‘দেবী’ নারীশক্তি নয় অত্যাচারিতের অভ্যুদয়

‘দেবী’ নারীশক্তি নয় অত্যাচারিতের অভ্যুদয়

বাংলাদেশের সিনেমা ‘দেবী’ একটি নিটোল নির্মান । কাহিনী কিংবদন্তী লেখক হুমায়ূন আহমেদের । এই সিনেমাতে সুচারু দৃশ্যপরম্পরা, আবহ সৃষ্টিতে শব্দ ও সঙ্গীতের সুসম প্রয়োগ, সুন্দর অভিনয়তো আছেই, আরও আছে হুমায়ূনী রসিকতার ঝিলিক(যেমন ঘরের ভেতর কমোডে ফুলের চাড়া গোবরে পদ্ম ফোটানোর প্রয়াস, ইউনানী দাওয়াখানার লিফলেট)। লেখক হুমায়ূন আহমেদ বিষয়ে কোন বিশেষণ যে ঠিকঠাক তা বলা মুশকিল । তর্কবিতর্ক শুরু হবে যাই বলা হউক না কেন । তবে এই লেখক বিষয়ে আমার একটা কথাই বলতে ইচ্ছে করছে যার যুৎসই বাংলাটা খুঁজে পাই নি বা আমার অপারগতা । ইংরেজীতেই মনের ভাবটা ভালভাবে আসছে He is irresistable. ব্যক্তি হুমায়ূন নন লেখক হুমায়ূনের লেখনীকেই বোঝাতে চেয়েছি । পারলাম কি?

রানু নামের এতিম একটি মেয়ে নিমশাসা নামের গ্রামে চাচার কাছে লালিত পালিত । একদিন বড়ও হয়। বিয়ে হয় সাদাসিধা ভালমানুষ আনিসের সাথে । রানুর এক্সট্রা সেনসেটিভ পারসোনালিটি নিয়ে বিপন্ন স্বামী । রানু কিছু শুনে, কিছু দেখে যা ব্যাখ্যার অতীত। স্বামী অধ্যাপক মিসির আলির কাছে সাহায্য চায় । মিসির আলির ঐকান্তিক তথ্যানুসন্ধানে বের হয়ে আসে ওই গ্রাম বা জনপদের ইতিহাস যে ইতিহাসে আছে অত্যাচার, আছে নারীর প্রতি নৃশংসতা । আছে নরাধম একলোকের পাশবিক আচরণ থেকে রক্ষা পাওয়া রানু নামের মেয়ের মনোজগতে ঘটতে থাকা অলৌকিক সব ব্যাপার স্যাপার ।

রানুদের গ্রামে ১৭৫৭সালের দিকে প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল পাল বংশের । পাল বংশীয়রা এক বিশাল মন্দির নির্মাণ করে দেবী মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে। মন্দির প্রতিষ্ঠার পরই পাল বংশে সন্তান জন্ম বন্ধ হয়ে যায় । তখন তারা কন্যাবলিদান শুরু করেন দোষমুক্তির অভিপ্রায়ে । সিনেমাতে ঝলকে সেই বলিদানও দৃশ্যমান হয় । পালপরবর্তী সময়ে লোকজনেরা ওই মন্দিরের ধারেকাছেও যেতো না । মা-বাপহীন রানু মাঝে মাঝে মন্দির প্রাঙ্গনে খেলতে বা কৌতুহলের বশে যেতো। একদিন গ্রামের বদলোক জালালুদ্দি রানুর উপর ঝাপিয়ে পড়ে। মুহূর্তে ঐশী এক শক্তি ভর করে রানুর উপর যা আগুন হয়ে ছিটকে আসে রানুর শরীর থেকে । দেবী যেন রানুর মাঝে অধিষ্ঠান নিয়ে ওকে রক্ষা করেন । জালালুদ্দি পালায়।

এরপর রানু হয়ে উঠে অসম্ভব স্পর্শকাতর একজন মানুষ । চারপাশের অনেক কিছু যা অন্যদের চিন্তারও অতীত তা রানু আগেভাগে টের পেতো।

