যতীন্দ্রমোহন বাগচী এবং আমি
একটি কবিতা। কিছু আবেগী শব্দের সংকলন মাত্র। কতটা শক্তিশালী হতে পারে মনের জন্যে, ভাবনার জন্যে – আবেগ অনুভূতির জন্যে – তা যতীন্দ্রমোহন বাগচী’র একটি কবিতা পড়ার আগে কখনো জানা ছিল না। সৌভাগ্য বসত যতীন্দ্রমোহন বাগচী’র “কাজলা দিদি” কবিতাটি ছিল আমাদের পাঠ্য পুস্তকে। এতো বছর পর, আজও – এই কবিতা, এই কবিতার ভাব আমাকে তাড়া করে ফিরে। ব্যথিত করে – উদাস করে – চোখ ঝাপসা করে দেয়।
আমার কখনো কোনো কাজলা দিদি ছিল না – এমন বললে হয়ত বেশ বড় ভুল হবার সম্ভাবনা আছে। বাস্তবে স্বশরীরে হয়ত ছিল না কেউ, কাজলা দিদি’র মতো – তবে আমার অবচেতন মনে একজন কাজলা দিদি’র বসবাস সব সময়ই ছিল এবং তাঁর উপস্থিতি টের পাওয়ার মতোই ছিল। কিছু অনন্য সুন্দর মানুষ – নিজে থেকেই আমার কাছে কাজলা দিদি হয়ে উঠেছেন, উঠেন। যখন তখন হারানোর ভয় হয় – মন ভারী হয়ে উঠে – মাগো আমার শোলক বলা “কাজলা দিদি” কই, বলতে হবে ভেবে!
পাঠ্য পুস্তকের কবিতা ছিল বলে – মুখস্থ করতেও হয়েছিল। তবে কোন শ্রেণীর পাঠ্য পুস্তকে ছিল এখন আর মনে নেই। যেই শ্রেণীতেই থাকুক কবিতাটির বেশ গুরুত্ব ছিল সব সময়। কোনো না কোনো প্রশ্ন থাকতো এই কবিতাটিকে ঘিরে। কবিতাটি পড়ে, শুনে বা মনে করে চোঁখ ঝাপসা হয়নি এমন সময় খুব কমই এসেছে আমার জীবনে।
কাজলা দিদি
– যতীন্দ্রমোহন বাগচী
বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই,
মাগো আমার শোলক-বলা কাজলা দিদি কই?
পুকুর ধারে লেবুর তলে
থোকায় থোকায় জোনাক জ্বলে
ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না একলা জেগে রই-
মাগো আমার কোলের কাছে কাজলা দিদি কই?
সেদিন হতে কেন মা আর দিদিরে না ডাকো;
দিদির কথায় আঁচল দিয়ে মুখটি কেন ঢাকো?
খাবার খেতে আসি যখন,
দিদি বলে ডাকি তখন,
ওঘর থেকে কেন মা আর দিদি আসে নাকো?
আমি ডাকি তুমি কেন চুপটি করে থাকো?
বল মা দিদি কোথায় গেছে, আসবে আবার কবে?
কাল যে আমার নতুন ঘরে পুতুল-বিয়ে হবে!
দিদির মত ফাঁকি দিয়ে,
আমিও যদি লুকাই গিয়ে
তুমি তখন একলা ঘরে কেমন করে রবে,
আমিও নাই-দিদিও নাই- কেমন মজা হবে।
ভুঁই চাপাতে ভরে গেছে শিউলি গাছের তল,
মাড়াস্ নে মা পুকুর থেকে আনবি যখন জল।
ডালিম গাছের ফাঁকে ফাঁকে
বুলবুলিটি লুকিয়ে থাকে,
উড়িয়ে তুমি দিও না মা, ছিঁড়তে গিয়ে ফল,
দিদি এসে শুনবে যখন, বলবি কি মা বল!
বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই-
এমন সময় মাগো আমার কাজলা দিদি কই?
লেবুর ধারে পুকুর পাড়ে
ঝিঁঝিঁ ডাকে ঝোপে ঝাড়ে’
ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না, তাইতে জেগে রই
রাত্রি হলো মাগো আমার কাজলা দিদি কই?
এমন নিখাত মায়া, ভালোবাসা ভরা কবিতা এখন খুব একটা আর দেখা যায় না। যদিও এই কবিতাটিই আমাকে আমার জীবনের প্রথম “মানসিক আঘাত” (trauma) টি দিয়েছিলো।
এখনো, এই বয়সেও এই কবিতা আমার চোঁখ ঝাপসা করে দেয়। আপ্লুত হই আবেগে, নস্টালজিয়ায়।
যতীন্দ্রমোহন লেখক খ্যাতির পাশাপাশি, অনেক ব্যক্তিগত জীবনের দুঃখ সঙ্গে করে চলতে হয়েছে। সইতে হয়েছে তাঁর তিন কন্যাসন্তানের অকাল মৃত্যু এবং স্ত্রী ভাবিনী দেবীর মৃত্যু। এক শোক থেকে বের হতে না হতেই তিঁনি পড়েছেন অন্য শোকে। সম্ভবত এই ধরণের ঘটনাগুলিই তাঁকে হৃদয়স্পর্শী বেশ কিছু উল্লেখ যোগ্য কবিতা রচনায় উদ্বুদ্ধ করেছে। তাঁর কন্যা ইলার অকাল মৃত্যুর পরই শোকার্ত হয়ে তিনি লিখেছিলেন ‘কাজলা দিদি’ কবিতাটি।
যতীন্দ্রমোহন বাগচী। জন্মস্থান, জমশেরপুর, নদীয়া। তাঁর পৈতৃক নিবাস বলাগড় গ্রাম, হুগলী। জন্ম ২৭ নভেম্বর, ১৮৭৮ সালে, ১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮ সালে দেহত্যাগ করেন।
যতীন্দ্রমোহন বাগচী ছিলেন গ্রাম প্রিয় মানুষ। গ্রামের প্রতি ভীষণ টান ছিল তাঁর। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও কবি জীবনানন্দ দাশের মত তাঁর কবিতা গুলিও কাব্যবস্তু নিসর্গ-সৌন্দর্যে ছিল চিত্ররূপময়। গ্রাম বাঙলার শ্যামল স্নিগ্ধ রূপ উন্মোচনে তাঁর প্রয়াস ছিল বেশ প্রশংসা পাবার মত। গ্রাম জীবনের অতি সাধারণ বিষয় ও সুখ-দুঃখ তিনি সহজ সরল ভাষায় সহৃদয়তার সংগে তাৎপর্যমণ্ডিত করে প্রকাশ করেছেন তাঁর গ্রাম বিষয়ক লেখনীতে।
Related Articles
সিডনির তুলি ভাবীর বাড়ির ঈদ
ফজলুল বারী: সিডনিবাসী শতাধিক প্রিয় প্রজন্মের জন্যে এবারও ঈদের খাবার রান্না করেছিলেন আলোচিত তুলি ভাবী। অস্ট্রেলিয়ায় পড়াশুনা করতে আসা এসব
অস্ট্রেলিয়ায় নতুন রাজনৈতিক দল ‘অস্ট্রেলিয়ান মুসলিম পার্টি’
অস্ট্রেলিয়ায় আগামী জাতীয় নির্বাচনে মুসলিমদের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য প্রথমবারের মতো একটি নতুন রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করেছে। দলটি আগামী জাতীয় নির্বাচনে
বোহেমিয়ান মন
বন্ধুর অনুরোধ ভ্রমণ বিষয়ক একটা লেখা যেন লিখি বন্ধুদের ম্যাগাজিনের জন্য! ভ্রমণ বিষয়ক লেখা কিন্তু আমিতো মুজতবা আলী নই আবার
I believe this article touches many of us, it reminds me of my childhood and my mother, who used to recite us this and other poems over and over during our bed time. Did not know that the poet wrote this one after death of his daughter Ila. Thanks Shahadat Manik for revealing the sad background of creation of Kajla Didi.