বিদেশে বৈশাখ
গত চার দিন হলো আমি সিজনাল ফ্লুতে আক্রান্ত, শরীরের ঠান্ডা গরম কে তোয়াক্কা না করেই গিয়েছিলাম গত কাল বৈশাখের অনুষ্ঠানে, যাওয়ার সময় পুরোটা রাস্তা আমার ভীষণ মাথা ব্যথা ছিল, পৌঁছানোর পর কোথায় উড়ে গেল জানি না, তার একটাই কারণ একসাথে অনেক গুলো বাঙালীর আওয়াজ, বাংলা ভাষায়, এ মনি দৌড়ায় না পড়ে যাবি, এই ভাবী কত দিন পর দেখা হলো, বাংলাদেশের খাবারের পসরা, একটা অদ্ভুত ভালোলাগায় ভিজে গেলাম।
অনুষ্ঠান সফল করার জন্য প্রধানত একজন মানুষের অবিশ্বাস্য অদম্য ইচ্ছাশক্তির ফসল, যার সাথে সাথ দিয়ে অনান্য কুশীলবরাও কম যান না। তাদের প্রচেষ্টা এক কথায় দারুন । বাঙ্গালীরা হৈ হুল্লাের, হেই ও রে, করে একসাথে যেমন করে তুলকালাম আন্দোলন করতে পারে, তেমনি কুটচালেও কম নয়। যতটা না তুই আমি ভাই ভাই, বিপদ আপদের বালাই নাই, বলে পাশাপাশি থাকলেও সবচাইতে খারাপ কাজটা একজনের জন্য আরেক জন আগে করে। বিদেশে আসার পর এটা খুব ভালো করে বুঝে গেছি।
শুধুমাত্র এখানে না পৃথিবীর যেখানেই গেছেন সেখানেই এমন নমুনা মেলা মুশকিল না। খুব স্বাভাবিক ঘটনা এটা। তাই কোন বাঙালীই মনে হয় একান্নবর্তী হয়ে থাকতে পারেন না, জুড়ে দেয় তেভাগা আন্দোলন। এর ফলোশ্রুতিতে গড়ে ওঠে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল, সংগঠন, আর এই সংগঠন গুলোর মধ্যে সবসময় একটা মারমার কাটকাট ভাব বজায় থাকে। কারা কাকে টপকে যাবে, কাদের প্রোগ্রাম কত হিট হবে, কে কত নতুন চিন্তা বুনে দেবে, এই নিয়ে চলে বছর জুড়ে জল্পনা কল্পনা, খুব কমই দেখা যায় যারা দলীয় শিল্পী, নাচিয়ে, বাচিক শিল্পী, মডেল, মেকাপম্যান, এমন কি ক্যাটারিং সার্ভিস ও দলের নামে সিলগালা করা।
যার যার দল তার তার দলে এই এক্সপার্টগণ তাদের সৃষ্টিশীলতা, সৃজনশীলতার প্রর্দশনের সুযোগ পায়। এমন কি নিজেদের বুকে দলীয় তকমার ব্যচ লাগিয়ে রাখতে পছন্দ করেন। ঠিক একই ভাবে দর্শকও ভাগা ভাগী হয়ে যায়। লক্ষ্য করলে দেখা যায় একদল আরেক দলের এফবিতেও লাইক কমেন্ট এভোয়েড করেন। আমার মনে হয় আমরা যারা লেখক মানুষ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছি কম বেশী অনেকেই পাখির চোখে বিষয় গুলোকে দেখতে ও বুঝতে পারি। তাই ব্যক্তিগত ভাবে আমি মনে করি আমি বিদেশের মাটিতে বাঙ্গালী এটাই আমার বড় পরিচয়, আমার কোন দল নেই একটাই দল বাঙ্গালী।
এটা ভেবেই যত অনু অনু দল গঠন হয়েছে আমি সব প্রোগ্রামেই যাই, বাংলা ভাষা, সাহিত্যর আস্বাদ নিতে, বিদেশের স্ট্রাগল লাইফের ভাপর টানতে টানতে যখন ক্লান্ত হয়ে যাই এই সব প্রোগ্রাম গুলো মনের প্রশান্তির জন্য টনিকের মত কাজ করে। সে ক্ষেত্রে আমি আমার দৃষ্টি ও বিবেচনার মাপকাঠিতে সৃজন শীল মানুষদের কাজ গুলোর মান নিরপেক্ষণ করতে পারি সহজেই। এখানে টাকা খরচ করে মিউজিক সন্ধ্যার আয়োজন করা হয়, বাংলাদেশ থেকে শিল্পীদের আমন্ত্রণ করা হয়।
এগুলো উপভোগ করা যায় সহজেই, যখন বাংলাদেশে ছিলাম গানের পাখি কিংবদন্তী সাবিনা ইয়াসমিন কে সামনা সামনি দেখার সৌভাগ্য হয় নি, আদৌ হত কিনা জানি না, তবে বাইরে আসলে এমন সুযোগ গুলো সহজেই হাতের নাগালে চলে আসে। তেমনি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অনেক প্রতিভা যারা কিনা দেশে হয়ত তেমন ফর্মে ছিলেন না কিন্তু এখানে এসে সহসাই স্টেজে উঠে সাবলিল ভঙ্গিতে অভিনয় নাচ গান উপস্থাপনা করার নজির রেখে যান। এদের মধ্যে অনেকেই আছেন গুরু শিক্ষায় শিক্ষিত গানে এবং নাচে। তারাও দলীয় করণ হওয়াতে নিজেদের প্রতিভা গুলো ঠিক মত ছড়িয়ে দিতে পারেন না। সংকীর্ণ আঙ্গিনায় বিশাল ডানা মেলা কঠিন।
তাই তারা নিজের প্রতিভা শুধু আপন বৈঠক ঘরেই মাতিয়ে চলেন দিনের পর দিন। আবার অনেক প্রতিভাবান শিল্পী আছেন যারা কিনা স্টেজে উঠলে উপস্থাপকের চ্যাটার বক্স থেকে এতই মনি মুক্তো ঝড়তে থাকে যে এমন একটা প্লাটফর্মের জন্যই যেন এই শিল্পী বা লেখকের এখানে আসা সার্থক হয়েছে। কিন্ত নেক্সট কোন একটা প্রোগ্রামে গিয়ে দেখা গেল কিছু ইউ টিউব দেখা নাচিয়ে বা বাংলাদেশ রেডিও ফূর্ত্তি শুনে শুনে রপ্ত করা শিল্প যার কিনা গানের গ্রামার জানা নেই, কিন্তু খানেক শাররীক কসরত আর উচা গলায় গান ধরে স্টেজ মাতিয়ে দিয়ে নেমে গেলেন, সেই একই উপস্থাপক যে কিনা গ্রামার শেখা শিল্পীর ভূয়ষী প্রশংসা করেছিলেন তিনি এই রেডিও ফূর্ত্তির শিল্পীকে জাষ্টিন বিবার কিংবা লতা, আশা শ্রেয়া হৈমন্তীর গানের সাথে তুলনা করে।
হায় সেলুকাস! সাধক শিল্পির ঢোল ফুটো করে ফেলেন। মুশকিল হয় তখনি, যে খোদ সাধনা করে গান শিখেছেন গুরুদের এত এত আর্শিবাদ সব জলে যায়। তখন এই শিল্পীগুলো নিজেদের কে গহ্বরে লুকিয়ে রাখেন মৃদু অভিমানে। তবে এটাও মানতে হয় নতুন প্রজন্মদের অন্তরে যাদের ইংরেজী ভাষার গাঁথুনি, তাদের কে বাংলা ভাষার পত্তন বোঝাতে সক্ষম হন অনেকেই, ইষ্টেইন্ডিয়া কেম্পানির লোকেদের মত বাংলা উচ্চারণে
কি ভালো কবিতা গান,না, করে শুনলে সত্যি মন ভরে যায়।
গত চারবছরে আমি দুবছর কোন বৈশাখী অনুষ্ঠান উপভোগ করতে যেতে পারিনি, সে সময় হাসপাতাল বাড়ি করতেই বেলা চলে গেছে। গত বছর থেকে অনেক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে এবং গিয়ে যা উপলোব্ধী করেছি তাই লিখলাম আজ। গত কাল ছিল এডেল এইডের “অবাক“ নামের একটা সংগঠনের বৈশাখী অনুষ্ঠান।
অনুষ্ঠানের একটা বিশাল অংশ ছিল ফ্যাশন শো। প্রথমে ভেবেছি যা হয় অনান্য গুলোতে তেমনি, যেই না প্রেজেক্টরে ভেসে উঠলো রবীন্দ্রনাথের ছবি, একটু চেয়ারে চেপে বসলাম, তারপর শুনলাম উপস্থাপকদ্বয় বিশ্লেষণ করছেন আমাদের ফ্যাশন শো একটু ভিন্ন আঙ্গিকে সাজিয়েছি, রবীন্দ্রনাথকে উৎসর্গ করে, এক এক করে মডেলরা র্যাম্পে যোগ দিলেন আমি জাস্ট মনে মনে ভাবলাম এই না হলো বাঙ্গালী আত্মার চাওয়া, রবীন্দ্রনাথ কে যে ধারণ করে এমন একটা কনসেপ্ট দাঁড় করাতে পারে সে কে?
একটু পরেই জানলাম অনামিকা নামেই তিনি এখানে পরিচিত। বুঝতে বাকী থাকলো না, তার বই পড়বার শখ। মনে মনে গিয়ে তাকে আলিঙ্গন করে আসলাম। এই ভিন্ন মাত্রার ফ্যাশন শো তে, রবীন্দ্রনাথের গল্প উপন্যাস নাটক, নাট্যকাব্যের বিভীন্ন চরিত্রের দুর্মর আকাঙ্ক্ষা, পোশাকের প্রেজেন্টেশনে সেই গল্পের প্লটের আবহ ছুঁয়ে গেছে সহজে। বাঙ্গালী পাখির যখন ছন্দোময় জীবন বাংলা সংস্কৃতির বাসায় ফেরা ডানার শব্দ নিয়ে তার সমাপ্তি রেখায় মডেলদের পায়ের স্টেপ যখন “সা“ তে এসে থেমে যায় তখনো শিল্প থেকে জীবন রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে ছন্দময় জীবনের শেষ প্রবন্ধ যেন সবার পড়া হয়ে যায়।
তখনি মনে হয়েছে ঠিক যেন প্রত্যাশিত ছঁকে বাঁধা একটা কনসেপ্ট। করিওগ্রাফির মুনশিয়ানার প্রকাশ রবীন্দ্রনাথের গানে সুর কথা ছবির নিরন্তর যাওয়া আসায় কিভাবে শ্রোতার জীবন স্মৃতিতে টান লাগাতে হয় তা সে জানতে পেরেছিল বুঝি। “অমন“ আমি যাকে এডেল এইডের গানের পাখি বলি, যার কথা বলতেই মনটা ভালো হলো এত মিষ্টি ভাষী হাস্যউজ্জ্বল মুখ খুব কম জনের হয়। গতকাল তাঁর গান শুনে মনে হয়েছে জীবনের সামনে দাঁড়িয়ে ব্যক্তির প্রসারণ। এছাড়াও ছায়াছন্দের গানে তুমুল নাচের রেশ ধরে অনুষ্ঠান সাঙ্গ হওয়া । এখনো মনোভূমিতে ভালোলাগার শঙ্খে আওয়াজ শুনে যাচ্ছি, দুরে বহুদুরে বাঙ্গালী জাতীর সমস্বরে গাওয়া “মেলায় যাইরে”।
বিদেশে এসে আমি যেমন ভাঙ্গন দেখে ভেঙ্গে যাই, তেমনি যখন এক ময়দানে আনন্দ উল্লাসে মাতে তখন গর্বে বুক ভরে যায়, যে আমি বাংলায় গান গাই , বাংলায় গালি দেই। ঠিক সকাল বেলা দেখা স্বপ্নের মত যদি একদিন দেখি বাঙ্গালীরা এক হয়ে গেছে, একসাথে গাইছ , লড়ছে বিজয় কেতন উড়ছে পতপত করে বিদেশের মাটিতে একটুকরো বাংলাদেশ। সবুজ শ্যমল হয়ে প্রত্যেকটি বাঙ্গালীর হৃদয়ে “বিশাল সমুদ্র নাও ছাড়িয়া, পাল উড়াইয়া স্বপ্ন সফল হলেই মন বন্দরে দোলা দেবে শান্তির ঢেউ”।
Najmin Mortuza
দার্শনিক বোধ তাড়িত সময় সচেতন নিষ্ঠাবান কবি। চলমান বাস্তবতাকে ইতিহাস-ঐতিহ্যের পরম্পরায় জারিত করে তিনি কাব্য রূপান্তরে অভ্যস্ত। কাব্য রচনার পাশাপাশি ক্ষেত্রসমীক্ষাধর্মী মৌলিক গবেষণা ও কথাসাহিত্য সাধনায় তাঁর নিবেদন উল্লেখ করার মতো। গবেষণাকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ফোকলোর ও লিখিত সাহিত্যঃ জারিগানের আসরে "বিষাদ-সিন্ধু" আত্তীকরণ ও পরিবেশন পদ্ধতি শীর্ষক গ্রন্থের জন্য সিটি-আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার ২০১২ অর্জন করেছেন।
Related Articles
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে কথাবার্তায় সতর্ক হোন
ফজলুল বারী: রোহিঙ্গা শরণার্থী ইস্যু বাংলাদেশের জাতীয় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নানামুখী স্পর্শকাতর অবস্থার সৃষ্টি করেছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের যাতে কেউ বাড়িভাড়া দেয়া
কিছু অপরাধ তামাদি হয় না
গায়ক আপেল মাহমুদকে নিয়ে লেখা প্রকাশের পর অনেকেই আমাকে জিজ্ঞাসা করেছেন যে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ এর ভোরে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সাথে
মেলবোর্ন কথা রাখে (না অশালীন না অপ্রাসঙ্গিক) দিলরুবা শাহানা
অশালীন ও অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ে কথা খরচ করা অযথা শক্তি ব্যয় ছাড়া আর কিছু নয়। তবে কবি ও কবিতা বিষয়ে কথা