খালেদা বিহীন নির্বাচন খালেদা জিয়ার ভবিষ্যত
ফজলুল বারী: রোববার সুপ্রিমকোর্টের সিদ্ধান্তের পর জানা হয়ে গেলো একাদশ জাতীয় নির্বাচন হচ্ছে খালেদা জিয়ার অংশগ্রহন ছাড়াই। তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যতও এখন সংকটের সম্মুখিন। কারন দুর্নীতির দন্ড নিয়ে কারাগারে থাকায় বয়োঃবৃদ্ধা খালেদার শরীরে বাসা বেঁধেছে বার্ধ্যকের নানা ব্যাধি। এখন এসব আরও বাড়বে। কারন যে কারও মন ভালো থাকার সঙ্গে শরীর ভালো থাকা না থাকা নির্ভরশীল। বিলাসবহুল জীবনে অভ্যস্ত খালেদা জিয়ার শরীর-মন জেলখানায় ভালো থাকবে এমন চিন্তা অবান্তর। এ লেখায় খালেদার রাজনৈতিক ভবিষ্যতের ব্যবচ্ছেদের চেষ্টা করা হবে।
সামরিক জেনারেল স্বামীর সামরিক অভ্যুত্থানে মৃত্যুর পর গৃহবধু থেকে রাজনীতিতে অভিষেক হয় খালেদা জিয়ার। এরপর ১৯৯১ সাল থেকে মাঝে একমাত্র ২০১৪ সালের নির্বাচন ছাড়া সবগুলো জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন। এবারে তার নামে তিনটি আসনে মনোনয়ন জমা হলেও আগের নির্বাচনগুলোতে তিনি পাঁচটি করে নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয়ী হয়েছেন। মাঝে ১৯৯৬ এবং ২০০৮ সালের আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় ফেরার নির্বাচনে তার নেতৃ্ত্বাধীন দলের পরাজয় হয়। প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেত্রী হিসাবে রানীর মতো ভূমিকা পালন করে গেলেও জাতীয় সংসদের বিরোধীদলের নেত্রী ভূমিকায় তার ভূমিকা মোটেই উজ্জ্বল ছিলোনা। নিয়মিত বেতন ভাতা নিলেও ধারাবাহিক সংসদ বর্জনের মাধ্যমে নানান অজুহাতে বিরোধীদলের নেত্রীর ভূমিকা তিনি যথাযথ পালন করেননি। ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় এসে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের যারা বিচার করতে চেয়েছে তাদের তিনি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বানান। তার মুক্তিযোদ্ধা স্বামী স্বাধীনতা বিরোধী মুসলিম লীগারদের ক্ষমতায়ন করলেও জামায়াতকে রাজনৈতিক সুবিধা দেননি। জামায়াতের ক্ষমতায়ন হয়েছে খালেদা জিয়ার হাতে। বিএনপির মুক্তিযোদ্ধা সদস্যদের জন্যে যা খুব স্বাভাবিক অস্বস্তিকর।
শুধু জামায়াতকে সুবিধা গিয়ে খালেদা জিয়ার একাত্তরের জীবনও বারবার সামনে চলে আসে। যদিও রাজনীতির রিপোর্টার হিসাবে জানি এরশাদের জাতীয় পার্টিকে নিয়ে চারদলীয় জোট গঠনের শুরুতে পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থন হারানোর ভয়ে খালেদা জিয়া জামায়াতকে জোটে নিতে চাননি। তখন জাতীয় পার্টির নেতা কাজী জাফরের অনুরোধে তিনি এতে রাজি হন। সেই জাতীয় পার্টির মূলধারা পরে খালেদার সঙ্গে থাকেনি। কিন্তু জামায়াত হয়ে ওঠে বিএনপির স্থায়ী মিত্র। এর যুদ্ধাপরাধী নেতাদের ফাঁসির পরেও খালেদা জিয়া কোন আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া দেননি। কিন্তু এখন দলটির নিবন্ধন না থাকলেও তাদের অস্তিত্ব রক্ষায় বিএনপির নির্বাচনী প্রতীক ধানের শীষ ঠিকই তাদের হাতে দেয়া হয়েছে।
২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে ব্যবসায়ী ভাই-ছেলেদের সুবিধা দিতে গিয়ে একটি বেপরোয়া ভাব খালেদা জিয়াকে পেয়ে বসে। হাওয়া ভবন কেন্দ্রিক প্যারালাল শাসন, দুর্নীতির ভরকেন্দ্র জনপ্রিয় দল এবং এর নেত্রীর ভাবমূর্তিতে কালিমার ছাপ পড়ে। কারন ছোট দেশে কোনকিছুই লুকোছাপা থাকেনা। যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামি, আলী আহসান মুজাহিদকে মন্ত্রিসভায় নিয়ে গিয়ে তাদের হাতে জাতীয় পতাকা তুলে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী হিসাবে তিনি যে সমালোচনার মুখে পড়েন, আজ পর্যন্ত তার দলের কাছে এর যুৎসই জবাব নেই। পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থাকে খুশি করতে গিয়ে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জন্যে আনা দশ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালানে সহায়তা করতে গিয়ে তার সরকার হারায় ভারত এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন ও আস্থা হারায়। সে সমর্থন আর ফেরেনি।
প্রকাশ্য জনসভায় গ্রেনেড হামলা চালিয়ে তৎকালীন বিরোধীদলের নেত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টা এবং পরে এ ঘটনা ধামাচাপা দিতে গিয়ে জাতীয় আন্তর্জাতিক মহলে বিএনপির বিশ্বাসযোগ্যতা আরও প্রশ্নের মুখে পড়ে। এরপর নিজেদের মতো করে একটি নির্বাচন করার চেষ্টায় নিজস্ব রাষ্ট্রপতি ইয়াজুদ্দিনের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করে পুরো ব্যবস্থাটিই প্রশ্নের মুখে পড়ে। বাংলাদেশে যখন যে সেনাবাহিনী প্রধান নিয়োগ করে তাদের পছন্দের ব্যক্তিকেই করে। খালেদা জিয়ার পছন্দের সেনা প্রধান জেনারেল মইনুদ্দিনরা যখন ক্ষমতা নেবার পর খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে যে সব মামলা হয় এর দুটি মামলাকে কেন্দ্র করেই খালেদা জিয়া এখন কারাবন্দী। তখন ভাঙ্গা মেরুদন্ডের চিকিৎসার জন্যে আর রাজনীতিতে না ফেরার মুচলেকা দিয়ে সেই যে তার বড় ছেলে তারেক দেশ ছেড়েছিলেন, আর দেশে ফেরা তার আর হয়নি। বিলাতে রাজনৈতিক আশ্রয় নিতে গিয়ে এর শ র্ত হিসাবে তারেক এরমাঝে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ও পাসপোর্ট ত্যাগ করেছেন। স্কাইপে-ভাইবার-হোয়াটআপ এসবে পারিবারিক নেতৃত্বের দখল ধরে রেখেছেন তারেক। এই নির্বাচনে শুধু খালেদা-তারেক না, পরিবারটির কোন সদস্যেরও অংশগ্রহন নেই।
ফৌজদারী মামলায় ২ বছরের বেশি সময়ের কারাদন্ডে দন্ডিত হিসাবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার যোগ্যতা হারিয়েছেন খালেদা জিয়া। বাংলাদেশে এর আগে একই দন্ড ভোগ করে জেনারেল এরশাদ পাঁচবছর কোন নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি। খালেদা জিয়ার একই পরিনতি দেখে এরশাদ নিশ্চয় মুচকি হাসছেন। কারন খালেদার জোট ছাড়ার কারনে এরশাদের সেই দন্ডের ব্যবস্থায় তখন সক্রিয় ছিল বিএনপি সরকারের আইন কর্তৃপক্ষ।
এতিমখানা দুর্নীতি মামলা-জিয়া চ্যারিটেবল দুর্নীতি মামলার অভিযোগপত্রের প্রমানাদি শক্ত থাকায় খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা এসব মামলা নিয়ে শুরু থেকেই ধীরে চলো নীতি নেন। বিদেশ থেকে টাকা এসেছে প্রধানমন্ত্রীর ত্রান তহবিলে। আর সে টাকা স্থানান্তর করা হয় জিয়ার নামে এতিমখানার একাউন্টে। কিন্তু এতিমখানা আর প্রতিষ্ঠা হয়নি। এসব বিএনপির ১৯৯১-১৯৯৬ মেয়াদের ঘটনা। আজ ২০১৮ সাল। এতিমের নামে আনা টাকায় আজ পর্যন্ত এতিমখানা কেনো হয়নি সে প্রশ্নের কোন জবাব মামলা হবার আগে কোনদিন খালেদা জিয়া দেননি। মামলা হবার পর তার জোড়াতালির বক্তব্য গ্রহন করেনি আদালত। মামলার ব্যাংক একাউন্টের কাগজপত্র, সাক্ষ্য এসব শক্ত থাকায় দলটির চতুর আইনজীবীরা নানা কায়দায় এসব মামলার বিচার বিলম্বিত করেছেন। হয়তো ভাবা হয়েছে এভাবে সময় কাটাতে কাটাতে সরকার পরিবর্তন হয়ে যাবে। কিন্তু সব কৌশল গুঁড়েবালি হয়েছে।
সাজা হবার পর বিএনপির পক্ষে বলা শুরু হয়েছে যেখানে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে পাচার হয়েছে সেখানে এসব মামলা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার। যারা এসব বলেন তারাও জানেন দুর্নীতির মামলার বিচার হয় প্রমানপত্রের ভিত্তিতে। হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি প্রমান করা কঠিন। এরশাদের পতনের পর তার বিদেশে হাজার হাজার কোটি টাকার পাঠানোর রিপোর্ট হয়েছে। এসবের কোন টাকা ফেরত আসেনি। ২০০১-২০০৭ মেয়াদে বিএনপির তারেক-কোকো-গিয়াস উদ্দিন আল মামুন-হারিছ চৌধুরী-ফালু সহ নানাজনের নামে হাজার হাজার কোটি টাকার পাচারের নানা রিপোর্ট প্রকাশ পেলেও সিঙ্গাপুরের একটি ব্যাংকে থাকা সামান্য কিছু টাকা দেশে ফেরত এসেছে। এই টাকাগুলোর সন্ধানও বাংলাদেশ সরকার পায়নি। মার্কিন এক আদালতে দায়ের হওয়া মামলার সূত্রে টাকাগুলো ফেরত পেয়েছে বাংলাদেশ।
দিনের শেষের সত্য হচ্ছে খালেদা জিয়া নির্বাচন করতে পারছেননা। ২০১৪ সালের নির্বাচন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বর্জন করা হয়। তখনও বিএনপির পক্ষে ভাবা হয় শেখ হাসিনার সরকার টিকবেনা। কাজেই শেষ হতে পারবেনা খালেদা জিয়ার মামলার বিচার। কিন্তু শেখ হাসিনার সরকার ধারাবাহিক দ্বিতীয় দফার মেয়াদ পূর্ণ করেছে এবং শেষ হয়েছে খালেদার বিরুদ্ধে দুটি-তারেক রহমানের বিরুদ্ধে তিনটি মামলার বিচার। এতিমখানা দুর্নীতি মামলায় হাইকোর্টে গিয়েও খালেদা জিয়া হেরেছেন। সেখানে তার পাঁচবছরের সাজা বেড়ে সাত বছর হয়েছে। এ অবস্থায় খালেদা বিহীন নির্বাচনে বিএনপির লাভক্ষতি নিয়ে এখন বিষদ আলোচনা-গবেষনা হবে। এসব আলোচনা-গবেষনা নির্বাচনের আগে একভাবে নির্বাচনের পর অন্যভাবে হবে। আমার ধারনা খালেদা নির্বাচন করতে না পারা বিএনপির জন্যে ইতিবাচক-নেতিবাচক দুটিই হতে পারে। ইতিবাচক হবার সুযোগ বেশি। কারন বাংলাদেশের জনমানস এমন হাটে-ঘাটে একটা ছিচকে চোর ধরতে পারলে তাকে পিটিয়ে বীরত্ব দেখায়। কিন্তু সেলিব্রেটির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের ব্যাপারে উল্টো উফআহ করে! যে কারনে এরশাদের মতো একজন দুর্নীতিবাজও গণআন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত-বন্দী থাকা অবস্থায় পরপর পাঁচটি আসনে বিজয়ী হয়েছেন। খালেদার সাজা-নির্বাচন করতে না পারা প্রতিপক্ষের ভোটের প্রচারে গুরুত্ব পাবে।
Related Articles
মুক্তিযুদ্ধে নতুন প্রজ্ম্ম: ন্যায় প্রতিষ্ঠার এক অবিরাম সংগ্রাম
পহেলা মার্চ। দিনটি আমার জীবনে অবিস্মরনীয় হয়ে আছে। আজ থেকে ৪২ বছর আগে এই দিনে একবুক স্বপ্ন নিয়ে আমি আমার
যত খুশি তত খান, তারই নাম মেজবান
মেজবান কিংবা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় “মেজ্জান”, চট্টগ্রামের অতিথি আপ্যায়নের বহুদিনের লালিত একটি ধারা। চট্টগ্রামবাসীদের কাছে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ খাবারগুলোর মধ্যে অন্যতম
দৌড়া, বাঘ আইলো!
১. বাংলাদেশ তখনও ওয়ানডে স্ট্যাটাসই পায় নি। চার বছর পরপর অনিয়মিতভাবে কখনো সখনো এশিয়া কাপ খেলার সুযোগ পায়। যাকে বলে
Wow wonderful explanation ????????????????