গ্রামের বাড়িতে একদিন
সিডনিতে আসা প্রায় তিন বছর পার হতে যাচ্ছে। এর মধ্যে একবারও দেশে যাওয়া হয় নাই বিভিন্ন কারণে। কিন্তু মনের মধ্যে গ্রামের বাড়ির প্রাকৃতিক পরিবেশের উপাদানগুলোকে খুবই অনুভব করছিলাম সেই শুরু থেকেই। কারণ পড়াশুনা করতে ঢাকায় যাওয়ার প্রথম বছর প্রায় প্রতি দু সপ্তাহ অন্তর গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়া চলে যেতাম। তাই যখন সিডনির এক বন্ধুর ফেসবুকে একটা জায়গার বেশ কটা ছবি দেখলাম তখন মনেহল এটাতো আমার গ্রামের বাড়ির সেই কলার বাগান, বাঁশের ঝাড়, পুকুর পাড় আর তাতে ফুটে থাকা অসংখ্য শাপলা। উনার কাছ থেকে জায়গাটার ঠিকানা নিয়ে আমি আর রুপা বৌদি মিলে প্ল্যান করলাম ২৬শে জানুয়ারি অস্ট্রেলিয়া ডে-তে ওখানে বেড়াতে যাবো। আমরা দুজন একই ব্যাচের হওয়াতে আমাদের দুজনেরই গ্রামের বাড়ির জন্য পেট পুড়ে। তাই আমরা অস্ট্রেলিয়া ডে’র ছুটিটা কাজে লাগাতে চাইছিলাম। আগেরদিন আশফাক ভাই জায়গাটার বর্ণনা শুনে উনিও রাজি হয়ে গেলেন আমাদের সাথে যাওয়ার জন্য।
অস্ট্রেলিয়া ডে’র দিন আমরা তিন পরিবার আর আমাদের তিন দুগুণে ছয়জন বাচ্চাকাচ্চা আলিশা, দৃপ্ত, এলভিরা, রেনোর, তাহিয়া এবং রায়ানকে নিয়ে হাজির হয়ে গেলাম কাঙ্খিত জায়গাটাতে। আমাদের বাসা থেকে মাত্র ২০ মিনিটের ড্রাইভ। জায়গাটাতে নামার পরই একটা শীতল বাতাস এসে আমাদের প্রাণ জুড়িয়ে দিল। এরপর আমরা যতই আরো ভিতরের দিকে যেতে থাকলাম আমাদের বিস্ময় আরো বাড়তে থাকলো। আমার বন্ধুর ফেসবুকে জায়গাটার খণ্ড চিত্র দেখে আসলে বুঝা যায় নাই যে জায়গাটা আসলেই এত বেশি সুন্দর। এ যেন বাংলাদেশেরই একটা আদর্শ গ্রামের চিত্র। ইটের খোয়ার পায়ে হাটা রাস্তা। তার পাশে কলার গাছ। কলার গাছগুলোর পরে এক সারিতে তিনটা বাঁশের ঝাড়। ছোটরা বাঁশের ঝড় এবং কলা গাছ দেখে খুবই খুশি। খুটিয়ে খুটিয়ে তারা সব দেখতে লাগলো আর আমাদেরকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে চললো। আর সবচেয়ে খুশি দেখা গেলো দু বছর বয়সের রায়ানকে। সে লুকানোর জায়গা পেয়ে আমাদের সাথে পলানটুক (লুকোচুরি) খেলা শুরু করলো বাঁশঝাড়ের ভিতর লুকিয়ে। এরপর এক টুকরো খোলা মাঠ। সেটার কোণাকুণি বা দিকে গেলেই একটা বিশাল পুকুর। পুকুর পাড়ে সারিসারি ঝাউ গাছের মধ্যে পায়ে হেটে চলার রাস্তা।
জায়গাটা একটা আশ্রম তাই সংগত কারণেই নাম উল্লেখ করলাম না কিন্তু ওখানে বেড়াতে যেয়ে একটা দিনের জন্য হলেও আমরা শহুরে যান্ত্রিকতা ভুলে থাকতে পেরেছিলাম। আশ্রমটাতে ঢোকার মুখেই দুটা রাস্তা দুদিক দিয়ে ভিতরের দিকে চলে গেছে। বাদিকের ইটের খোয়া বিছানো রাস্তার কথা আগেই বলেছি। ডানদিকের রাস্তাটা চলে গেছে সরাসরি আশ্রমের প্রার্থনা কক্ষের দিকে। এই রাস্তাটার শেষেই কলাগাছ আর বাঁশঝাড়ের সারি। এই দুই রাস্তার মাঝে বিশাল মাঠের মধ্যে সোনালি রঙের বুদ্ধের মূর্তি বসানো। আর মাঠের শেষ মাথায় নির্মানাধীন বিশাল মঠ। মঠটার দেয়ালের কারুকাজ আমাদের গ্রামবাংলার পুরোনো আমলের পাকা বাড়ির টেরাকোটার কথা মনেকরিয়ে দেয়।
ডান দিকের রাস্তাটার অনেকখানি অংশ দেয়াল বরাবর যেয়ে বায়ে বাক নিয়ে আশ্রমের পার্থনা কক্ষের দিকে চলে গেছে। দেয়ালের এই অংশটা আসলে একটা স্মৃতিসৌধের মত। এখানে প্রত্যেকটা মৃত ব্যক্তির জন্য একটা করে ইট রাখা আছে দেয়ালের গায়ে। আর ইটের উপরে ছোট একটা ফাঁকা জায়গা। সেখানে তার আত্মীয় স্বজনেরা ফুল দিয়ে গেছেন। ঠিক বাক নেয়ার জায়গাটাতে বুদ্ধের সাদা রঙের একটা দাড়ানো মূর্তি। দেয়ালের অপর পাশটাতে সারিকরে গাছ লাগানো আর সেই গাছের ছায়ায় বসার জন্য গাছের গোড়ায় বড় বড় পাথর খন্ড রাখা। ঠিক যেন বাংলাদেশের গ্রামের বাড়ির বাইরে গাছের তলায় বসানো বাঁশের মাচা যেখানে বসে ক্লান্ত পথিক একটু জিরিয়ে নেয়। এক গাছ গুলোর ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন রকমের ফুলের গাছ লাগানো। ঠিক যেন গ্রামের বাড়ির আঙিনায় লাগানো ফুলের সারি। এরমধ্যে দেখলাম জবা ফুলের গাছও আছে।
এমনকি পুকুর পাড়ে বিশ্রাম করার জন্য একটা চৌকিও রাখা। আমরা পুকুরের পাড় ধরে পুরো পুকুরটা একবার চক্কর দিয়ে পুকুরের মধ্যে নেমে পড়লাম। অস্ট্রেলিয়াতে এখন গ্রীষ্মকাল তাই পানি শুকিয়ে নিচে নেমে গেছে। আমরা শুকনা জায়গাগুলো দিয়ে ঘুরতে থাকলাম। বিজয় দা পাতলা পাতলা ইটের টুকরা খুঁজে পানিতে ব্যাঙাচির লাফ তৈরি করতে শুরু করলো। আর ইট সংগ্রহ করে উনাকে সহযোগিতা করে যাচ্ছিল তাহিয়া, দৃপ্ত আর রেনোর। উনার দেখাদেখি রায়ানও নিজে নিজেই হাতের কাছে যা পাচ্ছিল তাই পানিতে নিয়ে ফেলছিল। আলিশা আর এলভিরা একটু বড় তাই ওরা ছোটদের মত পাগলামি না করে ছবি তুলে বেড়াচ্ছিল। আমি প্যান্টের হাতা গুটিয়ে পানিতে নেমে যেয়ে শাপলা ছুয়ে দেখলাম। আহা সেই শৈশবের কোমল শাপলা। এরমধ্যে বেশ কিছু ছবি তুলে নিলাম শাপলা ফুলের।
ঘুরাফেরা শেষ করে আমরা পুকুর পাড়ে রাখা চৌকিটাতে একে একে সবাই মিলে বসে বিশ্রাম নিলাম। একসাথে সবার বসার উপায় ছিল না কারণ চৌকিটা ছিল খুবই দুর্বল। সবশেষে আমরা ফিরে এসে একটা গাছের তলায় কাপড় পেতে বসে আমাদের সাথে আনা খাবার খেতে বসলাম। সেটা দেখে আমার বাংলাদেশের চড়ুইভাতির কথা মনেহচ্ছিল বারবার। খাবার শেষে চাষিরা যেমন করে দুপুরের খাবারের পর গাছের ছায়ায় একটু জিরিয়ে নেয় আমরা সেইভাবে আধশোয়া হয়ে কিছুটা জিরিয়ে নিলাম। এভাবে কখন যে সময় গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে আমরা খেয়ালই করি নাই। কিন্তু এইবার ফিরতে হবে ভেবে আমাদের বড়দের খুব মন খারাপ হচ্ছিল। তবুও ফেরার প্রস্তুতি শুরু করে দিতে হল। গোছগাছ করা হয়ে গেলে বৌদি বললেন ধন্যবাদ ভাইয়া এত সুন্দর একটা জায়গায় নিয়ে আসার জন্য। জায়গাটা আমাকে আমার মামার বাড়ির (গ্রামের বাড়ি) কথা মনে করিয়ে দিল। আশফাক ভাই আর দিশা ভাবি বললেন আমরা অন্ততঃপক্ষে প্রতিবছর একবার করে হলেও এখানে বেড়াতে আসবো।
Md Yaqub Ali
আমি মোঃ ইয়াকুব আলী। দাদি নামটা রেখেছিলেন। দাদির প্রজ্ঞা দেখে আমি মুগ্ধ। উনি ঠিকই বুঝেছিলেন যে, এই ছেলে বড় হয়ে বেকুবি করবে তাই এমন নাম রেখেছিলেন হয়তোবা। যাইহোক, আমি একজন ডিগ্রিধারী রাজমিস্ত্রি। উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করতে অস্ট্রেলিয়াতে আমার আগমন ২০১৫ সালের মার্চে। আগে থেকেই ফেসবুকে আঁকিবুকি করতাম। ব্যক্তিজীবনে আমি দুইটা জীবের জনক। একটা হচ্ছে পাখি প্রকৃতির, নাম তার টুনটুনি, বয়স আট বছর। আর একজন হচ্ছে বিচ্ছু শ্রেণীর, নাম হচ্ছে কুদ্দুস, বয়স দুই বছর। গিন্নী ডিগ্রিধারী কবিরাজ। এই নিয়ে আমাদের সংসার। আমি বলি টম এন্ড জেরির সংসার যেখানে একজন মাত্র টম (আমার গিন্নী) আর তিনজন আছে জেরি।
Related Articles
NAIDOC Week
নেইডক সপ্তাহঅস্ট্রেলিয়াকে বলা হয় অভিবাসীদের বাসভূমি বা ল্যান্ড অব মাল্টিকালচারাল সোসাইটি। যদিও ১৬০৬ সালে ডাচ ক্যাপ্টেন উইলিয়াম ইয়্যানজ এবং ১৬৯৭
সিনেমার সর্বজয়া আর সাহিত্যের সর্বজয়া
বিভূতিভূষণ মানবজীবনের গভীর ভাষ্যের রূপ অসাধারন কারুকার্যে তুলে ধরেছেন তাঁর উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’তে। তারই ভিত্তিতে সত্যজিৎএর সৃষ্টি অনবদ্য সিনেমা ‘পথের