“একুশে’র চেতনার বৈশ্বিক প্রাতিষ্ঠানিকতা অর্জন” মাতৃভাষার বিশ্বপরিবার-এর প্রবর্তন (বিশ্বভাতৃত্ব ও সম্প্রীতির ভিত্তি)

“আমার ভাষা, তোমার ভাষা; বাংলা/(মাতৃ)ভাষা, বাংলা/(মাতৃ)ভাষা”। “মোদের গড়ব, মোদের আশা; ও আমার/(আ-মরি)বাংলা ভাষা”। দ্বিজাতিতত্বের ভিত্তিতে স্বাধীনপ্রাপ্ত পাকিস্তান রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা নির্ধারণ বিষয়ক নীতিমালা প্রণয়নে বাংলা ভাষাকে অন্যতম একটি রাষ্ট্রভাষা হিসেবে অন্তর্ভুক্তকরণের দাবী মেনে না নেয়ার সরকারের অনড় অবস্থানের প্রতিবাদে ১৯৫২ এর একুশে’র অনিবার্য প্রতিবাদী বিক্ষুব্ধ পরিস্থিতির অবতারনা ঘটে। মাতৃভাষাপ্রেমী বাঙালিদের দূর্বার প্রতিবাদ বিক্ষোভ প্রতিরোধে সরকারের নৃশংস রক্তাত্ব দমন ও হত্যার পরিণতি বায়ান্নের উত্তাল একুশকে পরবর্তীতে অমর ‘মহান একুশে’ উন্নীত করে। ‘মহান একুশ’ দ্বিজাতিতত্ব ভিত্তিক রাজনীতির মতভেদ-বিদ্বেষসহ সকল বর্ণ-ধর্মীয় মতভেদের সংকীর্ণ গণ্ডি পেড়িয়ে মাতৃভাষা বাংলা সুরক্ষার এক এবং অভিন্ন আপোষহীন প্রতিশ্রুতির চেতনায় মহান একুশের চেতনার ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। মহান একুশের প্রতিবাদ মিছিলে পুলিশের গুলিতে আত্মত্যাগী ভাষা শহীদদের তাজা রক্তে রঞ্জিত সবুজ চত্বরে নির্মিত শহীদ স্মৃতিস্তম্ভের স্থাপত্য প্রতিকৃত ‘শহীদ মিনার’ বাংলার আনাচে কানাচের প্রতিটি মানুষের কাছে একুশের চেতনার প্রতিবাদী বার্তা পৌঁছে দেয়। মাতৃভাষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা বাঙালির উপলব্ধিতে উজ্জীবিত হয়ে সময়ের সাথে সাথে প্রতিটি মানুষের প্রাত্যহিক ও সামাজিক জীবন ব্যবস্থায় দৃঢ়তর হয়ে উঠে। মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার আদায়ে সংগঠিত বাংলাভাষা আন্দোলন পর্যায়ক্রমে ‘একুশের চেতনার’ উদ্দীপনায় বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের সুতিকাগারে উন্নীত হয়। একুশের চেতনাই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঐক্যবদ্ধ অকুতোভয় আন্দোলনের মুখ্য উদ্দীপনার শক্তি হিসেবে পরিণতি পায়। এককথায় বিশ্বের বুকে ভাষাভিত্তিক স্বাধীন বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের অভ্যুদয় বাংলাভাষা আন্দোলনের দীর্ঘ পরিক্রমার ফসল, একুশের চেতনাই ছিল যার চালিকা শক্তি।
আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউনেস্কো কর্তৃক সর্বসম্মতভাবে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মত ঈর্ষনীয় আন্তর্জাতিক মর্যাদায় অলংকরণ ভাষা(মাতৃভাষা)সুরক্ষায় স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের বস্তুনিষ্ঠ ব্যতিক্রমী কার্যক্রমের বৈশ্বিক স্বীকৃতি। এই উত্তরণের মৌলিক ভিত্তি একুশের চেতনা। বাংলা ভাষা আন্দোলন, তথা মাতৃভাষা রক্ষার আন্দোলন, তথা একুশের চেতনাদীপ্ত বাঙালি জাতির মাতৃভাষা বাংলা রক্ষার আপোষহীন লড়াইয়ে ভাষাভিত্তিক একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা, এবং একুশকে বিশ্বনন্দিত একটি আন্তর্জাতিক দিবস আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করার মত ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত যেকোন ভাষাভাষীর মানুষকে উৎসাহিত করবে, অনুপ্রাণিত করবে নিজ নিজ মাতৃভাষা চর্চা এবং সুরক্ষায়। একুশের চেতনার ক্রমবিকাশ ও বিস্তার, এবং সর্বসাধারণের দৃঢ়সংকল্পে ঐকবদ্ধ হয়ে মাতৃভাষা বাংলা সুরক্ষার বাস্তবতার ইতিহাস বিশ্বমানব সমাজের সকল ভাষাভাষীর প্রাত্যহিক এবং সামাজিক জীবনব্যবস্থায় নিজের মাতৃভাষা রক্ষায় সমান গুরুত্ব পাবে। সকল ভাষাভাষীর প্রজমান্তরে মাতৃভাষার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি বাস্তবতার নিরিখে প্রতিষ্ঠা পাবে। একই বা অভিন্নভাবে নিজ নিজ মাতৃভাষার গুরুত্ব এবং সংস্কৃতি ও কৃষ্টির মর্যাদা সংরক্ষণের বিষয়টি বহুজাতিক সমাজের সকল ভাষাভাষীর কাছে অধিষ্ঠিত হবে। একুশের চেতনায় উজ্জীবিত বিশ্বব্যাপী মাতৃভাষাভিত্তিক সামাজিক এই গণজাগরনের ফলশ্রুতিতে ঝুঁকিপূর্ণ মাতৃভাষা সমূহের সকল ভাষাভাষীরা নিজ নিজ মাতৃভাষা চর্চা এবং সুরক্ষায় নতুনভাবে উদ্দীপনা পাবে। প্রতিষ্ঠিত হবে মাতৃভাষা সংরক্ষন ভিত্তিক বৈশ্বিক সামাজিক আন্দোলন, যার অন্তস্থ ভিত্তি হবে প্রত্যেকের নিজ নিজ মাতৃভাষা চর্চা এবং রক্ষার পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, তথা ভাষা সুরক্ষার ক্ষেত্রে সকলের মধ্যে পারস্পরিক সাহায্য সহানুভূতির পরিবেশ ও অঙ্গীকারের সাধারণ মননশীলতা। সৃষ্টি হবে মাতৃভাষা সংরক্ষণ ভিত্তিক একটি সমন্বিত বহুজাতিক পারিবারিক পরিবেশ। যে পরিবেশে সকল ভাষাভাষীর ক্ষেত্রেই সার্বজনীন বৈশ্বিক সাধারণ আবেদন “Conserve Your Mother Language” সকল রাজনৈতিক ভিন্নমতাদর্শ ভিত্তিক বিরোধ, ধর্মীয় বিশ্বাসী মতান্তর/সংঘাত, জাতিগত বৈষম্য, বর্ণীয় প্রথাগত বিভেদ-বিদ্বেষের দেয়ালকে প্রশমিত করে পরস্পরকে মাতৃভাষাসুত্রে একীভূত করে একই ধারায় নিজ নিজ মাতৃভাষা চর্চায় উৎসাহিত করবে। সকল ভাষাভাষীকে নিজ নিজ মাতৃভাষা রক্ষার একই প্রয়োজনের আলোকে পরস্পরের ভাষা সংস্কৃতিকে জানা এবং বুঝার আগ্রহে সৌহার্দপূর্ণ ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মানসিকতার সৃষ্টি তথা বান্ধবসুলভ সামাজিক পরিবেশ বিনির্মাণে উৎসাহিত করবে। প্রতিটি ভাষা পারস্পরিক যোগাযোগের প্রাথমিক এবং মুখ্য মাধ্যম হিসেবে সকলের মাতৃভাষা চর্চা এবং সুরক্ষার