জল ও জঙ্গলের কাব্য
সিডনি শহরের খুব কাছেই রয়েছে একটা সুন্দর লবনাক্ত পানির বন (ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট)। তবে আমার ধারণা স্থানীয়রা ছাড়া এটার খোঁজ খুব কম সিডনিবাসীই জানেন। সিডনি শহর থেকে গাড়িতে মাত্র চল্লিশ মিনিটের রাস্তা। অবশ্য আপনি ট্রেনেও যেতে পারেন সেক্ষত্রে পঞ্চাশ মিনিট লাগতে পারে। রিভারউড স্টেশনে নেমে মাত্র মিনিট পাচেক হাটলেই আপনি পেয়ে যাবেন রিভারউড পার্ক। রিভারউড পার্ককে ডানে রেখে গাছগাছালির মধ্যে থেকে আপনাকে আবিষ্কার করতে হবে লিলিয়ান রোডের শুরুটা। আবিষ্কার এজন্য বলছি কারণ রিভারউড পার্কের ধার ঘেঁষে সারিসারি গাছের মধ্যে থেকে হঠাৎই শুরু হয়েছে রাস্তাটা। একবার পেয়ে গেলে আর আপনার ক্লান্তি আসবে না।
কখনও লাল ইট বিছানো রাস্তা আবার কখনও উঁচু পাটাতনের উপর বাঁশের চাঙের মত করে তৈরি রাস্তা। উঁচু রাস্তাটার উপর দিয়ে হাটার সময় আপনার মনে হবে আপনি বাংলাদেশের সুন্দরবনের মধ্যে দিয়ে হেটে যাচ্ছেন। তাই আমি এই জায়গাটার নাম দিয়েছি মিনি সুন্দরবন। আর সাথে পাবেন কাঠের তৈরি দুইটা সেতু যেটা দেখলে আপনার বাংলাদেশের বাঁশের সাকোর কথা মনে পড়ে যাবে। স্থানীয়রা অনেকেই বিকেলে জগিং করার জন্য জায়গাটাকে বেছে নেন। আবার অনেকেই পুরো পরিবারসহ সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। তাছাড়াও এখানে মাছ ধরা যায় এবং মাছ পাওয়াও যায় অনেক।
একদিন বিকেলে আমরা পুরো পরিবার মানে আমি আর গিন্নী সাথে তাহিয়া এবং রায়ান বেরিয়ে পড়লাম রিভারউডের উদ্দেশ্যে। সাথেকরে গাড়ির পিছনের ডেকে নিয়ে নিলাম তাহিয়ার সাইকেল। রিভারউড পার্কে পৌছে আমরা হাটা শুরু করলাম। তাহিয়া সাইকেলে আর ছোট রায়ানের খুশি যেন ধরে না। সে মনের আনন্দে দৌড় শুরু করে দিল খোলামেলা জায়গা পেয়ে। রাস্তার দুপাশে ঘন ম্যানগ্রোভ বনের গাছ আর সাদের শ্বাসমূলের দেখা মিলবে সারাক্ষণই। তার ফাঁকেফাঁকে ডাহুক, বক এবং নাম না জানা আরও অনেক পাখির দেখা মিলবে। কিছুদূর হাটার পর দেখা পাবেন সল্ট প্যান ক্রিকের। ক্রিক বলতে এখানে নদী বুঝানো হয়। নদীর মধ্যে দলে দলে হাঁসের দেখা মিলবে নিশ্চিৎ। মাছ শিকারীরা বসে গেছেন মাছ ধরতে। তাই কাঠের সেতুর উপর দিয়ে একটু সাবধানে হাটতে হয় যাতে শব্দ বেশি না হয়।
আর নদীর উপরের রেলওয়ে সেতু দিয়ে একটু পরপর চলে যাচ্ছে ট্রেন। যখন ট্রেন চলে যায় তখন এক অদ্ভুত অনুভূতি হয় মনে। তবে আমার কাছে সবচেয়ে ভালো লেগেছে সল্ট প্যান ক্রিকের পানির সৌন্দর্য। আপনার ইচ্ছে করবে শুধুই চোখে মেলে তাকিয়ে থাকতে। ক্রিকের পানি যেখানে শেষ হয়ে গেছে সেখানে জবুথবু অবস্থায় গাছগুলো দাঁড়িয়ে আছে। দেখে মনেহবে ওরা আসলে বুঝে উঠতে পারছে না কি করবে এখন। সামনের দিকে যাবে না পিছনের দিকে যাবে সেটা নিয়ে দ্বিধায় পড়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে।
সল্ট প্যান ক্রিক থেকে রাস্তাটা দুভাগে ভাগ হয়ে রেললাইনের দুপাশ দিয়ে দুদিকে চলে গেছে। বাম দিকের রাস্তাটা সামান্য কিছুদূর যেয়ে ক্রিকের পাড়েই শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু ডান দিকের রাস্তাটা চলে গেছে অনেকদূর পর্যন্ত। ক্রিকের পাড় থেকে কখনও কংক্রিটের রাস্তা কখনওবা লাল ইটের রাস্তা পাড়ি দিয়ে সেটা আবার বনের মধ্যেই ফিরে এসেছে। সেখানে বনটা আগের চেয়েও ঘন এবং পরিষ্কারভাবে শ্বাসমূলগুলো দেখা যায়। আপনি হাটতে হাটতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে বসে বিশ্রাম নেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। পাটাতনের রাস্তাটা চওড়া করে সেখানে কাঠের বেঞ্চ বসিয়ে দেয়া হয়েছে বিশ্রাম নেয়ার জন্য। সেখানে বসে আপনি একটু জিরিয়ে নিতে পারেন। আর সাথে সাথে শুনতে পারেন পাখির কুজন। এই রাস্তাটা আবার শেষ হয়েছে স্টুয়ার্ট স্ট্রিট রিজার্ভ (পার্কে) যেয়ে।
তাহিয়া সবার আগে সাইকেল চালিয়ে এগিয়ে চললো। আমি ওকে অনুসরণ করে দৌড়ে চললাম। আমার পিছনে রায়ানও দৌড়ে আসছিল আর সবার শেষে ওদের মা। এভাবে চলতে চলতে ক্লান্ত হয়ে একসময় আমরা বিশ্রাম নিলাম রাস্তার পাশের বেঞ্চে। তখন রায়ান এক অদ্ভুত কান্ড করলো। সে একবার রাস্তার রেলিং ধরে সামনের দিকে ঝুলে পড়ে। আবার কখনও রাস্তার উপর শুয়ে পড়ে উদাস দৃষ্টিতে উপরের দিকে চেয়ে থাকে। আসলে প্রকৃতির সৌন্দর্য কিভাবে উপভোগ করতে হয় সেটার পাঠ আমাদেরকে শিশুদের কাছ থেকেই নেয়া উচিৎ। আমরা স্টুয়ার্ট স্ট্রিট রিজার্ভ পর্যন্ত যেয়ে আবার ফিরতে শুরু করলাম। কারণ অনেক ক্লান্ত লাগছিল। কিন্তু তাহিয়া আর রায়ান মোটেও রাজি ছিল না ফিরতে। তবুও আবার শুরুতে ফিরে আসতে হল।
এই জায়গাটা অনেক দিক থেকেই সুন্দর। ছায়াঘেরা শীতল রাস্তায় দুপাশের ম্যানগ্রোভ বন দেখতে দেখতে হাটা বা সাইকেল চালানোর জন্য উপযুক্ত জায়গা আর আপনি যদি মাছ ধরতে ভালোবাসেন সেই ব্যবস্থাও রয়েছে। এছাড়াও আমি ওখানে বার-বি-কিউ করার চুলাও দেখেছি তবে নিশ্চিৎ না ওগুলো কাজ করে কি না? তাই যেকোন দিন বিকেলে হাতে ঘন্টা খানেক সময় নিয়ে পুরো পরিবারসহ আপনি চলে যেতে পারেন রিভারউড লিলিয়ান রোড রিজার্ভে। আমরা ঘুরে আসার পর থেকেই আমি আর রুপা বৌদি মিলে প্ল্যান করছি সবাই মিলে একসাথে আবারো যাওয়ার।
Md Yaqub Ali
আমি মোঃ ইয়াকুব আলী। দাদি নামটা রেখেছিলেন। দাদির প্রজ্ঞা দেখে আমি মুগ্ধ। উনি ঠিকই বুঝেছিলেন যে, এই ছেলে বড় হয়ে বেকুবি করবে তাই এমন নাম রেখেছিলেন হয়তোবা। যাইহোক, আমি একজন ডিগ্রিধারী রাজমিস্ত্রি। উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করতে অস্ট্রেলিয়াতে আমার আগমন ২০১৫ সালের মার্চে। আগে থেকেই ফেসবুকে আঁকিবুকি করতাম। ব্যক্তিজীবনে আমি দুইটা জীবের জনক। একটা হচ্ছে পাখি প্রকৃতির, নাম তার টুনটুনি, বয়স আট বছর। আর একজন হচ্ছে বিচ্ছু শ্রেণীর, নাম হচ্ছে কুদ্দুস, বয়স দুই বছর। গিন্নী ডিগ্রিধারী কবিরাজ। এই নিয়ে আমাদের সংসার। আমি বলি টম এন্ড জেরির সংসার যেখানে একজন মাত্র টম (আমার গিন্নী) আর তিনজন আছে জেরি।
Related Articles
টিনের শ্লেট
আমাদের সময় লেখাপড়ার হাতেখড়ি হতো আদর্শলিপি বই আর টিনের শ্লেটে চক দিয়ে লেখার মধ্য দিয়ে। ক্লাসের হিসাবে তখন ছোট ওয়ান,
Old-mind set of political leaders needs to be changed in South Asia for peace and harmony
A seminar on “Dynamics of Security of South Asia” was organised by the South Asian Group Studies, Sydney University on