ছাত্রলীগে যা ঘটলো

ফজলুল বারী: ছাত্রলীগ নিয়ে তাঁর সময়োপযোগী সাহসী সিদ্ধান্তটির জন্যে প্রিয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা । কোন লেখা কি এভাবে দেশের প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ দিয়ে শুরু করা শোভন? ছাগুদের কাছে বিষয়টি তেল তেল মনে হবেনা? কিন্তু আমার মতে এ লেখাটিতে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ দেয়া যায়। কারন বাংলাদেশের রাজনীতিকরা-শাসকরা সচরাচর এমন সিদ্ধান্ত নেননা। তারা মনে করেন এতে বিরোধীরা মাঠ গরমের ইস্যু পেয়ে যাবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এমন সিদ্ধান্ত অনেক সময় এড়িয়ে যান। প্রধানমন্ত্রীত্বের বাইরে তিনি যখন হয়ে যান একজন মাতা অথবা ভগ্নী। মায়েদের কাছে কখনো সন্তানের কোন দোষ হয়না-থাকেনা। বোনের কাছে ভাইও হয় সন্তানের মতো নিষ্পাপ-আদরের। আওয়ামী লীগ সহ এর অঙ্গ-সংগঠনের নেতাকর্মীরা শেখ হাসিনাকে আপা ডাকেন। প্রিয় আপা-বুবু। সিনিয়ররা ডাকেন সভানেত্রী। শেখ হাসিনার পরিশ্রমের ওপর দাঁড়িয়ে বর্তমান শাসকদলের কত মতলববাজ তাঁর স্নেহের অপব্যবহার করে যে নিজেদের আখের গুছিয়ে নিয়েছেন। এ দলে বেশকিছু সাংবাদিকও আছেন। কিন্তু ছাত্রলীগের নেতৃত্ব নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শনিবারের সিদ্ধান্তটি একজন কঠোর প্রশাসকের। দুর্নীতিবাজদের জন্য ভয়জাগানিয়া। এই ব্যাটিং চালিয়ে কী যেতে পারবেন শেখ হাসিনা? দেখা যাবে। কারন গত নির্বাচনে এটিই ছিল তাঁর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি। বাংলাদেশে ইস্যু ভিত্তিক জনমত জরিপ হয়না। এ ইস্যুতে জরিপ চালালে দেখা যেত শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা আরও বেড়েছে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনীতির সমর্থক হিসাবে আমি আওয়ামী লীগের ক্ষমতায়নের শক্ত সমর্থক এবং সমালোচক। জাতির পিতাকে হত্যার বেনিফেশিয়ারি সামরিক শাসক জিয়া-এরশাদের সংগ্রহ করা দুষ্টগ্রহগণ দেশে রাজনৈতিক জঞ্জাল সৃষ্টি করেছে। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ। জাতির জনকের কন্যা একজন দৃঢ়চেতা সাহসী ব্যক্তিজীবনে দুর্নীতিমুক্ত নেত্রী। দিনে ১৮-২০ ঘন্টা কাজ করেন। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া দলটি যে আজ ধারাবাহিক তৃতীয়দফায় ক্ষমতায় এর কারনও শেখ হাসিনার নেতৃত্ব। অবিশ্বাস্য বাস্তব বাংলাদেশের অগ্রগতির নানা সূচক। দূর্নীতিও হচ্ছে। যেমন ছাত্রলীগ-যুবলীগ এসবের একটাও পরিশ্রমী নেত্রী শেখ হাসিনার বা সংগঠনগুলোর ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্ব করেনা।
সেই ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশের উৎস-বৃত্তান্তের প্রতিটি স্তরের পুরোভাগে ছিল ছাত্রলীগের নেতৃত্ব। কিন্তু আজ গুটিকয় সুবিধাবাদী অসাধু নেতৃত্বের জন্যে এই ছাত্রলীগকে দেশের মানুষ এখন চাঁদাবাজ হিসাবে চেনে জানে। ছাত্রলীগের সিংহভাগ নেতাকর্মী সংগঠনটির নীতি-আদর্শ কর্মসূচি জানেনা। অথবা জানা লাগেনা। সহমতভাই বলতে পারলেই চলে। শাসকদলের ছাতার নিচে থাকায় এর অনেক নেতাকর্মী অবিশ্বাস্য ব্যক্তিজীবন সাজিয়েছেন। অথচ এদের কোন বৈধ আয়সূত্র নেই। একটা ঘটনা বলি। ছাত্রলীগের এক কর্মী অস্ট্রেলিয়ায় পড়তে আসার পর তাকে একটি রেষ্টুরেন্টের কিচেনে জব ম্যানেজ করে দিয়েছি। ছেলেটা ধুমপায়ী। এদেশে আবার সিগারেটের দাম খুব বেশি। চল্লিশ ডলারের বেশি দাম কুড়ি শলাকার প্যাকেটের। প্রথম দিকে দেখা গেলো তার জবের বেতনে সিগারেটের দামও হয়না। দেশে থাকতে কিভাবে চলতো জানতে চাইলে বলে ছাত্রলীগের নামে তারা একটি এলাকায় নিয়মিত চাঁদা তুলতো। মাঝে পুলিশ এই ভূমিকা নিলে তাদের চাঁদা তুলতে সমস্যা হয়। এরপর পুলিশের চাঁদাবাজিতে অস্থির ব্যবসায়ীরা তাদের ডেকে বলে বাবারা চাঁদা তোমরাই নিও, তাও পুলিশের হাত থেকে বাঁচাও আমাদেরকে।
এই সংগঠনের নেতৃত্বে ছিলেন শোভন-রাব্বানী। তাদের চাঁদাবাজির প্রকাশিত অভিযোগের ভিত্তিতে শেষ পর্যন্ত তাদেরকেই ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারন সম্পাদককেও অপসারন করতে হয়েছে। কঠিন এই সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে শেখ হাসিনার ক্রোধ-কান্নার চরম রূপটি কেউ দেখেনি। কারন মায়ের মায়ায়-বোনের স্নেহে এই ছেলে দুটিকে তিনি নিজে পছন্দ করে তুলে এনেছিলেন। পোশাকে চেহারায় কথামালায়ও বেশ কেতাদুরস্ত ছিল দু’জন। সাধারন সম্পাদক রাব্বানী টেলিভিশন চ্যানেলগুলোয় কথা বলার যত সুযোগ পেয়েছেন সাম্প্রতিক সময়ের আর কোন ছাত্রনেতা তা পাননি। অনেক গুনও তার ছিল। কিন্তু সব আজ শূন্য। তাদের মাথায় তোলা শেখ হাসিনা উভয়কে ভূপাতিত করার পর ডাকসুর জিএস পদ থেকে রাব্বানীর, ঢাবি’র সিনেট সদস্যের পদ থেকে শোভনের অপসারনের দাবি উঠেছে। এই কয়েকদিন আগেও তা কী ভাবা গেছে? শোভনের বাবা পরিস্থিতিকে যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, এর মানে দাঁড়ায় তাঁর ছেলে ভালো ছিল। সঙ্গ(রাব্বানী) দোষে পরিস্থিতির শিকার হয়েছে। রাব্বানী সোশ্যাল মিডিয়ায় খুব তৎপর অথবা তার পক্ষে সংঘবদ্ধ তৎপরতাও ছিল। তার নামে বইও প্রকাশ হয়েছে। সহমত ভাই’রা এতো চটজলদি ঘুরে যাবে তা নিশ্চয় রাব্বানীও কখনো ভাবেননি। আদর্শহীন ধান্ধাবাজ সহমত ভাইগং হলে যা হয় আর কি।
তোফায়েল আহমদ-ওবায়দুল কাদের-জাফর ওয়াজেদ থেকে শুরু করে ছাত্রলীগের যতো উজ্জ্বল সময়ের নেতা-কর্মী, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর থেকে আওয়ামী লীগ যতোদিন বিরোধীদলে ছিল, এরশাদ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে নানান নিপীড়ন মোকাবেলা করে সংগঠনকে টিকিয়ে রাখা নেতাকর্মীদের কাছে এই ছাত্রলীগের ইমেজ বেদনার। এই ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের রক্তে সংগ্রাম নেই। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সংগ্রামও এরা দেখেনি। এদের সিংহভাগ কেতাদুরস্ত ভোগবাদী। এরা ছাত্রলীগের ইতিহাস-কর্মসূচির জানেনা। ছাত্রলীগকে ধারন করেনা।
ছাত্রলীগের নেতৃত্ব থেকে মূলধারার রাজনীতিতে আসা শেখ হাসিনাও এটা জানেন। সে কারনে তিনি একবার এই ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদও করেছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা সেই সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারেননি। ছেলেমেয়েদের অথবা ছোট ছোট ভাইবোনদের আকুতিতে ফিরেও এসেছেন। সিন্ডিকেট এড়াতে এবার ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারন সম্পাদক তিনি নিজে পছন্দ করেছিলেন। কিন্তু এই ছাত্রলীগ তাঁর সম্মান-মর্যাদা রাখেনি। চট্টগ্রামে-সিলেটে কে কোথায় কিসের আশায় যাতায়াত করতেন তা শুনতাম। বিশ্বাস করতামনা। চাঁদা-কমিশনের জন্যে এরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও চলে গিয়েছিল! সেখানে গিয়ে তারা বলেছেন শেখ হাসিনা নাকি তাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেখভালের দায়িত্ব দিয়েছেন!
যুগান্তরের রিপোর্ট পড়ে মনে হচ্ছিল শেখ হাসিনার সঙ্গে এমন ব্ল্যাকমেইলিং’এর সাহস এর আগে আর কোন ছাত্রলীগ নেতাও কখনো করেনি। এদের বয়স হয়তো ভাবতে শেখায়নি যে এসব প্রধানমন্ত্রীকে গিয়ে সব বলে দেবেন ভিসি। অথবা শেখ হাসিনার স্নেহধন্য ছাত্রলীগ নেতাগণ নিজেদের ভাবতে চেয়েছেন নেত্রীর কাছে তারা ভিসির চেয়ে বড়! পেশাদার গোয়েন্দা সহ শেখ হাসিনার তথ্য পাবার যে কত সোর্স সেটাও যদি তারা ভাবতো। দল ধারাবাহিক ক্ষমতায় থাকায় তেলতেলে হয়ে ওঠা লোকজনের অবশ্য ধরাকে সরাজ্ঞান করার বাতিক হয়। গণভবনের পাস যখন বাতিল হয়, বোকারা এরপরেও নানা জায়গায় আত্মপক্ষের যুক্তি তুলে ধরছিলেন! এতোদিন সবাই জপমালার মতো জপতেন নেত্রী যা বলেন-বলবেন সেটাই ঠিক। এবার কী হঠাৎ মনে হলো নেত্রীর সিদ্ধান্ত ভুল হে সহমত ভাইগণ। গণরোষ থেকে দলকে বাঁচাতে প্রধানমন্ত্রী সঠিক সিদ্ধান্তটিই নিয়েছেন। এখন কী তিনি দুদককে তাদের কাজ করতে বলবেন? নইলে কিন্তু ফলাফল শূন্য।
এক যুগের বেশি সময় ধরে বিদেশে থাকায় দেশের ছাত্র সংগঠনগুলোর ব্যাপারে মাঝে মাঝে যা কিছু বলি বা লিখি তা অনেকে পছন্দ করেননা। আমি এগুলো এখন বিলুপ্তির পক্ষে। বাংলাদেশের যত ছাত্র বিদেশে পড়তে যান তাদের অনেকে দেশে ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু বিদেশ গিয়ে তারা এসব থেকে দূরেদূরে থাকেন। কারন তাদের এখানে প্রথম দরকার কাজ। সপ্তাহে থাকা-খাওয়ার খরচ বাংলাদেশের টাকায় কুড়ি হাজারের বেশি। বাংলাদেশের দশ-পনের লাখ টাকার বেশি প্রতি সেমিস্টারে টিউশন ফী। এসব স্পটে বছরের পর বছর বাংলাদেশের নানা সংগঠনের পদ-পদবী যারা ধরে রেখেছেন তাদের সবাইকেও কাজের চাপে দৌড়ের ওপর থাকতে হয়। আর বাংলাদেশের বয়স পঞ্চাশ হতে চললেও রাজনীতির নামে বিস্তর লোকজনের জীবনযাপনের আয়সূত্র চাঁদাবাজি! দেশের তরুন-যুবারা তাহলে কি শিখবে?
প্রধানমন্ত্রী শোভন-রাব্বানীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেন, বিএনপির রিজভি ব্রিফিং করলেন, ছাত্রলীগের চাঁদাবাজি আড়াল করতে ছাত্রদলের সম্মেলন স্থগিত করা হয়েছে! কেউ কী কখনো জিজ্ঞেস করেছে রিজভি সাহেব অফিসে শুয়েবসে যে নন্দলালের জীবন নিয়েছেন, আপনার খাবার কী ভূতে যোগায়? আপনার পরিবারের ভরনপোষন আসে কোত্থেকে? ছাত্রলীগের মতো ছাত্রদলেরও এখন কী সাধারন ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে কোন গ্রহনযোগ্যতা আছে? এটি কী ডাকসু নির্বাচনেও টের পাননি। এই সুযোগে আরেকটি চাছাছোলা কথা বলি। ছাত্রলীগ সহ এসব সংগঠনের চাঁদাবাজি এর গঠনতন্ত্রে, নেতৃত্ব নির্বাচনে। ওখানে বলা হচ্ছে এর নেতারা ,কোন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকতে পারবেনা! সারা দুনিয়ায় ছাত্রদের জব মানে পার্ট টাইম জব। সপ্তাহে সর্বোচ্চ কুড়ি ঘন্টা। এর বেশি কাজ করলে তারা পড়াশুনায় মনোযোগ দিতে পারবেনা। ক্লান্তি আসবে। আর আপনারা গঠনতন্ত্রে, নেতা নির্বাচনের নীতিমালায় বলে দিচ্ছেন কাজ করতে পারবেনা! তাহলে কী তারা চাঁদাবাজি করে চলবে? আরেক আজগুবি অমানবিক বিধান ছাত্রনেতা বিবাহিত হতে পারবেনা। তাহলে কী তারা ধর্ষন করবে? আন্ডারগ্রাউন্ড এই সোসাইটিতে ধর্ষন কেনো মহামারী হয়েছে তা কী কেউ খুঁজে দেখেছেন?
বাংলাদেশের গত কয়েক যুগের অভিজ্ঞতা ছাত্রলীগ-ছাত্রদল এসব সংগঠন আর ছাত্রদের ইস্যু ভিত্তিক আন্দোলন করেনা। সাধারন ছাত্রছাত্রীদের এদেরকে ভয় পায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলের আন্দোলন থেকে শুরু করে সর্বশেষ কোটা আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন এবং ডাকসু নির্বাচনে সাধারন ছাত্রছাত্রীদের মনোভাব জানা গেছে। গণরূমের ছেলেরা হলে সিট পাবার আশায় মিছিলে যায়। যেতে বাধ্য হয়। বঙ্গবন্ধুর নীতি আদর্শ ভালোবাসার বদলে যদি অস্ত্র হয় ভয়, এই প্রজন্মের ভবিষ্যত কী। প্রিয় প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ, হাত যখন দিয়েছেন ছাত্রলীগের যুগোপযোগী সংস্কারের উদ্যোগ নিন। বাংলাদেশের জন্ম প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দেয়া সংগঠনকে ঠ্যাঙ্গাড়ে বাহিনী করে রাখলে এ সংগঠন টিকবেনা। ছাত্রনেতাদেরও বৈধ আয়সূত্র থাকতে হবে। ডাকসু ভিপি নুরুর আগে যদি টিউশনির আয়ে চলতে হতো, তার যদি এখন টিউশনি করা লাগেনা তাহলে আয়টা কোথা থেকে আসে তা জানাতে হবে। কারন ডাকসুর জিএস এর মতো ভিপিরও কোন মাসিক বেতন নেই।
Related Articles
Mani Shankar Aiyar’s visit to Dhaka: Does his call to invest in Northeastern states overlook some ground realities?
Former Indian Union Minister and Congress MP Mani Shankar Aiyar came for a four day visit to Dhaka. He was
Trade Investment Cooperation Framework Agreement (TICFA) with the US Bangladesh
Bangladesh seeks trade and investment from the US and other countries. Most economists say that investment up to 34% of
মুজিব ভাই – বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিজীবনের ছায়া
বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উপর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকমের বই লেখা হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে কিন্তু এবিএম