ছোটবেলার ওই ভীতিকর, জঘন্য অভিজ্ঞতা ওকে চারপাশ সম্পর্কে অসাধারন রকম সচেতন করে তোলে, এই সচেতনতাই অনেক কিছু আগেই বুঝতে সাহায্য করেছে ওকে । রানুর সচেতনতা ওর রহস্য । অবচেতন মনেও রানুকে তাড়া করতো কিছু তা ওই ঘটনার বিভৎসতার ফলেই।

রানু অলৌকিক নয়, তবে আন্দাজ করার ক্ষমতা রানুর মাঝে উদ্ভব হয় ওই লাঞ্ছনার পর । সদা উৎকীর্ন রানুকে হাতছানি দেয় কেউ । যা রানুর স্রষ্টা হুমায়ূন আহমেদের এক মধুর যাদু । এর যৌক্তিকতা খুঁজতে গেলে গল্পের মজা নষ্ঠ হবে । কার্যকারন খুঁজে বেড়ানো মিসির আলির কথা মেনে নিয়ে যদি ভাবা যায় তবে প্রায় অনেক মানুষই এমন কিছু অভিজ্ঞতা অর্জন করেন যার কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যাবেনা। যেমন রানু যখন টেলিফোনে মিসির আলিকে বললো তিনি যার সাথে কথা বলছেন সে লটারী জিতেছে । মিসির আলি চমকে উঠেন নি। কারন ব্যাখ্যার অতীত ঘটনা তো ঘটে বলে তিনি জানেন । রানুর শক্তি ওর সচেতনতা। তবে রানু নারী শক্তির প্রতীক নয়।

চাচাতো বোনের বিয়েতে রং খেলে, কাদা মেখে রানু সঙ্গীসাথীর সাথে পুকুরে গোসলে নামে । উঠে আসার সময়ে পানির নীচ থেকে রানুর পা কেউ টেনে ধরে । ওই ঘটনার পরই একটি লাশ পুকুরের নীচে পাওয়া যায় । মিসির আলি রানুকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারেন লাশটি জালালুদ্দির । তবে গ্রামের আর কেউ রানুর এই কথা সমর্থন করে নি । কার্যকারন সন্ধানে মিসির আলি পুলিশের কাছে প্রয়োজনীয় তথ্য জানতে চান । পোষ্টমর্টেম রিপোর্টও দেখতে চান যা থেকে জানা যেতো লোকটির মৃত্যুর সঠিক সময় ।

রিপোর্ট পাওয়া যায় নি । দর্শক ধারনা করতে পারেন পানির নীচে তলিয়ে থাকা লাশটি সদ্য মৃত কোন ব্যক্তির । কারন পানিতে ডুবে মৃত্যুর পর পরই মানুষের মরদেহ পানির উপর ভেসে উঠে না । যৌক্তিক হল লাশ নয় জীবিত লোকটিই পুকুর থেকে রানুর পা ধরে টেনেছিল এবং রানুর অদ্ভুত শক্তির কাছে হেরে গিয়ে তলিয়ে যায় সে । এবং মারাও যায় । রানুর তীব্র ঘৃনা ছিল জালালুদ্দির প্রতি তাই লোকটিকে জালালুদ্দি মনে করেই ওর হাত থেকে বাঁচার জন্য প্রচন্ড শক্তিতে পা ছুড়েছিল রানু । রানুর পায়ে ভর করেছিল সেইসব নির্যাতিতা সব মেয়েদের শক্তি যাদের ক্ষমতাবানরা অবলীলায় বলিদান করেছিল, যাদের উপর নরাধম পুরুষেরা নেকড়ের মত ঝাপিয়ে পড়েছিল । মেয়ে বলেই রানু জালালুদ্দির নির্যাতনের শিকার । ক্ষোভ আর ঘৃনাই রানুকে শক্তি দেয় পা থেকে লোকটিকে ঝেড়ে ফেলতে ।

তবে মিসির আলির কথা হল এমন অনেক কিছু ঘটে যার ব্যাখ্যা করা যায় না বা ব্যাখ্যার অতীত । এই কাহিনীর যৌক্তিকতা না খুঁজে পাঠকদর্শক তার নিজের ক্ষেত্রেও কোন অতিন্দ্রিয় বা অলৌকিক কিছু ঘটেছিল কি না তা নিয়ে ভাবতে ভালবাসবেন, ভাবতে ভাবতে তেমন ঘটনা মনেও পড়ে যেতে পারে ।

সিনেমাটির বড় সম্পদ শিল্পীদের অভিনয় । সবার অভিনয় মনকাড়া । চঞ্চল চৌধুরী অসাধারন, শবনম ফারিয়ার সন্ত্রস্ত, দ্বিধাগ্রস্ত আচরণ অপূর্ব, জয়া আহসানের অবচেতনে যে কেউ তাকে তাড়িয়ে বেড়ায় অভিনয়ে তা ফুটে উঠেছে প্রশ্নাতীত ভাবে। ইরেশ জাকের ভালভাবেই ধুরন্ধর স্বভাবের ব্যাক্তিকে রূপায়ন করেছে । অনিমেষ আইচ ভাল তবে রানুকে নিয়ে বিপন্ন, চিন্তিত ব্যাকুল ভাবের একটু যেন অভাব ছিল ।রানু নারী শক্তির প্রতীক নয় তবে ‘দেবী’ সিনেমার মার্কেটিংয়ে নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন একথা মানতেই হবে । সিনেমার বিপণনের জন্য কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় কোন জায়গা বাদ যায়নি জয়া আহসান ও শবনম ফারিয়ার ভ্রমণ তালিকা থেকে । ভাল সিনেমা বা ছবি দেখার জন্য দর্শকদের উৎসাহিত করার প্রয়াস ছিল আপ্রাণ ।

প্রথমেই বলা হয়েছে বাংলাদেশের ‘দেবী’ একটি নিটোল সিনেমা । এই সিনেমা শুরু আটকে গিয়েছিল হুমায়ূন আহমেদের উত্তরাধিকারদের অনুমোদন না নেওয়ার কারনে । পরে জয়া আহসান হুমায়ূন পরিবারের সাথে সমঝোতায় এসে কাজ শুরু করেন । এখানে উল্লেখ্য যে একজন লেখকের মৃত্যুর পঞ্চাশ বছর পরই কেবল কেউ তার সৃষ্ট গল্পকাহিনী নিয়ে কোন কাজ করতে চাইলে তার পরিবারপরিজন মানে উত্তরাধিকারদের অনুমতি নেওয়ার আইনগত বাধ্যবাধকতা থাকবে না ।

যারা ২০১৪তে নির্মিত কলকাতার সিনেমা ‘একটি রহস্য গল্প’(কাহিনীকার হিসাবে শিবাশীষ রায় বলে একজনের নাম রয়েছে) দেখেছেন তারা জানেন ওই কাহিনীও হুমায়ূন আহমেদের ‘দেবী’র কপি । ছবিটিতে নামীদামী তারকার (ঋতুপর্ণা, রাইমা সেন) ভীড় আছে তবে নির্মানশৈলী তেমন আকর্ষণীয় নয় ।

দিলরুবা শাহানা


Place your ads here!

Related Articles

ইন্টারভ্যু: মুশফিকের বাবা মাহবুব হামিদ

ছেলের সঙ্গে কথা বলে ব্রিসবেন যাত্রা বাতিল করেছেন মুশফিকের বাবা মাহবুব হামিদ। শুক্রবার রাতে সিডনিতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে

Quarantiny – Chapter 8 – Day 8

Chapter 8 – Day 8 – Friday 24 April 2020 “You never know how strong you are,until being strong is

Is Bangladesh foreign policy becoming Indo-Russia centric?

On 27 March, Bangladesh abstained from voting at the UN General Assembly resolution on Russia’s annexation of Crimea. While 100

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment