“একুশে’র চেতনার বৈশ্বিক প্রাতিষ্ঠানিকতা অর্জন” বাস্তবায়নের রূপরেখা-২ (সাংগঠনিক ভিত্তি)
– নির্মল পাল
মহান একুশে ফেব্রুয়ারীতে প্রতিবছর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে উদযাপনের ইউনেস্কোর প্রাতিষ্ঠানিক ঘোষণা বিশ্বব্যাপী ভয়াবহভাবে অবক্ষয়মান মাতৃভাষা সমূহের ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার মুখুমুখী পরিস্থিতির কথা সকল ভাষাভাষীর জন্যই নজর কাড়া বিশেষ সতর্ক বার্তা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বকারী সংস্থা ইউনেস্কো কর্তৃক আনুষ্ঠানিক এই ঘোষণার প্রেক্ষাপটে বিশ্বব্যাপী ঝুঁকিপূর্ণ মাতৃভাষা রক্ষায় সংশ্লিষ্ট ভাষাভাষীদের সচেতনতা এবং সম্পৃক্ততার অনিবার্যতার গুরুত্বকে অত্যন্ত স্পষ্টতর করা হয়েছে। সমাজ, সভ্যতা, শিক্ষা, বিজ্ঞান অথবা প্রযুক্তির সবকিছুই যেহেতু যেকোন না কোন একটি ভাষার মাধ্যমেই অনুবাদিত, প্রকাশিত এবং প্রচারিত সেহেতু ব্যাক্তি, গুষ্টি, জাতি এবং রাষ্ট্রের সকল পর্যায়ে প্রতিটি ভাষার চর্চা, সুরক্ষা এবং সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তার কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়াই প্রতিবছর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের মুখ্য উদ্দেশ্য।
ভাষা চলমান, যা মানুষের চর্চা বা ব্যাবহারের মধ্যেই টিকে থাকে। গতিশীল ভাষার মাধ্যমেই সমাজ-সংস্কৃতি-শিক্ষার সম্প্রসারণ প্রচার-প্রসারতা মানব সভ্যতাকে ধীরে ধীরে আজকের বিজ্ঞান-প্রযুক্তি নির্ভর অত্যাধুনিক সমাজে উন্নীত করেছে। মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশে ভাষার প্রসারতার পাশাপাশি ভাষা নিকটস্থ/পার্শ্ববর্তী ভাষার সাথে সংমিশ্রণে সংকরায়িত ভাষার সৃষ্টি হয়ে থাকে। বহুল প্রচারিত অথবা শিক্ষা-সংস্কৃতিতে অপেক্ষাকৃত প্রভাবশালী ভাষা উন্নয়নমুখী বৃহত্তর জনগুষ্ঠিকে প্রভাবিত করার কারনে ক্ষুদ্রতর ভাষা সমূহের প্রয়োগ বা ব্যাবহার সবসময়ই অপেক্ষাকৃত কম। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তুলনামূলকভাবে কম ব্যবহৃত ভাষাগুলি প্রয়োজন এবং সময়ের সাথে সাথে বিলীন হওয়ার ঝুঁকির মুখোমুখি হতে হয়। ভাষা গবেষক এবং বিশেষজ্ঞদের মতে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন আদি মানবসমাজে (৮০০০BC) সর্বমোট ভাষার সংখ্যা ছিল বিশ সহস্রেরও অধিক। সমাজ-সভ্যতার প্রয়োজনে, মানুষের মাঝে পারস্পরিক যোগাযোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি, শিক্ষা-সংস্কৃতির উন্মুক্ত প্রসার, সম্প্রসারণ ও সমন্বয়তার প্রয়োজনে প্রভাবশালী ভাষাগুলির গ্রহণযোগ্যতা ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়ে আসছে। ফলশ্রুতিতে ছোট ছোট ভাষাগুলির প্রভাব বা প্রচলন ক্রমেই সংকুচিত হতে হতে এক পর্যায়ে বিলীন হয়ে চলেছে।
অনুন্নত মানবসভ্যতার আদি তথা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার গোড়াপত্তন থেকে প্রয়োজনীয় প্রকাশনা, প্রচারণা বা সংরক্ষণের প্রথার অভাব এবং ইউনাইটেড ন্যাশানস এর ন্যায় কোন সমন্বিত আন্তর্জাতিক সংস্থা গড়ে না উঠার কারনে ভৌগলিকভাবে বিচ্ছিন্ন ভাষাগুলি বিলীন হওয়ার নির্ভরযোগ্য তথ্য, পরিসংখ্যান বা অস্তিত্ব সম্পর্কে আধুনিক এই সভ্যসমাজে জানার কোন সুযোগ নেই। ফলে উনবিংশ শতাব্দীর গোঁড়ার দিকে পরিচালিত পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে প্রকাশিত সাত-আট হাজারের মাঝামাঝি সংখ্যক ভাষার অস্তিত্বকে বিশ্বের প্রচলিত ভাষার সংখ্যা হিসেবে বিবেচিত হয়, যা উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে (১৯৭০-২০০৫) পরিচালিত পরিসংখ্যানে মাত্র পাঁচ হাজারের কোটায় নেমে আসে। বিশেষজ্ঞ গবেষকদের মতে ভাষা পরিসংখান পরিচালনার ৩০ বছরের মধ্যেই ২০ শতাংশ ভাষা অবক্ষয়ের তথ্য স্পষ্ট। যার মধ্যে প্রতিবছরে অবক্ষয়ের হার ১৯৭০-১৯৮৮ সনে গড়ে ০.