপ্ত হয়ে আবুলের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতেন। তাদের যেন ভয় করতো তাদের ক্রেডিট কেউ নিয়ে নিচ্ছেন কীনা!
আবুলকে তখন আমরা বলে দেই, খবরদার কোথাও আমাদের নাম বলবেননা। কারন আমাদের লক্ষ্য আবুলের চিকিৎসা। চিকিৎসা সংশ্লিষ্টদের খুশি রেখেই এটি বাংলাদেশে আদায় করতে হয়। আর আমরা তার জন্যে নানাকিছু করতে পারবো, চিকিৎসাতো দিতে পারবোনা। চিকিৎসা দেবেন চিকিৎসকরা। অনেকের আবুলের চিকিৎসা নিয়ে খন্ডিত ধারনা আছে। আবুলের কেবিন ভাড়া, অপারেশন-ওষুধের সমুদয় খরচ বহন করেছে হাসপাতাল তথা সরকার। একজন চিকিৎসক যিনি একমাত্র তার প্রথম অপারেশনে ছিলেন তিনি তাকে বাড়ি করার জন্যে জমিও কিনে দিয়েছেন। কিন্তু এসবের পাশাপাশি প্রায় দু’বছর আবুল যে হাসপাতালে ছিলেন তার ব্যক্তিগত নানা চাহিদা পূরন সহ পরিবারের ভরনপোষনের অনেক কিছুর ব্যবস্থা নেপথ্যে থেকে আমাদের করতে হয়েছে। কারন চিকিৎসার পাশাপাশি ম্যানেজমেন্ট ব্যয় ওয়াকিবহালরাই শুধু জানেন। আবুলকে কেবিনে আমরা একটি উন্নত জীবন দিয়েছিলাম। পছন্দের স্মার্টফোনটিও তার হাতে পৌঁছে গিয়েছিল। এছাড়া আমরা লিখলেই ঢাকাবাসীদের অনেকে আবুলের জন্যে রান্না করা খাবার, কাপড়চোপড় নিয়ে যেতেন। আমাদের প্রতিনিধি হিসাবে একজন নিবেদিতপ্রান স্বেচ্ছাসেবক কাজী বাহার প্রতিদিন তার সঙ্গে দেখা করতে যেতেন। এরজন্যে বাহার দু’বছর ঈদেও বাড়ি যাননি। মিডিয়া ব্যক্তিত্ব শরীফুল হাসান আবুলের মেয়েকে স্কুলে ভর্তির ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু আবুল হাসপাতাল থেকে চলে যাওয়ায় তা আর সম্ভব হয়নি।
আবুল যখন হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যান, এর আগে হাসপাতালের নানা সমস্যা নিয়ে আমাদের সঙ্গে কথা বলতেন। পুরনো রোগী আর চিকিৎসা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়ায় তার আদরযত্ম কমে গিয়েছিল। কিন্তু আমরা আবুলকে বরাবর নিবৃত্ত করার চেষ্টা করতাম। আমরা বোঝাতাম সবকিছুই সহ্য করে হাসপাতালে থেকে চিকিৎসা আদায় করতে হবে। হাসপাতাল থেকে চলে গেলে পন্ড হবে এতোদিনের সব অর্জন। কিন্তু আমাদের ব্যর্থতা আমরা আবুলকে থামাতে পারিনি। আমাদেরও না বলে সে চলে গেলো। পরিবারের ভরনপোষনের জন্যেও আবুল আমাদের ওপর নির্ভরশীল ছিল। বাড়ি যাবার পরও সে আমাদের টাকার জন্যে ফোন করতো। কিন্তু চিকিৎসায় না ফেরা পর্যন্ত আমরা তাকে আর টাকা পয়সা না দেবার সিদ্ধান্ত নেই। ঢাকা মেডিকেলের চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে মিডিয়ায় তার ইন্টারভ্যু নিয়ে আমরা বিব্রত হই। কারন চিকিৎসার জন্যেতো তাকে ডাক্তারদের ওপরই নির্ভর করতে হবে। এরমাঝে আমরা তার চিকিৎসার ভিন্ন একটি উদ্যোগ নিয়েও কাজ করছিলাম।
