প্রবাসীর ঈদ,পরান পোড়া ও শাস্তি

প্রবাসীদের সম্পর্কে অনেকের ভাবনা এমন হতে পারে যে এরা কতো পদ রান্না করে !! কত জায়গায় ঘুরে বেড়ায় !! কত জায়গায় দাওয়াত খায় ,! ! কতো মানুষকে দাওয়াত দেয় ,আবার সেগুলোর ছবি তুলে ফেসবুকে সবাইকে দেখায় ,আছে তো বেশ ! ! ! কিন্তু এই বেশের পেছনে যে সত্যিটা লুকানো সেটা হল ,ঘর আর বাইরের সব কাজের হিসাব এক মাথা আর দুই হাতে প্রবাসীরা করে । শূন্যতা ভুলাতে বা ভুলতে এই মানুষগুলো কতো রকম রং -তামাসা আড্ডাবাজীর চেষ্টা করে! ! তবে ঈদের দিনের শেষে ,শুরুতে ,মাঝখানে যেকোনো সময় ই তাদের সঙ্গী থাকে আপনজনদের সাথে না থাকার দীর্ঘশ্বাস ।।
প্রবাসীরাও মনে করে হ্যাঁ ,তাইতো ,আছি তো বেশ ! ! দেশের ধুলা -ময়লার ঝামেলা ,খাবার দূষণ ,পরিবেশ দূষণ ঝামেলা , একগাদা যৌথ পরিবারের মানুষের মন জয় করার ঝামেলা, তার চাইতে এই আছি বেশ ! ! কিন্তু না,এই এত ভালোর বা বেশের মাঝেও তাদের ভেতরে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস সব সময় ই থাকে। বাড়ীর সবাই একসাথে খেতে বসার ,গল্প করার ,তর্ক করার , হাসি -ঠাট্টা ,মান অভিমানের শূন্যতা,বন্ধুদের সাথে মজা পুকুরের পাশের টং দোকানের চা খেতে খেতে,আড্ডা না দেওয়ার শূন্যতা ।। মেয়েদের শূন্যতা থাকে মা -শাশুড়ির সাথে রান্না না করতে পারার ,ভাই -বোনের সাথে খুনসুটি করার শূন্যতা ,দেবর -ননদ-জাদের সাথে মস্করা না করার শূন্যতা ।। এসব না পাওয়াগুলো দীর্ঘশ্বাসের সৃষ্টি করে ।।
খুব শক্ত -পোক্ত মনের বাস্তববাদী প্রবাসী মানুষেরও বুকের ভেতরটা চিনচিন করে ওঠে ঈদের মতো কিছু কিছু বিশেষ দিনে।।
বাড়ির প্রতিটা সদস্যদের কাছ থেকে ভিন্ন -ভিন্ন ভালো লাগা , দায়িত্ব -কর্তব্য , অথবা রীতিনীতি মানা প্রচণ্ড বাস্তববাদী মানুষটা যখন দেশ থেকে দূরে ঈদের দিন বাধ্য হয়ে অফিস করেন তখন একবার হলেও তার বুকের ভেরত ভাই- বন্ধুর সাথে কোলাকুলির শূন্যতায় হাহাকার করে।
ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়ে “হা” করে থাকা অথবা দুই ঠোঁট না মিলিয়ে অস্পষ্ট করে কথা বলা যেন কোন ভাবেই লিপস্টিক মুছে না যায় ,দুহাতে আগের রাতে মেহেদী দেওয়া,সকালে ঘুম থেকে উঠেই সবার কাছ থেকে গোপন রাখা নতুন পোশাকটা পড়া ,vanity bag কাঁধে করে সবার কাছ থেকে সালামী নেওয়া ,সারাদিন ঘুরে এসে রাতে ক্লান্ত শরীরে আরামের ঘুম আবার তারপরের তিনদিন ,আনন্দ ,ভালবাসায় ঘুরে বেড়ানো এই বিষয়গুলো থেকে প্রবাসে বড় হওয়া বাচ্চাগুলো বঞ্চিত ।এই আনন্দের সংজ্ঞা তাদের জানা নাই । তাদের প্রাপ্য মানবীক আদর ,ভালবাসা,আনন্দ থেকে তারা বঞ্চিত ।। আর এজন্য প্রত্যক্ষ হোক বা পরোক্ষ ,দায়ী আমরা ।।
