শেকড়ের সন্ধানে একদিন এবং একজন হারুন ভাই

প্রাথমিকের পাঠ্যবই হাতে পাওয়ার সাথে সাথেই আমরা বইয়ের একেবারে উপরের পৃষ্ঠায় নিজের নামসহ ঠিকানা লিখে ফেলতাম। যাতে বইটা হারিয়ে গেলেও সহজে খুঁজে পাওয়া যায়। প্রথমে নাম তারপরেই গ্রামের নাম লিখতাম “চর ভবানীপুর”। তখন জানতাম না এই চর কথাটার মানে কি? কারণ আমাদের জন্ম এবং বেড়ে উঠা এই চরেই। আমাদের গ্রামের আশেপাশের গ্রামগুলোর নামও একইভাবে শুরু হত যেমন চর ঘোষপুর , চর রঘুনাথপুর ইত্যাদি। আমাদের গ্রামের চারদিকের মাঠের নামকরণগুলো ছিল আরো মজার। পশ্চিমের দিকের মাঠটাকে আমরা বলতাম মুন্সির মাঠ পরবর্তিতে এসে জেনেছি মুন্সির মাঠের বেশির ভাগ জমিরই মালিক কোন এক মুন্সি হওয়াতে এরূপ নামকরণ। দক্ষিণের দিকের মাঠগুলোর মধ্যে নাম ছিল পাল্লিছাম, খড়ের দাড়ি, খুদার গাড়ি ইত্যাদি।
মুন্সির মাঠে সাধারণতঃ মৌসুমী ফসলের আবাদ হত যেটা আলাদাভাবে পাহারা দিতে হত না। “বায়োরদার” একজন মানুষকে সারা গ্রামের মানুষ নিয়োগ দিত। উনি এক বিশাল লাঠি হাতে সবার ক্ষেত পাহারা দিতেন। আর কারো ক্ষেতে কোন গরু ছাগলকে ক্ষেত নষ্ট করতে দেখলে ধরে নিয়ে খোয়াড়ে দিয়ে দিতেন। খোয়াড়ে দিলে আপনাকে টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে আসতে হত। তাই সবাই নিজে থেকেই সাবধান থাকতেন। কিন্তু অন্য ফসল যেমন উচ্ছে, পটল, কাকুর এগুলো পাহারা দিতে হত বিশেষকরে রাতের বেলাতে। এরজন্য ক্ষেতের মাঝখানে দোচালা কুঁড়েঘর তৈরি করা হত। কুঁড়েঘরগুলোতে দিনের বেলায় বিশ্রাম নেয়া বা খাওয়া দাওয়ার কাজ চলতো আর রাতে ক্ষেত পাহারা দেয়ার জন্য ঘুমানো হত।
ক্ষুদার গাড়ি মাঠের বিশাল ক্ষেতে একবার আবাদ করা হয়েছিল কাকুরের। আমি স্কুল শেষ করে চলে যেতাম মাঠে। তারপর পাশের ক্ষেতের বাচ্চাদের সাথে দারুণ সময় কাটতো। আমি যেহেতু নিয়মিত ক্ষেত পাহারা দিতাম না তাই ওরা আমাকে সহজভাবে নিত না। কিন্তু যখন বুঝতে পারলো আমি ওদের চুরির খবর অন্য কাউকে বলবো না তখন সবাই বন্ধু হয়ে গেল। আমরা সারা ক্ষেত্রে খুজে কোথায় কোন গাছে ভালো স্বাদের কাকুর ধরেছে খুঁজে বের করতাম। তারপর সেটা মাটিতে পুঁতে রেখে দিতাম। আর জায়গাটা চেনার জন্য কোন একটা কিছু দিয়ে চিহ্নিত করে রাখতাম। অবশ্য চিহ্নিত করে রাখার খুব একটা দরকার পড়তো না। কারণ কাকুর পেকে গেলে উপরের মাঠি ফেটে যেত। আর ফেটে যাওয়া মাটি দেখেই আমরা বুঝতে পারতাম ওখানে একটা কাকুর পুঁতে রাখা হয়েছিল। তারপর সবাই মিলে সেটা তুলে ভাগাভাগি করে খাওয়া হত।
প্রত্যেকদিন সকালবেলা সারক্ষেত খুজে একেবারে পাকা কাকুরগুলো তুলে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হত। তারপর প্রতিবেশিদের সাথে সেটা ভাগ করে নেয়া হত। যেগুলো প্রাকৃতিকভাবে পাকতো সেগুলো খেতে হট খুবই সুস্বাদু। কিন্তু পেকে ফেটে যাওয়াতে সেগুলো আর হাতে নিয়ে যেয়ে বিক্রি করার মত অবস্থায় থাকতো না। কাকুরের অনেক রকমের প্রকার এবং নামগুলোও ছিল অনেক সুন্দর। আজ আর নামগুলো মনে নেই কিন্তু প্রকার মনেআছে কয়েকটা যেমন একটা প্রকার পাকার পর তার দানাগুলো হত বালির মোট ঝুরঝুরে। আবার এক প্রকারের কাকুর ছিল যেটা পাকলে একটু আঠালো হত দানাগুলো। এছাড়াও ক্ষেতের মধ্যে তরমুজের বীজ লাগানো হত। তবে সে তরমুজগুলো ছিল গাঢ় সবুজ বর্ণের অনেকটা প্রায় কালো বর্ণের। সেগুলো পাকলে খুবই মিষ্টি হত। কিন্তু পাকার আগেই আমরা সেগুলো খেয়ে ফেলতাম বেশিরভাগ সময়। ক্ষেতের সবচেয়ে ভালো কাকুরগুলোকে মাটির তৈরি একটা প্রকোষ্ঠে সাজিয়ে সেখানে খড়ের আগুন দিয়ে এক বিশেষ প্রক্রিয়ায় কাকুরগুলো পাকানো হট। এতেকরে সেগুলো ফেটে যেতো না। হাতে নিয়ে বিক্রি করা যেত। এইভাবে পাকানোর প্রক্রিয়াটাকে আমরা বলতাম জাগ দেয়া। তখনও কৃষকেরা এত কেমিকেলের ব্যবহার শিখে নাই তাই এভাবেই কাকুরগুলোকে পাকানো হত।
এক বছর পাল্লিছাম মাঠে পটল আর উচ্ছের চাষ করা হয়েছিল। সেখানেও আমি স্কুলের বাইরের সময়টুকু পাহারা দিতে যেতাম। কত রকমের পটল আর উচ্ছে আবাদ হত। কোন পটল লম্বা কোন পটল খাটো আবার কোনটা সরু কোনটা মোটা। গায়ের রঙের ও অনেক তফাৎ থাকতো। কোন কোনটার গায়ের রং হালকা সবুজ বার কোনোটার গাঢ় সবুজ। একইভাবে উচ্ছেরও প্রকার ছিল। দেশিগুলোর আকার একটু ছোট কিন্তু গায়ে কাটা অনেক আর বিদেশিগুলোর আকার বড় কিন্তু গায়ের কাটা মোটা মোটা এবং সংখ্যায় কম। পটল বা উচ্ছে পেকে গেলে লাল বর্ণ ধারণ করতো। পাকা পটল খেতে অনেক সুস্বাদু ছিল। প্রতি সপ্তাহের একটা নির্দিষ্ট দিনে ব্যবসায়ীরা বিশাল বিশাল আকৃতির ঝুড়ি নিয়ে ক্ষেতে চলে আসতো পটল বা উচ্ছে কিনতে। আমরা সেদিন সকাল থেকেই লাইন ধরে তুলতে লেগে পড়তাম। তারপর সবগুলো এক জায়গায় স্তুপ করে ছোট এবং অপুষ্টগুলোকে আলাদাকরে রেখে দিতাম নিজেদের খাওয়ার জন্য আর ভালোগুলো উনাদের কাছে সের দরে বিক্রি করা হত। এই ছোটগুলোকে আমরা “ক্যাট” পটল বা উচ্ছে বলতাম।
গত সপ্তাহে ক্ষেত পাহারা দেয়ার, সবজি তোলার পুরোনো সব স্মৃতিগুলো ঝালিয়ে নেয়ার একটা সুযোগ হয়েছিল। সেইসাথে আমাদের ছেলে রায়ান আর মেয়ে তাহিয়াকে দেখানোর সুযোগ হয়েছিল ক্ষেতে কিভাবে কোন ফসল আবাদ করা হয়। ফেবুকের মাধ্যমে খবর পেলাম লেপিংটনে “রামিন’স ফার্ম” নামে একটা শাক-সব্জির ক্ষেত রয়েছে। যেখানে সুলভে একেবারে ক্ষেত থেকে সব্জি সংগ্ৰহ করা যাবে। সাথে দেয়া ছিল বেশ কিছু সব্জির ছবি তারমধ্যে বেগুন, লাউ, পুঁইশাক, লালশাক, ধুন্দল, মরিচ অন্যতম। শনিবার সকালের কাজ শেষ করতে করতে দেরি হয়ে যাওয়াতে ফেসবুকে দেয়া নম্বরে ফোন করতেই হারুন ভাই ওপাশ থেকে জানালেন উনারা বেলা সাড়ে বারোটা পর্যন্ত খোলা আছেন। লেপিংটন আমাদের বাসা থেকে মাত্র পনের মিনিটের ড্রাইভ। দ্রুতই আমরা পৌছে গেলাম। ইতোমধ্যেই অনেক পরিবার তাদের বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে চলে এসেছেন। হারুন ভাই তাদেরকে তাদের পছন্দ অনুযায়ী সব্জি ক্ষেত থেকে তুলে মেপে মেপে দিচ্ছেন। আমি উনার দিকে এগিয়ে যেয়ে হাত বাড়িয়ে দিতেই বললেন কি কি লাগবে নেয়া শুরু করেন। উনি তখন একজন ক্রেতাকে পুঁইশাক তুলে দিতে ব্যস্ত দেখে আমরা বললাম আমাদেরও পুঁইশাক লাগবে। উনি আগেরজনকে দেয়া শেষ হয়ে গেলে আমাদেরটা কাটতে শুরু করলেন।
আমি ভাবলাম এটাই সুযোগ নতুন তাহিয়ার হাতে পলিথিন দিয়ে বললাম তুমি চাচাকে সাহায্য কর। আর অন্যদিকে রায়ান ক্ষেতের খোলা অংশে মাটি গায়ে মেখে খেলা শুরু করে দিয়েছিল দেখে হারুন ভাইকে বললাম আপনার কোন কর্মী লাগলে আমাকে জানাবেন। আমার ছেলে রায়ানকে দিয়ে যাবো। ও শুধু সারাদিন এখানে কাজ করবে তার বিনিময়ে আমাদের কিছুই দেয়া লাগবে না। অন্ততঃপক্ষে ঐ সময়টুকু আমরা শান্তিতে থাকতে পারবো। শুনে হারুন ভাই হেসে দিলেন। সেই হাসি এতটাই নিষ্পাপ আর প্রান্তবন্ত ছিল যে এখনও চোখ বন্ধ করলে আমি অবিকল দেখতে পাই। এরপর আমরা উনার কাছ থেকে কাস্তে নিয়ে ধুন্দলের মাচা থেকে ধুন্দল সংগ্রহ করলাম নিজ হাতে। অনেকেই উচ্ছে ক্ষেত থেকে উচ্ছে নিচ্ছিল। আবার কেউকেউ বেগুন গাছ থেকে বেগুন উঠাচ্ছিল। উনি বলছিলেন পারলে আপনারা বেগুনের গাছসুদ্ধ নিয়ে যান কারণ উনাকে বেগুন গাছ উঠিয়ে সেখানে আবার অন্য গাছ লাগাতে হবে।
উনার ওখান থেকে কেনাকাটার সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব হচ্ছে উনি সবাইকে ক্ষেত থেকে নিজের পছন্দমত তুলে নিতে বলছেন। কারো জন্য কোন বাধা নেই। এমনকি বাচ্চারাও বাবা-মায়ের সাথে হাত লাগাচ্ছে আর বাবা-মায়েরাও খুশি হয়ে তাদের ছেলেমেয়ের কাছে ব্যাখ্যা করছে কোনটা কি, সেটা কিভাবে আবাদ করা হয়। উনি কাউকে মরিচ নিতে সাজেস্ট করছিলেন না কারণ হিসেবে বললেন এগুলোর ঝাল নেই মোটেই। নতুন করে ঝালওয়ালা মরিচ গাছ লাগাচ্ছি সেটা বড় হলে ঝাল বিক্রি করবেন। উনার ক্ষেতে এখন পাওয়া যাচ্ছে উচ্ছে, লাউ, ধুন্দল, ঢেড়স আর বেগুন। টমেটোর গাছ শুকিয়ে গেছে। আর সবে শিমের গাছ লাগিয়েছেন। উনি বললেন এইবার দেশে গেলে পটলের গাছ আনার চেষ্টা করবেন। সবাই খুবই স্বতস্ফুর্তভাবে কেনাকাটা করছেন। কারণ উনি প্রচারের দাম রাখছেন বাজার মূল্যের প্রায় অর্ধেক। আর সামনা সামনি দেখে কেনার মজাটার দামতো একেবারে অমূল্য।
শহুরে শিক্ষিত ভদ্রলোকেরা বইয়ের পাতার সবজি আর ফলমুল বাজারে কিনতে যেয়ে বাংলাদেশের চাষীদের সততা প্রায় পুরোপুরি নষ্ট করে দিয়েছেন। এখন তারা লাউ সবুজ করার জন্য, কলা তাড়াতাড়ি বড় করার জন্য এমনকি পাকানোর জন্যও, আনারস তাড়াতাড়ি বড় করার জন্য এমনকি পাকা আনারসের গায়ের রং বইয়ের রঙের কাছাকাছি আনার জন্য, আমের গায়ের রং বইয়ের রঙের কাছাকাছি আনার জন্য, শসাটাকে আরো সবুজ করার জন্য কেমিকেলের ব্যবহার শিখে গেছে। আমি এটাতে চাষীদের মোটেও দোষ দেই না। কারণ আমার আপনার কুশিক্ষিত রুচি অনুযায়ী ফসলের যোগান “দিতে যেয়ে” প্রতিবছর ক্ষতি গুনতে গুনতে যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাবে তখন আপনি অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য হলেও দুই নম্বরি করবেন।
যাইহোক হারুন ভাইয়ের এখানে প্রত্যেকটা সব্জি একেবারে একশত ভাগ প্রাকৃতিক উপায়ে বেড়ে উঠছে। এবং আপনি নিজের চোখেই সেটা দেখতে পাবেন। যারফলে পরিপূর্ণ মানসিক তুষ্টি নিয়ে আপনি বাজার করতে পারবেন।
আর অন্তত একটি দিনের জন্য হলেও আপনি ফিরে যাবেন বাংলাদেশে ফেলে আসা আপনার পূর্বপুরুষের ভিটেমাটির কাছে যেখানে প্রয়োজনীয় সব সব্জির চাষ করা হয়। বাড়তি পাওনা হিসেবে নতুন প্রজন্মকে ধারণা দিতে পারবেন কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে কিভাবে চাষাবাদ করা হয়।

Md Yaqub Ali
আমি মোঃ ইয়াকুব আলী। দাদি নামটা রেখেছিলেন। দাদির প্রজ্ঞা দেখে আমি মুগ্ধ। উনি ঠিকই বুঝেছিলেন যে, এই ছেলে বড় হয়ে বেকুবি করবে তাই এমন নাম রেখেছিলেন হয়তোবা। যাইহোক, আমি একজন ডিগ্রিধারী রাজমিস্ত্রি। উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করতে অস্ট্রেলিয়াতে আমার আগমন ২০১৫ সালের মার্চে। আগে থেকেই ফেসবুকে আঁকিবুকি করতাম। ব্যক্তিজীবনে আমি দুইটা জীবের জনক। একটা হচ্ছে পাখি প্রকৃতির, নাম তার টুনটুনি, বয়স আট বছর। আর একজন হচ্ছে বিচ্ছু শ্রেণীর, নাম হচ্ছে কুদ্দুস, বয়স দুই বছর। গিন্নী ডিগ্রিধারী কবিরাজ। এই নিয়ে আমাদের সংসার। আমি বলি টম এন্ড জেরির সংসার যেখানে একজন মাত্র টম (আমার গিন্নী) আর তিনজন আছে জেরি।
Related Articles
গৌলগঞ্জ, সাহেব আর রতন – হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির নাম
আমরা বলতাম গৌলগঞ্জ। প্রকৃত নাম হতে পারে – গকুলগঞ্জ। গোপালগঞ্জ হলেও হতে পারে। প্রশন্নপুরের খিলা বাজারে আমাদের বাড়ি। সে খান
প্রবাসে বাংলাদেশের গর্ব
একজন খুবই সাধারণ মানের দর্শক হিসেবে ক্রিকেট খেলাটা আমার কাছে অনেক বড় বিনোদনের বিষয়। যেহেতু দেশ বিদেশ ঘুরে দেখার মত
অস্ট্রেলিয়ায় রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পাচ্ছেন মেলবোর্নের কামরুল হোসাইন চৌধুরী
অস্ট্রেলিয়ার সরকার কর্তৃক ঘোষিত অস্ট্রেলিয়া ডে সম্মাননা ২০১৯ পেতে যাচ্ছেন দেশটিতে বসবাসরত বাংলাদেশি ব্যবসায়ী কামরুল হোসাইন চৌধুরী। ২০১৯ সালের প্রকাশিত