৩% হলেও ১৯৯০-২০০৫ সনের পরিসংখানে তা বেড়ে ১.০% এর বেশী দাঁড়িয়েছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে অর্থাৎ এই ধারা প্রতিরোধে কার্যকরী ব্যাবস্থা গ্রহন করা না গেলে আগামী প্রজন্মের ৮৫% মানুষ মাত্র ১০-১২% বর্তমানে প্রচলিত ভাষা ব্যাবহারের সুযোগ পাবে। ফলে আগামী প্রজন্মের কাছে বহুভাষা সমন্বয়ের ভিত্তিতে গড়ে উঠা সমাজ, সভ্যতা, শিক্ষা, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির শেকড়ের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে শিক্ষা গবেষণার মৌলিক যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া অনেকটাই অসম্ভব হয়ে পড়বে। ফলশ্রুতিতে শিক্ষা, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির বিকাশের অব্যাহত ধারা কোন না কোন ভাবে প্রতিবন্ধকতার সন্মুখিন হতে বাধ্য।
বিশ্বায়ন এবং ডিজিটাইলাইজেশনের দ্রুত ক্রমোত্থানের সাথে পাল্লা দিয়ে ভাষা সমূহের অবক্ষয়ের দ্রুতধারা প্রতিরোধের বিষয়কে এমএলসি মুভমেন্ট ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। প্রচলিত ভাষাসমুহের ভয়াবহ এই অবক্ষয়রোধে শুধুমাত্র “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” উদযাপনের আনুষ্ঠানিকতা প্রকৃত অর্থে ঝুঁকিপূর্ণ ভাষাসমূহ রক্ষায় কোন বাস্তব অবদান রাখবে বলেও এমএলসি মুভমেন্ট বিশ্বাস করে না। কারন ভাষা গতিশীল, নিত্য-নিয়মিত ব্যাবহার ব্যতিরেকে ভাষার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা অসম্ভব। প্রাতিষ্ঠানিক, সামাজিক এবং সমন্বিত উদ্যোগ তথা সংশ্লিষ্ট গুষ্ঠির সরাসরি গণসম্পৃক্ততা ছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ ভাষাসমূহের রক্ষা অসম্ভব। প্রতিবছর ইউনেস্কো ঘোষিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের বার্ষিক কর্মসূচী পালনের পেছনে প্রয়োজন ভাষা সংরক্ষণে বছরের প্রতিটি দিনে সংশ্লিষ্ট সকল সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্থার কার্যকরী পদক্ষেপ এবং প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানের সুনির্দিষ্ট কর্মসূচী প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ মাতৃভাষাগুলি সুরক্ষায় সংশ্লিষ্ট ভাষাভাষীকে সম্পৃক্ত করে নিজ নিজ ভাষা রক্ষায় উৎসাহিত করার সহযোগী কার্যক্রম। বিশ্বব্যাপী ভাষা রক্ষার এই অনিবার্য প্রয়োজনকে সামনে রেখেই এমএলসি মুভমেন্ট ইন্টারন্যাশনালের সাংগঠনিক রূপরেখা প্রণীত হয়েছে। যেই রূপরেখার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বাংলা ভাষা আন্দোলনের সামগ্রিক উপাদানগুলিকে ‘একুশের চেতনা’ হিসেবে আন্তর্জাতিক আদলে জুতসই উপাদানে রূপায়িত করে উপস্থাপনের কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে। বাংলা ভাষা আন্দোলনের বায়ান্নের স্মৃতি রক্ষার নিমিত্তে নির্মিত ‘শহীদ মিনারে’র আদলে প্রতিটি শহরে “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ” নির্মাণ; বাংলা একাডেমী প্রতিষ্ঠার মত সর্বত্র সকল ভাষা সংরক্ষণের ন্যূনতম আঞ্চলিক প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি সৃষ্টির লক্ষ্যে বিশ্বের প্রতিটি লাইব্রেরীতে “একুশে কর্নার” প্রতিষ্ঠার দর্শন, এবং প্রত্যেক ইউএন সদস্যভুক্ত রাষ্ট্র কর্তৃক মাতৃভাষা সংরক্ষণে একই ধরনের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়নের উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ এমএলসি মুভমেন্টের সাংগঠনিক প্রক্রিয়ার মুখ্য বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