প্রবাবাসীদের সন্তানেরা যদি প্রতি ঈদে বাড়ী যেতে পারতো হয়তো তাদের সন্তানেরাও আগামী ৭ দিন শুধু ছোট পাখীর মতো আপনজনদের আশেপাশে ফুড়ুৎ -ফারুত দৌড়ে বেড়াতে পারতো ,আদর -সেনেহ পেতো ।২০/৩০ জন পরিবারের সদস্যদের ভালোবাসা শুধুমাত্র বাপ-মা দুজনের পক্ষে দেওয়া অসম্ভব ! ! হাজারো মা হয়তো ছুটি না পেয়ে জব করেছেন।। বাড়ীর কর্তা করেছেন অফিস,সন্তান স্কুলে ,প্রতিদিনকার দিনলিপিতে দিন শেষ হয়েছে ।অথচ দেশে সে ই সময় বাজির দ্রুম -দ্রাম শব্দ ,তারাবাজির আলো ,মোড়ে মোড়ে আড্ডা ,হিন্দি -বাংলা গানের জোরালো আওয়াজ ,উঠতি বয়সী ছেলেদের আনন্দে পাগলা নাচ …… আর এখানে শুধুই ভদ্রতা আর মান্যার ,আক্সকিউজমি ,সরি ,থাকন্সের দেশ ।। এখানে ক্রিসমাসের দিন থাকে নিরবতা আর কিছু সামান্য নিরব আলোকসজ্জা ,শুনশান ভদ্রতা।।
উন্নত দেশে পাড়ি জমিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করা , দেশে একেবারে ফিরে না যাওয়া আসলে একটা নেশা এ এমন এক নেশা যা থেকে বের হওয়া খুব মুশকিল অথবা এই বিদেশ থাকার নেশা থেকে বের হতে চাইলেও মানুষ পড়ে যায় ভবিষ্যতের চিন্তায় এক গোলক ধাঁধায় আর এই জন্যই হয়তো ঈদের মতো বিশেষ বিশেষ দিনে প্রবাসীদের পেতে হয় মানসিক শূন্যতা বা শাস্তি ।
কয়েকটা ভালো থাকার জাকজমক / সমৃদ্ধ জীবন যাপনের ছবি অথবা চকচকা গাড়ী , ঝকঝকা বাড়ি ,তক্তকা রাস্তা এসবের চাইতে দেশে পরিবারের সান্নিধ্য ,ভালোবাসা ,স্নেহ ,বন্ধুদের আলিঙ্গন ,আড্ডা ,মায়ের পরশ -বাপের প্রশ্রয় -শাসন ,শবেবরাতের রুটি -হালুয়া , কোরবানি ঈদের জাল দেওয়া গরুর মাংস , দুধ সেমাই ,জিলাপি , আমেত্তী , বিয়ে বাড়ীর রোষ্টের ঘ্রাণ ঢের বেশী সমৃদ্ধ ।

Sharifa TulTuly
শরিফা তাসমীম (টুলটুলী)। জন্মস্থান ; ফরিদপুর। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে, প্রথমে ই আইডিয়াল স্কুল ও কলেজে শিক্ষকতা করেন। এর পর ঢাকা কমার্স কলেজে প্রভাষক হিসাবে যোগদান করেন। ২০১৩ সালে স্বামী সন্তানের সাথে অস্ট্রেলিয়া আসেন ও স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
Related Articles
Remembering Humayun Ahmed
In 1974-1975 as a new student in Dhaka University Chemistry Department I got to know a young teacher. Shy and
বড় ভেন্যুতে প্রবাসীদের বড় স্বপ্নের ম্যাচ
অস্ট্রেলিয়ার এত বড় ভেন্যুতে বাংলাদেশ এর আগে কখনো খেলেনি। এক সাকিব ছাড়া এখানে খেলেনি বাংলাদেশি কোন ক্রিকেটার! মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ড।
অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী – ক্যানবেরা’র যত কথা
ক্যানবেরা অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী। অনেকেই এখনো মনে করে থাকেন সিডনী বা মেলবোর্ন হয়ত বা এই দেশের রাজধানী। সে যাই হোক আমি