সিডনি চেরি ব্লোসম ফেস্টিভ্যালে একদিন

সিডনি চেরি ব্লোসম ফেস্টিভ্যালে একদিন

প্রতি বছরের ন্যায় এবারো সিডনির অবার্ন বোটানিক গার্ডেনসে হয়ে গেল চেরি ব্লোসম ফেস্টিভ্যাল। ১৭ই আগস্ট থেকে শুরু হওয়া এই ফেস্টিভ্যাল ছিল ২৬শে আগস্ট পর্যন্ত। ফেসবুকে এই ইভেন্টের খবর পেয়েই আমাকে জানালেন আমার মেয়ের বান্ধবী জেইনার মা। আমরা তখন থেকেই পরিকল্পনা শুরু করে দিলাম কবে আমরা চেরি ব্লোসম ফেস্টিভ্যালে যেতে পারি সেটা নিয়ে কিন্তু সবার কাজের সময় মিলিয়ে আর সময় বের করা সম্ভব হচ্ছিল না। অবশেষে আমরা ভাবলাম ঈদের দিন ২২শে আগস্ট ফেস্টিভ্যালে যাবো কিন্তু ঈদের দিন আগত অতিথিদের আপ্যায়ন করতে যেয়েই বিকাল চারটা বেজে গেলো তাই আর যাওয়া হল না কারণ ফেস্টিভ্যাল সকাল ৯টা থেকে শুরু হয়ে ৫ টায় শেষ হয়। আর আমাদের বাসা মিন্টো থেকে যেতে প্রায় এক ঘন্টার মত সময় লাগে।

সিডনি চেরি ব্লোসম ফেস্টিভ্যাল

অবশেষে ২৫শে আগস্ট শনিবার সকালেই আমরা সংসারের সব কাজ গুছিয়ে জেইনার বাবার সজিবের জন্য অপেক্ষায় রইলাম। দুপুরের পর উনি কাজ থেকে ফিরলেই আমরা রওয়ানা দিয়ে দিলাম। আমাদের গাড়িতে আমি, গিন্নি, তাহিয়া আর রায়ান। জেইনাদের গাড়িতে জেইনার বাবা সজিব, মা ফাহিমা আর জেইনার বোন জাহিয়া। অবার্ন বোটানিক গার্ডেনের কাছাকাছি পৌছাতেই রাস্তার পাশের একটা বোর্ডে দেখলাম লেখা উঠতেছে সেখানকার অপর্যাপ্ত পার্কিংয়ের কথা বলে। সৌভাগ্যবশত আমরা কাছাকাছিই দুইটা পার্কিং স্পট ফাঁকা পেয়ে বোটানিক গার্ডেনসে হেটে রওয়ানা দিয়ে দিলাম।

সিডনি চেরি ব্লোসম ফেস্টিভ্যাল

গেটে ঢোকার মুখেই টিকিটের তিনটা লাইন। একটা অত্র এলাকার বাসিন্দাদের জন্য, দ্বিতীয়টা যারা অনলাইনে টিকিট কিনেছে তাদের জন্য আর তৃতীয়টা যারা এখানে এসে টিকিট করবে তাদের জন্য। আমরা তৃতীয় লাইনে দাড়িয়ে টিকিট করে নিলাম। অনেকগুলো কাউন্টার তাই টিকিট করতে তেমন একটা সময় ব্যায় হলো না। ভিতরে ঢুকেই আমরা শুরুতে ইনফরমেশন বুথ থেকে একটা মানচিত্র নিয়ে সেটা বুঝে নিলাম। তারপর সেই মোতাবেক পরিকল্পণা করে আমরা এগিয়ে চললাম। শুরুতেই চেরি ডোম বলে একটা বড় পলিথিনের বল যেটাকে হাওয়া দিয়ে ফুলিয়ে রাখা হচ্ছে। তাহিয়া জেইনা ওরা অনেক বায়না ধরছিল সেটার মধ্যে ঢোকার জন্য কিন্তু আমরা চাইছিলাম আগে চেরি বাগানটা ঘুরে দেখতে। যাইহোক আমরা চেরি বাগান ঘুরে এসে দেখি তখনও বেশ লম্বা লাইন। অবশ্য আমরাই ছিলাম শেষ ভাগ্যবান যারা চেরি ডোমে ঢুকতে পেরেছিলাম সেদিন। পলিথিনের মধ্যে চেরির রঙয়ের সাথে মিলিয়ে ছোট ছোট কাগজের টুকরা বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে তাহিয়া জেইনা আর রায়ান অনেক আনন্দ পেলো কিন্তু জাহিয়াকে আমরা ঢোকাতে পারলাম না কারণ আমাদের পিছনে যারা লাইনে ছিল তারা আমাদেরকে অনুরোধ করে ওদের সাথে ঢুকে পড়েছিল।

সিডনি চেরি ব্লোসম ফেস্টিভ্যাল

চেরি ডোমের পরেই আছে সুমো স্টেডিয়াম। সেখানে সুমোরা কি শারীরিক কসরত প্রদর্শন করে সেটা আর দেখা হলো না সময় শেষ হয়ে যাওয়াতে কিন্তু আমরা একজন অতিকায় সুমো কুস্তিগিরকে দেখতে পেলাম। শুনলাম মাইক্রোফোনে একজন ঘোষণা করলো উনার ওজন ২৪০ কিলোগ্রাম। আপাতত উনাকে দেখেই আমরা সামনের দিকে এগিয়ে চললাম।

সিডনি চেরি ব্লোসম ফেস্টিভ্যাল

এরপরই আবার ছিল বাচ্চাদের জন্য আলাদা খেলার জায়গা হেলো কিটি কিন্তু আমরা সেদিকে না যেয়ে চেরি বাগানের দিকে এগিয়ে গেলাম। বাগানে ঢোকার মুখেই রাস্তাটা দুভাগ হয়ে গেছে। একটা গেছে মূল বাগানের দিকে। আমরা সেদিকে না যেয়ে পাশের রাস্তা দিয়ে এগুতেই দেখলাম একটা ময়ূর বসে বিশ্রাম নিচ্ছে। ময়ূর আসলেই একটা অদ্ভুত পাখি যার শরীরের চেয়ে পালক অনেক বড়। ময়ূর দেখে তাহিয়া বলল বাবা আমি ময়ূরের পালকের উপরে যেয়ে দাড়ায় তাহলে ময়ূরটা যখন সরে যেতে চাইবে তখন নিশ্চয় একটা পালক খসে পরবে তখন আমি সেটা নিব। আমি তখন ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম ময়ুরের পালক পুরনো হয়ে গেলে এমনিতেই খসে পড়ে। আমি তোমাকে কিনে এনে দেব একদিন।

সিডনি চেরি ব্লোসম ফেস্টিভ্যাল

ময়ূর দেখা শেষ করে আমরা একটু ঘুরপথে যেতেই একটা রাস্তার দুপাশে হালকা গোলাপি বর্ণের চেরি ফুলের সারি দেখতে পেলাম। রাস্তার দুপাশের গাছের ডালগুলো বড় হয়ে সরু রাস্তাটার উপরে চলে এসেছে তাই মনেহচ্ছিল যেন রাস্তাতার উপরে হালকা গোলাপি বর্ণের চাঁদোয়া টানানো। সবাই সেখানে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় ছবি তুলছে। আমরাও জেইনার বাবা-মায়ের একটা যুগল ছবি তুলে দিলাম। এরপরই আমাদের জন্য আসল বিস্ময় অপেক্ষা করছিল।

সিডনি চেরি ব্লোসম ফেস্টিভ্যাল

মূল চেরি বাগান যেটা জাপানিজ গার্ডেন নামে বেশি পরিচিত সেখানে প্রবেশ করতেই চোখদুটো জুড়িয়ে গেলো শরীরে এক ধরণের প্রশান্তির ছোয়া লাগলো। এই বাগানের বিশেষত্ব হচ্ছে পুরো বাগানটা একটা কৃত্রিম হ্রদকে ঘিরে। আবার দুকোণ থেকে দুটো ঝরনাও হ্রদে এসে মিলেছে। হ্রদের পানিতে রাজহাঁস খেলা করে বেড়াচ্ছে। আর হ্রদের চারদিকে চোখজুড়ানো সবুজের সারি। নদীর এবং পুকুরের দেশের মানুষ হওয়াতে পানি দেখলেই মনটা ভালো হয়ে যায়। রাজহাঁস দেখে তাহিয়া আর জেইনা বায়না ধরলো তারা রাজহাঁস ধরবে। আমি বললাম পাড়ে যে রাজহাঁসগুলো গা শুকাচ্ছে তাদেরকে ধরতে পারো তবে সাবধান কারণ রাজহাঁস কিন্তু ঠোকর মারে। এটা শুনে তাহিয়া বলল তুমি জানো কিভাবে? আমি বললাম ছোটবেলায় আমাকে রাজহাঁস ঠোকর দিয়েছিল। তাই আপাতত ওরা রাজহাঁস ধরার মিশন থেকে নিজেদেরকে নিরস্ত্র করলো।

সিডনি চেরি ব্লোসম ফেস্টিভ্যাল

হ্রদের চারপাশের সবুজের পরের সারিতেই রয়েছে শতশত চেরি গাছ। আর সেখা ফুটে আছে হালকা গোলাপি রঙয়ের চেরি ফুল তবে এখানে পরিমাণে অনেক বেশি তাই উপরের দিকে তাকালে হঠাৎ সেগুলোকে হালকা গোলাপি মেঘ ভেবে ভুল করতে পারেন। সবাই বিভিন্নভাবে ছবি তুলছে দেখে আমরাও সবাই দাঁড়িয়ে গেলাম ছবি তোলার জন্য। ছবি তোলা শেষ হলে আমরা শুধু ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম এই হালকা গোলাপি রঙয়ের মেঘগুলোকে। যতই দেখি ততই আরো দেখতে ইচ্ছে করে। তাই আমরা বের হওয়ার রাস্তায় যেয়েও আবার ফিরে আসলাম তবে একটা লাভ হলো। সেটা হচ্ছে বের হয়ে যাওয়ার রাস্তার দুপাশে কৃত্রিম গাছে লাইটিঙয়ের মাধ্যমে কৃত্রিম চেরি তৈরি করা হয়েছে সেগুলোও দেখতে অনেক সুন্দর। এভাবে আমরা দুইবার চক্কর দিয়ে দেখে ফেললাম।

সিডনি চেরি ব্লোসম ফেস্টিভ্যাল

এরমধ্যেই দেখি কিছু তরুণ তরুণী জাপানি পোশাকে ঘুরাঘুরি করছে। তাদেরকে অনুরোধ করে আমরা তাদের সাথেও ছবি তুললাম। জাপানি পোশাকগুলো  যেমন রঙিন তেমনি অনেক বাহুল্য সম্বলিত। আমার অবাক লাগে এতো কাপড়চোপড় পরে ওরা কিভাবে চলাফেরা করে। আসলে অস্ট্রেলিয়ার সাংস্কৃতির মূল বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে বহু দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এই মিশেল। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে আমাদের অনেক ক্ষিদে পেয়ে গিয়েছিল তাই আবার প্রবেশ পথের কাছে ফিরে আসতে হল কারণ খাবার দোকানগুলো সেখানেই। সেখান থেকে আমরা খাবার কিনে নিয়ে চেরি ডোমের লাইনে দড়ালাম। তবে একটা কথা এখানে বলে রাখা ভালো সবদেশের মেলাতেই খাবরের দাম বাইরের তুলনায় প্রায় আড়াই তিনগুণ এখানেও তার ব্যাতিক্রম ছিল না। চেরি ডোমে চড়া শেষ হতে হতেই বিকেল পাঁচটা বেজে গেলো তাই আমরা প্রবেশ পথের পাশের বাইরে আসার দরজা দিয়ে বের হয়ে আসলাম যেটা অন্যসময় বন্ধ থাকে।

সিডনি চেরি ব্লোসম ফেস্টিভ্যাল

বাইরে এসে জেইনার মা বলল আমরা আবার খুব শীঘ্রই এখানে আসবো। আমি বললাম অবশ্যই অন্ততপক্ষে হ্রদের ধারে চুপাচাপ বসে থাকার জন্যে হলেও আমার আবার আসবো খুব শীঘ্রই।

ছবিঃ ফাহিমা আহমেদ খান, সজিব খান।

Md Yaqub Ali

Md Yaqub Ali

আমি মোঃ ইয়াকুব আলী। দাদি নামটা রেখেছিলেন। দাদির প্রজ্ঞা দেখে আমি মুগ্ধ। উনি ঠিকই বুঝেছিলেন যে, এই ছেলে বড় হয়ে বেকুবি করবে তাই এমন নাম রেখেছিলেন হয়তোবা। যাইহোক, আমি একজন ডিগ্রিধারী রাজমিস্ত্রি। উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করতে অস্ট্রেলিয়াতে আমার আগমন ২০১৫ সালের মার্চে। আগে থেকেই ফেসবুকে আঁকিবুকি করতাম। ব্যক্তিজীবনে আমি দুইটা জীবের জনক। একটা হচ্ছে পাখি প্রকৃতির, নাম তার টুনটুনি, বয়স আট বছর। আর একজন হচ্ছে বিচ্ছু শ্রেণীর, নাম হচ্ছে কুদ্দুস, বয়স দুই বছর। গিন্নী ডিগ্রিধারী কবিরাজ। এই নিয়ে আমাদের সংসার। আমি বলি টম এন্ড জেরির সংসার যেখানে একজন মাত্র টম (আমার গিন্নী) আর তিনজন আছে জেরি।


Place your ads here!

Related Articles

কাম্বারল্যান্ড কাউন্সিলের প্রতিটি লাইব্রেরীতে “একুশে কর্নার” প্রতিষ্ঠাঃ “সকল মাতৃভাষা সংরক্ষণে ‘Cumberland Council, NSW’ বৈশ্বিক মাইলফলক” (IMLD’র গণসম্পৃক্ততা বিষয়ক বিশেষ প্রবন্ধ)

স্থানীয় সকল ভাষাভাষীর মাতৃভাষা চর্চা এবং সুরক্ষায় প্রাত্যহিক গণসচেতনতা গড়ে তোলার নিত্য-নৈমত্তিক সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টির কার্যকরী পদক্ষেপ হিসেবে প্রতিটি লাইব্রেরীতে “একুশে

Quarantiny – Chapter 3 – One Day Before Day 1

Thursday 16 April 2020 “A prerequisite of adaptability,you have to be happy with what you have” It is not that

Does Begum Khaleda Zia step out of anti-India posture?

Bangladesh people have to grasp geo-political realities of the country. One can choose friends but not neighbours because geography dictates

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment