টেলষ্ট্রা টাওয়ার : ক্যানবেরার অন্যতম ল্যান্ডমার্ক

সেই ১৯৮৪ সালের শেষের দিকে কোন এক শনিবার শফিক ভাইয়ের গাড়িতে করে মেহেরুন এবং আমি ব্ল্যাক মাউন্টেনের উপরে স্থাপিত টেলষ্ট্রা টাওয়ারে উঠেছিলাম। সেই ছিল আমার প্রথম যাওয়া। তখন আমাদের গাড়ি ছিল না। বয়সের দিক থেকে শফিক ভাই ছিলেন আমার সমসাময়িক। তবে একটা বিষয়ে আমাদের মধ্যে মধুর পার্থক্য ছিল। সেই সময় তিনি ছিলেন হাত-পা ধোওয়া, অর্থাৎ নিপাট ব্যাচেলার এবং তাঁর গাড়ি ছিল। তাই মন-খারাপের সাপ্তাহিক বন্ধের দিনগুলোতে আমরা একসঙ্গে ক্যানবেরার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যেতাম। এমনই একদিন আমরা টেলিকম টাওয়ারে গিয়েছিলাম। যদিও উচ্চতার প্রতি আমার এক ধরনের ফোবিয়া আছে, কিন্তু এখনো স্পষ্ট মনে আছে সেদিন আমার পা একটুও কাঁপেনি, এমনকী বুক ধরফরও করেনি। হয়তো গাড়িতে বসা ছিলাম এবং পাহাড়ের গা ঘেষে আঁকাবাঁকা সরু পথ দিয়ে গিয়েছিলাম। হয়তো মনের মধ্যে থ্রিল ছিল, যা ভয়কে গ্রাস করে ফেলেছিল। তবে এমনও হতে পারে যে, আমরা কথার ভেতর আকন্ঠ ডুবেছিলাম এবং আঙুলের ফুটো দিয়ে সময় গড়িয়ে গেছে, আদৌ টের পাইনি। ব্ল্যাক মাউন্টেনের উপরে উঠে শফিক ভাই নির্দিষ্ট জায়গায় গাড়ি পার্ক করে। তারপর আমরা কয়েক ধাপ সিঁড়ি টপকে উপরে উঠে গ্রাউন্ড ফ্লোরে যাই এবং টাওয়ারের উপরে উঠার জন্য কাউন্টার থেকে টিকেট সংগ্রহ করি। রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনের মতো এতদিন পরেও আমার মনে আছে তখন প্রবেশ মূল্য ছিল পঞ্চাশ সেন্ট। আর এখন ? সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে প্রবেশ মূল্যও বেড়েছে কয়েক গুণ। এখন প্রবেশ মূল্য সাড়ে সাত ডলার।
অষ্ট্রেলিয়ার রাজধানী ক্যানবেরা শহরের প্রায় কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত ব্ল্যাক মাউন্টেনের চূড়ায় ক্যানবেরার অন্যতম ল্যান্ডমার্ক এবং আইকন এই টেলষ্ট্রা টাওয়ার। কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করে আমি কতবার টেলষ্ট্রা টাওয়ারে গিয়েছি, স্মৃতির ঝাপি সম্পূর্ণ খুলে দিলেও আমি তার সঠিক সংখ্যা কিছুতেই বলতে পারবো না। কেননা যখনই দূর-দূরান্ত থেকে কোন আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব কিংবা পরিচিত লোকজন বেড়াতে এসেছে আমাদের বাসায়, তখনই ক্যানবেরার নৈসর্গিক সৌন্দর্যকে উপভোগ করার জন্য তাদের নিয়ে গিয়েছি টেলষ্ট্রা টাওয়ারে। অবশ্য আদিতে টেলষ্ট্রা টাওয়ার হিসেবে পরিচিত ছিল না। তখন নাম ছিল ‘টেলিকম টাওয়ার’। অনেক আবার আদর করে ডাকতো এবং এখনো ডাকে ‘ব্ল্যাক মাউন্টেন টাওয়ার’। কেননা ব্ল্যাক মাউন্টেনের চূড়ায় খোলা আকাশের দিকে সগর্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এই টাওয়ার।
টেলিকম টাওয়ারের ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, এই টাওয়ার নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য ছিল দুটি: টেলিযোগাযোগের জন্য অ্যান্টিনা বসানো এবং দর্শনার্থীদের আকর্ষণ স্থান। ১৯৭০ সালে তৎকালীন পোষ্টমাষ্টার জেনারেলের নির্দেশে টাওয়ার নির্মাণের জন্য সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। কিন্তু আধিপত্যতা নিয়ে শুরুতেই সরকারি দুটি সংস্থার মধ্যে বিবাদ সৃষ্টি হয়। এছাড়া স্থানীয় কিছু লোক বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। তাদের বক্তব্য ছিল পাহাড় কেটে রাস্তা বাবানো এবং চূড়ায় টাওয়ার নির্মাণ করা হলে চারপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। যাহোক, শেষপর্যন্ত হাই কোর্টের বিজ্ঞ বিচরকদের কাছে স্থানীয় লোকজনের দাবী ধোপে টেকেনি। মামলায় সরকার জয়ী হয়। অবশেষে ১৯৮০ সালের ১৫ মে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ম্যালকম ফ্রেজার টেলিকম টাওয়ার উদ্বোধন করেন। পরবর্তীতে ১৯৯৩ সালে টেলিকম টাওয়ারের নাম পরিবর্তন করে নামকরণ করা হয় টেলষ্ট্রা টাওয়ার।
যাহোক, মূল গেইট দিয়ে টাওয়ারের গ্রাউন্ড ফ্লোরে ঢোকার মুখেই মাঝখানে কাঁচের ত্রিকোণ ফ্রেমের ভেতর রয়েছে টেলষ্ট্রা টাওয়ারের মডেল, যা অত্যন্ত ধীর গতিতে ঘোরে। হাতে পর্যাপ্ত পরিমানে সময় থাকলে আমি অতিথিদের নিয়ে সেখানে থামি এবং টাওয়ারের আদ্যপান্ত বলার চেষ্টা করি। সময় না থাকলে নিরাপত্তা গেটে টিকেট দেখিয়ে লিফটে উঠে উপরে চলে যাই।
টেলিকম টাওয়ারের লিফট্ দিয়ে উপরে উঠলে প্রথমেই দেখা যায় ‘ইনডোর অবজারভেশন ডেক’। এই অবজারভেশন ডেকের চতুর্দিক মোটা কাঁচে ঘেরা। দূরের দৃশ্য স্পষ্ট করে দেখার জন্য সেখানে রয়েছে দূরবীণ। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো দূরবীণ দিয়ে দর্শনার্থীরা কী কী উল্লেখযোগ্য স্থাপনা দেখছে, ছবিসহ তার নাম এবং অতি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা সেখানে রয়েছে। তাই টাওয়ারে কোন গাইড নেই। বর্তমানে এই অবজারভেশন ডেকে আছে স্যুভেনির শপ এবং আরাম-আয়েশে চা-কফি পান করার জন্য লাউঞ্জ। অবশ্য আগে সেখানে ছিল ক্যানবেরার একমাত্র ঘূর্ণায়মান রেঁস্তোরা, যা প্রতি একাশি মিনিটে একবার ৩৬০ ডিগ্রীতে ঘুরতো। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেই রেঁস্তোরা বন্ধ হয়ে যায়।
‘ইনডোর অবজারভেশন ডেক’ ছাড়াও দর্শনার্থীদের জন্য রয়েছে দুটি ‘আউটডোর ভিউয়িং প্লাটফর্ম’। যেহেতু জায়গাটা অনাবৃত, তাই সেখানে প্রচন্ড বাতাস। কথিত আছে, মাথায় ক্যাপ পড়ে বাইরের খোলা ডেকে গেলে এবং একটু অসাবধান হলে প্রচন্ড বাতাসের তোড়ে ক্যাপ উড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক। যাহোক, সমতল ভূমি থেকে ৮১২ মিটার উচচ্তায় (টাওয়ারের উচ্চতা পাহাড়ের চূড়া থেকে ১৯২ মিটার) নির্মিত টেলষ্ট্রা টাওয়ারের ভিউয়িং গ্যালারীতে দাঁড়ালে ৩৬০ ডিগ্রীতে ক্যানবেরার চতুর্দিকের দৃষ্টিনন্দন দৃশ্যাবলী দেখা যায়। এছাড়া পর্যটকদের মনোরঞ্জনের জন্য রাতের বেলা বিভিন্ন রঙের আলোয় আলোকিত করা হয় টাওয়ার, যা স্থানীয় বিশেষ কোন ঘটনা কিংবা স্কুল বা চ্যারিটির উল্লেখযোগ্য ঘটনার উপর ভিত্তি করে আলোর রঙ পছন্দ করা হয়। এসব কিছু অবলোকন করার জন্য ভিড় জমায় স্থানীয় এবং দেশ-বিদেশের অগণিত দর্শনার্থী। প্রতি বছর গড়ে প্রায় চার লক্ষের মতো দর্শনার্থীদের সমাগম ঘটে।

রক্তিম আলোয় আলোকিত রাতের টেলিকম টাওয়ার। পেছনে ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারির রাতের আকাশে মেঘের ফাঁকে ঝুলে আছে সুপার মুন, ব্লু মুন এবং ব্লাড মুন
ইনডোর অবজারভেশন ডেক কিংবা আউটডোর ভিউয়িং প্লাটফর্মে দাঁড়ালে দেখা যায় পাহাড়ের গা ঘেষেই পূর্ব দিকে রয়েছে বিশ্বের অন্যতম বিশ্ববিদ্যালয় ‘অষ্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি’, তারপরে আছে ডাউনটাউন এবং আরেকটু দূরে আইনস্লি পাহাড়, যার পাদমূল রয়েছে ক্যানবেরার প্রধান আইকন ‘অষ্ট্রেলিয়ান ওয়ার মেমোরিয়াল’। আরেক দিকে রয়েছে লেক বার্লি গ্রীফিন ও পার্লামেন্ট চত্বর। খানিকটা দূরে পশ্চিম দিকে দাঁড়িয়ে আছে ঘন সবুজ গাছ-গাছালি ঘেরা বৃন্দাবেলা পাহাড়। সেই পাহাড়ের দিকে তাকালে আমার প্রতিবারই কাজী নজরুল ইসলামের সেই বিখ্যাত কবিতার পংক্তি মনে পড়ে, ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় অই’। এছাড়া মূল রাস্তা থেকে পাহাড়ী আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে টাওয়ারে উঠার ডান পাশেই আছে ‘অষ্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল বোটানিক গার্ডেন’। এসব প্রসঙ্গ এখানেই চাপা থাক।
ফিরতি পথে একসময় আমরা লোয়ার গাউন্ড ফ্লোরে প্রবেশ করি। সেখানে রয়েছে থিয়েটার হল। সেই হলে টাওয়ারের নকশা এবং নির্মাণ পদ্ধতি ভিডিওর মাধ্যমে প্রদর্শন করা হয়। আমি কয়েকবারই সেই ভিডিও দেখার সুযোগ পেয়েছি। টাওয়ারের নকশা এবং নির্মাণ এমন ভাবে করা হয়েছে যে, যদি কোন কারণে বা প্রচন্ড বাতাসে শূন্যে দুলতে হয়, তাহলে টাওয়ার কেন্দ্রবিন্দু থেকে দেড় মিটার পর্যন্ত দুলতে পারবে। উল্লেখ্য, টেলষ্ট্রা টাওয়ারের নকশা এবং নির্মাণ শৈলীর জন্য ১৯৮৯ সালে ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অফ গ্রেট টাওয়ার্স বিশ্বের বিখ্যাত টাওয়ারের, যেমন টরোন্টোর সিএন টাওয়ার, ইংল্যান্ডের ব্ল্যাকপুল টাওয়ার এবং নিউ ইয়র্কের এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং, কাতারে শামিল হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানায়।
একসময় ফেরার মুহূর্ত এসে আমাদের সামনে দাঁড়ায়। আমরা গাড়ির দিকে হাঁটতে থাকি। যাহোক, প্রতিবারই ক্যানবেরার নান্দনিক সৌন্দর্য্য এবং অপার মুগ্ধতা দুচোখে মেখে আমি টাওয়ার থেকে নিচে নেমে আসি। সত্যি বলতে কি, এই একটি মাত্র কারণেই টেলষ্ট্রা টাওয়ারে যেতে আমার ইচ্ছা এবং উৎসাহে কখনই ভাটা পড়েনি, এখনও কোন কমতি নেই।
সবশেষে একটা অনুভূতির কথা উল্লেখ না করলেই নয়। বিগত প্রায় তিন যুগে আমি দু’চারদিন থেকে শুরু করে এক মাসেরও বেশি সময়ের জন্য ক্যানবেরা ছেড়ে বহুবার বাইরে দূরে চিন-অচিনপুরে গিয়েছি। যতবারই ফিরে এসেছি আপন কুলায়, ততবারই দূর থেকে টেলষ্টা টাওয়ার দেখার সঙ্গে সঙ্গে অজান্তেই আমার মনের মধ্যে একধরনের স্বস্তির সুবাতাস বইতে শুরু করে। আমি আবেগে আপ্লুত হই।
********
কৃতজ্ঞতা স্বীকার: সব ছবি ওয়েব থেকে সংগৃহীত। রাতের আলোয় আলোকিত টেলষ্ট্রা টাওয়ারের ছবি তুলেছেন অষ্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ফটোগ্রাফার ল্যানন হার্লি গত ৩১ জানুয়ারি ২০১৮।
Related Articles
নুসরাত নুসরাত
ফজলুল বারী: দেশজুড়ে চাঞ্চল্যকর নুসরাত হত্যার বিচার নিম্ন আদালতে শেষ হয়েছে অবিশ্বাস্য কম সময়ে। বিচারের রায় ঘোষনার পর আসামি পক্ষ
European Union – A bureaucratic fantasy doomed from inception
“European Union – A lopsided bureaucratic fantasy doomed from inception, thus the demise of Euro is inevitable” I have two
Law of Maritime Boundary in the Bay of Bengal
Under the UN Convention of the Law of the Sea of 1982 (UNCLOS), a coastal state can claim jurisdiction of
চমৎকার লেখা। অস্ট্রেলিয়ায় না গিয়েও যেন টেলেস্ট্রা টাওয়ার পরিদর্শনের স্বাদ পেলাম।