প্রতি সকলেরই পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং আন্তরিকতা বিশ্বব্যাপী মাতৃভাষা রক্ষার সামাজিক সংস্কৃতিতে উন্নীত হবে। বিভিন্ন ভাষাভাষীর পারস্পরিক সহযোগিতায় মাতৃভাষা সমূহের দ্রুত অবক্ষয়ের ভয়াবহ পরিস্থিতির গতি মন্থর হয়ে পর্যায়ক্রমে বিশ্বায়নের ধারার সাথে সংগতি রেখে ঝুঁকিপূর্ণ ভাষাসমূহের সহনশীল চর্চার পরিবেশ সুনিশ্চিত করা সম্ভব হবে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনকে সামনে রেখে Conserve Your Mother Language বৈশ্বিক বার্তার আলোকে বিশ্বের প্রতিটি ভাষাভাষী নিজ নিজ সময় সুযোগমত এলএলসি মুভমেন্টের সমন্বিত-সামগ্রিক কৌশলী পরিকল্পনানুযায়ী মাতৃভাষা চর্চায় উৎসাহিত হবে। যে বার্তা বিশ্বের সকল ভাষাভাষীর কাছে অনুরণিত হয়ে বাস্তবায়িত হবে মাতৃভাষা চর্চা এবং সুরক্ষার বিবর্তিত নতুন বৈশ্বিক ধারা। মাতৃভাষা বাংলা রক্ষার আন্দোলনের আবেগে সৃষ্ট মহান একুশের চেতনার বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠাই হবে সেই ধারার মুখ্য চালিকা শক্তি। বাঙালির বাংলাভাষা আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে সৃষ্ট মহান একুশের চেতনা, সকল ভাষাভাষীর ক্ষেত্রেই নিজ নিজ মাতৃভাষা রক্ষার একক ও অভিন্ন চেতনা হিসেবে বিশ্বে প্রতিষ্ঠা পাবে। মাতৃভাষা রক্ষায় সকল ভাষাভাষী হবে উজ্জীবিত, মাতৃভাষা বাংলা হবে সকল ভাষাভাষীর কাছে সম্মানিত, বাঙালি হবে গর্বিত।


Nirmal Paul
নির্মল পাল; ইমেইলঃ nirmalpaul@optusnet.com.au; প্রতিষ্ঠাতা এবং চেয়ারপারশনঃ এমএলসি মুভমেন্ট ইনটারন্যাশন্যাল ইনক; প্রাথমিক নকশা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নকারী দলনেতাঃ পৃথিবীর প্রথম “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ”; প্রকাশিত গ্রন্থঃ “বিশ্বায়নে শহীদ মিনার”; বৈশ্বিক দর্শনঃ “লাইব্রেরীতে একুশে কর্নার”, (স্থানীয় বর্ণমালা সংরক্ষণ কেন্দ্র)
Related Articles
Malaysian Prime Minister’s visit to Bangladesh: A sign of strengthening partnership
Prime Minister of Malaysia Datuk Seri Najib Razak began his three-day trip to Bangladesh from November 17th to further enhance
Canberra Eid-ul-Fitr on Sunday 25th June 2017
Canberra Eid-ul-Fitr has been announced by the Imams Council of the ACT for Sunday 25th June 2017AD, 1438H, IA, completing
রোহিঙ্গা শরণার্থী ইস্যুতে প্রতিক্রিয়া প্রকাশে বুদ্ধিমান হোন
ফজলুল বারী: শেষ দফার প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াতেও কোন রোহিঙ্গা শরণার্থী তাদের দেশে ফেরত যায়নি। অথবা ফেরত যেতে তাদের রাজি করানো যায়নি।