বাংলাদেশের সকল শহর ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বায়ান্নের মহান একুশের স্মৃতিতে সৃষ্ট শহীদ মিনার এর দ্রুত ক্রমবিস্তার মাতৃভাষা বাংলা রক্ষায় প্রতিমুহূর্তে মাতৃভাষা রক্ষার নীরব স্থাপত্য বার্তায় প্রতিটি মানুষকে যে আকুতি জানিয়েছে, উজ্জীবিত করেছে স্বাধিকার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে, বিশ্বের প্রতিটি শহরে “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ” এর সৃষ্টি বিশ্বব্যাপী ঝুঁকিপূর্ণ মাতৃভাষাসমূহ রক্ষার সকল ভাষাভাষীকে একইভাবে নিজ নিজ মাতৃভাষা রক্ষায় অনুপ্রাণিত করবে। শহরের প্রধান লোকালয়ে প্রতিষ্ঠিতব্য স্মৃতিসৌধে খচিত বৈশ্বিক বার্তা, “কন্সারভ ইউর মাদার ল্যাংগুয়েজ” সকল ভাষাভাষীকেই নিজ নিজ মাতৃভাষা চর্চা এবং সংরক্ষণে সার্বক্ষণিক তাগিদ জুগিয়ে যাবে। লাইব্রেরীতে প্রতিষ্ঠিতব্য “একুশে কর্নার” সৃষ্ট এই অনুপ্রেরণার সহযোগী আঞ্চলিক প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে। পাশাপাশি ভাষাভাষীরা নিজ নিজ এলাকার লাইব্রেরিস্থ “একুশে কর্নারে”র সুযোগ-সুবিধা গ্রহণের মাধ্যমে সময়-সুযোগ মত নিজ নিজ মাতৃভাষা চর্চা এবং ভাষার বর্ণমালাসহ সংশ্লিষ্ট উপকরনাদি সংরক্ষণ করার প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধা পাবে। সারাবিশ্বে ইউনেস্কোর নেতৃত্বে এই কৌশল বাস্তবায়িত হলে বিশ্বব্যাপী মাতৃভাষা রক্ষার নীরব বিপ্লব সাধিত হবে। বিশ্বায়নের উত্থানের ধারায় গণমুখী প্রচলিত কমন ভাষা ব্যবহারের পাশাপাশি নিজ নিজ ভাষা রক্ষার মানসিক তাগিদ অনুভূত হবে। যার জন্য প্রয়োজন প্রস্তাবিত কৌশলগুলি বাস্তবায়নের জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউনেস্কোর সকল সদস্য রাষ্ট্র কর্তৃক সুনির্দিষ্ট সমন্বিত সাধারণ নীতিমালা প্রণয়ন এবং এই নিতিমালার জন্য প্রয়োজন ইউনেস্কোর সাধারণ সভার সম্মিলিত ঐকমত্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ। ইউনেস্কোর সাধারণ সভার এই প্রয়োজনের বাস্তবতা এবং বস্তুনিষ্ঠটা প্রমান করার গুরুত্বের কথা বিবেচনা করেই সংগঠনের তৃতীয় সাংগঠনিক ভিত্তি হিসেবে “সকল ইউএন সদস্য রাষ্ট্র কর্তৃক মাতৃভাষা সংরক্ষণে সুনির্দিষ্ট সাধারণ এবং সমন্বিত নীতিমালা গ্রহন” এর প্রক্রিয়া এমএলসি মুভমেন্ট ইন্টারন্যাশনাল গ্রহণ করেছে।
পরবর্তী লেখাঃ
একুশের চেতনার বৈশ্বিক প্রাতিষ্ঠানিকতা অর্জন
বাস্তবায়নের রূপরেখা-৩
Nirmal Paul
নির্মল পাল; ইমেইলঃ nirmalpaul@optusnet.com.au; প্রতিষ্ঠাতা এবং চেয়ারপারশনঃ এমএলসি মুভমেন্ট ইনটারন্যাশন্যাল ইনক; প্রাথমিক নকশা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নকারী দলনেতাঃ পৃথিবীর প্রথম “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ”; প্রকাশিত গ্রন্থঃ “বিশ্বায়নে শহীদ মিনার”; বৈশ্বিক দর্শনঃ “লাইব্রেরীতে একুশে কর্নার”, (স্থানীয় বর্ণমালা সংরক্ষণ কেন্দ্র)
Related Articles
Attacks on overseas students in Australia
The recent attacks on overseas students in Australia is a big surprise for everyone. Australia is a multicultural country and
Pakistan’s new President: How did Asif Zardari manage to win?
On 6th September, Asif Ali Zardari,(52), the widower of former Prime Minister Benazir Bhutto, has won a sweeping victory in
Bangladesh Parliamentary Elections on January 5th
On 2nd January, Awami League President and Prime Minister Sheikh Hasina said “We had taken oath as an elected government
Thanks for publishing this important article