আবুলের চিকিৎসকদের অন্যতম অধ্যাপক কবির চৌধুরী শমরিতা হাসপাতালে আমাদের বিভিন্ন রোগীদের ফ্রি চিকিৎসা দেন। শমরিতা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাদের ফ্রি বেড দেয়। শুধু খাবার-ওষুধ এসবের খরচ আমরা দেই। এমন একটি উদ্যোগের আয়োজনের পর আমরা আবুলকে মাঝে একবার ঢাকায় নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু সে কেবিন ছাড়া থাকতে রাজি হয়নি। আমরা তাকে বুঝিয়েছি হাসপাতালের আশেপাশে কোথাও একটা রূম নিয়ে তার স্ত্রীর থাকার ব্যবস্থা করবো। দিনের বেলা তার স্ত্রী হাসপাতালে থাকবেন। রাতের বেলা থাকবেন তার জন্যে ভাড়া বাসায়। কিন্তু আবুল এতে রাজি না হয়ে গ্রামে ফিরে যান। আসলে আবুল বাথরূম ব্যবহার সহ নানাকিছুর জন্যে তার স্ত্রীর ওপর নির্ভরশীল। মাঝে সাংবাদিক শিশির মোড়ল আরেকটি চেষ্টা করছিলেন। আবুলের সমস্যার জিন রহস্যের গবেষনার অংশ হিসাবে এই চিকিৎসার কথা হচ্ছিল হলি ফ্যামেলি হাসপাতালে। কিন্তু এই আলোচনা চলার সময়েই আবুল আমাদের না জানিয়ে একা একা চলে আসেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। এখানে প্রথম দিন তিনি ছিলেন ওয়ার্ডের বারান্দায়। এরপর ওয়ার্ডে তাকে বেড দেয়া হয়। কিন্তু এবার তাকে কেবিন দেয়া হয়নি। এবার আসার পর তাকে শর্ত দেয়া হয় যাতে আমাদের লোকজন তার কাছে না যায়।
অথচ ঢাকায় এ রোগীর কোন স্বজন নেই। এখানে নানাকিছুর জন্যে তিনি তার স্বেচ্ছাসেবক কাজী বাহারের ওপর নির্ভরশীল। তারও এখন আবুলের কাছে যাবার অনুমতি নেই। বাহারকে আমরা বুঝিয়েছি যে কোন শর্তে আবুলের চিকিৎসা হোক। দেশবাসীর মতো আমাদেরওতো একটাই চাওয়া, তাহলো আবুলের চিকিৎসা। কিন্তু আবুল ঢাকা মেডিকেলে ফিরলেও এখানে চিকিৎসা নিতে রাজি না হওয়ায় এ নিয়ে নতুন হতাশার সৃষ্টি হয়েছে। এরজন্যেও আবুলের কাউন্সিলিং দরকার। আমাদের ধারনা বিরল বৃক্ষ মানব আবুল বাজানদার বিদেশে চিকিৎসা চান এ খবরটি দেশি মিডিয়া ভায়া বিদেশি মিডিয়ায় গেলে বিদেশের কোন চিকিৎসা গবেষনা প্রতিষ্ঠান তাকে নিয়ে যাবার উদ্যোগ নিতে পারে। সরকার থেকে নির্দেশ পেলে এ নিয়ে চেষ্টা করতে পারে বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসমূহও। এর আগ পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেলেই আবুলের চিকিৎসা আবার শুরু হতেই পারে। অনলাইনের মাধ্যমে তার চিকিৎসার পিছনে বিদেশের অনেক চিকিৎসক-গবেষক জড়িতও। কাজেই চিকিৎসা পেতে চাইলে আবুলকে হাসপাতালেই পড়ে থাকতে হবে। বাড়ি চলে গেলে আবার পন্ড হবে সব উদ্যোগ। আবুলের চিকিৎসা শুরু হলে আমরাও আবার আবুলের পিছনে ফিরবো। আপনারাও সঙ্গে থাকুন প্রিয় দেশবাসী। কাজেই ভুল না বুঝে তার সমস্যাগুলো বাস্তবসম্মত মানবিক দিক দিয়ে বিবেচনা করুন। হাতেপায়ে পঁচিশটি অপারেশন হলে কার আর মাথা-মগজ ঠিকমতো কাজ করে? ভালো থাকুক আমাদের ভালোবাসার আবুল।
Related Articles
Suspension of GSP: its impact and possible deeper reasons
On June 27th, the US suspended Generalized System of Preferences (GSP) for Bangladesh. It will be effective after 60 days.
Quarantiny – Chapter 5 – Day 2
Saturday 18 April 2020 “Quarantine being colour blind,constantly reminding how colourful the world is” There was a knock on the
Climate Change, Food and Energy Security: Bangladesh Context
While climate change is slowly and surely affecting agricultural production in Bangladesh, the fear is growing by the reports that