বাজলো তোমার আলোর বেনু
“বাজলো তোমার আলোর বেনু , মাতলো রে ভুবন
আজ প্রভাতে, সে সুর শুনে, খুলে দিনু মন
বাজলো বাজলো বাজলো তোমার আলোর বেনু।“
বছর ঘুরে আবার শুরু হয়েছে বাঙালির সার্বজনীন উৎসব, বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা | দুর্গা পূজা মানেই দূর্গা পূজার মর্মবাণী মন ও মননে ধারণ করে নতুন অঙ্গীকারে সামনের দিকে এগিয়ে চলা। দুর্গা পূজা মানেই মহামিলনোৎসব , কয়েকটা দিন সবাই মিলে খাওয়া দাওয়া , আনন্দ আর হৈ হুল্লোড় । পূজার কথা মনে হতেই কানে যেন সবসময় বাজছে ঢাক ঢোল আর কাসর ঘন্টার শব্দ। সাথে ধুপ ধুনোর গন্ধ আর মঙ্গল শংখধ্বনি , সব মনে করে মন হয়ে যায় উচাটন যখন তখন । মা আসবেন এই আনন্দে সবাই মাতোয়ারা, আমরাও আছি সেই দলে । ঢাক ঢোলের শব্দ আর ধুপ ধুনোর গন্ধের কথা মনে করে মুহূর্তেই মন চলে যায় প্রিয় জন্মভূমিতে। মনের জানালায় উঁকি দিয়ে যায় ছোটবেলায় দুর্গাপূজায় কাটানো নানান সব স্মৃতি গুলো।
মনে পড়ে , ছোটবেলায় প্রতিবছর বাবা মায়ের সাথে আমরা সব ভাই বোনেরা মিলে ঢাকার ঢাকেশ্বরী মন্দিরে যেতাম পুজো দেখতে। পাড়ার পুজো তো থাকতোই। চারিদিকে ঢাক ঢোলের শব্দ আর উলুধ্বনিতে মন প্রাণ উৎসবের আনন্দে ভরে থাকতো । সাথে পুজোর খিচুড়ি আর লাবরার স্বাদ যেন এখনো জিভে লেগে রয়েছে। প্রতিবছর বিজয়া দশমীতে আমার শিক্ষা গুরু সরকার মেসো আর মায়া মাসিমার বাড়িতে নেমন্তন্ন থাকতো।আহা কত পদের মজার সব খাবার!!
আরো মনে পড়ছে ভারতেশ্বরী হোমস-এ দুর্গাপূজার সময় আনন্দে কাটানো মুহূর্তগুলোকে।সুবাদে একবছর ভারতেশ্বরী হোমস-এ কেটেছে । তখন আমি অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী | ভারতেশ্বরী হোমস এ কি আনন্দ আর ঘটা করে যে পূজা পালন করেছি তা কখনো ভুলবার নয়। ভারতেশ্বরী হোমস এর দুর্গা পূজার আয়োজন শুরু হতো প্রায় একমাস আগে থেকে । ছাত্রীরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকতো এই ক’দিনের জন্য। মহাষষ্ঠীতে সন্ধ্যায় মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে আর আগমনী গান ‘জাগো তুমি জাগো জাগো দুর্গা’ গেয়ে উন্মোচন মায়ের হতো মায়ের প্রতিমা। তারপর শুরু হতো মঙ্গল আরতি। অপূর্ব নৃত্য ভঙ্গিমায় ছাত্রীরা প্রণাম জানাতো মা’কে। সপ্তমী, অষ্টমী , নবমী প্রতিদিনই অনেক আড়ম্বরের মাঝে সম্পূর্ণ হতো মায়ের পুজো। দেশ বিদেশের অনেক দর্শনার্থী ভিড় জমাতো কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট-এর এই পুজো পরিদর্শনের জন্য। হোমস-এ পুজো মানেই বাদল দা’র নির্দেশে হবে গীতি নৃত্য নাট্য । তখন হোমস-এ পুজোর অনুষ্ঠানের জন্য আমাদের গান শেখাতে আসতেন সংগীতজ্ঞ মৃন্ময়ী দাসগুপ্ত স্যার আর পরে যোগ দিয়েছিলেন সংগীতজ্ঞ জগদানন্দ বড়ুয়া ( আমার দাদু )। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মহড়ার সেই দিনগুলি কেন যে শেষ হয়ে গেলো!! গীতি নৃত্যনাট্যের সেকি চমৎকার নির্দেশনা !! এখনো চোখে ভাসছে অরুণা বিশ্বাস তখন শিবের ভূমিকায় আর মালা পার্বতীর ভূমিকায়। সত্যিই যেন শিব কৈলাশ পর্বত থেকে নেচে নেচে নামছেন।!! কি অসাধারণ মঞ্চ এবং আলোকসজ্জা, আর কি দারুন পরিবেশনা!! ভাবলেই আমি বার বার শিহরিত হই । চিন্তাই করা যায়না এসব ছিল স্কুল পড়ুয়া মেয়েদের পরিবেশনা !! এতো সুন্দর এবং দক্ষ পরিবেশনা দেখে বার বার মনে হয়েছে এরা বড় হয়ে এসব ক্ষেত্রে নিশ্চই অনেক নাম করবে। উল্লেখ্য ,পরবর্তীতে এই শিল্পীদের অনেকেই জাতীয় পর্যায়ে বেশ খ্যাতি অর্জন করেছেন।
এই দূর প্রবাসে থেকেও দুর্গাপূজা পালনের আনন্দ থেকে আমরা খুব একটা বঞ্চিত নই । পুজোর সময় সপ্তাহান্তে ছুটির দিনগুলিতে ঘটা করে দুদিন ব্যাপী চলে এই উৎসব। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সেই আনন্দে সবাই যোগ দেই , সবার সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেই । পূজা উৎসব রূপ নেয় এক মহামিলন মেলায়।
দেবী দুর্গা সুরক্ষাদায়িনী, অপশক্তি বিনাশিনী ও মুক্তিদায়িনী। আনন্দময়ী দুর্গা দেবী আমাদের মাঝে বিরাজ করেন মাতৃরূপে। । দুর্গাকে বলা হয়েছে সৃষ্টির প্রতীক, সমৃদ্ধির প্রতীক, সুরক্ষার প্রতীক। দুর্গা নামের মধ্যেও রয়েছে তাৎপর্য। ‘দ’ অক্ষর দৈত্যনাশক, উ-কার বিঘ্ননাশক, ‘রেফ’ রোগনাশক, ‘গ’ অক্ষর পাপনাশক ও অ-কার ভয়-শত্রুনাশক। অর্থাৎ, দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও ভয়-শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন, তিনিই দুর্গা।
দেবী দুর্গা হলেন শক্তির রূপ, তিনি পরব্রহ্ম। হিন্দু ধর্মশাস্ত্র অনুসারে দেবী দুর্গা ‘দূর্গতিনাশিনী’ বা সকল দুঃখ দুর্দশার বিনাশকারিনী। পুরাকালে অসুরদের অত্যাচারে পৃথিবী যখন অতিষ্ট, দেবতারা যখন স্বর্গ থেকে বিতাড়িত, তখন অসহায় দেবতারা ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের স্মরণাপন্ন হন। এই ত্রিশক্তির সম্মিলিত তেজে এক নারী শক্তির উৎভব হয়, তিনি ই দুর্গা| তৎকালীন সমাজের অনাচার দুরকরতে অত্যাচারী মহিষাসুর ও তার দলবলকে ধ্বংস করে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতেই ত্রিশক্তি দূর্গা দেবীর আত্মপ্রকাশ। দিব্য অস্ত্রে সজ্জিত আদ্যাশক্তি মহামায়া অসুর কুলকে একে একে বিনাশ করে স্বর্গ তথা বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে শান্তি স্থাপন করেন।
অশুভ শক্তির বিনাশ, ঐক্য ও মহামিলনের প্রতীক দূর্গোৎসব । দূর্গা পূজার মূলমন্ত্র হচ্ছে, হিংসা লোভ ক্রোধরূপী অসুরের বিনাশ ঘটিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। আজকের পৃথিবী এক অস্থির সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।এই অস্থির পৃথিবীতে নিজেদের মাঝে হানাহানি ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে প্রয়োজন ঐক্যের । ঐক্যবদ্ধ সম্মিলিত চেষ্টাই হচ্ছে এই পুজার অনন্য সারমর্ম। মানুষ হিসেবে আমাদের কর্তব্য- হিংসা-বিদ্বেষ পরিহার করে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং অন্যায় অবিচার প্রতিরোধে ব্রতী হয়ে দেশ, সমাজ ও মানুষের কল্যাণে যার যার অবস্থান থেকে কাজ করে যাওয়া। মহামিলনের উৎসবে আমাদের সবার অঙ্গীকার হোক: মহা শান্তির জন্য, মহা প্রেমের জন্য। অশুভ শক্তি দূরে সরে গিয়ে আনন্দঘন উৎসবে মুখর মুখরিত হোক শারদীয় দিনগুলো এবং আগামী । অনন্তকাল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং ধর্মীয় উৎসবের বৈচিত্র্য অটুট থাকুক আমাদের মাঝে।
“হে দেবী সর্বমঙ্গলা, শিবা, সকল কার্য সাধিকা, শরণযোগ্য, গৌরি ত্রিনয়ণী, নারায়নী তোমাকে নমস্কার।“
Related Articles
Excellence in dancing – Arpita Shome Choudhury
Dance, the supreme art form which skillfully embodies the three primary ingredients- BHAVAM, RAGAM and THALAM fascinated her right from
Prime Minister Sheikh Hasina’s visit to India: Momentous Occasion
Majority of people in South Asia looks at India, the larger and resourceful neighbour with admiration and apprehension. Admiration is