যত খুশি তত খান, তারই নাম মেজবান

যত খুশি তত খান, তারই নাম মেজবান

মেজবান কিংবা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় “মেজ্জান”, চট্টগ্রামের অতিথি আপ্যায়নের বহুদিনের লালিত একটি ধারা। চট্টগ্রামবাসীদের কাছে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ খাবারগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মেজবানের খাবার। মেজবানের নিমন্ত্রণ পেলে অভিজাত কোনো কমিউনিটি সেন্টারে বিয়ে, রেস্তোরাঁয় পার্টি অথবা শত পদের খাবার দিয়ে আয়োজিত কোনো অনুষ্ঠানও একজন চট্টগ্রামের মানুষ উপেক্ষা করতে দ্বিধা করেন না। মেজবানের খাবারের প্রতি চট্টগ্রামবাসীর এমন দুর্নিবার আকর্ষণ অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের কাছে দুর্বোধ্য মনে হতে পারে। তবে এটাই হল চট্টগ্রামের সংস্কৃতির বৈশিষ্ট।

সাদা ভাত এবং গরুর মাংসের বাহারী পরিবেশনায় গনভোজের নাম হল মেজবান। তবে সাথে গরুর মাংসের হাঁড়-গোড় ও নেহারি (চট্টগ্রামের ভাষায় নলা) দিয়ে ডাল ও সব্জির কয়েকটি পদও পরিবেশন করা হয় মেজবানে। “যত পারো তত খাও” এই হচ্ছে মেজবানের মূল মন্ত্র। কারণ মেজবানে যত ইচ্ছে তত গো-মাংস খেতে কোনো বাধা নেই।

বিশেষ ধরনের মশলা মিক্স ও অধিক পরিমানে কাঁচামরিচ দিয়ে রান্না করা হয় মেজবানের মাংস। বাবুর্চিদের মেজবানী রান্নার নিজস্ব কিছু গোপন কৌশল থাকে যা কেবল হেড বাবুর্চিরই জানা থাকে। চট্টগ্রামের ফুল বাবুর্চি হলেন মেজবান রান্নার সেলিব্রিটি বাবুর্চি। মেজবানী রান্না করার জন্য তিনি নিয়মিত বিদেশ সফরও করে থাকেন। বিশেষ প্রক্রিয়ায় রান্না করা মেজবানের খাবার ক্রমশঃ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের কাছে। কাতারের প্রায় সকল বাংলাদেশি রেস্তোরাঁয় বৃহস্প্রতিবার রাতে মেজবানী মাংস মহা-সমারোহে বিক্রি হচ্ছে।

মূলতঃ ধর্মীয় অনুভূতির কারনেই মেজবানের যাত্রা শুরু হয়। যেমন আকিকা ও খৎনা অনুষ্ঠান। কেউ মারা গেলে মৃত্যুর চতুর্থ এবং চল্লিশ দিনে আয়োজিত হয় “চাইদিন্ন্যে” ও চল্লিশার মেজবান। সামর্থ্যবানরা প্রতিবছর মৃত্যুবার্ষিকীর দিনেও মেজবানের আয়োজন করেন। এছাড়া বিভিন্ন পীরের জন্ম দিনে ও মৃত্যু বার্ষিকীতেও মেজবান দেয়া হয়।

বিত্তশালী থেকে শুরু করে এমনকি নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোও অনেক সময় ধার-দেনা করে পারিবারিক ঐতিহ ধরে রাখার জন্য মেজবানের আয়োজন করে থাকেন। মেজবান নিয়ে চট্টগ্রামের বিত্তশালীদের মধ্যে কার মেজবানে কতটা গরু জবাই করা হয় সে নিয়ে কখনও চলে প্রতিযোগিতা। তবে ইদানিং মহিষের মাংস দিয়েও মেজবানের খাবার তৈরী হচ্ছে। কিছুদিন আগে কাতারে দোহা শহরের হারেজ মার্কেটে মহান্নাদী গ্রুপ মহিষের মাংস দিয়ে মেজবানের আয়োজন করেন। যা ভোজন রকিসদের কাছে বিপুল সমাদর পেয়েছে।

মেজবান খাওয়ার জন্য নিমন্ত্রণের প্রয়োজন হয়না। ওমুকের বাড়ীতে মেজবান চলছে, এইটুকু জানলেই হল। মেজবানের খাবার সাধারণতঃ মুখোমুখি লাইন করে মাটিতে বসিয়ে খাওয়ানো হয়। গন্যমান্য ব্যাক্তি ও মুরুব্বীদের জন্য চেয়ার টেবিলের ব্যবস্থা করা হয়। প্রথমে দু’জন একটি বড় গামলা ভর্তি ভাত নিয়ে যান আর পেছন থেকে একজন প্রতিটি অতিথির থালায় ভাত বেড়ে দেন। ভাতের পেছন পেছন একজন বালতি ভর্তি মাংস, একজন সব্জি, ও একজন ডাল/নলা বেড়ে দিতে থাকেন।

ইদানীং মেজবান আর ধর্মীয় গন্ডিতে সীমাবদ্ধ নেই। এখন উপলক্ষ্য পেলেই মেজবানের আয়োজন করা হয়। যেমন বিয়ের আগের দিন গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানে, কিংবা বিভিন্ন সংগঠনও তাদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে মেজবানের আয়োজন করে থাকে।

বাড়ীর উঠোনে জায়গার সঙ্কুলান না হওয়ায়, মেজবান এখন বাড়ীর গন্ডি ছাড়িয়ে কমিউনিটি সেন্টারে ঠাঁই নিয়েছে। মেজবান স্থলে মানুষের জ্যাম এবং হুইসেলের শব্দ শুনে অনেকের কাছে পুরো বিষয়টি গোলমেলে মনে হতে পারে। তবে মেজবানের সময় একটু ঠেলা-ঠেলি কিংবা ধাক্কা-ধাক্কি না হলে মেজবানের সত্যিকারের আবহ সৃষ্টি হয়না। অবশ্য মানুষের ভীড় অনেক সময় বিপর্যয়ে রূপ নিতে পারে। যা চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম এবিএম মহিউদ্দীন চৌধুরীর মেজবানের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। কিন্তু এজন্য মেজবান নিয়ে চট্টগ্রামের মানুষের মধ্যে উত্তেজনায় বিন্দুমাত্র ভাটা পড়েনি।


Place your ads here!

Related Articles

Alternative Idea to Transit facilities

India wants transit facilities through land territory of Bangladesh. The request is not new. Since 1972 India has sought for

‘ত্রয়ী পাবলিকেশন’ থেকে প্রকাশিত প্রথম বইয়ের জন্যে লেখা আহবান

প্রবাসে পাড়ি জমানো প্রায় প্রতিটা মানুষ বা পরিবারের পিছনেই থাকে কিছু না কিছু গল্প। অবশ্যই সব যে দুঃখের গল্প তা

London: Ditio Bangla

লন্ডনঃ দ্বতিীয় বাংলাঅধ্যাপক নজরুল ইসলাম হাববিীশব্দ বাক্যের প্রাণ। বাক্য রচনার চোখ। চোখ দিয়ে আমরা যেমন দেখি, একজন লেখক বাক্য দিয়ে

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment