নূরজাহান বেগমকে শ্রদ্ধাঞ্জলি

নূরজাহান বেগমকে শ্রদ্ধাঞ্জলি

২৩ মে ২০১৬ আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন বাংলাদেশের কৃতি নারী, সাংবাদিকতার পথিকৃৎ, সাহিত্যিক এবং ভারত উপমহাদেশের প্রথম নারী সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘বেগম’ সম্পাদক নূরজাহান বেগম।

উনি সুস্থ নেই শুনছিলাম, তার আগে থেকেই ভাবছিলাম ‘উনি’ ও ‘উনার অমর সৃষ্টি বেগম’কে নিয়ে। আমার মত একটা খুব সাধারন গ্রামে বেড়ে উঠা মেয়ের কি ভীষণ অন্য রকম কিছু অনুভূতি আছে তা লিখবো, মনে মনে সাজিয়েও রেখেছি, এর মাঝেই পেতে হলো সেই দুঃসংবাদ, উনি আর নেই। খুব অসহায় লাগছিলো, কষ্ট হচ্ছে, যেন করুণ সুরে মন বলছে ”কেন চোখের জলে ভিজিয়ে দিলেম না শুকনো ধুলো যত”!!! কেউ কি উনাকে বলতে পেরেছিল চলে যাওয়ার আগে ”উনি ও উনার কর্মের জন্যে কতটা শ্রদ্ধ্যার আজকের পোড়া এই বাংলাদেশে!!!

আশির দশকে ময়মনসিংহের হোগলা গ্রামে (এখন নেত্রকোণা জেলা) আমার বেড়ে উঠা। স্কুলে পড়ি, একটু বুঝতে পারি, তখন থেকেই দেখি ওই গ্রামে একমাত্র আমাদের বাসায়ই ডাক যোগে আসে একটা পত্রিকা আমার মায়ের নামে আর সেটি ছিল ”বেগম”। পরবর্তীতে ধারাবাহিকতায় ঢুকে যায়, ”চিত্রালি” রহস্য পত্রিকা সহ আরো কিছু, কিন্তু আমাদের দৃষ্টি জুড়ে তখন মধ্যমনি ওই ”বেগম”।

মনে হয় সপ্তাহে মঙ্গল বা বুধবার পত্রিকাটা হাতে আসতো।পোস্ট অফিসে যেয়ে নিয়ে আসতাম। যেদিন পত্রিকা’টি হাতে আসার কথা আমি তার আগেই যেয়ে ঘুর ঘুর করতাম পোস্ট অফিসের আসেপাশে। পোস্ট মাষ্টার চাচা সেটি বুঝতেন, আমাকে নিয়ে মজা করতেন যেদিন পত্রিকাটি হাতে দিতেন সেই সময়… ইস কি যে সেই আনন্দময় মুহূর্ত আজও অমলিন।

আমরা মা-মেয়ে স্কুলে যেতাম এক সাথে গ্রামের সরু আল পথ ধরে হেঁটে হেঁটে, আমার প্রকৃতি প্রেমিক মা স্কুল শিক্ষক সেই সুবাদে। একদম ছোটবেলায় অনুমতি না থাকলেও, নিজের অজান্তেই নিষেধাজ্ঞা উঠে যায় একটা সময়। মা মেয়ে অপ্রুপ প্রকৃতি আর সবুজ দেখতে দেখতে স্কুলে যাই আর টুকিটাকি কথায় উঠে আসে সেই ”বেগম” প্রসঙ্গ।

কোন কবিতাটা মন ছুঁয়ে গেছে, কোন গল্প’টা একটু অন্য রকম হতে পারতো, ধারাবাহিক উপন্যাসে এরপর কি হতে যাচ্ছে। আজকাল লোকেরা টিভি সিরিয়াল নিয়ে যেমনটি করে।

Nurjahan Begum - photo by Salma Ahmed

Nurjahan Begum – photo by Salma Ahmed

ঈদ সংখ্যা, সানন্দা পুজা সংখ্যাগুলো কি যে ভালো লাগা নিয়ে আসতো, যেন উৎসবের আনন্দই বাড়িয়ে দিতো। লেখিকাদের ছবি, রান্না বান্না, রুপ/স্বাস্থ্য কথা, সুন্দর ছবি সবই ভালো লাগা এক মোড়কে আগাগোড়া আনন্দ বার্তা যেন। আম্মা কবিতা ভালোবাসতেন, খুশনুর আলমগীরের লেখাও আম্মার বিশেষ পছন্দ ছিল। আমাকে কবিতা ওভাবে না টানলেও উপন্যাস গোগ্রাসে গিলতাম।

তখন বোধ হয় ক্লাস ৬/৭ এ পড়ি, ডঃ সুলতানা জামান উনার একটা উপন্যাস ধারাবাহিক প্রকাশিত হচ্ছিলো, এক মা এবং মেয়ের অন্য রকম একটা সংগ্রামী জীবন গাঁথা, মেয়েটার নাম বোধ হয় ”শবনম” আমি খুব করে সেই মেয়েটির সাথে নিজের সব অনুভূতি এক করে ডুবে যেতাম ভালোবাসায়। মেয়েটির প্রেম হল যেন আমারও হল, আমার কোথাও কেউ নেই তারপরও ভালোবাসতে শিখলাম, গভীর করে বোধ হয় সেই প্রথম। নায়িকা নায়ক নিয়ে উড়ে যায়, আমি যাই আমার বুঝা না বুঝা অবুঝ প্রেমানুভূতি নিয়ে!!!

আম্মা নিজেকে উপন্যাসের সেই মা মনে করতো কিনা কে জানে, (কালই জিজ্ঞেস করতে হবে)!!! ”বেগম” সেই গ্রামে থাকা একজন মা-মেয়ে কে অন্য এক বাইরের আলো দেখিয়েছিল, অন্য আলো, প্রথম আলো!!!

আম্মা লিখতেন কিন্তু কখনও কোথাও পাঠাতেন না। তারপরও একবার আমার বাবাই বোধ হয় এডিট করে আম্মার কবিতা পাঠিয়েছিলেন বেগমে। ঝাপসা মনে পড়ছে, তবে আম্মাকে যে ঘটনা অবর্ণনীয় সুখ দিয়েছিল সেটা হচ্ছে উনার এই এলেবেলে গ্রাম গ্রাম মেয়েটাকেই ”বেগম” একদিন এক কিশোরীর মুখ এর মডেল বানিয়ে দিয়েছিল। ‘বেগম’ এর একটা পাতায় শুধু ছবি ছাপা হত, তাদের নিজস্ব ক্যাপশন দিয়ে, আমার এই ছবিটা ছাপা হয়েছিল সেখানে!!! (ছবিটা প্রথম কমেন্টে দিলাম কারো দেখতে ইচ্ছে করলে)

বাংলাদেশে নারীদের সাহিত্য চর্চা এবং নারী জাগরণের ক্ষেত্রে এই পত্রিকাটির অবদান বাংলাদেশের ইতিহাসে অবিস্মরনীয় হয়ে থাকবে, সাথে করে এই মহিয়সী নারীর নাম। শুধু প্রশ্ন থেকে যায়, উনাকে ধারণ করা মেয়ে কি যতোটা বেশী বাংলার ঘরে ঘরে থাকার কথা ছিল, আছে সেই ”মেয়ে” সেই কাংখিত অগ্রসর নারী, সাহিত্য অনুরাগী নারী!!!

কে জানে কবে যে কোথায় কি যে হলো ভুল আমাদের। আমরা হারিয়ে ফেলেছি সেই আলোময় সময়। রাষ্ট্র কি উনাকে দিয়েছে প্রাপ্য সম্মানটুকু তাঁর জীবদ্দশায়?

শ্রদ্ধেয় নূরজাহান বেগম-আপনার বিদেহী আত্মার অনন্ত শান্তি কামনা করছি, আপনি ঘুমান শান্তিতে, অতল শ্রদ্ধা।

নাদিরা সুলতানা নদী
মেলবোর্ন, ভিক্টোরিয়া,
অস্ট্রেলিয়া
২৩ মে ২০১৮


Place your ads here!

Related Articles

বিশ্বকাপ ফুটবল ২০১৮

আমাদের সময় ছিল মোহামেডান – আবাহনী। কত দিনরাত গেছে শুধু নিজ ক্লাবের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরতে। ফুটবল নিয়ে ইটা ইটি, মারামারি,

Prime Minister Hasina’s visit to Russia: Building a stronger bilateral architecture

Prime Minister Sheikh Hasina’s visit from 14 to 16th January to Russia is important by any measure. Her first visit

কোটা পূরণ না হলেও কোরিয়াতে বাড়ছে বাংলাদেশি বৈধ জনশক্তি

প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় অর্থনৈতিক পরাশক্তির দৌড়ে জাপানের সাথে পাল্লা দেয়া দেশ দক্ষিণ কোরিয়াতে ক্রমান্বয়ে বাড়ছে বাংলাদেশি বৈধ জনশক্তি। তবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment